জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন /পর্ব ৭/বাসুদেব গুপ্ত

কুয়াশা যখন  
পর্ব ৭
বাসুদেব গুপ্ত 

সাপ নড়ে বৃষ্টি পড়ে

অক্টোবরের শেষ, কিন্তু সারা রাত ধরে কাল বৃষ্টি হয়েছে। শহরের মহাপুজো শেষ, রাস্তা ভরে রয়েছে লক্ষ লক্ষ দর্শন যাত্রীর ফেলে যাওয়া আবর্জনা। প্যান্ডেলের কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে আছে উৎসবের কঙ্কালের মত। স্বপন গতরাতে একটু বেশিই টেনেছিল, চোখে তখনও অ্যাসিট্যালডিহাইডের হ্যাং ওভার। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছিল, হাত থেকে ফস্কে যাওয়া  এক স্বপ্নের ভবিষ্যৎ।  এক ভবিষ্যৎ, যা চিরকাল তার স্বপ্নেই থেকে যাবে।
স্বপ্নে সে চলে গেছে এক ঝলমলে আলোয় ভরা মলে।  আজ অফিস থেকে অনেক বোনাস পেয়েছে, অনেক কেনাকাটা হবে, হবে চুটিয়ে খাওয়া। সিকিউরিটির লাইনে দাঁড়িয়ে স্বপন, তার বৌ ঊষা, মেয়ে রেশমি, ছেলে প্রীতম, আর নাতনি আয়েশা। গোঁফওয়ালা নিরাপত্তারক্ষী সবার শরীরের চারদিকে একটা  গোল রড ঘুরিয়ে স্ক্যান করছে। আজ ঠিক হয়েছে সেই রেস্টুরেন্টে যাওয়া হবে, যেখানে যত খুশি খাওয়া যায়। ঊষার ইচ্ছে আজ অনেক বিরিয়ানি খাবে। লাইনে দাঁড়িয়ে রেশমি ঠেলা দিল প্রীতমকে, “আমি শুধু প্রন কাবাব খাব, দারুণ আর জুসি! আহ, ফ্যান্টাস্টিক, লাজবাব!” প্রীতম আবার এতে রাজি নয়, সে শুধু চায় চিকেন টেংরি কাবাব।
🍂

ঊষার খাওয়াতে মন নেই, ও  তাকিয়ে আছে গোলাপি-সোনালী আলোয় ঝলমলে শাড়ি মিউজিয়ামের জানালায়।
সিকিউরিটি একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“পকেটটা একবার দেখি, কী লুকিয়ে রেখেছ পকেটে?” বলে গোল স্ক্যানার ঘুরিয়ে দিল শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যানারটা সাইরেনের মতো চিৎকার করতে লাগল। স্বপন তাড়াতাড়ি পকেট হাঁকড়াল, কোথায়, সেখানে তো  কিছুই নেই। ফোন নেই, মানিব্যাগ নেই, পকেট ফাঁকা, আর পকেটের নীচে একটা বিরাট গর্ত। এদিকে সিকিউরিটি স্ক্যানার ঘুরিয়েই যাচ্ছে, আর সাইরেন বেজেই যাচ্ছে। 

স্বপন ঘুম থেকে উঠে পড়ল আয়েশার  চিল চিৎকারে।

চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার। একটা সাপ বৃষ্টির তোড়ের হাত থেকে বাঁচতে ঢুকে পড়েছে স্বপনের জবর দখল করা ডেরায়। কর্পোরেশনের পড়ে থাকা জমিতে। জমি রাস্তার লেভেলের নিচে। বৃষ্টিতে ভেসে গেলে  রাস্তার সব   কাদা-আবর্জনা, ভেসে যাওয়া শালপাতা, রোল ওলার ফেলে দেওয়া কেচাপের বোতল, লেকের ধারে ঝোপে পড়ে থাকা ব্যবহৃত কন্ডোম, সব বাড়িতে ঢুকে পড়ে। টিভিটা নড়বড়ে পায়ে  পুরনো ফ্রিজের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। ফ্রিজে কয়েকটা বিয়ারের বোতল আর আধখাওয়া ভাত-সবজি।
সাপটা আয়েশার কাছে গেল, কচিটি তখনও ঘুমিয়ে, পেট ব্যথার ওষুধে গভীর ঘুমে। সাপটা ওর গায়ে গিয়ে ঠেকল, হয়তো একটু মানবিক উষ্ণতার জন্য। আয়েশা নড়ল না, সাপটা এদিক ওদিক কিলবিল করে ঘুরল, ঘুরতে ঘুরতে আয়েষার খেলার পুরনো মোবাইলটা ছুঁয়ে দিল। মোবাইলটা একটা খেলনা গাড়ির ওপর বসে ছিল, সেখান থেকে পড়ল খটাস করে। আর পড়ে গিয়ে তাতে  এক চেনা ঘুমপাড়ানি গান বাজতে লাগল—“সূরময়ি আঁখিয়োঁ মে…” 
ঘুম্পাড়ানি গান শুনে সবাই জেগে উঠল, চেয়ে দেখল সাপটা মোবাইলের ওপর বসে গান শুনছে। আয়েশা ঘুম ভেঙ্গে কিছু না জেনেই চিৎকার করে উঠল। স্বপের স্বপ্ন গেল টুটে। তাড়াতাড়ি মোবাইল খুঁজে টর্চ জ্বালাতেই দেখল সাপটা চুপচাপ গান শুনছে।

