জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন /পর্ব ৩ /বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  

কুয়াশা যখন  পর্ব ৩ 
বাসুদেব গুপ্ত 

অফিস খুলেই হুলুস্থূলু

আজ হবে তুতুতে। মানে জানো? জাপানী ভাষায় হাতাহাতি। স্বপন বেশ চালাক চালাক মুখ করে জানায় ড্রাইভার যাদবকে। স্বপন গ্রীন ওয়্যার কম্পানীর অফিস এসিট্যান্ট, যাদব অফিস ড্রাইভার। ওদের মতে ওদের জন্যই অফিসটা চলে, একদিন না এলেই হই হই। স্বপন সব পারে কিন্তু ইংরিজিটা ঠিক পড়তে লিখতে পারে না। যাদব বাইক থেকে বাস কিছুতেই অসুবিধা নেই, কিন্তু এটিএম থেকে টাকা তুলতে গেলেই মুশকিল, তখন দরকার স্বপনকে। কিন্তু দুজনেরই ফোনে সারাক্ষণ নানা মেসেজ আসতে থাকে ইংরিজীতে। কাজ না থাকলেই রীল দেখতে বসে যায় ওরা দেশের ১৫০ কোটি লোকের মতই। কিন্তু মেসেজ এসে বিরক্ত করে, কিছু বোঝে না, শুধু এক লাখ, দশ লাখ এই সংখ্যা গুলো বোঝা যায় তখন যেতে হয় চন্দন, ম্যানেজারবাবুর কাছে। ম্যানেজারবাবু রোজ ছ ঘণ্টা ডেলি প্যসেঞ্জারী করে খিটখিটে হয়েই থাকে, মাঝে এদের এই মেসেজগুলো পড়ে মানে বলতে হয়। স্ক্যাম স্ক্যাম, একদম ক্লিক করবে না বলেই ফেরত পাঠিয়ে দেয় ওদের। 

গ্রীন ওয়্যার বদলে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। পুরনো মালিক বুড়ো, তিনি টেকনিকাল ব্যাপারটা চালিয়ে এসেছেন, আর না পেরে রিটায়ার করলেন জুলাই মাসে। আর কম্পানি কিনে নিল জাপানী ক্লায়েন্ট হিকোমা জলের দরে। শোনা যাচ্ছে নামও নাকি পাল্টাবে। 
হিকোমা মানে তরুণ ছেলে। কিন্তু হিকোমাও দেখতে দেখতে পঞ্চান্ন। তার মসৃণ হাসিমাখা মুখে এখন জালের মতো রেখা ফুটছে এক এক করে, নতুন কমলা রঙের চুল স্টাইলিশের চেয়ে বেশি এলোমেলো।   বহু বছর ধরে জাপান থেকে তিনি এই  ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিটিকে অর্ডার দিয়েছেন।  সফটওয়্যার অর্ডার  ।   ক্রেতা  এখন মালিক হয়েছেন। 
 
🍂

টেকনলজি একটা ঘোড়া। বা একদিন ছিল ঘোড়া। এখন সে হয়েছে জেট বিমান। সেই কবে হিকোমার জাপানী কাস্টমাররা সফটওয়্যার চাইতেন, পিসির জন্য। ডেস্কটপ তারপর ল্যাপটপ। হাজার হাজার পিসি, তার জন্য দরকার নতুন নতুন সফটওয়ার। তারপর এসে গেল ইন্টারনেট, সবকিছু পাল্টাতে লাগল। বড় ক্মপানীরা পিসির বদলে কিনতে লাগল ক্লাউড সার্ভিস, নিজেরা হাজার হাজার সারভার ডাটা বেস নিয়ে হিমসিম না খেয়ে সব ক্লাউড ক্মপানীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল, আর কমে গেল হিকোমার ব্যবসা। তারপর এল মোবাইল, এসে জীবনযাত্রাই পালটে গেল, এখন কেউ আর বসে সফটওয়ার লেখে না, মোবাইলে এপ আছে, সবরকম এপ, তারা করে দেয় দরকার মত কাজ। 
টেকন্সলজি যেমন এগিয়েছে হিকোমার ক্মপানীও তেমনি দৌড়েছে। কিন্তু এ আই আসার পর এখন সব কিছু কেমন চলে যাচ্ছে হাতের বাইরে। লোকে আর চাইছে না হিকোমার সফটওয়ার, তারা আদেশ দিচ্ছে এ আইকে, এ আই করে দিচ্ছে। এদিকে অফিস চালানোর খরচ বেড়েই গেছে বছর বছর মাইনে বাড়ার সঙ্গে। হিকোমা ঠিক করেছে খরচ কমাতেই হবে, নইলে আর চলবে না। একমাস ধরে হিকোমা সব মাইনে খরচ, অরডারের অবস্থা দেখে এক সিদ্ধান্তে পউঁছেছেন। আজকের মিটিঙ্গে হিকোমা সেটা বলবেন। বলবেন ফ্যাট বাদ না দিলে আর চলছে না। আর কে কে ফ্যাট কে কে প্রোটিন সেটাও বোল্ড করে লেখা আছে তার নোটপ্যাডে। 

