জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন পর্ব ৫. /বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  

কুয়াশা যখন  পর্ব ৫.  
বাসুদেব গুপ্ত 

কফির ফেনায় মায়া

স্টারবাকসে কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। পৃথা, সুমন আর চন্দন লাট্টে আর রেড ভেলভেট কেক অর্ডার করেছিল। এত কিছুর মধ্যেও, এই মাস থেকে তাদের বেতন ১২% বেড়েছে এবং হিকোমার নতুন আদেশবলে তারা হয়েছে  ডিরেক্টর। হিকোমার বুদ্ধি। মাইনে বাড়ল না, দায়িত্ব বেড়ে গেল। যাই হোক এটা একটা ঘটনা, সেলিব্রেট করা দরকার। চন্দন ছোট্ট কফি পার্টির প্রস্তাব দিল। কফি খাওয়াও হবে, আবার স্বপনকে কিভাবে রাখা যায় সেটা হিকোমাকে বোঝানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হবে।   স্বপন ছাড়া অফিসের কাজ যে একদিনো চলবে না সেটা পরিষ্কার। কেউই নিজে কফি বানাতে বা বাথরুম পরিষ্কার করতে রাজী নয়। ডিরেক্টর হয়ে তো আরোই নয়

চন্দন তিন দশক ধরে কোম্পানির বড়বাবু বা এডমিন।  ফাউন্ডারের দূরসম্পর্কের ভাই হিসেবে মার্কেটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গ্রীন ওয়ারে ঢুকেছ সেই কবে। তারপর থেকে, তখন কোম্পানি ভরতি লোকজন, আমেরিকা, জাপান, দেশের নানা প্রান্তে যাচ্ছে এদের লেখা সফটোয়্যার, পুরস্কার আসছে, কাগজে নাম বেরোচ্ছে, চন্দন কফির ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে সেসব ভাবছিল। সেই কোম্পানি ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে আজ  ছোট্ট এক টুকরো  । চন্দনই কোম্পানির অপরিবর্তিত প্রতীক—চন্দন স্যার। শুধু আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা, এই সম্বল করে চালিয়ে গেছে এতদিন। কিন্তু এখন কোম্পানি আরেকটি মোড়ে দাঁড়িয়ে।   এবার কীভাবে সামলাবে মাথায় কিচ্ছু আসছে না।
🍂

—হিকোমা হুকুম দিয়েছে আর আমাদের সেটা মানতে হবে। উনি কি সামুরাই নাকি? 
চন্দনের ভাষায় চাপা বিদ্রূপ। আজ   মার প্রেসার বেড়েছে, সকালে মার দেখাশোনা, ব্রেকফাস্ট বানিয়েছে ঘুম থেকে উঠে। বৌ করবী তাড়াতাড়ি ভাত আর মাছের ঝোল রান্না করেছে। তারপর এই দীর্ঘ যাত্রা, ডেলি প্যাসেঞ্জারি, বাস, অটো। শহরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিলে মাইনের অনেকটাই কাটা যাবে, আর মা ঐ শহরতলীর বাগান ঘেরা বাড়ি থেকে কি মেনে নিতে পারবেন এখানে ঘুপচি ফ্ল্যাট? চন্দন স্ট্র দিয়ে কফির কাপের ভাসমান হৃদয়টা ফুটুস করে ফুটো করে ফেলল। তারপর কাউন্টারে এক প্রগলভ যুগলের কার্যকলাপ দেখে  ভ্রু তির্যক হয়ে উঠল, যেন অদৃশ্য তীর ছুঁড়তে প্রস্তুত।
—রাগ করবেন না স্যার, হিকোমা কোম্পানি উন্নত করার চেষ্টা করছেন, বলল পৃথা  পৃথা এমন একজন, যার কাজ দিনরাত সবার ঝামেলা পোয়ানো। তবু মেটারনাল ইন্সটিংট ছাড়তে পারে না, মনে করে, সবাইকে ঠিকঠাক  করা ওরই দায়িত্ব। 
—হিকোমা কী করতে পারে? বাজার খারাপ, আমরা সময়মতো প্রজেক্ট শেষ করতে পারছি না। তাকে তো সামলাতে হবে।  
 —সামলাতে গিয়ে যে সব বেসামাল করে দিচ্ছে পৃথা।  স্বপনকে বাদ দিলে অফিস চলবে কীভাবে? কে দরজা খুলবে? সবাই কাজ করলে কেউ এলে কে দেখবে?
 —হিকোমা আগেই বলেছে, আমাদের কাছে চাবি থাকবে, আমরা নিজেরা কফি বানাব, বাথরুম পরিষ্কার রাখব। 
সুমনের মন্তব্য। 