গান শেষ হলে সাপটা যেমন এসেছিল, তেমনিই শান্তভাবে চলে গেল। এই বৃষ্টি ভরা রাতে তারো ঘুম এসে গেল কিনা কে জানে।  ঊষা তাড়াতাড়ি আয়েশাকে কোলে নিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দিল। স্বপন শুনতে পেল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মনে পড়ল, নতুন অফিস ক্লিনিং সার্ভিসের জন্য কেনা জিনিসগুলো সব বাইরে পড়ে আছে।

চারটে ঝাড়ু, OLX থেকে কেনা সেকেন্ড-হ্যান্ড ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ক্লিনিং লিকুইড আর নানা  সাইজের গব্রাশ—সব বৃষ্টিতে ভিজেছে এতক্ষণ কিন্তু কিছুই ক্ষতি হয় নি। শুধু ফ্লোর ক্লিনারের ছিপিটা খুলে সবটা পড়ে গেছে। বৃষ্টির স্রোতে মিশে মিশে সারা গলি পরিষ্কার করছে, স্বপনের ভেবে একটু হাসি এল।
সোমবারেই স্বপন চন্দনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল,  অফিস ক্লিনিংয়ের কাজটা যদি ওকে দেয়। অন্তত একবার। ট্রায়াল । চন্দন অনেক তানানা করল। বলল, খুব ঝামেলা চলছে, চা কফি নেই, সবার মাথা গরম। আর অফিস বাথরুম সব নোংরা কিন্তু হিকোমা কি বলবে কে জানে। 

অনেক অনুরোধের পর চন্দন রাজি হল। কিন্তু হিকোমা বলেছে ও খালি কোম্পানিকেই অর্ডার দেবে, কোন লোককেন্য। তুই একটা খোল, প্রোপ্রাইটারশিপ কোম্পানি তারপর আসিস।   চন্দন ভেবেছিল, স্বপন এসব পারবে না, কোম্পানীও হবে না, ঝামেলা যত। কিন্তু স্বপন ছাড়ার পাত্র নয়। আর ওর দুই দশকের ক্যারিয়ারে কম্পানীর কাজে ঘুরে ঘুরে সত্যিই অনেক অদ্ভুত বন্ধু হয়েছে।
স্বপনের সত্যিই এক আইনজীবী বন্ধু আছে—আলতাফ। সে তার পুরনো বন্ধু ও মেন্টর আসরাফের ছেলে। আসরাফ ছিলেন মানবাধিকার সংগঠনের পরিচিত মুখ, ‘লইয়ার্স ফর জাস্টিস’ ফোরামের সেক্রেটারি। আদিবাসী ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে মামলা করতেন। কিন্তু একদিন খনি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা লড়তে গিয়ে খুন হয়ে যান। কেউ কেউ বলে এঙ্কাউন্টার, খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, আদিবাসী উগ্রপন্থীরা নাকি সন্দেহ করে খুন করে। আশরাফ কলকাতায় এলেই  স্বপন ওর বাড়িতে যেত, ছোটখাটো কাজ করে দিত। এত ভাল ব্যবহার, ওকে ডাকত দোস্ত  বলে। ওরকম লোক কি আর হবে!

আলতাফ বিশ বছর আগে  ছিল ছোট্ট একটা ছেলে, গড় গড় করে ইংরিজি ছড়া শোনাত স্বপনকে আর স্বপন কিচ্ছু বুঝত না। সেও  এখন রীতিমত একজন উকিল। স্বপনকে তার এখনো খুব পছন্দ। স্বপন তাকে ফোন করতেই বলল, স্বপনের নামে প্রোপ্রাইটরশিপ কোম্পানি খুলে দেবে। স্বপন শুধু সই করলেই হবে, বাকি কাগজপত্র আলতাফ করবে। কোম্পানির একটা নামও বলে দিল ‘চকমক, দ্য অফিস ক্লিনার্স’। কয়েকদিন লাগবে, পনেরো দিনের মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স হবে।
এটা হয়ে গেলেই স্বপনের একটা রীতিমত কোম্পানি। তখন চন্দন আর কোন আপত্তি করবে না নিশ্চয়। হ্যাঁ বা না বলার কথা ছিল আজ। আজ চন্দনের ফোন আসার কথা ছিল।
কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরল না। ফোন এল না, বা এলেও স্বপনের কাছে পৌঁছাল না। রাস্তা কাদায় ভরা, সব দোকান বন্ধ। কাছেই দুজন মারা গেছে, ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক তারে হাত দিয়ে। স্বপনের ব্যবসা আজ শুরু হল না। আর গ্রীন ওয়ারের অর্ডার না এলে ও কিসের ভ্রসায় অন্য কোথাও যাবে। সবাই বলবে, রেফারেন্স দেখি, আগে কি করেছ। এবার কী?
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

2 Comments