জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /শেখর সিরাজ

গুচ্ছ কবিতা 

শেখর সিরাজ

সেল্ফ রেস্পেক্ট


অনেকদিন লিখি না, কী লিখব? সুইসাইট নোট? নাকি কিংবদন্তি কালপুরুষ? 

লিখতে গেলে মাথার ডান পাশে চিনচিন ব্যথা করে, বুকের বাম পাশে পোস্টমর্টেমে জমানো আছে রক্তাক্ত ক্লেদ, এ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, ট্রমা।

অনেক দুঃখ পেলে মানুষ ফাঁপা বেলুনের মতো চুপসে যায়, নক্ষত্রের মতো নির্ঘুম রাত জাগে-

বিকেলের চেম্বারে সুদীপ ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করলেন, অক্সিজেন সল্পতা, হিমোগ্লোবিন স্ট্যাবিলিটিতে এলার্জি, অনিদ্রা।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জগদীশ মন্ডল পরামর্শ দিলেন- ঘরে দম বন্ধ লাগলে, খোলা বারান্দায় দাঁড়াবেন, বারান্দা ভালো না লাগলে বড় রাস্তায় হেঁটে যাবেন পরিত্যক্ত শহরের দূষিত বাতাস। 

আমি একদিন ঘর ছাড়লাম, প্রিয় শহর ছেড়ে দিলাম, ছেড়ে দিলাম প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় সব মানুষ ছেড়ে হলাম বোহেমিয়ান উদ্বাস্তু, শরনার্থী। 

অসমের সেই অকাল প্রয়াত বিখ্যাত গায়ক জুবিন গর্গের মতো আমারও খুব চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে- "আমার কোনো জাতি নাই, ধর্ম নাই, আমি মুক্ত"।

প্রত্যাশা থেকে প্রাপ্তি বড়, স্বার্থপর মানুষদের মতো নিজেকে ভালো বাসতে শিখলাম, শিখলাম সেল্ফ রেস্পেক্ট। 

তেত্রিশ কোটি দেবতা থেকে তেত্রিশ বছর বয়সী আলেকজান্ডার জয় করলেন অর্ধেক পৃথিবী।

আর আমি? বোকার হদ্দের মতো লুজার হতে হতে বাঁকা ঠোঁটের হাসির আড়ালে দেখেছি চতুর লোকের তুরুপের তাস।

ইস্ট দেবতাদের নাম জপে কোনো কোনো পুরুষ হয় লম্পট, বিস্ময়কর প্রতিভার নাম এখন ভণ্ডামি। 

মানুষ ফুল ভালো বাসতে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে সূর্য দীঘল বাড়ীর সুদীর্ঘ সোনালী অতীত। 

আমি ভুলতে পারি না হারানো শৈশব, কৈশোরের বালখিল্য, উদীপ্ত তারুণ্যের প্রথম প্রেমের জলযান।

বারিধারার কাছের বন্ধু খুব গর্ব করে বলেছিল, আমার হাইরাজ বিল্ডিং, ডুপ্লেক্স 
অ্যাপার্টমেন্ট,বিলেতি ধাঁচের রেঞ্জ রোভার। 
সোস্যাল ভ্যালুস, স্ট্যাটাস...

আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল মন নিয়ে শুধু বলেছিলাম, পৃথিবীর সব থেকে বড় শৃঙ্খলের নাম " পুঁজিবাদ"।

🍂


অব-লুন্ঠন

আর সব, সব ফলিত পুরুষের মতো আমি খুলতে যাইনি দেরাজের আয়নায় ব্রা ব্লাউজের হুকে ঝুলে থাকা লটকনের ফল।

অব-লুন্ঠন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণে আমি পারদর্শী নই। অমল মিত্র আমার বন্ধু, ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে বলেছিল, খাসিয়া নারীর মতো পেটানো সুডৌল স্তনের খাসা মাল- যাবি?

অসভ্য লম্পট পুরুষের মতো আমারও টক টকে লাল হয়ে গিয়েছিল দুই কানের ভিতরের অন্ডকোষ।

মিসেস মিত্র কী জানেন?রেডিসন ব্লু বারের চড়া দামে যে কোনো সময়ে অমল মিত্র কিনে ফেলতে পারে গোটা একটা দার্জিলিং শহর।

মিসেস মিত্র আমাকে সন্ধ্যা আরতীর থালা  হাতে সেদিন খিলখিল করে নিমন্ত্রণ দিয়ে বললেন, থার্টি ফার্স্ট নাইটের পার্টিতে আসবেন না? আপনাকে দেখাব, চল্লিশের ফিতা গজে কত রকম খেলা করে একুশের জলযান।

চিলেকোঠার সন্ধ্যায়- সন্ধ্যা মালতী ফুলের মতো বুকের কাছে নেমে এসেছিল মিসেস মিত্রের গলার মঙ্গল সূত্র- ব্লাউজের বোতাম, ব্রা'র স্ট্রিপ।

চোখের সঙ্গম নিলামে উঠতে উঠতে প্রায়  তড়িঘড়ি করে সিঁদেল চোরের মতো কাই-কুইয়ে সেদিন আমি পালিয়ে বেঁচে ছিলাম শব যাত্রার মিছিল।

কী করলেন? ওভাবে শরীরে ঝড় তুলে উট পাখির মতো বালিতে মুখ গুজে কেউ পালায়?
বিয়ের বাজারে আপনি থেকে যাবেন আজন্মকালের নপুংসক।

সারস পাখির লম্বা ঠোঁটে চুমোর বদলে ঠোঁট এগিয়ে বলেছিলাম, হারাধনের পাঁচটি ছেলের একটির নাম পদ্মলোচন!