সুমন চুপচাপ ছিল, এবারে কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ল, কফির অর্ধেক শেষ করে। সুমন কোন ব্যাপারে বেশি চিন্তা করে না, ওর মোটো এঞ্জয় এঞ্জয় এন্ড এঞ্জয়। চোখ ছোট করে, ঝুলে থাকা গোঁফের ডগা চেটে নিল, যাতে কফির ফোঁটা নষ্ট না হয়। 
—আচ্ছা বলত কোন সাহসে হিকোমা স্বপনের চাকরী বাঁচাতে আমাদের পে কাট করতে চায়? কেন? আমরা তো সরকার নই, সংসদও নই, এন জিও নই, গরিবদের দুঃখ নিয়ে ভাবতে হবে কেন? দেশের সব এম এলে এম পি, মন্ত্রী এরা তো কেউ ত্যাগ করে না, শুধু আমাদের মত সাধারণ দেশবাসীকে ত্যাগের ডাক দেয়, রক্ত দিতে বলে। আমার মাইনে থেকে ত্যাগ করতেও আমি রাজী নই। 
—যাই বলো, এটা কিন্তু নৈতিকভাবে ঠিক নয়, পৃথা নীরবতা ভেঙে বলল।
 —ঠিক নয় কী? ব্যবসা আর যুদ্ধে সব ঠিক, চন্দন বলল। 
-ওটা হবে প্রেম আর যুদ্ধে সব ঠিক, সুমন কারেকশান করে, 
-হ্যাঁ হিকোমা আমাদের প্রেমে ডগমগ একেবারে। চন্দন বড়বাবু, কারেকশান করা পছন্দ নয়। ওর ভ্রু কুঁচকালো। 
—স্বপনের ফ্যামিলির কথা ভাবো একবার? যাদব তো অবসর নেবে, গ্রামে জমি আছে, । স্বপনের কিছুই নেই,  কীভাবে চলবে? কী খাবে? পৃথার বিবেক দংশন বন্ধ হয় না, সে  আবার অনুরোধ করে।
 —কিন্তু আমরা কী করতে পারি? তোমার মাতৃসুলভ অনুভূতি বাস্তব জগতে কোনো কাজে আসে না, পৃথাদি, 
এবার সুমনের পালা, এসব কচকচি ওর ভালো লাগে না। চাকরি আসে, চাকরি যায়, মানুষ বাঁচে, মানুষ মরে, কেউ কিছু করতে পারে না। এঞ্জয় এঞ্জয়, ওর মাথার মধ্যে এই কথা সব সময় গুঞ্জন করে চলে। 
—ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমরা কি কিছুই করতে পারি না? 
পৃথা রেড ভেলভেটের ছোট টুকরো ছোট্ট চামচে দিয়ে ভেঙ্গে তোলে। সত্যিই লাল আর সুন্দর, তার লাল নখের সঙ্গে মিলে গেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে পড়ে গেল, অনেকদিন একটা ভালো পারফিউম কেনা হয় নি, আমি কি বুড়ী হয়ে যাচ্ছি? 
ওঠার সময় এলো। পুরো কফি হাউসটা কি অপূর্ব সাজানো।  পৃথার মনে পড়ল, যখনই কাউকে উপহার বা ফুলের তোড়া বানাতে হত, স্বপনকে বললেই সব সুন্দর করে রঙ্গীন ফিতা দিয়ে মোড়ক বানিয়ে দিত। ক্রিসমাসে সাজাত পুরো অফিস, কারো জন্মদিন হলে সাজাতো হ্যাপী বার্থডে লেখা, সাজাতো বেলুন দিয়ে, কেক কাটার ছবি তুলে সবাইকে ফরোয়ার্ড করত। 
—টিপস রেখে যাবো? পৃথার প্রশ্ন।
—এখানে আমাদের মাইনে কাটতে বলা হচ্ছে, আর তুমি আবার দান করতে চাও? না, চল। 
সুমন কাপ আর প্লেট পরিষ্কার করে শেষ করল। একটু কেকের টুকরো, এক ফোঁটা কফিও বাকি রাখল না। 
আলোচনা শেষ।

