জ্বলদর্চি

অভূতপূর্ব নয় /আকাশ নট্ট

প্রবন্ধ

অভূতপূর্ব নয়

আকাশ নট্ট


আমরা যারা গত শতকের নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি তাদের অনেকরই স্কুল জীবনের শুরু একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স হাতে। বাক্স বদল হয়েছে বহুকাল। আমার বাক্সটি এতদিন সিঁড়ির ঘরে বস্তার মধ্যে অতীত হয়েছিল। আজ হঠাৎ সেই ‘প্যান্ডোরা বক্স’কে খুঁজে পেয়ে ভারি কৌতুহল বোধ হল— খুলে দেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না। ‘স্মৃতি সততই সুখের’ কথাটির যথার্থতা প্রতিপাদন করতে গিয়ে দেখলাম বাক্সটির ভিতরে রয়েছে গোটা সাত-আটেক বিচিত্র ভূতের বই, আমার ছড়া ছাপা দুটি লিটল ম্যাগাজিন আর কিছু গ্রিটিংস কার্ড। 

‘পথের পাঁচালী’র অপুর মতো ছোটবেলায় আমারও রেলগাড়ির প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। ট্রেনে উঠলেই দু-একজন হকারকে পেয়ে যেতাম যারা হরেক রকম চটি বই বিক্রি করতেন। সেসব বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ বোধ করতাম বিচিত্র রকম ভূতের বইগুলোর প্রতি। বইগুলোর আকার আয়তন এবং প্রচ্ছদ বটতলা সাহিত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তখনও গোলকায়ন এত পরিব্যপ্তি লাভ করেনি। কাজেই এভাবে বই বিক্রি করা মোটামুটি একটা জীবিকা হতে পারত। ‘তখন’ শব্দটি কালের বিচারে যদিও খুব দূরের নয়— মেরে কেটে পঁচিশ বছর আগেকার। অথচ পরিবর্তনের প্রাবল্য সেই সময়টিকে যেন একটু বেশিই প্রাচীন করে তোলে। ইতিহাসে কালের ধারণা শুধু তো সংখ্যা নয়— বরং তা প্রতিটি যুগের ধর্মকে প্রকাশ করে। সেখানে স্বতন্ত্র বলে কিছু নেই। প্রতিটি যুগই তার পূর্ববর্তী যুগের কিছু ধারাবাহিকতা (continuity) এবং কিছু পরিবর্তনের (changes) ফসল। অতীত যেন রবি ঠাকুরের ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের শৈলবালার ভূতের মতো— চলে গিয়েও থেকে যায়। 

🍂

আবার ফিরে যাই আমার ভূত-প্রীতির প্রসঙ্গে। একটা একটা করে প্রায় একগুচ্ছ ভূতের বই জমিয়েছিলাম— কোনটা স্কন্ধকাটা, কোনটা মেছোভূত, আবার কোনটা ঝুলন্ত ভূত! প্রচ্ছদগুলো দেখেই ভয় লাগত। এই ভূতের প্রতি আকর্ষণের সূত্রপাত আমার বাবার কাছে। ছোটবেলায় দুপুর হলেই বাবা আমায় ঘুম পাড়াত। তখন আকর্ষণের বিষয় ছিল ‘বন্ধু-ভূতের গল্প’। সে বেজায় ভালো ভূত, লোকের উপকারে আসে। তখন ভাবতাম আমার যদি এরকম একটা ভূত থাকত! সমস্ত হোমওয়ার্ক তাকে দিয়ে করাতাম— আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ যেন! আজও সেই ভূত আমার মাথায় চেপে আছে— সেখান থেকেই লেখায় নামিয়ে দিলাম। 

আমার কলেজ জীবনে একজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম, যিনি বাংলা পাশের ক্লাস নিতেন। উনি একদিন বললেন ওঁরও  নাকি এমন ভূত-টান আছে। ভাবলাম যাক আমি একা নই, এমন ভূতপ্রিয় মানুষ এ জগতে আরও আছেন। জ্ঞানীগুণী মানুষদের সাথে একটু-আধটু সাদৃশ্য থাকলে উৎসাহটা বেড়ে যায়— আমিও দ্বিগুণ উৎসাহে ভূতান্বেষী হয়ে বসলাম। 

