ছোটবেলাকার কিছু অমলিন স্মৃতি
কথাকলি সেনগুপ্ত
মায়ের কাছে শুনেছিলাম - উড়িষ্যার কটকে যখন আমরা ছিলাম, বাবার সেই কোয়ার্টার টিতে থাকবার দশটি মাস আমরা কেউ কিন্তু কোনো স্কুলেতে ভর্তি হয় নি; এটা তো বড় হয়ে আমার কাছে বিশেষ কৌতূহলে বিষয় হয়েছিল; কারণটি জেনেছিলাম যে স্থানীয় ভাষা না জানলে স্কুলে ভর্তি করতে অসুবিধে হচ্ছিলো; আমি তখন তিন বছরের ও কম, তাই আমার কোনোই সমস্যা ছিল না; দাদা আর দিদির পড়া ক্ষতি হয়ে যাবে, চাই তা যথাক্রমে ক্লাস ওয়ান আর অপার কেজির ই হোক না কেন, সেটা নিয়ে মা বাবা বেশ চিন্তিত থাকতেন; তবে যতক্ষণে বড়রা চিন্তা ভাবনা করছেন, আমরা যে বেশ খেলে ধুলে সময় কাটিয়ে যাচ্ছিলাম, সে বিষয়ে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই।
একবার এক্সচেঞ্জ এতে কিছু মালপত্র দিতে আসা দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাক এতে আমি বেশ দড়ি বেয়ে উঠে পড়েছিলাম; দাদা দিদি ওরা ও সঙ্গে ই ছিল; কিন্তু ওরা নজর করতে পেরেছিলো যে মালপত্র নামানো সেরে এবারে চালক আর তার সাথী গাড়িতে উঠে পড়ছে; আমি অন্য কোনো কিছু দেখতে ব্যস্ত ছিলাম, সেদিকে চোখ যায় নি; ওরা ও শুরুতে লক্ষ্য করে নি যে গাড়িতে কোনো `কুচো' রয়ে গেছে; যেই গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, আমি তো ঘাবড়ে গিয়ে `চিৎকার' শুরু করে দিয়েছি; দাদা দিদি ও নিচে থেকে `দাঁড়াও দাঁড়াও, আমাদের ছোট বোন রয়ে গেছে' বলে গলা মিলিয়েছে; তারা ও চমকে গিয়ে তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখতে পায়, তখন স্টার্ট বন্ধ করে সাবধানে আমায় নিচে নামিয়ে দিয়ে যায়; তারপর থেকে শিক্ষা পেয়ে গেছিলাম, যতই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকুক, তাতে আর উঠতে যেতাম না!
🍂
মা তো মন্টেসরি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষিকা ছিলেন, তিনি নিজেই ওদের কে পড়াতেন; দাদা পড়তো সামনের ঘরে একটা ছোট খাটিয়াতে টুল কি ডেস্ক নিয়ে বসে, আর পাড়ার একটি কালো সাদায় ছোপানো কুকুরছানা প্রায় ই দেখতাম বাড়িতে ঢুকে পড়ছে, আর লাফিয়ে দাদার কাছে গিয়ে উঠে বসে থাকছে; তাকে আমরা টুসি নাম ডাকতে লাগলাম; ক্রমে তার পেছন পেছন চলে এলো `টুঙ্কু' `ফুচকা' আর `জিঞ্জার' - আর আমাদের খেলার সঙ্গী পেয়ে সে কি আনন্দ! বাবা অবাক হতেন, আর সময় সময় যে বিরক্ত ও হতেন না তা নয়, কিন্তু আমাদের উৎসাহের বিরাম ছিল না।
ওই বাড়ির বিষয়ে মনে পড়ে যে তাতে কোনো বাগান ছিল না; সিমেন্ট করা পেছনের উঠোন, আর তার পরেই খিড়কির দরজা; সেটা খুললে পর সবুজ ঘাসে ঢাকা একটি মাঠের মতন তো চোখে পড়তো, সেখানে আশে পাশের অনেকগুলো বাড়ির ই পেছনের দরজা খুলতো; তাই বিশেষ করে বিকেলের দিকে অনেক বড় মেজো ওদের দৌড়াদৌড়ি ধরাধরি এসবের মাঝে আমাদের বয়সের কুচো কাঁচারা তত জায়গা পেতাম না; তাই বাড়িটির সামনের খোলা জায়গাতে আমরা নিজেদের মতন বেশি খেলা করতাম।
সেই খেলা ও বেশ পুষ্টি পেতো যখন যখন কাছের ব্রাহ্মণী নদীতে জোয়ার আসতো; বেশ তার সঙ্গে কিছু ছোট মাছ আর প্রচুর ব্যাঙাচি ওই জলের সঙ্গে চলে আসতো; তিন ভাই বোনে খুব হা হা হি হি করতে করতে মগ হাতে কি ছোট গামছা নিয়ে ওদের কে ধরতে লেগে পড়তাম; জল অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও কখনোই আমাদের হাঁটুর ওপরে উঠতো না; তাই মা এ নিয়ে মানা করতেন না।