সঙ্গম প্রিয় পুরুষ ভালোবাসা ছাড়াই খুলে নেয় লটকন ফলের ব্রা ব্লাউজের হুক- আমি মুখ চিনতে চিনতে চিনে ফেলেছি সংখ্যাতীত মানুষের মুখোশ। চিনে ফেলেছি, খাট পালঙ্কের স্পর্শে ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো সংখ্যাতীত সঙ্গম প্রিয় লম্পট পুরুষ!



পাখি- কথন

সব কথা বলা যায় না, মানুষের  কথা বলা এখন খাঁচার ভিতরের অবরুদ্ধ পাখি। কথা বলা পাখিকে অবশ্য কেউ কেউ আদর করে পোষ্য বলে। কথা তো জেলখানার বন্দী কয়েদীরাও বলে, তবে কী কয়েদীরাও পোষ্য?

সব অংকের হিসাব মেলে না, মানুষের জীবন উচ্চতর জটিল গনিত। শিমুলতলী স্কুলের গনিত মাষ্টার তৈয়ব স্যার, গনিতের মতোই রসকষহীন জাঁদরেল পন্ডিত।

জাঁদরেল শাসকের কথা শুনেছি, জাঁদরেল কর্ণেল, মেজরদের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু জাঁদরেল পন্ডিতের কথা সেই প্রথম শুনেছিলাম। 

জীবনে অনেক কিছুই এমন প্রথম শুনতে হয়, শুনতে হয় যাপিত জীবন চর্চার ব্যর্থ উপাখ্যান। 

তৈয়ব মাষ্টার ছাত্রদের পড়ান, প্রকৃতির অপর নাম গনিত, গনিতের অপর নাম বিজ্ঞান। সৃষ্টির রহস্য গাণিতিক, শূন্য। হিসাব মেলাতে পারে না কোনো হরিদাস পাল। 

আলঝেইমার মানুষের মস্তিষ্ক বিভ্রম স্মৃতি বিনষ্টকারী রোগ। মহাবিশ্ব বিভ্রম, হলোগ্রাফিক। পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র কাজ করলেই কেবল মানুষের কোলাহল, হৈ চৈ, চিৎকার, শোরগোল উপলব্ধি করা যায়।

জীবন থেকে প্রয়োজনের বেশি কিছু নিতে হয় না, চার্বাক দর্শন বলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবেই বিষ। বিষ খেলে কোলাহল, হৈ চৈ, চিৎকার, শোরগোলের বিষাক্ত সাপ আসে। 

কথা, লোভ, অহংকার মানুষের আত্মার শত্রু, প্রতিবন্ধীদের কোনো শত্রু হয় না, জগত সাক্ষী। প্রিয়তম মানুষের মতো রাতের অন্ধকারের নির্জনতাকে, একাকীত্বকে যে ভালোবাসে সে সুখী, জগতের জগত বিখ্যাত সুখী মানুষ।

প্রত্যাশা, লোভ, অহংকার জীবনের অপচয়ের উপাখ্যান। পাখিদের মতো শিস দিতে দেয় না।

পাখিদের মতো শিস দিতে দিতে যে মানুষ হয়ে উঠতে জানে সে সুখী মানুষ। ভোরের ফুলের মতো তার শরীর থেকে দিনভর সুগন্ধ সৌরভ ছড়ায়।

যে শরীর থেকে সুগন্ধ সৌরব ছড়ায় না, সে কখনো ছায়া মানব হতে পারবে না, তাঁর শরীরে চামড়ার বলিরেখা বলে দেয় সে অতিশয় কৃপণ এবং বৃদ্ধ। নদীর জোয়ারের জলের মতো তাঁর তারুণ্য ভরা যৌবন অভিশপ্ত। 

কৃপণ এবং বৃদ্ধদের দিয়ে কখনো প্রেম ও বিপ্লব হয় না। যে ছায়া মানব, সে আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল। বয়স নব্বইতেও তরুণ, সে প্রেম ও বিপ্লবের মিছিলের অগ্রভাগে থাকে, নেতৃত্ব দেয়।

পিস্তলে ম্যাগজিনের চেয়েও সে সহস্রগুন শক্তিশালী, তাঁর ঠোঁটে শুধু প্রিয়তম মানুষের চুম্বন থাকে না। থাকে, বলিষ্ঠ সাহসী সত্য উচ্চারণ। 

বাক- স্বাধীনতা ফিরিয়ে দে, ফিরিয়ে দে- পাখিদের মুক্ত বিহঙ্গ, খোলা ময়দান, ফিরিয়ে দে- আকাশে উড়ার স্বাধীনতা।

 বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments

  1. ভাস্কর সেনNovember 01, 2025

    শেখর সিরিজের গুচ্ছ কবিতা নতুন ধরনের লেখা। পড়ে ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. সিরিজের নয় সিরাজের হবে....ভা.সে.

    ReplyDelete