গোপীনাথ মাহাতো (অভিনেতা, কাঁকড়াঝোর)
ভাস্করব্রত পতি
গোপীনাথ মাহাতো জঙ্গলমহলে রাজত্ব করা কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলনা। কিন্তু সবাই তাঁকে 'মোড়ল' বলে ডাকতো। ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি ব্লকের কাঁকড়াঝোর গ্রামের বাসিন্দা অভিনেতা গোপীনাথ মাহাতো। সাতের দশকের শুরুতে তাঁর নিজের বাড়ির দোতলা ঘরে প্রথম 'মাহাতো লজ' নামে অতিথিনিবাস চালু করেন। বলা হয়ে থাকে যে, এটিই দক্ষিণবঙ্গের প্রথম 'হোম স্টে'। একসময় এখানে এসে রাত কাটিয়ে গিয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সরোজ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ দিকপাল মানুষজন। আজ তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর ভাইপোরা চালিয়ে যাচ্ছে স্বনামধন্য মাহাতো লজ।
'চারমূর্তি' সিনেমার পোস্টার
একসময় পর্যটকরা যখন কাঁকড়াঝোর যেত, তখন তাঁদের কাছে মনে হত যে - একই বৃন্তে দুটি ফুল : কাঁকড়াঝোর আর গোপীনাথ। সেই গোপীনাথ ঐসব পর্যটকদের কথা ভেবেই চালু করেছিলেন সস্তার হোম স্টে। প্রখ্যাত সাংবাদিক কুমারেশ ঘোষের বন্ধু ছিলেন এই গোপীনাথ। তিনি লিখেছেন, "বনবিভাগের বাংলো তখন সকলকে দিত না। কিন্তু কাঁকড়াঝোরের সৌরভ যতই ছড়াতে লাগলো, দলে দলে পর্যটক আসতে শুরু করল। কিন্তু রাত্রিবাসের আর জায়গা নেই তো! আমার পরামর্শমতো গোপীনাথ তৈরি করল 'মাহাতো লজ'। তিনতলা মাটির বাড়ি তাঁর নিজের গৃহসংলগ্ন জায়গায়। খাবার তৈরি করে দেওয়ার লোক ছিল, ছিল বিছানা। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের জন্য আদর্শ ব্যবস্থা। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সে সুবিধা ভোগ করে পাহাড়রানির অপার সৌন্দর্য দুচোখে উপভোগ করে ফিরতে পারত কলকাতা সহ দূর অঞ্চলের সব অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ট্যুরিস্টরা।"
সামনে টেনিদা সহ চারমূর্তি গান গাইছে। পেছনে গরুরগাড়ি চালিয়ে আসছে গোপীনাথ মাহাতো
উমানাথ ভট্টাচার্য পরিচালিত 'চারমূর্তি' সিনেমায় গাড়োয়ানের ভূমিকায় অভিনয় করেন গোপীনাথ মাহাতো। 'চারমূর্তি'(১৯৭৮) সিনেমায় ঘন শালবনের মাঝে লাল মেঠো পথ ধরে টেনিদার (চিন্ময় রায়) গলায় গান -- "তোলপাড় দুদ্দাড় ঝোপঝাড় তোলপাড়।" টেনিদার সঙ্গে প্যালারাম, ক্যাবলা এবং হাবুল। উমানাথ ভট্টাচার্যের পরিচালনায় এই চারমূর্তির পেছন পেছন গরুরগাড়ি চালিয়ে আসছেন শক্ত সামর্থ্য এক গাড়োয়ান। বেশ গোছানো গোঁফ ছিল ঐ গাড়োয়ানের। সামান্য এই ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কাঁকড়াঝোরের গোপীনাথ মাহাতো। কিন্তু অল্প সময় স্ক্রিনে থাকা এই চরিত্রে অভিনয় তাঁকে বিখ্যাত করে রেখেছে আজও। কাঁকড়াঝোর গেলে আজও সকলের মনে পড়ে গোপীনাথ মাহাতোর স্মৃতি।
কাঁকড়াঝোর আর গোপীনাথ মাহাতো যেন সমার্থক নাম। আজ যে এলাকার পর্যটনের এতো বাড়বাড়ন্ত, তার জন্য বেশ কিছুটা অবদান এই মানুষটির। আরেক সাংবাদিক কিংশুক গুপ্ত লিখেছেন, "শোনা যায় 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবির স্থান নির্বাচনে কাঁকড়াঝোরে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। যদিও লোকেশন পছন্দ হয়নি। কিন্তু আলাপ হয়েছিল গোপীনাথের সঙ্গে। সেই সূত্রে পরে পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্য আসেন কাঁকড়াঝোরে। চারমূর্তি ছবির ঝন্টিপাহাড়ির জন্য কাঁকড়াঝোর বেছে নেন।"
এখানকার যে বনবাংলোতে 'চারমূর্তি' সিনেমার শুটিং হয়েছিল, সেটি অবশ্য ২০০৪ সালের ৪ ঠা ডিসেম্বর মাওবাদীদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মাইন বিস্ফোরণ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় রাতারাতি। কিংশুক গুপ্ত লিখেছেন, "ষাটের দশকের শেষে কলকাতা গিয়েছিলেন গোপীনাথ। তাঁর গোঁফজোড়া পছন্দ হয় সত্যজিৎ রায়ের। পরে একবার কাঁকড়াঝোরে এসেছিলেন সত্যজিৎ। থেকেছিলেন বনবাংলোতে। সেই সুত্রেই উমানাথ জেনেছিলেন কাঁকড়াঝোরের কথা।"
🍂
1 Comments
এই গোপীনাথ। মাহাতোর কথা আমিও শুনেছি কুমারেশ বাবুর মুখ থেকে। কুমারেশ বাবুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন এই জঙ্গলমহলের মানুষটি। ওঁর সম্পর্কে একটু বেশি লেখা, তথ্য দাবি করে লেখাটির শীর্ষ নাম
ReplyDelete