ওই বাড়িতে থাকতে ই প্রথম মায়ের কাছে সন্ধ্যে বেলায় হারমোনিয়াম নিয়ে গান শিখতে তিন জনের নিয়ম করে বসা, কাছের কোনো লাইব্রেরি থেকে বই এনে তা মা আমাদের কে পড়ে শোনাতেন প্রায় নিয়ম করে এসব মনে পড়ে; `টুয়েন্টি থাউসেন্ড লীগস আন্ডার দি সি' র গল্প, ক্যাপ্টেন নিমো, হোপিরিয়া নামের এক অদ্ভুত লম্বা নাকের আর লালচে দেখতে বাঁদরের গল্প এসব ওই বাড়ির কিছু প্রিয় স্মৃতি।
তার পর তো বাবা বদলি হলেন আর আমরা রাউরকেল্লাতে চলে এলাম; সময়টা খুব সম্ভব '৬৪ সাল থেকে '৬৬ সাল পর্যন্ত হবে; বাবার সেই A / 1 সেক্টর 5 এর কোয়ার্টার টিতে তখন আমরা থাকি; অবশ্য রাউরকেল্লা থাকবার সময়ের নানা ঘটনার গল্প আপনাদের সঙ্গে আগে ও আমি করেছি; তবে আজকের গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে মনে হয় আগে আলোচনা করি নি; তার মধ্যে প্রথমটি হলো - দিদির এক বিকেলে আমাদের কোনো খেলার সাথী মেয়ের বাড়িতে গাছে চড়তে গিয়ে পিছলে নিচে পড়ে চোট পাওয়া; ওর সালোয়ার পরে থাকা থাইতে কাপড় ভেদ করে দু দুটো বড় পাথরের কুচি একেবারে গেঁথে বসে গিয়েছিলো! বেচারি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওই নিয়েই আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিলো।
অবস্থা দেখে আর সব শুনে মায়ের তো মাথায় হাত! বাবা কে বলে তাঁর অফিসের সেই জিপ গাড়িই করে তো দিদিকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো; ডাক্তার ওঁরা খুব সাবধানে সেগুলো বার করে ভালো করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন; আর বেশ কয়েকদিন ওকে রোজ সেখানে যেতে হতো ড্রেসিং করানোর জন্যে, জখম শুকোতে বেশ সময় নিয়েছিল; আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, যে দিদি একটু ও কাঁদে নি সমস্ত সময়টা; ডাক্তার ওঁরাও ওর সাহসের আর সহ্য ক্ষমতার খুব প্রশংসা করেছিলেন মনে আছে।
অপর ঘটনাটি আমার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে; পার্ক এতে একদিন স্লিপ এতে চড়ে খেলছি, একটি বয়সে বড় ছেলে স্লিপ খেয়ে ঢালু যে দিক দিয়ে আমরা নেমে আসি, সেই দিক দিয়ে ই বেয়ে ওপরে চড়ছিলো; কয়েকবার দেখেই আমার ও মাথায় সেই চিন্তা এলো; কিন্তু আমি ওর কুশলতা তো বুঝি নি, দেখা দেখি খেলতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে সিমেন্ট এর স্লিপ এতে দমাস করে মুখ থুবড়ে পড়লাম, ব্যাস - সামনের দাঁত ভেঙে রক্ত বের হতে লেগে পড়লো।
দিদি বেচারি বোন কে ধরে ধরে আমার থুতনির তলায় হাত রেখে আমায় নিয়ে এলো বাড়িতে; আমি তো ফুঁপিয়ে অস্থির; আবার সেই বাবাকে খবর দেয়া; জিপ গাড়ি নিয়ে ত্রিপাঠি কাকুর আসা আর আমায় নিয়ে হাসপাতাল যাওয়া; তবে মা নিজেও সঙ্গে গেছিলেন; ডাক্তার কষ্টে রক্ত বন্ধ করা ওষুধ দেয়া এসব করেছিলেন; সামনের দুইটি দাঁত ভেঙে গেছিলো, সে দুটিকে পরে গিয়ে যাও বা ঠিক করা গেছিলো, বাকি দুইটি incisor দাঁত আর বের ই হলো না; আর এক মাস কেবল গলা ভাত ঠান্ডা খুব নরম খাবার ছাড়া কিছুই যেন মুখে না দি, এই সতর্ক বাণী আমায় তাঁরা বার বার দিয়ে তবে বাড়ি পাঠিয়ে ছিলেন; তবে বড় হয়েও সামনের দু দুটি দাঁত আর মুখ দেখায় নি; জানি না কেন, নিচের সারির একটা দুধে দাঁত আবার সারা জীবন পড়লো ই না; সেটা গিয়ে আমার তেষট্টি বছর বয়সে পড়লো; কত রকম কান্ড, তাই না?
0 Comments