জ্বলদর্চি

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র/চতুর্দশ পর্ব /প্রসূন কাঞ্জিলাল


মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র
চতুর্দশ পর্ব 

প্রসূন কাঞ্জিলাল


অহিল্যাবতী

মহাভারতে অহিল্যাবতী নানান নামে পরিচিতা ছিলেন যেমন মৌরভি, মৌরবি এবং কামকণ্ঠিকা ।  তিনি ছিলেন দ্বিতীয় পান্ডব ভীমসেন ও হিড়িম্বা র একমাত্র পুত্র ঘটোৎকচ এর স্ত্রী ও মহাবলী বর্বরিকের মা।

'যা নেই ভারতে, তা নেই মহাভারতে’ --- কথাটি বহুল প্রচলিত। এই বিশালজাত মহাকাব্যে চরিত্রের ছড়াছড়ি। মহাভারতে আমরা পরিচিত হই অসংখ্য বীরের সঙ্গে। কিন্তু মহাভারতের অন্যতম মূল আকর্ষণ হল এর নারী চরিত্ররা। এখানে দ্রৌপদীর মতো নারী চরিত্র যেমন আছেন, তেমনই আছেন অহিল্যাবতী ও হিড়িম্বার মতো অবহেলিত চরিত্ররাও।


 হিড়িম্বা যেন ঠিক আমাদের আধুনিক সময়ের এক নারী চরিত্র। হিড়িম্বার জীবনকে লক্ষ্য করলে মনে হবে, সে যেন আধুনিক সময়ের এক সিঙ্গেল মাদার। অথচ এই বর্ণিল চরিত্রটিকে যেন অনেকটা ছায়ায় রেখে দেওয়া হয়েছে মূল মহাকাব্যে। শুধু তাই নয়। মহাভারতে হিড়িম্বাকে অনেকটাই উপেক্ষা, অনাদর ও অসম্মানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। মধ্যম পাণ্ডব ভীমের এই স্ত্রীর চরিত্রকে খুব বেশি আলোতে আনাও হয়নি। সেটা কেন হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন করে এখন আর লাভ নেই।

তবে হিড়িম্বার চরিত্রটি যেন আধুনিক নারীর অসংখ্য চিহ্ন বহন করে। এটুকু নিশ্চিত যে হিড়িম্বা অন্তত আর্য ছিলেন না। মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুযায়ী ভারতে তখন কিছু অর্ধ-যাযাবর অনার্য জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আর্যরা সচরাচর অনার্যদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করতো না। সেই অনার্য মানুষদেরই প্রতিভূ হিড়িম্বা।

মহাভারতে হিড়িম্বার গল্পটিও যেন অদ্ভুতভাবে শেষ হয়। তাও কিনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচের আগমনের জন্যেই হিড়িম্বাকে ব্যবহার করা।
🍂

হিড়িম্ব ও হিড়িম্বা মহাভারত মতে রাক্ষস ও রাক্ষসী ভাই-বোন । জতুগৃহে পাণ্ডবরা সপরিবারে রক্ষা পাওয়ার পর মহামতি বিদুরের সহায়তায়  বারানাবত নগরী থেকে বের হয়ে গঙ্গা নদী পার হয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে যেতে যেতেই এক সময় তাঁরা এক জঙ্গলে প্রবেশ করলেন। জতুগৃহে মৃত্যুর থেকে মুক্তি পেয়ে এই প্রথম আশঙ্কামুক্ত হতে পেরে পাণ্ডবরা মানসিক চাপমুক্তি, পথচলার ক্লান্তি, আর একটানা জেগে থাকায় সবাই ছিলেন অবসন্ন। এসময় কুন্তি, দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরা বিশ্রামের জন্যে থামেন। সবাই ঘুমিয়ে গেলেন। জেগে রইলেন শুধু ভীম। ভীম সহজে ক্লান্ত হতেন না। এদিকে পাণ্ডবদের আগমণের কথা জানলেন ঐ জঙ্গলরাজ রাক্ষস হিড়িম্ব। বিনা অনুমতিতে এই প্রবেশ তার ভালো লাগেনি। বোন হিড়িম্বাকে আদেশ করলেন পাণ্ডবদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে।  সে এঁদের বধ ও  খাওয়ার উদ্যোগ নিলেও পঞ্চপাণ্ডবের ভয়ে সরাসরি আক্রমণ থেকে বিরত থাকেন। ভীমকে কৌশলে সরিয়ে আনার জন্য, তাঁর বোন হিড়িম্বাকে পাঠান। হিড়িম্বা গিয়ে দেখলেন ভীম বাদে সবাই ঘুমিয়ে আছেন। ভীমের রূপ দেখে মুগ্ধ হলেন  হিড়িম্বা। হিড়িম্বা মোহনীয় রূপ ধরে ভীমের কাছে আসেন। হিড়িম্বা নিজেই তখন ভীমের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং হিড়িম্বের অভিসন্ধির কথা ভীমকে জানান। একই সাথে হিড়িম্বা ভীমের কাছে প্রেম নিবেদন করেন। এখানেই হিড়িম্বার চরিত্র যেন নতুন মোড় নেয়। ভীমের প্রতি মুগ্ধ হয়ে সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ভীম তো সবশুনে অবাক। এত বছরের ক্ষত্রিয় জীবনে কোনো নারী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন, এমনটাই বা কে শুনেছে ?