স্বপন আর যাদব কদিন ধরেই গন্ধ পাচ্ছিল, অফিসে কিছু একটা হচ্ছে। নতুন মালিক খুবই ইস্ট্রিক্ট,  পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে। যাদবের বয়স ৬৫, ড্রাইভার হলেও গাড়ি চালানোর কিছু নেই, কারণ চন্দন গাড়ি ব্যবহার করতে চায় না—পেট্রোল খুব দামি। স্বপন সকালে অফিস খোলে, ইঞ্জিনীয়াররা আসার অনেক আগেই মেঝে আর টয়লেট পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে রাখে সব। ডেভেলপার আর টেস্টারদের দল, হই হই করে মোবাইল দেখতে দেখতে ঢোকে, ঢুকেই অর্ডার চা-কফি গরম গরম, স্বপনদা… সস্তা বলে এখন রাস্তার পাশের দোকান থেকে খাবার আসে,  সেসব নিয়ে আসা, পরিবেশন করা, শেষে আবার পরিষ্কার করা। দিন শেষে, শেষ কর্মীটি বেরোলে  আবার অফিস বন্ধ করে। বাড়ী ফিরতে রাত নটা। এছাড়া আছে পিয়নের কাজ—অফিসের মোটরসাইকেলে সরকারি অফিসে কাগজ নিয়ে যায়, ব্যাংক থেকে টাকা আনে।
এর পরে আরো কাজ। স্টোর অ্যাসিস্ট্যান্ট আর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট একসঙ্গে। ইঞ্জিনিয়াররা চাইলে পুরনো সিডি, হার্ডডিস্ক, রাউটার খুঁজে বের করে দেয়। পিসি সেটআপ করতে পারে, ফার্নিচার মেরামতও। স্বপন তাই  নিশ্চিত   অফিস তাকে ছাড়া চলবেই না। তবু ভয় তো লাগেই। কে জানে বিদেশী মালিক কি করে। হাওয়ায় একটা অবিশ্বাসের গন্ধ। রক্তপাত আসছে।




স্বপন আর যাদবের তো ইংরেজি আসে  না।  হিকোমার হাতাহাতিতে যখন ওদের হাজির করা হল, তখন পৃথার মনে হল যেন দুই বলির পাঁঠা কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার অমর পান্ডে হল দোভাষীর। 
—তোমার কাজ কী?
—স্যার, আমি ড্রাইভার। 
—এখন গাড়ি চালাও? 
—না স্যার, চন্দন স্যার গাড়ি বার করতে চান না। পেট্রলের দাম… বলে যাদব মাথা চুলকিয়ে নিল। 
- গাড়ি বার করতে চান না। তাহলে কী করো সারা দিন? ঘুমোও?
যাদব কিছুক্ষন হাঁ করে রইল, কি বলবে বুঝতে পারল না। তারপর আমতা আমতা করে বলল
 —স্বপনকে কাজে হেল্প করি। 
হিকোমার মুখ শক্ত হয়ে গেল, তার ঠোঁটে ঝোলানো হালকা হাসি বেঁকে গিয়ে বিদ্রূপের ইমোজি হয়ে রইল কিছুক্ষণ। যাদব বুঝে গেল, তার কপাল পুড়েছে। 

এবার স্বপনের পালা। স্বপনের ঘাড় উঁচু, চোখে আত্মবিশ্বাস, হাতটা মুঠো করা, কিন্তু বুড়ো আঙ্গুলটা যে কাঁপছে সেটা যাদবের চোখ এড়াল না। 
—তোমার কাজ কী?
 —সবকিছু স্যার। দরজা খোলা থেকে খাবার, চা-কফি… স্বপনের  অপমানও লাগছে, কেউ এভাবে ওকে জিজ্ঞেস করে নি ওর কাজ কি। 
 —সবকিছু মানে? হিকোমা প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, যা সাধারণত জাপানিরা করেন না। 
স্বপন   গুছিয়ে বলতে পারছিল না দেখে অমর সাহায্য করল, 
-হিকোমা, ও  খাবার পরিবেশন করে, কফি বানায়, অফিস পরিষ্কার করে। আর স্টোর থেকে জিনিষ বার করা, মেসিন এসেম্বল করা এসব আর কি।

মিটিং শেষ হতে হতে লাঞ্চ এসে গেল। খাবার টেবিল অন্যদিন হাসি ঠাট্টা জোকস চলতে থাকে, আজ সবাই গম্ভীর। হিকোমা বলেছে সিদ্ধান্ত আসবে সপ্তাহান্তে। মোটামুটি হাব ভাব দেখে বোঝা গেল, গ্রাফিক ডিজাইনার, ডিজিটাল মার্কেটিং গার্ল, দুই অ্যান্ড্রয়েড ডিজাইনার, স্বপন, যাদব—সবাই ঝুঁকিতে।
আজ আলো নিভে গেল তাড়াতাড়ি, সবাই বাড়ি চলে গেল। স্বপন দরজা বন্ধ করে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়। তার মেয়ের আবার পেটব্যথা, যা শুরু হয়েছে প্রিম্যাচিউর বাচ্চা হওয়ার পর থেকে।  প্রতিবেশী ও স্থানীয় পার্টি কর্মী রুদ্রদাকে ফোন করল মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য। আজ রাতে হয়তো জাগতে হবে।   আইটি সিটির ঝলমলে আলো ছেড়ে স্বপন পৌঁছে গেল আধা অন্ধকার ফুটপাথ হাউসে। 

-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments

  1. সুন্দর এগোচ্ছে।খুব ভালো লাগছে,রোজ রোজ

    ReplyDelete