পিলসুজ
কমলিকা ভট্টাচার্য
“বাবা, আপনি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?” — অদিতি চিৎকার করে ওঠে।
“দেখছেন না, আদরিণী আপনাকে দেখে ভয় পাচ্ছে!”
প্রলয় ইতস্তত করে বলে,
“এই তো চলে যাচ্ছি, বৌমা... আদরিণীমার খুব লেগেছে না? কেটে গেছে কি?”
অর্ণব বলে,
“বাবা, তুমি ভিতরে যাও, আমি দেখছি।”
প্রলয় ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে আসে।
জানলা দিয়ে দেখে — অর্ণব গাড়ি বার করছে, অদিতি আদরিণীকে কোলে নিয়ে কপালে কাপড় চেপে গাড়িতে উঠছে।
প্রলয় হতভম্বের মতো জানলার ধারে রাখা আরামকেদারায় ঝপ করে বসে পড়ে।
তারপর রাধারাণীর ছবির দিকে তাকিয়ে হাওহাও করে কেঁদে ওঠে।
চিৎকার করে বলে —
“রানী! তুমি আমাকে এ কোন অভিশাপ দিয়ে গেলে?
আমার একমাত্র নাতনীটা আমায় দেখে ভয় পায়, আমার কাছে আসতে চায় না!
আমি সেদিন রাগের মাথায় পুজোর ঘরে ওই পিলসুজটা দিয়ে তোমার মাথায় আঘাত করেছিলাম।
তোমার মাথা ফেটে গিয়েছিল, তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে।
তুমি আমাকে বাঁচাতে সবাইকে বলেছিলে — সকাল থেকে উপোস ছিলে, ঠাকুরঘরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে পিলসুজে লেগে মাথা ফেটেছে।
সেদিন তুমি আমাকে শাস্তি দিলে না কেন, রানী?
জানি, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছিলে — কিন্তু ভিতরে ভিতরে অভিমানে নিজেকে তিলতিল করে শেষ করে ফেলেছিলে।
আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, আমায় শাস্তি দিতেই...
তুমি জানতেই, আমি তোমাকে এত ভালোবাসতাম যে তোমাকে কারও সঙ্গে কথা বলতে দেখলে আমার সহ্য হত না।
সেই ভালোবাসাই আমাকে অন্ধ করেছিল।
সেদিন সুদীপের মুখে তোমার বইয়ের প্রশংসা শুনে রাগে মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল — তাই তোমাকে আঘাত করে ফেলেছিলাম।”
প্রলয় থেমে এক নিঃশ্বাসে বলে,
“রানী, আজ আমি তোমার বইগুলো বারবার পড়ি।
বুঝেছি — যে প্রেমকে একদিন কলুষিত ভেবেছিলাম, সেই প্রেমই তো মানবতার আধার।
ভালোবাসাই ভক্তি, ভালোবাসাই মুক্তির পথ।
তোমার মনে এত করুণা ছিল বলেই তুমি আমাকে ক্ষমা করেছিলে।
আমি জানি, তুমিই আমার কাছে আদরিণী হয়ে ফিরে এসেছো তবে মাঝে মাঝে মনে হয় সে আমাকে ভালোবেসে নাকি তিলে তিলে আমাকে অপরাধ বোধে বিঁধবে বলে?।”
বাইরে গাড়ির হর্ন বাজে।
অর্ণবরা ফিরে এসেছে।
প্রলয় তাড়াতাড়ি বাইরে আসে।
বাইরের ঘরে দেখে — পিলসুজটা উল্টে পড়ে আছে।
সে রমলাকে ডেকে বলে,
“কে বার করেছে এটা আজ?
এতদিন হলো এই বাড়িতে আছিস — জানিস তো, তোর বৌদিমনির ইচ্ছেমতো শুধু তার বার্ষিক শ্রাদ্ধের দিনেই এটা বের হয়!”
রমলা বলে,
“আজ আদরিণী দিদিভাইয়ের পাঁচ বছরের জন্মদিন। তাই বৌমা বলতে, নামিয়ে আনলাম।
খেতে বসার আগে জ্বালিয়ে দেব বলেছিলাম, কিন্তু তার আগেই আদরিণী দিদিভাই ছোটাছুটি করতে গিয়ে পিলসুজে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। তখনই এই বিপদ।”
প্রলয় শান্ত স্বরে বলে,
“যা, ওটা রেখে আয়।”
দরজায় বেল বাজে।
প্রলয় এগিয়ে গিয়ে ভাবে — না, যদি আদরিণী আবার ভয় পেয়ে কাঁদে?
সে রমলাকে বলে,
“যা, দরজাটা খুলে দে, ওরা এসেছে।”
তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে হালকা করে দরজাটা ভেজায়।
রাধারাণীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“তুমি সেদিন যখন হাসপাতাল থেকে ফিরেছিলে,
তোমার কাটা ঘায়ের উপর হাত বুলিয়ে জানতে চেয়েছিলাম — কষ্ট হচ্ছে কিনা।
আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমায় শাস্তি দাও।
তুমি বলেছিলে — ‘আমি মরে গেলে আমার ছবির ধারে ওই পিলসুজটা জ্বালিও — সেটাই তোমার শাস্তি।’
সে যে কত বড় শাস্তি, রানী, আজ দশ বছর ধরে বুঝছি।
তবু বলো, কেন আদরিণী আমার কাছে আসতে ভয় পায়? তুমি কি এখনো আমাকে ক্ষমা করোনি?”
ঠিক সেই সময় দড়াম করে দরজা খুলে যায়।
আদরিণী দৌড়ে এসে প্রলয়কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“দাদু, তুমি ঠাম্মার সঙ্গে কথা বলছো? আমায় ঠাম্মার গল্প শোনাবে?”
প্রলয় আদরিণীকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
“নিশ্চয়ই! তোমার জন্যই তো সব রাখা।”
তারপর আদরিণীর কপালের কাটা জায়গায় আলতো করে হাত রেখে বলে,
“খুব লেগেছে? খুব কষ্ট হয়েছে না?
আমি পিলসুজটাকে খুব বকেছি — আমার আদরিণী দিদিভাইকে কষ্ট দিয়েছে বলে।”
আদরিণী হঠাৎ গম্ভীর মুখে বলে,
“পিলসুজটাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।”
তারপর খিলখিল করে হেসে ওঠে — ঠিক তেমন করেই,
যেমন করে ভালোবাসা আর ক্ষমাভরা হাসি লেগে থাকত রাধারাণীর মুখে।
এরপর...
প্রতিদিন দুপুরে, রাতে ঘুমের আগে দাদুর মুখে ঠাম্মার লেখা গল্প-কবিতা শুনেই আদরিণী বড় হতে লাগল।
গল্প চলতে থাকলো।
নটে গাছটি মুড়োল না —
কারণ ভালোবাসা আছে, থাকে...
ভালোবাসা কখনও মরে না।
🍂
6 Comments
ভীষণ ভালো লেখা আপনার।
ReplyDeleteআচ্ছা,অনেক ধন্যবাদ।
Deleteবেশ ভালো। আর একটু বড় হলে আরো মন ভরত।
ReplyDeleteদিল মাঙ্গে মোর।😊 ধন্যবাদ
Deleteশুরু হল, শেষ হল না
ReplyDeleteআদরিণীর হল শুরু
Deleteরাধারাণীর হল শেষ
কিন্তু ভালোবাসা তো আছে ...
নটে গাছটি তো মোড়ায় নি এখনও।