সুরমার কালি
কমলিকা ভট্টাচার্য
নন্দিনীরা যেদিন নতুন বাড়িতে শিফট করল, সেদিন নন্দিনী খুব খুশি ছিল। খুশিটা শুধু নতুন বাড়ির জন্য নয়—এই চেন্নাইতে এসে প্রথম সে এমন একজন প্রতিবেশী পাবে, যারা হিন্দি বোঝে। নন্দিনী কথা বলতে ভীষণ ভালোবাসে, কিন্তু ইংরেজিতে কি আর মনের কথা বলা যায়? তাই মুখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে পেটের ভেতরটা যেন কেমন গুলিয়ে ওঠে।
নন্দিনীর সামনের বাড়ির ওরা অনেকদিন বম্বেতে ছিল। ওদের বাড়ির নতুন ছোট বউটি ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে—নাম জেসমিন, বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি নয়। সব সময় মেয়েটির মুখে হাসি লেগে থাকে। ওর উপস্থিতিতে নন্দিনী যেন সদ্য ফোটা জেসমিন ফুলের গন্ধ পায়। ইতিমধ্যেই নন্দিনীর সঙ্গে জেসমিনের এক আলাদা রকমের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে—যদিও জেসমিন তাকে ‘আন্টি’ বলেই ডাকে।
জেসমিন প্রায়ই নন্দিনীকে চা বানিয়ে খাওয়ায়। নন্দিনীও কিছু নতুন বানালে জেসমিনকে দেয়। দুই প্রতিবেশী পরিবারের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক কিছুদিনের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল। জেসমিন যেদিন প্রথম জানতে পারল সে মা হতে চলেছে, সেদিন সে ছুটে প্রথম নন্দিনীর কাছেই এসেছিল। জেসমিন কানে কানে বলেছিল, “আন্টি, আপকো এক খবর দেনা থা।” নন্দিনী ওর গাল টিপে বলল, “মার কাছে কি এই খবর লুকানো থাকে?” তখন জেসমিন বলেছিল, “আন্টি, আপ বেঙ্গলি মে ক্যা ক্যা বলতে হো, মুঝে কুছ সমঝ নেহি আতা।”
জেসমিনকে নন্দিনী নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করত। জেসমিনও নন্দিনীকে নিজের মায়ের মতো, আর নন্দিনীর ছেলেদের ভাইয়ের মতো ভালোবাসত। এরপর নন্দিনী রোজই নতুন কিছু বানিয়ে জেসমিনকে খাওয়াত, কারণ ওদের পরিবারে নিরামিষ রান্না হতো না—সব সময় নন-ভেজ খেতে জেসমিনের ভালো লাগত না।
🍂
প্রায়ই জেসমিনের বর আমিন কাজের সূত্রে বাইরে থাকত। জেসমিনের কোনদিন শরীর খারাপ হলে নন্দিনী বা নন্দিনীর বড় ছেলে ওকে গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যেত। এইরকম করে কয়েক মাস কেটে গেল। তবে তাদের পরিবারে প্রায়ই অশান্তি লেগেই থাকত।
জেসমিনের শাশুড়ি ফারিদা একদিন নন্দিনীকে বলেছিল, ওদের বড় ছেলে রিয়াদে থাকে; ছ’ বছর বিয়ে হয়ে গেছে, এখনো কোনো বাচ্চা নেই। তাই নিয়ে সংসারে নানা অশান্তি লেগে থাকে। এখন জেসমিনের প্রেগনেন্সির খবরে সেই অশান্তি আরও বেড়েছে। বড় ছেলে তার বউ সারিনকে তালাক দিতে চায়। সারিনও বড় ভালো মেয়ে—কদিন আগে ডাক্তার দেখাতে এসেছিল। ডাক্তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়েছিল সারিনের কোনো সমস্যা নেই মা হতে।
জেসমিনের তখন সাত মাস চলছে। নন্দিনী একদিন দেখল সারিন এসেছে একা—সঙ্গে তার হাজব্যান্ড আসেনি। সারিন জানিয়ে ছিল, সে কিছুদিন ইন্ডিয়াতে থাকবে, আরও কিছু ডাক্তার দেখাবে।
তখন নভেম্বর মাস চলছে। বছরের এই সময় চেন্নাইতে ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ লেগেই থাকে। সেদিন এরকমই একটি ঘূর্ণিঝড় আসার আশঙ্কা বারবার বলা হচ্ছিল—যে ঝড় নন্দিনীদের এলাকার ওপর দিয়েই বয়ে যাওয়ার কথা।
নন্দিনীদের ফ্ল্যাট বাড়িটি সমুদ্র থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে, তাই একটা রিস্ক ছিলই। ফ্ল্যাটের অনেকেই বাড়ি ছেড়ে শহরের অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। প্র্যাকটিকালি দু-চারটি পরিবার ছাড়া সেদিন আর কেউ ছিল না।
নন্দিনী আর জেসমিন ঠিক করেছিল, ঝড় আসার আগে ছাদে যাবে—ছাদ থেকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখতে খুব ভালো লাগে। আগের রাত থেকেই অল্প অল্প ঝড়, বৃষ্টি, হাওয়া শুরু হয়েছিল। আর কয়েক ঘণ্টার ভেতরে ল্যান্ডফল হওয়ার কথা।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে জেসমিনকে ডাকবে বলে নন্দিনী যখন দরজা খুলল, তখন দেখল ফারিদা দিদি অত ঝড়ের মধ্যে সিটিতে যাচ্ছে। আর আমিন ও সারিন ছাদ থেকে নেমে ফ্ল্যাটে ঢুকছে। নন্দিনী জেসমিনের কথা জিজ্ঞেস করার আগেই তারা দরজা বন্ধ করে দিল।
নন্দিনীর একটু অবাক লাগল। মনে মনে ভাবল, জেসমিনের শরীর কদিন ভালো নেই—তাই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে উপরে নিয়ে গিয়ে ডিস্টার্ব করাটা ঠিক হবে না। তাই সে একলাই ছাদে গেল।
প্রকাশিতব্য
ছাদে গিয়ে নন্দিনী দেখল, জেসমিন ছাদের পাঁচিল ধরে দাঁড়িয়ে, জোরে জোরে কাঁদছে। হাওয়ায় ওর বোরখাটা উড়ে যাচ্ছে। নন্দিনী ছুটে গেল ওর দিকে। জেসমিন পিছন ফিরে তাকে দেখে জাপটে জড়িয়ে ধরল।
জেসমিনের শরীর থরথর করে কাঁপছিল। নন্দিনী আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি হয়েছে?”
জেসমিন একভাবে নন্দিনীর কাঁধে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগল। ততক্ষণে ঝড়ের ল্যান্ডফল হয়ে গেছে—প্রবল গতিতে হাওয়া বইছে, মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। দুইজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে।
জেসমিনের ঠোঁট কাঁপছিল কিছু বলার জন্য, কিন্তু গলা রুদ্ধ। তাদের দুজনের চোখের ধারা সেদিন বৃষ্টির ধারাকেও হার মানিয়েছিল। জেসমিনের সুন্দর সাদা নরম গাল বেয়ে সুরমার কালো জল গড়িয়ে পড়ছিল।
ঠিক সেদিন থেকে দু’মাস পর জেসমিন একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। আর তার আরও ঠিক সাত মাস পর সারিনও একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়।
0 Comments