ভূতের ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক পরে ভেবেছি। তারপর দেখলাম জাক দেরিদা ভূতের খুব সুন্দর একটি অর্থ দাঁড় করিয়েছেন— ভূত হল এমন এক অবস্থা যা না জীবিত, না মৃত— বরং দুটোই। ভূতকে আপনি অতীত বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না, আবার পুরোপুরি বর্তমানও বলতে পারবেন না। ভূতেরা মনুষ্য সমাজকে চিরকালই এমন দোদুল্যমান অবস্থায় ফেলে দেয়— মগজটাকে অধিকার করে রাখে। সেই অদ্ভুতুড়ে অবস্থান থেকে আমরা যদি ইতিহাসকে দেখি তবে ইতিহাস অতীত হয়েও বর্তমানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রবি ঠাকুরের ‘কঙ্কাল’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে? অতীতের উপাদানগুলো সেই কঙ্কালের মতো ইতিহাসের কথা বলে যায়। সুতরাং ইতিহাসের ছাত্র হয়ে আমার এই ভূতটানটা স্বাভাবিক।

এবার ভূতের অপর একটি মাত্রা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। গল্পের ভূত শুধু গাছে নয়, আরও অনেক জায়গাতেই চড়তে পারে— কল্পনা তার অবারিত বিচরণ ক্ষেত্র। রবি ঠাকুর ভূতের এত সুন্দর সুন্দর মাত্রার কথা বলে গেছেন যে, তার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তাঁর ‘কর্তার ভূত’ গল্পে কর্তা বলেন, “ওরে অবোধ আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।”

তারা বলে, “ভয় করে যে কর্তা।”

কর্তা বলেন, “সেইখানেই তো ভূত।” 

সম্প্রতি স্টিফেন কিং-এর ‘ইট’ উপন্যাস অবলম্বনে একটি সিনেমা বানানো হয়েছে। সেখানে একটি ভূতুড়ে জোকার আছে— জোকারটিকে যারা ভয় পায় তাদের ওপরেই সেটি চড়াও হয়। কিন্তু যারা ভয় পায় না তাদের কাছে সেটি নিছক জোকার হয়েই থাকে। সুতরাং মূল কথা হল ভয়ে ভূত। ইতিহাসও এই কথাটাই এতদিন ধরে বলে এসেছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? কুসংস্কারের অচলায়তনে মানুষ এখনও আবদ্ধ। তাই আজও টি-টোয়েন্টির যুগে গ্রহণের সময় শাঁখ বাজে, উলুধ্বনি ওঠে। আজও ধর্মগ্রন্থের ভূত মানুষকে ছাড়েনি। এটাই নাকি রীতি রেওয়াজ। তাই চুপচাপ ভূতকে মেনে চলো। 

মানুষ না বিজ্ঞানকে সার্বিকভাবে মানতে পেরেছে, না সে ইতিহাসকে জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে পেরেছে। এই যে গ্রহণের ধারণা— বিজ্ঞান তার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিয়েছে। ইতিহাস দিয়েছে তার সামাজিক ব্যাখ্যা। পৌরাণিক গল্প অনুযায়ী রাহু চন্দ্র-সূর্যকে খেয়ে ফেললে গ্রহণ হয়। এখানে সামাজিক সম্পর্কের দুটি দিক প্রতিফলিত হয়েছে। এক, অশুচির ধারণা। রাহু অশুচি, তাই সে চন্দ্র-সূর্যকে ছুঁয়ে দিলে তারাও অশুদ্ধ হয়ে যায়। তখন চন্দ্র-সূর্যের আলোতে যে কোন কাজ করলেই তা অপবিত্র হয়ে ওঠে। এখানেই সেই ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিতে নিচু জাতকেন্দ্রিক অস্পৃশ্যতার ধারণাটি ফুটে ওঠে। অপর দিকটি হল, সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস, যা জাতিভেদ ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

সুতরাং মোদ্দা কথা হল এখনও অধিকাংশ মানুষ কুসংস্কারের ভূতে ভূতগ্রস্ত হয়ে দিনযাপন করেন। সেই অজ্ঞতা থেকেই বহু সমস্যার সূত্রপাত। যেমন— ধর্মের ভূত রক্তে ঝরে। যতদিন অজ্ঞতার ভূতে মানুষ বিভোর হয়ে থাকবে ততদিন প্রকৃত ভোরের আলো সে দেখতে পাবে না। সমাধান একটাই বিজ্ঞান ও ইতিহাসকে মানুষের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু তত্ত্ব নয়, অ্যাপ্লিকেশন চাই।  প্রতিটি মানুষের জীবন হয়ে উঠুক এই অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্র।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments