জ্বলদর্চি

মধুবাবুর পুরুষদিবস/কমলিকা ভট্টাচার্য


মধুবাবুর পুরুষদিবস

কমলিকা ভট্টাচার্য

সকাল এগারোটায় এক কাপ চা নিয়ে মধুবাবু ব্যালকনিতে বসেন। তারপর খবরের কাগজটির আগা-গোড়া সব খুঁটিয়ে পড়েন। পড়তে পড়তে একটু সুখটান ঘুম নিয়ে নেন—রিটায়ার্ড জীবনের রোজকার অভ্যাস।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

কয়েকদিন আগেই বিহারে ভোট হয়ে গেছে। যারা জেতার, তারা জিতেছে। কিন্তু বিপক্ষ দল হেরে গিয়ে আত্মসমালোচনার বদলে শুরু করেছে দোষারোপ—ইভিএম খারাপ, টাকা বিতরণ, আরও কত কি! তবে খবরের কাগজ বলছে, মহিলা ভোটাররাই নাকি এবার জয়ের প্রধান কারণ—তাদের মাথাপিছু বড় অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বা টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে—সবটাই নাকি জয়ী দলের স্ট্র্যাটেজি।

এর ঠিক নিচে ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপনে মধুবাবুর চোখ আটকে গেল—
আজ আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস।

মধুবাবু মনে মনে ভাবলেন, “এই জায়গায় যদি মহিলা দিবস হত—তা হলে তো বিজ্ঞাপনে ভেসে যেত কাগজ! অনুষ্ঠান, প্রচার, সেমিনার—কত কি!”
ভাবতে ভাবতে আবার মনে হলো—“আমি অন্য পুরুষদের কথা না- জানলেও, কিন্তু আমাদের মতো সংসারী পুরুষেরা সারাজীবন অবহেলিত। পুরুষ মানেই যেন দোষী, পরাধীন!”
🍂

মনের মধ্যে যেন প্ল্যাকার্ড হাতে ভাবনার মিছিল নেমে এল—
‘পুরুষের উপর অত্যাচার বন্ধ করো’
‘পুরুষের স্বাধীনতা চাই’

মধুবাবু মনে মনে হাসলেন—“বিপক্ষ পার্টির লোকজন রাজনীতির কিছুই বোঝে না! যদি মহিলা ভোটারদের টাকা দিয়ে বাজিমাত করা যায়, তাহলে পুরুষরা কি মরে গেছে? দুটো করে বোতল দিলেই হত! রাজনীতি মানেই খেলা—বুঝল না বেটারা!”
হাসি থামতেই আবার দীর্ঘশ্বাস—“এদের জন্যই পুরুষদের ভ্যালু নেই!”

না, আর চলবে না।
আজ তিনি ঠিক করলেন—নিজের মতো বাঁচবেন!
মনে মনে নিজেকেই বললেন—“হ্যাপি মেনস ডে, মধু! চল আজ পুরুষের মতো বাঁচি।”


নিজের আলমারিতে কিছুই পছন্দমতো জামা পেলেন না—সব সাদামাটা, বুড়োটে।
ছেলের আলমারি খুলতেই মনের ‘ছোকরা পুরুষ’ জেগে উঠল—ঝটপট একটা লাল টুকটুকে জামা আর জিন্স পরে রেডি!

ছেলে বিদেশে। তার এনফিল্ড বুলেট পড়ে থাকে। অনেকবার বলেছে, ‘‘বাবা চালাও না!’’ কিন্তু কল্যাণীর কড়া নজরে আর চালানো হয়নি কখনো।
আজ বুলেট বের হলো।

মধুবাবু গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলেন ও 
সিগারেটে টান দিলেন।
রোদে চকচক করা নদীর ধারে হাঁটতে থাকা মহিলাদের আড়চোখে দেখে নিলেন—“পুরুষ দিবস, একটু তাকালে দোষ কি!” 

তারপর ফোন লাগালেন—বিবেক, নীতিশ, জগনকে—
“এই পুরোনো আড্ডার ঠেকে আয়—আজ প্যাক হবে জমিয়ে!”