পৃথা অটো স্ট্যান্ড খুঁজতে গেল। সুমন   চন্দনকে নিচু গলায় বলল, পৃথাদির বলছে যখন  আমরা সবাই ২% করে কাটব, তাহলে আমি রাজি। 
—কিন্তু এতে স্বপনের মাইনে হবে না, চন্দন বলল। 
 অটোতে উঠে স্টারট দেবার পরে সুমন হিসেব দিল, অটো চলতে চলতে। 
—চন্দন আর আমি ৫ হাজার করে দেব। পৃথাদির মাইনে আমাদের চেয়ে বেশি। ও দেবে ১০ হাজার। খুব কঠিন, কিন্তু ম্যানেজ করতে হবে। এতে হবে না।
—আমি কীভাবে ১০ হাজার দেব? কিছুদিন আগে মেয়ের জন্য এসি কিনেছি, না হলে পড়াশোনা করতেই পারে না। ওকে শক্ত শক্ত এ আই এর কোডিং করতে হয়, পুরনো এসিতে ঘর ঠান্ডাই হত না। এখন আমি কীভাবে ১০ হাজার দেব? এটা অসম্ভব, পৃথা জোর দিয়ে বলল।

কলকাতার অটোচালক নিউইয়র্কের ক্যাবিদের মত  প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে বক বক করে না, তারপর  কলকাতার ট্রাফিকের মধ্যে গাড়ি চালাতে গেলে অন্যদিকে মন দেওয়াও মুশকিল। তবুও হঠাৎ সে বলে বসল 
 —আপনাদের অফিসেও ছাঁটাই হচ্ছে? আপনারা তো মনে হয় আইটি লাইন। দিনকাল খুব খারাপ; কোনো পেশা কি নিরাপদ নেই? 
অটোচালক মনে লো ক্লাসের লোক হিসেবেই ধরা হয় শিক্ষিত মহলে, তার এমন  অপ্রত্যাশিত মন্তব্য ওদের মাথার ওপর এক চাঁই পাথরের মতো এসে পড়ল। তিনজনেই চুপ।

অটো থেকে নেমে লিফটে উঠতে উঠতে, সুমন বলল,
 —এত গোলমাল আমার ভাল লাগে না, আমি ঠিক করলাম আমরা পেকাট করব না। স্বপনকে যেতে দাও, আমার কী? আমি প্রতিদিন বাড়ি থেকে কাজ করব। 
পৃথা, চন্দন দুজনেই কোন সাড়া দিল না। 

চন্দন অফিসে আলমারি খুলল, ফাইলের পর ফাইল বন্দী  আয় ব্যয়ের হিসেব। আর এক খোপে মাসিক জি এস টির  রিটার্নের ফাইল আছে, সরকার প্রতি মাসে খবর রাখে। চন্দনের মনেীক্টা অশ্লীল ভাবনা উঠেই আবার লুকিয়ে পড়ে। এগুলো অ্যাকাউন্ট্যান্টকে পাঠাবে, রাত ৮টা বাজবে। তারপর বাড়ি ফেরার দীর্ঘ যাত্রা, রাত ১২টায় পৌঁছাবে। তার মা জেগে থাকবে, কাঁপা গলায় ডাকবে, “খোকা, ফিরে এসেছো? খাওয়া দাও।” স্বপনের কি হবে কে জানে?
পৃথার বাড়ি থেকে ফোন এল, 
“পরীক্ষা দিতে পারিনি”, ঋদ্ধিমার ফোন। 
—কেন? পড়ার সময় পাওনি, না অসুস্থ? 
—এমনিই। তুমি বাড়ি এসো। পনির কারি রান্না করো। রাঁধুনি বিচ্ছিরি চিকেন রান্না করেছে, সব ফেলে দিয়েছি। 
—এখন কীভাবে যাব রি? জানো তো, অফিসে বড় ঝামেলা চলছে। বিশ্রাম নাও। অনলাইনে কিছু অর্ডার করি। সন্ধ্যায় দেখা হবে। 
প্রিথা ভাবল, “সব সমস্যাই আমার জন্য?”
তারপর স্বপনকে ফোন করল। কোনোভাবে ওর চাকরি বাঁচাতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?

-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. যে করেই হোক ... বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

    ReplyDelete