গল্প ধারাবাহিক
কুয়াশা যখন
পর্ব ১০
বাসুদেব গুপ্ত
পার্টির শহর ডাকছে আয়
ছয় সপ্তাহ কেটে গেছে, পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ব্যাংকের জমা ঠেকছে তলানিতে। ঊষার শরীরে জুত নেই, রক্ত নাকি কম, হাসপাতালে বলেছে। আয়েশার কখন পেট ব্যথা আসে আবার কে জানে। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। স্বপনের পা ঠিক হয়ে এসেছে, এখন ক্রাচ ছাড়াই চলতে পারে, কিন্তু হাঁটলে এখনও ল্যাংড়ায়। ব্যথা তাকে কষ্ট দেয়, নিয়মিত পেইনকিলার খেতে হয়।
ডাক্তাররা কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, ওষুধ খাওয়ার সময় এক ফোঁটা মদও চলবে না। নেহাত ভয়েই ও মদ খাবার লোভ সামলে আছে। হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা রুদ্রদার পার্টি-কানেকশানের জন্যই হতে পারল। নইলে ও কোথায় যেত!
রুদ্রদা আজ দেখতে এসেছিল। সে পার্টির ফুলটাইমার, মূলত পার্টির কর্মী, মাসিক ভাতা পায়।
—“তাহলে স্বপন, কাজকর্মের কথা কিছু ভেবেছিস?”
—“না দাদা, কাজ বলতে তো ডেলিভারি, সে আর হবে না। এই পা নিয়ে সারাক্ষণ টাইম কে টাইম ডেলিভারী, একটু লেট হলেই গলা ধাক্কা দেবে। আর গেলেও ওরা হয়তো আর নেবে না। কারণ ওরা যখন ডেকেছিল তখনই যেতে পারিনি। তুমি কোনো কোম্পানি চেনো, যেখানে আগের মতো পিয়ন বা অফিস অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ পাব?”
রুদ্রদা ঊষার করা লিকার চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসল,
“কোথায় কাজ? উলটে সব কোম্পানি বন্ধ হচ্ছে। নতুন কারখানা নেই। বাজার খুব খারাপ।”
—“একটা কথা ভাবছিলাম, বলব?” স্বপন লাজুকভাবে বলল,
-তোমার মতো পার্টিতে চাকরি পাওয়া যাবে না?”
—“এটা তো চাকরি নয়, আমি তো পার্টির হোল্টাইমার। মানে লাইফটাই পার্টিকে দিয়ে দিয়েছি। আর পার্টির আদর্শ বুঝতে হবে, পার্টির প্ল্যান প্রোগ্রাম আত্মস্থ করতে হবে, অত সহজ নয়, অনেক বছর ধরে সংগ্রাম করতে হয়।”
—“আমি তো হোল্টাইমের বলিনি, নানা রকম কাজ তো আছে। ঐ যে শুনি আইটি সেল, ওরা তো আর আদরশের জন্য কাজ করে না। ওরা পার্টিকে কিছু একটা কাজ করে দিচ্ছে। এম্নি কত তো কাজ আছে, দেখোনা, কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই। দাদা, দেখো তো, আয়েশার অবস্থা খারাপ হচ্ছে পুষ্টির অভাব হাসপাতালে বলেছে। আমি যে কোনো কাজ করব, পিয়নের কাজ, যেকোনো শারীরিক কাজ।”
রুদ্রদা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, হয়তো দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী, ভাইয়ের মতো, মনে মনে বিচার করছিল, কি কাজে লাগানো যায়। কাপ টাকে নামিয়ে রেখে উঠল। তারপর বলল,
—“ঠিক আছে, একদিন পার্টি অফিসে আয়, আমি লোকাল কমিটি সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলব।”
🍂
রহিম আবার একদিন চায়ের দোকানে দেখা করল। এতদিনে হাওয়া ঠান্ডা হয়েছে, লেকের ধারে চায়ের দোকানে হালকা শীতের হাওয়া ঢুকছে, শীত উঁকি দিচ্ছে স্বপনের ভঙ্গুর ঘরে, মনে হচ্ছে পৃথিবী বদলাচ্ছে। শীত আসছে, কয়েক মাসের জন্য ঘাম, গরম আর ভ্যাপ্সানি থেকে মুক্তি।
—“বাহ চা আজ সলিড হয়েছে, কী দিয়েছো? এলাচ?” রহিম টাকরায় একটা টকাস আওয়াজ করে জিজ্ঞেস করল।
—“আমার ইয়ে দিয়েছি,” চা-ওয়ালার মুখ খারাপের জন্য ওর পিছনে লাগেও সবাই।
—“আরে দাদা, সকাল সকাল কী কথা! ঐ দেখো স্বপনদা আসছে, ওর জন্য আরেক কাপ চা বানাও ঠিক এমনি করে।”
স্বপন ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে দোকানে ঢুকল, গায়ে পাতলা চাদর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুক খুক করে একটু কাশল, তারপর কথা শুরু করল।
—“সুক্রিয়া রহিম ভাই। কেমন আছো? ডেলিভারির কাজ কেমন?”
—“চলছে তো খুব ভাল। শীত মানেই অর্ডার বেশি। কিন্তু কোম্পানি তো আমাদের ফি কমাতে চাইছে, ওরা নাকি লসে রান করছে। যাই হোক, তুমি এখন কী করছো? পায়ে এখনো ব্যথা?”
—“এতগুলো টাকা গেল, আমার যা সময় যাচ্ছে। যাই হোক, পাটা ঠিক হচ্ছে, আর এক মাসেই মনে হয় হাঁটতে পারবো। ডাক্তার বাবু তো সাহস দিচ্ছে। ”
-আমার বাইকটার জন্যই তোমার এত ভোগান্তি। কি খারাপ যে লেগেছিল আমার।
- না রে না, ওটা আমারই দোষ। বাদলদা তো বলেইছিল, ঠিক করানো রিস্কি, আমিই জোর করলাম।
—“তোমার ক্লিনিং সার্ভিস? আবার চেষ্টা করো না?”
—“শুরু করতে অনেক টাকা লাগে। অর্ডার কে দেবে? এখন সবাই অনলাইনে অর্ডার দেয়। ভেবেছিলাম, পুরনো অফিসে কাজ পেলে অন্যদের কাছে রেফারেন্স দেখাতে পারব। কিন্তু ভাগ্য খারাপ।”
—“আমি কীভাবে সাহায্য করব জানি না। খারাপ লাগছে। দেখো কিছু একটা হবে নিশ্চয়।”
রহিমের ফোনে ডেলিভারির কল এল, সে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। স্বপন দেখল, সে আর মোটরসাইকেল চালায় না, সাইকেলে নেমে এসেছে। রহিমের অবস্থাও সুবিধের না। স্বপনের ব্যাংক ব্যালান্সও কমছে। হয়তো রুদ্রদাকে ধরে পার্টিতেই ঢুকতে হবে।
স্বপন কোনদিন ভাবে নি পার্টির কর্মী হবে। দিব্যি একখানা চাকরি ছিল, পরিবার ছিল, মধ্যবিত্তের মত স্বপ্ন ছিল, ফুটপাথে ঘর বেঁধেও। তবু এই গ্ণতান্ত্রিক দেশে গরীব মানুষ চাইলেও পারবে না পার্টিকে এড়াতে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে, চিকিৎসা পেতে, সবকিছুতে পার্টির সুপারিশ লাগে। ফুটপাথে সবজি, মাছের বাজার গজিয়ে ওঠে, কে বসবে, কে বসবে না, পার্টি ঠিক করে। অটোচালকদের অনুমতি দেয় স্থানীয় পার্টি দাদা। কখনো ট্যাক্স দিতে হয়, কখনো শুধু ভোট দিতে বলে। ইলেকট্রিক সংযোগও পার্টি ঠিক করে দেয়, না হলে কলকাতার দামি বিদ্যুৎ বিল দিয়ে ফ্রিজ চালানো অসম্ভব হত স্বপনের। পার্টি আছে, ঈশ্বরের মত, সর্ব
কিন্তু একেবারে পার্টির কাজ? ভয় লাগে। পার্টি তিমির মতো, গিলে ফেলে। ভেতরে কী আছে কে জানে। কিন্তু স্বপন আর কী করতে পারে? প্রতিদিন শোনে, কত পরিবার না খেতে পেয়ে বা পাওনাদারের তাড়নায় সবাই মিলে আত্মহত্যা করছে। স্বপন তা পারবে না। আত্মহত্যা ভাবতেই ওর লজ্জা হয়, রাগ হয়। সে লড়াকু, লড়বেই। শেষ তক।
স্বপন তিন দিন ভাবল। ঊষার সঙ্গে আলোচনা বৃথা, সে সামান্যতেই কাঁদে বা চেঁচায়, এখন আবার এক সপ্তাহ ধরে বিছানাতেই শুয়ে। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে, কিন্তু ফোনের EMI, খাবার, পুজোয় নতুন জামা—সব কিনতে হবে। সংসার চলবে কি করে? ঊষা বলেছিল ও দুটো রান্নার কাজ দেখেছে, কিন্তু চারদিকে সবাই নিরামিষাসীদের ফ্ল্যাট। ওকে কেউ রাখবে না। তাহলে? টাকা কোথায়?
