জ্বলদর্চি

মোহিনীমোহন মণ্ডল (স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট নেতা, দাসপুর)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৮৫
মোহিনীমোহন মণ্ডল (স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট নেতা, দাসপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

দাসপুরের ব্রাহ্মণবসান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কমিউনিস্ট নেতা মোহিনীমোহন মণ্ডল। পিতা কৃত্তিবাস ছিলেন এলাকার বর্ধিষ্ণু জমিদার। দীর্ঘসময় ঘাটাল পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন (১৯০৩-২৫) তিনি। তাঁরই তৃতীয় সন্তান মোহিনীমোহন। 

কৃত্তিবাসের বড়পুত্র ললিতমোহন মণ্ডল ছিলেন ৩ নং ইউনিয়ন বোর্ডের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। আর মধ্যমপুত্র কিশোরীমোহন মণ্ডল ছিলেন গান্ধীবাদী নেতা। তাঁর কাজের জন্য তাঁকে বলা হত 'দাসপুরের গান্ধী' নামে। আর ছোটপুত্র মনমোহন মণ্ডল ছিলেন স্বনামধন্য শিল্পী। ফলে পারিবারিক সূত্রেই মোহিনীমোহন মণ্ডলের রক্তে ছিল স্বদেশপ্রেমের বীজ। তা তিনি সঞ্চারিত করেন নিজের জীবনের পরতে পরতে। শেষদিন পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন দেশের প্রতি তাঁর অনুরক্ততা। 

সোনাখালি হাইস্কুলে ছাত্র থাকাকালীন লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেন। এই অপরাধে তাঁকে ছয়মাস কারাবরণ করতে হয়। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে রাখা হয়। মোহিনীমোহন মণ্ডল মেদিনীপুর কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। ১৯২১ সালে জেলায় অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলাতেও তাঁর নাম ছিল অভিযুক্তদের তালিকায়। 

১৯৩৪ সালে BCLA ধারায় অভিযুক্ত হয়ে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে চার মাস এবং বক্সার ক্যাম্পে তিন মাস বন্দী ছিলেন। ১৯৩৪ এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল বহরমপুর ক্যাম্পে। এই ক্যাম্প থেকে ১৯৩৭ এর ৮ ই জুলাই তাঁকে পাঠানো হয় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামে। সেখানে তিনি নজরবন্দী ছিলেন কিছুদিন। সেখান থেকে বছরের শেষের দিকে অবশেষে মুক্তি পান। শুরু করেন কমিউনিস্ট আন্দোলন। 

আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে ফিরে আসা বন্দীদের মধ্যে কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের (১৯৩৫) মাধ্যমে তিনি মার্কসবাদের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর ওপর কড়া নজরদারি থাকতো পুলিশের। কিন্তু তিনি তাঁদের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে নিবিড়ভাবে দেশের কাজ করতে থাকেন। কমিউনিস্ট পার্টির ভাবধারায় প্রচার চালাতে থাকেন। 

স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সাথে ১৯৩৮ সালে মেদিনীপুর জেলায় সারা ভারত কিষাণ সভার সূচনা ঘটে। মোহিনীমোহন মণ্ডল এই সংগঠনের অন্যতম নেতৃত্ব হিসেবে জেলার কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় কৃষি আন্দোলনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে ব্রতী হন। কিন্তু এতদ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। তখন গ্রাম সমিতি গঠন করে নিচুস্তর থেকে জোরদার সংগঠন গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়। ১৯৪১ সালে কলোড়াতে পার্টি অফিসও খোলা হয় তাঁর ও মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে। তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। 

অবশেষে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৪২ সালে। মেদিনীপুর জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির সূচনাপর্বের অন্যতম শহীদ ছিলেন তিনি।  এরপর কংসাবতী নদীর পূর্বপাড়ে পার্বতীপুরে জনৈক বাঁশরী সানকীর বাঁশবনে তাঁর লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপনে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। এই মানুষটি যথার্থই ছিলেন মেদিনীপুরের রত্ন। কিন্তু আমরা অনেকেই তাঁর কার্যক্রম সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নয় আজ।

🍂

Post a Comment

0 Comments