সৌমেন রায়
অচিন্ত্যবাবুর সন্তান বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় আছে গবেষণার কাজে। বৎসরান্তে একবার আসে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রথম যে কথাটা বলে তা হল, ‘দুটো জায়গার বাতাসের তফাৎ যন্ত্র ছাড়াই বোঝা যাচ্ছে’। অচিন্ত্যবাবু এমনিতে দুশ্চিন্তা করেন কম। কিন্তু এই কথায় তারও চিন্তা বেড়ে যায়। শেষমেশ বাতাসের অজুহাতে বিদেশে থেকে যাবে নাকি? ঘটনা দুই - সুধাময়বাবুর ছোট বাচ্চা। সারা বছর ধরেই ঠান্ডা লেগে থাকে। বছরে বাহান্নবার ডাক্তারের কাছে দৌড়ান। ডাক্তার ইনহেলার লিখে দেন। তিনি বলেছেন বাতাসের যা অবস্থা ইনহেলার ছাড়া গতি নেই। সাময়িক উপশম হলেও সুধাময়বাবুর ছেলের রোগ নিরাময় আর হয় না। তিনি সারাক্ষণ বিষন্ন থাকেন। অফিসের কাজে মন বসে না। মন দিয়ে কাজ করতে পারেন না বলে আরেক দফা মন খারাপ হয়। দুটি ঘটনাই একই সূত্রে বাঁধা – সূত্রটি শ্বাসবায়ুর গুণমান।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) বাতাসের গুণমান সংক্রান্ত একটি পরিমাপ। এটি বাতাসে উপস্থিত PM 2.5, PM 10 ( ধূলো, ধোঁয়ার কণার আকৃতি 2.5 মাইক্রোমিটার ও 10 মাইক্রোমিটার বা তার কম। একটি চুলের ব্যাসের মোটামুটি 30 ভাগ 2.5 মাইক্রোমিটার ) কার্বন মনোক্সাইড, ওজন, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এইরকম কিছু প্যারামিটার পরিমাপ করে একটি সহজবোধ্য সংখ্যায় প্রকাশ করে। এর থেকে বোঝা যায় বাতাসের গুণমান কেমন। অবশ্য AQI বাতাসের একমাত্র পরিমাপ নয়। এর কিছু ফাঁক ফোকর আছে। তবে একটা ধারণা অবশ্যই পাওয়া যায়। ভালোভাবে বসবাসযোগ্য AQI পরিমাপ 0 থেকে 50 , 200 পেরোলে POOR এবং 300 পেরিয়ে গেলে VERY POOR। যা বসবাসের পক্ষে, মানব স্বাস্থ্যের পক্ষে একদম গোলমেলে। লেখা তৈরি করার (16 ডিসেম্বর 2025) দিন ছোট শহর মেদিনীপুরের AQI ছিল 414!! দিল্লি 341, মুম্বাই 217, চেন্নাই 125, কলকাতা 240, নিউইয়র্ক 61, জুরিখ 57, লন্ডন 56, বেইজিং 105, ইসলামাবাদ 196 ঢাকা 222, সিঙ্গাপুর 36 । বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহরগুলির তালিকায় প্রথম 12 পর্যন্ত ভারতবর্ষের জয়জয়কার। প্রথম 35 এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশের বাইরে কেউ ঢুকতেই পারেনি। বুঝিয়ে বলার দরকার নেই পরিস্থিতি কি! বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর বেইজিং দশ বছর আগেও দিল্লির মতই দূষিত শহর ছিল। তারপর সরকারি উদ্যোগে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। কারখানাগুলি শহরের বাইরে পাঠানো হয়। জীবনযাত্রার ধরনের বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়।পরিবেশ সংক্রান্ত বাজেট কয়েকগুণ করা হয়। এখন শুধুমাত্র ছোট পার্টিকেল কমাতে পারলেই বেজিং বিশুদ্ধ শহরের তালিকায় ঢুকে পড়বে। দিল্লি কি কিছুই করেনি? কিছু উদ্যোগ নিয়েছে নিশ্চয়। তার ফলে দূষণের পরিমাণ আর উর্ধ্বমুখী নয়,সামান্য নিম্নগামী। কিন্তু যা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। বেশি কিছু করা যায়নি কেন? এত পলিউশনের কারণই বা কি? এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বড় বড় কাগজে। বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। সংক্ষেপে সমস্যাটা আমাদের মানসিকতায় আর গণতন্ত্রে। প্রতি ভোটে আমরা তাজা নররক্ত দিয়ে গণতন্ত্র মাইয়ার পূজা করে থাকি। তার ফলে আমরা বাক স্বাধীনতায় প্রবল ভাবে বিশ্বাস করি এবং আমাদের ‘পোতিবাদের’ একটা নেশা আছে। তাই যা হচ্ছে সেটা ভালো না মন্দ না ভেবেই আমরা পতিক্ষণে পোতিবাদ উৎসব পালন করি। একবার AC ‘র তাপমাত্রা 24 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট বেঁধে দেওয়ার কথা হয়েছিল। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে হৈচৈ করে থামিয়ে দিয়েছি। ফলে সরকারের বেশ সুবিধা হয়েছে। সম্পূর্ণ দূষন নিয়ন্ত্রণ করা বড্ড বৃহৎ কাজ। তার পরিবর্তে যমুনার জলে কেন ফেনা হচ্ছে সেটা না খুঁজে যাতে ফেনা দেখা না যায় তার জন্য কেমিক্যাল স্প্রে করে। দূষনের ডাটা যে যন্ত্র কালেকশন করে তার আশেপাশে জল স্প্রে করে , যাতে ভ্যালু কম আসে। দূষনের প্যারামিটারের পারমিসেবল ভ্যালু বাড়িয়ে প্রবল দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধ বাতাস বলে। সম্প্রতি জানা গেল কেন্দ্র আর সুপ্রিম কোর্ট মিলে আরাবল্লী পাহাড়ের সংজ্ঞা পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছে। সামান্য দূষিত বাতাসের মাপকাঠি পাল্টানো তো সামান্য কাগুজে কাজ।
বড় শহরের এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু মেদিনীপুরের মত ছোট শহর এত দূষিত কেন? চপ ছাড়া আর কোন শিল্প তো নেই! শুধু মেদিনীপুর তো নয় এরকম ছোট শহরগুলি প্রায় সবকটি দূষিত। ওই একই দিনে খড়্গপুরের AIQ কি ছিল 436, বাঁকুড়া 240। কয়েক বছর আগেও মেদিনীপুর শহরে নভেম্বর মাসের থেকে ঝকঝকে আকাশে তারামণ্ডল দেখা যেত। বিগত বছর দুই আকাশ সারাক্ষণ ঘোলাটে। কদাচিত পরিষ্কার থাকলেও উৎকট আলোক প্রদর্শনের জন্য প্রায় কোন নক্ষত্র মন্ডল দেখা যায় না। এইসব ছোট শহরে দূষিত গ্যাস কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এগুলির পরিমান অতীতের থেকে অনেকখানি বাড়লেও এখনও সহনসীমার অনেকখানি নিচেই আছে। এখানের মূল সমস্যা হল ধুলো এবং ধোঁয়া। মেদিনীপুরে ডাস্ট পার্টিকেল বড় শহরের দুই তিন গুণ বেশি। কোথা থেকে আসে এত ধুলো? শীতকালে এমনিতে ধুলোর পরিমাণ বাড়ে। আসে পাশের কৃষিক্ষেত্র থেকে কিছু ধুলো আসে।এছাড়া মেদিনীপুর এখন নির্মাণ স্থলের স্বর্গরাজ্য। শহরের আনাচে-কানাচে আইনি- বেআইনি নানা রকমের নির্মাণ অবিরত চলছে। শহরাঞ্চলের মধ্যে নির্মাণ চালাতে গেলে যে সমস্ত বিধি নিষেধ মেনে চলা উচিত তার কোনটাই প্রায় মেনে চলা হয় না। নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। গোটা শহরের ফুটপাথে গাছ প্রায় নেই। বস্তুত এমনভাবে ফুটপাথ দখল করা আছে গাছ লাগানোর জায়গাই নেই। অনাবৃত জায়গা থেকে ধূলো শীতের বাতাসে বেশি মেশে। গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তার ধোঁয়া খানিক যোগান বাড়ায়। খড়গপুর শিল্পাঞ্চলে (?) স্পঞ্জ আয়রন কারখানা এবং সিমেন্ট কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং ধুলো বাতাসে খানিকটা মেদিনীপুর শহরে এসে পড়ে। বাতাসে ধুলো - ধোঁয়ার পরিমাণ বেশি থাকলে কি হয়? সর্দি কাশি, চোখে জ্বালা, এলার্জি, বুকে চাপ, শ্বাস নিতে সমস্যা, সিওপিডি, শ্বাসযন্ত্র ইনফেকশন, লাং ক্যান্সার, হৃদ যন্ত্রের সমস্যা সহ আরো অনেক কিছু। উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থগুলির জন্য ক্ষতির কথা বাদই দিলাম। একদম লেখার শুরুতে দুটি ঘটনার সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। অচিন্ত্যবাবু নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ছেলের বলা কথাটা অজুহাত নয়।
এত সমস্যা সত্বেও আমাদের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই কেন? বিরোধী দলনেতা থেকে প্রশাসনিক প্রধান সবার মুখে গীতা পাঠ আর চিকেন প্যাটিস বিক্রির গল্প কেন? দূষণ কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা নয় কেন ? কেন এই ব্যাপারে সবাই নীরব? কারণ আমরা জনগণ ঐ গল্পগুলোই খেতে ভালবাসি। সারাক্ষণ চিবুতে ভালোবাসি। এগুলো নিয়ে মিম হয়, ফরওয়ার্ড হয়।AQI এর কথা বললে লোকে জিজ্ঞেস করবে সেটা খায় না মাথায় দেয়? না জানাটা অপরাধ নয়। সমস্যা হল জানার পর বলবে তুই তাহলে বেজিং চলে যা। তার চেয়ে বরং মেসিকে নিয়ে তামাশা, সে নিয়ে চাপান উতর অনেক ভালো। বলুন বাতাস শ্বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে, চলুন আন্দোলন করি। উপস্থিত লোক হাতে গোনা যাবে। ঐদিন সকলের বিশেষ কাজ থাকবে কিংবা আমাশা হবে। কেউ হয়ত কোন তৃতীয় অজুহাত খুঁজছেন না থাকাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে। তার প্রয়োজন নেই। এরকম ডাক কেউ দেবে না নিশ্চিত থাকুন। এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ভাবনাচিন্তার কোন প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায় না। ফাইলে ফাইলে উদ্যোগ সীতার মত বন্দী হয়ে আছে কিনা সেটা অবশ্যই জানার উপায় নেই। কেন্দ্রীয় সরকার কিভাবে দূষণ সমস্যার সমাধান করে আগে পড়েছেন। রাজ্য সরকার সমাধানের রাস্তায় না হাঁটলেও কি কি সমাধান করতে পারে সে বিষয়ে একটা ধারণা বিভিন্ন কাজকর্ম থেকে পাওয়া যায়। যেমন I LOVE FRESH AIR বলে গ্লো সাইনবোর্ড লাগাতে পারে। তার সামনে সেলফি তোলা যাবে। সপ্তাহে তিন ঘন্টা স্বাস্থ্য - ছুটি দিতে পারে। দূষণশ্রী প্রকল্পে প্রত্যেককে কিছু স্বাস্থ্য উদ্ধার ভাতা প্রদান করতে পারে। সরকার থেকে মিছিল বের করে বাতাস দূষিত কেন তার জবাব চাওয়া হতে পারে ( কার কাছে চাওয়া হয় জানা নেই), মঞ্চ বেঁধে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বাংলাদেশ থেকে কিভাবে চক্রান্ত করে ধূলো পশ্চিমবঙ্গে ঢোকানো হচ্ছে সে ব্যাপারে বক্তিমা করা হতে পারে।
এবার সকলে চিকেন প্যাটির পক্ষে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ুন। সম্মুখ সমর আসন্ন। আর নেহাত দল পছন্দে অপরাগ হলে দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখুন। কিন্তু সুধময়বাবুর কি হবে? আপনি বরং একটা এয়ার পিউরিফায়ার কিনে ফেলুন। ছেলে সুস্থ থাকবে, আর কোম্পানির শ্রীবৃদ্ধিও হবে। লাভ হলে তবে না তারা ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা ঢালবে।
2 Comments
লেখাটি পড়ে আপনার তারিফ করা আর আমার কিছু জ্ঞান বৃদ্ধি ছাড়া আর বোধহয় কিছু লাভ হবেনা ।
ReplyDeleteঠিকই বলেছেন।
ReplyDelete