ভীম বোঝালেন, নিজের পরিবার ছেড়ে তিনি আলাদা হতে পারবেন না।এদিকে বোনের আসতে বিলম্ব দেখে হিড়িম্ব নিজে হাজির হন ও অকুস্থলে চলে আসেন। বোনের এই প্রেম সে মেনে নিতে পারেনি। বোনকে মারতে উদ্যত হতেই ভীমের সঙ্গে তার প্রাণপণ যুদ্ধের শুরু হয়। ভীমই অবশ্য বিজয়ী হন ও হিড়িম্বকে হত্যা করেন। ভীম-হিড়ম্বের যুদ্ধের সময় অন্য সকল পাণ্ডবরা ঘুম থেকে জেগে উঠেন। হিড়িম্বকে হত্যা করার পর, ভীম হিড়িম্বাকেও হত্যা করতে উদ্যত হলে, হিড়িম্বা মাতা কুন্তীর শরণাপন্ন হন এবং সে ভীমের প্রতি যে অনুরক্তা, সে কথা জানান। হিড়িম্বা অবশ্য ভাইয়ের হত্যাকারীকে ঘৃণা করতে পারেন নি। বরং তার ভালোবাসা আরও বাড়তে থাকে ভীমের প্রতি।

এরপর যুধিষ্ঠির ও কুন্তীর সানুগ্রহে হিড়িম্বা ভীমের হাত থেকে রক্ষা পান। যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার সাথে ভীমকে শর্তসাপেক্ষে মিলিত হওয়ার অনুমতি দেন। শর্তটি ছিল, স্নান-আহ্নিক শেষে ভীম সারাদিন হিড়িম্বার সাথে থাকবেন, তবে সূর্যাস্তের পূর্বে তিনি আবার পাণ্ডবদের সাথে মিলিত হবেন। তবে ভীম প্রতিজ্ঞা করেন যে, যতদিন না হিড়িম্বার গর্ভে তাঁর পুত্র জন্মাবে ততদিন তিনি হিড়িম্বার সাথেই থাকবেন। পরে ভীমের ঔরসে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচ  নামক এক মহাবলী পুত্রের জন্ম হয়।

হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের বিয়ে হয়। এই অরণ্যেই তাঁরা আগামী এক বছর দিনাতিপাত করেন। হিড়িম্বা পাণ্ডবদের জন্যে কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন, এমনকি তাদের সেবা-যত্নও করেন। অবশেষে পাণ্ডবরা যখন সময় শেষে ফিরে যেতে উদ্যত হন, তখন হিড়িম্বাকে যেন অবহেলাই করা হয়। দ্রৌপদী তো বলেন, ‘তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবেনা, কিন্তু তোমার এই আতিথেয়তার কথা কোনোদিন ভুলবো না।’

বিপদে যার আশ্রয় নেওয়া হলো। ঠিক সুখের সময় তাকে ভাগ দেওয়া হলোনা। হিড়িম্বা একাই নিজের সন্তান ঘটোৎকচ কে বড় করলো। শেখালেন মায়াবিদ্যা ও যুদ্ধবিদ্যা। আর যখন সময় এলো সন্তানকে পাঠিয়ে দিলেন মহাযুদ্ধে। সেই সন্তানও আর ফিরেও এলো না।

পাণ্ডবরা হিড়িম্বার থেকে শুধু কেড়েই নিয়ে গেছেন। হিড়িম্বা, যে কিনা ভীমের প্রতি মুগ্ধতা স্বীকার করেছেন এবং সন্তানের গুরুদায়ভার ওনিজের কাঁধেই চাপিয়ে নিয়েছেন, কোনোদিনই জানা সম্ভব হয়নি, একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর সংবাদটিও আদৌ এই সাহসী মায়ের কানে গেছে কি না। তবে মহাভারতের মাঝে যেন এক আধুনিক সিঙ্গেল মাদার হিড়িম্বা। এক স্বাবলম্বী ও আত্নপ্রত্যয়ী নারী।