সবাই হাজির।
এসেই বিবেক বলল "বেশীক্ষণ বসতে পারব না। বউ রাগ করেছে—সুগার বেড়ে গেছে।”
মধুবাবু বললেন—
— “আজ পুরুষ দিবস! আর কতদিন মা-বউ-মেয়েদের ভয়ে বাঁচবি? স্বাধীনতা আমাদেরও আছে! চাইলে আন্দোলন করব!”
সবাই একসঙ্গে, “ ঠিক! ঠিক! হবে! হবে!”

নীতিশ বলল—
— “আমাদের সব কাজের ওপর ওদের তদারকি—এ একেবারেই চলতে পারে না! সবটাই তাদের কন্ট্রোল!”

জগন এক পেগ শেষ করে বলল—
— “আমাদের একটা রিজার্ভেশন চাই!”
সবাই চমকে—“কিসে?”
জগন বলল—
— “প্রতি রবিবার ব্যাচেলর পার্টিতে!”
হাসির রোল উঠল।

আড্ডা শেষ করে বুলেট স্টার্ট করতে যাবেন, এমনসময় কেউ পিছন থেকে ডাকল—
— “মধুদা! চেনাই যাচ্ছে না! বয়স কমে চল্লিশ লাগছে দেখছি!”

মধুবাবুর ভেতরের নারী-বিরোধী উচ্ছের তিক্ততা যেন হানি জ্যামে পরিণত হল।
— “আরে! সুদক্ষিণা? আর চল্লিশ কী—পঁয়ষট্টি হলাম! তবে তোমাদের চোখে দক্ষিণা থাকলে আশিতেও পঁচিশ লাগে!”

সুদক্ষিণা বলল—
— “আপনি একদম বদলাননি!”

মধুবাবু বললেন—
— “বাড়ি ফিরছ? তোমার  অসুবিধে না থাকলে আমি বাইকে করে পৌঁছে দিই?”

সুদক্ষিণা লজ্জা পেয়ে—
— “না… তবে বাইকে চড়ার অভ্যাস নেই—পড়ে গেলে?”
মধুবাবু হেসে—
— “তাহলে জাপটে ধরো আমাকে! লজ্জা কিসের? জড়িয়ে ধ’রো… ধরো… ধরো…”

পেছন থেকে জোরে ধাক্কা—
কল্যাণী দেবী বললেন—
— “একটা বাজতে চলল! বসে বসে কত ঘুমোবে? ওঠো—স্নানে যাও!”

মধুবাবু ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন।
কল্যাণী দেবী মুচকি হেসে বললেন
— “স্বপ্নে কাকে বুলেট চড়ালে? মঞ্জুবৌদি, না সুদক্ষিণা?”

মধুবাবু হতবাক।
মনে মনে ভাবলেন—
“আরে! বিবাহিত পুরুষের কি স্বপ্ন দেখারও স্বাধীনতা নেই? স্বপ্নেও এরা ঢুকে পড়ে জাসুসী করতে! প্রাইভেসি নেই কোথাও!”
না, আন্দোলন করতেই হবে!
“আন্দোলন! আন্দোলন!” বলতে বলতে স্নানে ঢুকে গেলেন।

কল্যাণী দেবী পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন—
— “কিসের আন্দোলন?”
মধুবাবু বললেন—
— “পুরুষ স্বাধীনতার!”

অবশ্য যথারীতি, স্নানঘরে ঢোকার আগে গামছা নিয়ে যেতে ভুলে গেলেন।
আবার ডাক—
— “কল্যাণী! কল্যানী! গামছাটা দাও!”

হাত গলিয়ে গামছা বাড়িয়ে কল্যাণী দেবী হেসে বললেন—
— “আজ পুরুষ দিবসে তোমাকে স্বাধীন হওয়ার শুভেচ্ছা জানাই।
তোমার আন্দোলন সফল হোক।”

Post a Comment

4 Comments

  1. মধু ছিল, বাবু হয়ে যত গণ্ডগোল। জমিয়ে মজিয়েছেন

    ReplyDelete
    Replies
    1. Kamalika BhattacharyaNovember 19, 2025

      এই টুকু মধুই থাক।অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  2. Like an oasis in the literary desert full of cantankerous cactii. To laugh is to live. Your sketch is so much a celebration of life.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Kamalika BhattacharyaNovember 19, 2025

      Thank you so much for your beautiful words.
      To be called an oasis in a desert of cantankerous cactii is a compliment I’ll treasure.
      If my writing brought you a moment of laughter, I feel truly rewarded.
      Your appreciation means a lot.

      Delete