জ্বলদর্চি

বসন্ত কালের নিউজিল্যান্ড: সুন্দর পরিবেশে আমার হাঁটার পথের রোজনামচা /কথাকলি সেনগুপ্ত



বসন্ত কালের নিউজিল্যান্ড: সুন্দর পরিবেশে আমার হাঁটার পথের রোজনামচা


কথাকলি সেনগুপ্ত 

সপ্তাহান্ত এলে পর বেশ একটা ঢিলে ঢালা ভাবে সময় চলতে শুরু করে; যদিও সকালে এসে রান্নাঘর আর লাগোয়া বসে খাবার জায়গার পর্দা গুলো সরাতে গেলেই নজরে আসে, তিন দিক ঢাকা সামনের বারান্দায় ড্রাইভওয়ে আর তার ঠিক পেছনের বেড়ার ওপরেই প্রায় সারি দিয়ে বসে থাকা উৎসুক কয়েকটি মুখ; বেশ কয়েক ধরণের পাখি - কিছু তো আমাদের অতি পরিচিত চড়াই, তার পরে গায়ে ছিটে ছিটে দেয়া ভারি মিষ্টি সুরের শীষ দেয়া `বেল বার্ড', কিছু আমাদের দেশের শালিখের চেহারার আর বাকি কয়েকটি ছাতারে; তাদের `সকাল' তো যাকে বলে গিয়ে কাক ডাকা ভোরে ই শুরু হয়ে গিয়েছে; আর তারা এবারে পাউরুটির টুকরো খাবে বলে ব্রেকফাস্ট এর আশায় আছে।

অগত্যা স্নান পুজো সারা হলে পরে সব ঢিলেমি পরিত্যাগ করতেই হয়; নিজের চায়ের জলের কেটলি চালু করবার সাথে সাথেই ওদের জন্যে পরিমানমতোন পাউরুটির টুকরো নিয়ে যাই, ছড়িয়ে দিতে আর তার পর সরে আসতে যতটুকু দেরি, দরজা বন্ধর শব্দ পেলেই সব বেড়া আর আশে পাশের চেরি ক্যামেলিয়া গাছের ঝোপের থেকে নেমে পরে, আর আমি ওদের সতর্ক চোখ এড়িয়ে বড় জানলার পর্দার পাশে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ওদের খাওয়া দেখি; খুব মজা লাগে।
ওদের মধ্যে একটি পাখির নাম আমরা `চৌকিদার' রেখেছি; তার বাঁ দিকের ডানাটি একটু বেশি ছড়িয়ে বসবার অভ্যেস, হয়তো কখনো চোট পেয়েছিলো; আমাদের বের হয়ে আসতে দেখেও এ বড় একটা জায়গা ছাড়ে না, ভয় ডরের ব্যাপার ওর মধ্যে কম, পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বড় জোর একটু দু কদম সরে বসে, যেন `এই তো যথেষ্ট জায়গা আছে তোমার যাবার, যাও না বাপু' গোছের ভাবখানা তার; প্রায় সময়েই তার সঙ্গে একটি বিশেষ চড়াই পাখি দেখি, ও বোধহয় তার সাগরেদ হবে!

ওদের সবাই এর দিকে তাকিয়ে দেখি আর ভাবি, চড়াই শালিখ এরা যদি এখানে দেখতে পাই, কাক কেন দেখা যায় না? কল্পনার চোখে দেখতে চেষ্টা করি - এত্তোটুকু ডানা নিয়েও যদি চড়াই আর তুলনায় ছোট মাপের শালিক এরা এ দেশে আসতে পারলো, তাহলে কাক কেন আটকা পড়ে গেলো? কাকের কাছাকাছি অবশ্যই আছে, রাভেন বলে তাদেরকে; যদিও দেখলে মনে হবে, পিঠে তাদের যেন এক খাবলা করে বরফ ছিটিয়ে রেখে দেয়া আছে; তারা অবশ্য বাড়ির ধারে কাছে নয়, সেই স্থানীয় পার্ক টি তে হাঁটবার সময়েই শুধু দৃশ্যমান হয়ে থাকে। 

সেই পার্ক আর তার ঠিক গা ঘেঁষেই স্থানীয় সেমেটারি তথা কবরস্থান; তবে ক্রিস্টান দের, অন্য ধর্মের লোকেদের আলাদা জায়গা রয়েছে; কেন, সে প্রশ্ন কিন্তু আমায় করে লাভ নেই, উত্তর আমি জানি না; তবে এই দুটি জায়গা জুড়েই পাখির যেন মেলা বসে থাকে; শতেক পায়রা তো আছেই, অনেক গাং চিল জাতীয় পাখি, জলজ পাখি হাঁস এরা ও প্রচুর আসতে দেখি; শুধু তাই নয়, এতো সুন্দর তাদের মধ্যে কয়েকটি ধরণের পাখিকে শীষ দিতে শুনি, বড় ভালো লাগে।
🍂

 swallow জাতীয় অনেক ছোট পাখি পার্ক এর ঘাসের ওপরে দেখি, তাদের দেখলে পরে আবার পয়েন্টার জাতীয় পোষ্য গুলো খুব উত্তেজিত হয়ে `এখুনি ধরে ফেলবো তোদেরকে' এরকম একটা ভাব করে তাড়া করে দৌড়োতে থাকে; তবে কখনোই ধরে উঠতে পারে না, খানিক বাদেই হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে নিজের মালিকের কাছে ফিরে এসে একসাথে চলতে লেগে পড়ে।

পার্ক এতে নিয়মিত হাঁটতে আসা কিছু কিউই বন্ধুর কাছে জেনেছি, বড় ধরণের গাং চিল এর চেহারার যেগুলোকে দেখি, সেগুলো আসলে স্কুয়া; বেশ নিষ্ঠুর স্বভাবের এই ধেড়ে চেহারার পাখিগুলো; বাগে পেলেই অন্য পাখি কে তাড়া করে তাকে ঠুকরে মেরে খেয়ে নিতেও এরা পিছ পা হয় না; ভাবা যায় না! ইউ টিউব এতে একটা ভিডিও দেখেছি, যাতে দেখাচ্ছে যে দৌড়ে আসা একটা লালচে রঙের কাঠবিড়ালি কে ঝপ করে তেড়ে এসে ধরে সোজা গালে পুরে নিচ্ছে একটা স্কুয়া; আবার বি বি সি আর্থ এতে স্যার ডেভিড এটেনবোরো'র একটি ভিডিও তে টার্ন জাতীয় পাখি বা পায়রা কেও এরা ঘায়েল করে খেয়ে নিতে ছাড়ে না বলে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেছি।

প্রাণিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছি; আমার ধারণায় ঈগল, চীল, আর বাজ জাতীয় পাখি ই কেবল স্বভাবে শিকারী হয়ে থাকে ছিল; এখন সেই তালিকায় এই দেশের আরো পাখির নাম যোগ করতে হয়েছে; ঈগল কদাচ এদিকে আসে, আরো বেশ কিছুটা দক্ষিণে ফিয়র্ড ল্যান্ড এর বনের দিকে ওদেরকে দেখা যায়; হক তথা বাজ অবশ্য মাঝে মধ্যেই চলে আসে, আর তাদের কে দেখতে পেলেই পার্ক এর পায়রা'র ঝাঁক দেখি একদিক থেকে আকাশের অন্যদিকে গোল হয়ে উড়তে থাকে, কিন্তু গাছে চট করে বসতে যায় না।

আমি নিজের মনেই ভাবতাম, ঝট করে উঁচু কোনো গাছের ডালে যদি ওরা বসে যায়, তাহলে কি বাঁচতে পারবে না? একদিন আরেক বয়স্ক আর অভিজ্ঞ কিউই বন্ধুর থেকে এর উত্তর পেয়ে গেছিলাম; যদি ওরা নিজের ছাড়া অন্যের বাসার কাছে নেমে পড়ে, সেখানের পাখিরা ওকে তেড়ে আসতে পারে; আবার নিজের বাসার কাছে নামলে ওই হক তার বাচ্ছা ছানাপোনা খেয়ে নেবে, ছোট গুলো তো আর উড়ে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারবে না; তাই এরকম করে ওরা গোল হয়ে যতটা পারে উড়তে থাকে, যদি হতাশ বা বিরক্ত হয়ে বাজ সেখান থেকে চলে যায়!

সকালে প্রায় ই হাঁটতে গিয়ে কিছু পাখি কে দেখি ওই রকম ঠান্ডাতেও পার্ক এর দুটি ছোট জলের ধারা আর ডোবায় সকাল সকাল মাথা চুবিয়ে গা ভিজিয়ে স্নান করে নিচ্ছে; কি তাড়া তাদের কে জানে; হাঁস স্নান করলে অবাক হতাম না, তারা তো জলের মধ্যেই বেশির ভাগ সময় থাকে, এই পায়রা আর শালিখ গুলোর কি দরকার যখন আমাদের ই জলের কাছে যেতে দু বার চিন্তা করতে হয়, তাই ভাবি মনে।

Post a Comment

0 Comments