এবার আসা যাক অহিল্যাবতী র কথায়।


মহাভারতের বিশালতা তথা দার্শনিক গূঢ়তা কেবল
ভারতের পৌরাণিক আখ্যানই নয়, বরং এটিকে সমগ্র  হিন্দু ধর্ম এবং বৈদিক দর্শন ও সাহিত্যের
সারসংক্ষেপ বলা যেতে পারে। ‘মহাভারত' নামটির
উৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি আখ্যান প্রচলিত যে,
দেবতারা তুলাযন্ত্রের একদিকে চারটি বেদ রাখেন ও অন্যদিকে বৈশম্পায়ন প্রচারিত ভারত গ্রন্থটি
রাখলে দেখা যায় ভারত গ্রন্থটির ভার চারটি বেদের
চেয়েও অনেক বেশি।
সেই কারণে ভারত গ্রন্থের বিশালতা দেখে দেবগণ ও ঋষিগণ এর নামকরণ করলেন ‘মহাভারত'।
আবার একে ‘পঞ্চম বেদ’ও বলা হয়। জগতের তাবৎ শ্রেষ্ঠ বস্তুর সঙ্গে একে তুলনা করে বলা
হয়েছে : “মহত্ত্বাদ্ ভারতবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।”


অহিলাবতী বা মৌরবী ছিলেন দানব নরকাসুরের
সেনাপতি  মুরা র কন্যা। ভগবান কৃষ্ণ তার স্ত্রী
সত্যভামা সহ নরকাসুরকে পরাজিত করার জন্য
রওনা হলে প্রথমে মৌরবী সত্যভামার সাথে যুদ্ধ
করেন। কৃষ্ণ নরকাসুরকে হত্যা করার পর মৌরবীর পিতা মুরা কেও হত্যা করেন। মৌরবী তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।  যাইহোক, 
কৃষ্ণের দেবত্ব উপলব্ধি করার পরে, তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কৃষ্ণ তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সান্ত্বনা দেন যে শীঘ্রই তিনি বিয়ে করবেন।

 আসলে অহিল্যাবতী ছিলেন একজন নাগকন্যা (সৰ্প- কুমারী)। তিনি ছিলেন দেবতা শিবের পবিত্ৰ সৰ্প বাসুকীর কন্যা। কাহিনী অনুসারে, শিবের স্ত্রী পার্বতী শিবকে বাসি ফুল দেওয়ার জন্য অহিল্যাবতীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।

মহাভারতের নারী চরিত্রের কথা মনে এলেই প্রথমেই চোখে ভেসে ওঠে দ্রোপদীর নাম। দ্রোপদী নিঃসন্দেহে এই মহাকাব্যের প্রধান নারী চরিত্র। তবে দ্রোপদী ছাড়াও মহাভারতে আরো এমন অনেক নারী চরিত্র রয়েছে, যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মহাকাব্যে তারা এক প্রকার উপেক্ষিতা হয়েই থেকে গিয়েছেন। মহাভারতের এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আহিল্যাবতী।


 পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম ভীম একবার রক্ষা পেয়েছিলেন এই নাগকন্যার জন্য। সর্পরাজ বাসুকীর ঔরসজাত কন্যা আহিল্যাবতী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও প্রতিভাবান। নিজ পুত্রকে তিনি নিজ হাতে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। 

তবে এই গল্পের শুরু আরো অনেক আগে। তখন পঞ্চপাণ্ডব ছোট। শকুনির কু মন্ত্রনায় ভীমকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে খাওয়ান দুর্যোধন। অতঃপর ভীমকে নদীর জলে ফেলে দেন। বিষক্রিয়ায় অচেতন ভীম এসে পৌছান নাগরাজ্যে। সেখানে আহিল্যাবতী ভীমকে দেখেই পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে চিনতে পারেন। বিষক্রিয়ায় ততোক্ষণে মৃত্যুবরণ করেছেন ভীম। আহিল্যাবতীর অনুরোধে তার পিতা বাসুকী মহাদেবের দেয়া বর ব্যবহার করে ভীমের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।পরবর্তীকালে মানবীজন্ম নিয়ে ভীমের পুত্র ঘটোৎকচের সঙ্গে বিয়ে হয় আহিল্যাবতীর।ঘটোৎকচ ও আহিল্যাবতী দম্পতির পুত্র বর্বরিক। 

আহিল্যাবতী নিজেই পুত্রকে যুদ্ধবিদ্যা শেখান। বর্বরিকের নৈপুণ্যে খুশি হয়ে মহাদেব তাঁকে তিনটি অসাধারণ তীর উপহার দেন এবং অগ্নিদেব উপহার দেন একটি ধনুক।মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন বর্বরিক ।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments