জ্বলদর্চি

প্রথম রোদের স্নান/ বিবেক বাউলিয়া

প্রথম রোদের স্নান 
                           
বিবেক বাউলিয়া   

তিন রাস্তার মোড়ে একসাথে দুই তিনটে বেকারির দোকান। সঙ্গে ফাস্টফুডের দোকান। একেবারে এক লাইনে বেশ কয়েকটা দোকান পরপর। সকাল হতে না হতেই কেউ ডেয়ারির দুধ, খাস্তা বিস্কুট আরও এটা ওটা কেনার জন্য প্রতিদিন আসে। 

সকাল বেলা করে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোনো কুশলের বরাবরের অভ্যাস। প্রতিদিন পালা করে বেরোতেই হবে এই এক নাছোড়বান্দা প্রতিজ্ঞা। মাঝে মাঝে তো এমনও হয়েছে হুট করে বৃষ্টি নামায় ভিজে পড়ে বাড়ি ফিরেছে। একটু পরিষ্কার আকাশ দেখতে পেয়ে বেশ করে বেরিয়ে কিছুদূর গিয়েই বৃষ্টি নামল। আর শীতকালের সময় না বললেও চলে। কম্বল কে কেই বা ছাড়তে চায়?

কী জানি, কী এক অদ্ভুত মন ভালো করা ওই তিন রাস্তার মোড়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোটামুটি দূরে হলেও ওর মর্নিং ওয়াকের রাস্তা কোনো দিন পাল্টায় না। আরও একটু নাক বরাবর সোজা এগিয়ে গেলেই একসাথে দুটো স্টেডিয়াম সহ বেশ বড়সড় খেলার মাঠ। সেখানে কেউ না কেউ সকালে ব্যায়াম করার জন্য থাকেই। হাতে সময় থাকলে স্টেডিয়ামের উপর উঠে ব্যায়াম করা শুরু করে দেয়। একটা নরম রোদেলা সকাল সমস্ত সবুজ ঘাসের মাঠ জুড়ে কুশলের স্বপ্নে দেখা কোনো জায়গার সাথে মিল পায়। ব্যায়াম করার ইচ্ছে না হলে মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে কী যেন একটা খুঁজতে চায় ঐ ঐটুকু মুহূর্তে জুড়ে। যেন তার কাছে এক অবর্ণনীয় মুহূর্ত। যাই হোক, একঘন্টার মধ্যে মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ি ফিরতেই হবে এ যেন নিজের কাছে আর এক প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে। একটু বেশি হলেই খুঁতখুঁতেমি টা শুরু হবে।
                                   
সেই তিন রাস্তায় যাওয়ার আগেও আরও এক চার রাস্তা আছে। মেন রোড ধরে ভিতরে চার রাস্তায় গিয়ে বাঁদিক গেলে সেই তিন মাথার মোড় পড়ে। দেখে ঠিক যেন ওর মনে হয় শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সরাসরি ভিতরে আর একটা রাস্তা ধরে সোজাসুজি গেলেও চলে যাওয়া যায়, কিন্তু তবুও ও যাবে না এ এক নিজের কাছে নাছোড়বান্দামি। কখনো কখনো মনে হয় কাজ না থাকলে ওখানেই কিছুক্ষণ থেকে দেখতে থাকুক সকাল সকাল চায়ের দোকান থেকে উনুনে বসানো চা আর আঁচের ধোঁয়ার গন্ধ। উপচে পড়া সদ্য পুবালি রোদের বিচ্ছুরণ। চায়ের দোকানে বসে রোজনামচা মানুষের চায়ের গল্প। হেঁটে ঐ মাঠ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে পিছন ফিরে দেখা একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। ইস্, আর একটু যদি দাঁড়িয়ে থাকা যেত। সেই প্রথম রোদের স্নানে যদি আরও গা ভিজিয়ে নেওয়া যেত! মাঝে মাঝে ভাবে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সব গুছিয়ে নিয়ে ঠিক এরকম ভাবে প্রতিটা দিন গুলো ব্যস্ততাহীন হয়ে কাটাবে। সেই রোদের ভিতর চোখ মুছে আলত রোদের মুখোমুখি হয়ে ঠোঁট চাপা হাসিতে সেসব কথা ভাবে আর সূর্য-দেবতা‌ কে সাক্ষী রেখে দেয় প্রতিদিন। সূর্য, নীল আকাশ, কোলাহলহীন সকালের কয়েকটা মানুষের মধ্যে রাস্তা জুড়ে কয়েক মুহূর্ত হারিয়ে যায় নিজের মধ্যে। 

                                 
কয়েকদিন যাওয়ার পর সেই চার রাস্তায় ঢুকে যখন সেই তিন মাথার মোড়ের দিকে এগিয়ে যেতে চলেছে একটু দূর থেকেই দেখল মোটামুটি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে একটা মেয়ে, হাতে ঝোলানো একটা ব্যাগ। মুখটা হালকা করে ওড়না দিয়ে ঢাকা। তার বয়স অনুমান করতে গেলে বোধ থার্ড আই কে কাজে লাগাতে হবে কুশলের। থাক তার বয়স জানা। দেখে কুশলের মনে হল, হয়ত কোনো ভালোবাসা তাকে পেরিয়ে গেছে, তার দেখার সময় হয়নি সমস্ত কাজ সামলিয়ে ক্লান্তি তে ভোগা এক রোজনামচা মানুষ হিসেবে। 
দিন কয়েক পর থেকে দেখল মাথার উপর ওড়না দিয়ে যেতে। তার দুধে আলতা গায়ের রঙে আর শীর্ণ পরিশ্রান্ত মুখে যেন সেই ভাষা ফুটে বেরোচ্ছে। দেখে তাই মনে হল। এতদিন ধরে নিজের একটা জগৎ নিয়ে কুশল চলছিল। হঠাৎ করে কোথা থেকে কীভাবে এমন এক মানুষ ধরা দিল, সবটাই কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।

প্রায় দিন তারপর থেকে কুশল দেখল ঠিক সকাল ছ'টার আশেপাশে মেয়েটি সেখান দিয়ে একইভাবে যায়। ক্রমশ দিন যায়। তাকে যে ভালো লেগে যায় ঠিক তেমন না, যেন ভালো লাগাকে অতিক্রম করে এক মুহূর্তের জন্য নিজের ভিতর কে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তাকে পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে অজানা ভাষার মতো। হয়ত যে ভালোবাসা তাকে পেরিয়ে গেছে তার জায়গায় কুশল নিজেকে যদি…; না থাক এসব কেন ভাবছে?
আসলে সে যেন সত্যিই অজানা ভাষার মতো। বোধ হয় সকালের ঘুম ভাঙা অলস শরীর গুলো তাকে কেউ দেখেনি। সে নিঃশব্দে হেঁটে চলে যায়। কুশলও এগিয়ে যেতে থাকে ওখানে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু একটু করে জোর বাড়িয়ে। পিছন ঘুরে তাকে আর দেখা যায় না। কতবার দেখার চেষ্টা করেছে কোথায় যায়, বাড়িটাই বা কোথায়, সব যেন বিষ্ময়ে তার কাছে জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে থাকে। তাকেও দেখে বোঝা যায় তারও যেন ব্যস্ততা লেগে আছে। একটা দীর্ঘ পরিশ্রান্ত হওয়ার ছাপ আপাদমস্তক লেগে আছে।

                                   
বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর কুশল হঠাৎ করে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল আসলে ও ওখানের ঐ দোকানে ডেয়ারির দুধ কিনতে যায়। এমনও কয়েকদিন দেখেছে সকাল সকাল খরিদ্দার একটু বেশি থাকায় চাপ থাকায়, লাইন হওয়ায় মেয়েটি বেশ ব্যস্ততা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নেওয়া হয়ে গেলে সেই কিছুটা আধ নোয়ানো মাথা নিয়ে চলে গেল। কুশল ঐ মোড়ের মাথায় একটু চেপে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। কুশলের মনে একটা নামমাত্র প্রশ্ন জাগলো, প্রতিদিন একটা মানুষ দুধ কী করতেই পারে! নিজেই আবার ব্যবসা করে নাকি? যাক, তাতে কী যায়-আসে? 
সারাদিনে আর অন্য সময় বের হয় কিনা বোঝা যায় না। হয়ত সকাল সকাল এটুকুই কাজ থাকে। এসবের মতো নানা হাবিজাবি কথা মাথায় ভাসতে থাকে। চোখের পলক ফেলে ঘুরে কুশল এগিয়ে যেতে থাকে রোদের পথ ধরে। বাড়ি পৌঁছানোর বাকিটা পথ একটু থমকে থমকে এগিয়ে যেতে থাকে কখনো কখনো পিছন ঘুরে তাকিয়ে। সে কোথায় যায় তারপর, বাড়িটাই বা কোথায়? পথে এত মানুষ থাকতে তার এভাবে হেঁটে চলে যাওয়া কুশলের কাছে যেন অন্য রকম জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।


রোজকার মর্নিং ওয়াক করতে বেরোনোর জন্য কুশল কে বোধ হয় সে-ই ডেকে আনত আজ যদি তার ঠিকানা টা জানা যায়। সেই কারণেই রোজ হাঁটতে যাওয়ার ঝোঁক টা লেগেই থাকে। এমনও দিন গেছে তার দেখা মেলেনি। কুশল ধরে নিত হয়ত শরীর খারাপ নতুবা ওর আসার আগে চলে গেছে। সেসব দিন গুলোতে সেই রোজকার রোদ ফিকে লাগলেও তবুও মনে হয় এই বুঝি হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে এমন ভেবে সেই টুকু পথ সে পার করে। তাই কুশল একটু একটু পা পা করে এগোচ্ছে, সেই রোদ আর মেয়েটির মধ্যবর্তী হয়ে। 

দূর্গা পুজো শুরু হওয়ার থেকে হঠাৎ দেখল আর দেখাই যাচ্ছে না। তাহলে কি দোকানে আসা বন্ধ করে দিয়েছে? নাকি অন্য সময় আসে? নাকি ওর আসার আগেই নিয়ে চলে গেছে? বিয়ে টিয়ে হয়ে যাইনি তো আবার? হতেও পারে, মেয়ে মানুষ। কখন কী হয়ে যায় কে বলতে পারে? শেষবার যদি দেখতে পেত। এমন উচাচনে পড়ে মনে হয়েছে একদিন পিছু নিলে বোধ হয় ভালো হত? নাহ্, তা ভালো দেখায় না। ওখানের দোকানে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখবে, কিছু বলে কিনা? না এভাবে খোঁজ নেওয়া ঠিক না। কী থেকে আবার কী হয়ে যাবে। 
এভাবে আরও মাস এগোয় আর দেখা মেলে না। পুজো শেষ হয়ে গেল, বছর গড়িয়ে শেষের দিকে। শীত আসতে লাগল। তাও আর আসে না। নতুন বছর শুরু হল। কিন্তু তবুও...। 
🍂

কুশল মাঝে মাঝে মর্নিং ওয়াকে বেরনো বন্ধ রাখত। ইচ্ছে করে বেরত না। যদিও তখন শীত পড়ে গেছে। থাক, এমনিতেও আর দেখা মেলে না তার। এই কুয়াশা পার করে কে-ই বা যাবে? শীতটা কেটে যাক। মন চাইলে এক দুবার বেরিয়েছে। তবু দেখা মেলেনি। ভাবত, আজকে যাওয়া হল না, আর আজকেই আবার আসেনি তো! এভাবে কি অপেক্ষা করা যায়? ভালোলাগা-ভালোবাসার মানুষ হলে না হয় দুজন দুজনের জন্য অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু এই দুটোকেও ছাপিয়ে গিয়ে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী হয়ে কেউ জন্মালে তার অপেক্ষার কোনো সারবত্তা থাকে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলার মধ্যে দিয়ে বিষ্ময় সূচক প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এভাবে আর কতদিনই বা অপেক্ষা করা যায়।  কুশল সেসব ভুলে গিয়ে একটু গরমের আভাস পড়তেই প্রতিদিন মর্নিং ওয়াকে যাওয়া শুরু করল। এভাবে আরও কয়েকমাস যায়। একান্তে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে রীতিমতো মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে হঠাৎ করেই একদিন এক শনিবারে দেখল দোকান করে ঠিক সেই ভাবে ফিরছে একটা কচি কলাপাতা রঙের সবুজ সালোয়ার পড়ে। এক নিক্ষেপে কুশলের চোখ আটকে গেল তার দিকে। এতদিন পর এভাবে তার মানানসই এমন পোশাকে তাকে কুশল ভাবতেই পারিনি। দূর থেকে দেখল চোখের ভুল না তো? সেরকম মনে হল সে-ই আসছে হয়ত। আর একটু এগিয়ে যেতে দেখল সত্যিই সে। সেদিনের সকালটাও ছিল নীল টইটুম্বুর আকাশ, সবুজ গাছের পাতার ভিতর দিয়ে সেই উপচে পড়া রোদ যেন দুজন কে স্নান করিয়ে দিচ্ছে মুখোমুখি হতে পেরে। কুশল আফসোসে নিজের কাছে বলল, ইস্, আজ যদি বৃহস্পতিবার হত; লক্ষী বার। এক অজ্ঞাত লক্ষী লাভ হত। কাকে ধন্যবাদ দেবে, সেই এতদিনের নিঃসঙ্গতার সঙ্গ দেয়া রোদেলা সকাল নাকি ঈশ্বর কে, ভেবে পায় না। সে-ও একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায়। এটাই ছিল তার ভালো ভাবে মাথা উঁচু করে চোখ তুলে প্রথম তাকানো। কুশল ভাবলো তাকে দেখে কিছু সে ভাবেনি তো! ও যে দূর থেকে তাকাতে তাকাতে আসছিল। সে-ও কিছুটা ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। 

কুশল তখনও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারে না। পিছন ফিরে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যেতে থাকে, যতক্ষণ না মিলে যায় ঠিকানা জানতে না পারা রোদের পথ ধরে। সেদিন সেই তিন মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে কুশলের এর মনে হল এ কোন অপার্থিব জগতে প্রবেশ করেছে। এক্ষুনি যা দেখল সেটা কি সত্যিই ছিল? একথা কাকে বলে বোঝাবে যে এটুকুতেই সে যে কী পেয়েছে? রোদের ভিতর দিয়ে সে যেন সাদা বকের মতো ডানা মেলে ভেসে যেতে লাগলো সূর্য-দেবতার দিকে তাকিয়ে পরম শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সেই মাঠ পেরিয়ে, সবুজ ঘাস পেরিয়ে, রোদ মেখে ফিরতে থাকলো বাড়ির দিকে।

Post a Comment

0 Comments