এক আধো কুয়াশা নামা সন্ধ্যায় স্বপন ভয়ে ভয়ে পার্টি অফিসে গেল। স্থানীয় কাউন্সিলর তাকে ভালোই চেনে, কারণ স্বপনের প্রতিবেশী নিয়মিত পার্টি কর্মী।
—“তুই স্বপন না? কী হয়েছে, এত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অফিসে যাচ্ছিস না? শুনেছি জাপানি কোম্পানিতে কাজ করিস।”
স্বপন জানত, দ্রুত কাজ করতে হবে, ইমপ্রেস করতে হবে একে কুইক। সে হাঁটু গেড়ে কাউন্সিলরের পা ছুঁয়ে কাঁদতে শুরু করল,
—“পরেশদা, আমার চাকরিটা চলে গেছে। নতুন জাপানি মালিক সবাইকে বের করে দিয়েছে। তিন মাস বেকার। ভাবলাম একটা অফিস ক্লিনিং সার্ভিস শুরু করি, কিন্তু অর্ডার দিল না। ডোর ড্রপে ডেলিভারি বয় হতে গিয়ে পা ভেঙেছি। আমাকে একটা পার্টিতে কাজ দিন? নইলে সবাই মিলে মারা যাব। রুদ্রদা তো জানে, আমি চিরকাল পার্টির সাপোরটার। একটু কাজ দিলে আমরা বাঁচতে পারি। ”
পরেশদা পুরনো কালের নেতা, পার্টির পরিচালক, পার্টির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পার্টির লোকের কাছে তিনি স্নেহশীল গুরুজন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর হাত ধরে ওকে তুলে বসালেন হলুদ রঙ্গের প্লাস্টিক চেয়ারে।
-কাঁদিস না। উঠে দাঁড়া। পার্টি যদি তোদের মতো মানুষদের সাহায্য না করে, তাহলে কীসের পার্টি? এই পার্টির চিহ্ন দেওয়া নীল শার্ট পরে ভর্তি হয়ে যা। কানুদার কাছে পাবি। দশটাকা দিয়ে কিনতে হবে কিন্তু। কাল ঐ জামা পরে আয় সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমরা সবাই বলো ধীরেন্দ্রজী, আমাদের ভগবান, আমাদের একমাত্র নেতার আশীর্বাদ করুন স্বপনকে। জয় ধীরেন্দ্রজি, একমাত্র নেতার জয়।”
ঘরে সবাই চিৎকার করল, “জয় ধীরেন্দ্রজি, একমাত্র নেতার জয়।!” স্বপনও সুর মেলাল সেই সঙ্গে। ঢুকে গেল প্রবাহের মধ্যে জলকণা হয়ে।
স্বপন থরথর করে কাঁপছিল, এই হঠাৎ সুনামির মত ধেয়ে আসা পরিবর্তন সামলাতে। যেন অফিসের পনেরো তলা বিল্ডিং থেকে আগুনের এক কুন্ডে ঝাঁপ দিচ্ছে। সে? স্বপন? শেষকালে পার্টি ওয়ার্কার? যে এতদিন সব বড় বড় পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে একসঙ্গে বসেছে, ডেস্কটপ থেকে ল্যাপটপ, নেটওয়ার্কিং, সিকিউরিটি প্রজেক্টে কাজ করেছে। ওর কাজ দেখে আর বুদ্ধি দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত, বলত পড়াশোনাটা করলে না স্বপনদা, তাহলে তুমিও পারতে প্রোগ্রাম লিখতে। সত্যি, আরও পড়াশোনা করা উচিত ছিল, সবসময় আফসোস। যদি বাবা এত তাড়াতাড়ি মারা না যেতেন। স্বপন ঘরের অন্ধকার কোণে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। ঊষা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। সে উত্তর দিল না।
কাল থেকে নতুন জীবন। যা সে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। মানুষকে ভয় দেখানো, টাকা তোলা, দাঙ্গা, বোমা ছোড়া, ব্যালট চুরি—পার্টি এসবই করে। নেতার ছবি সেঁটে দখল করে সবকিছু। নিজেকে নোংরা লাগছিল। আয়নায় তাকিয়ে দেখল, অন্ধকারে শুধু দুটো গোল চোখ, যেন ট্রাকের হেডলাইটে ধরা খরগোশ। কী হবে কাল? একদিন ওও ওরকম নেতা হবে, না প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংয়ের গুলিতে পড়ে যাবে? স্বপন ঘেমে উঠল, তখনি হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া এসে দরজা হাট করে খুলে দিল। খুব শীতে স্বপন আবার থর থর করে কাঁপতে লাগল।
-ক্রমশঃ-
2 Comments
❤️
ReplyDelete💚
Delete