কুয়াশা যখন পর্ব ৪
বাসুদেব গুপ্ত
হিকোমার হিকারি
হিকোমার মাথায় নানা চিন্তার হিকারি বা আলো জ্বলছে নিভছে। হিকোমা জানে জাপানে বসে চাপটা ম্যানেজ করতে পারবে না, কোম্পানির কাটাছেঁড়ার চাপটা চাপিয়ে দিতে হবে লোকাল লোকদের। অমর, স্বঘোষিত টেকনো-উইজার্ড, পরদিন সকালে মেসেজ পেল, আর পেল পৃথা আর সুমন। “তোমাদের কোম্পানির রি-অরগ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে, কাল সকাল ১০টায় মিটিং। ডোণ্ট মিস ইট।”
অমর যথা রীতি বাড়িতে সোফায় পা তুলে দিয়ে, প্লে স্টেশন নিয়ে ব্যস্ত। সদ্য বিয়ে করেছে, কিন্তু শহর তলীর মেয়ে, এখানে ফাঁকা ফ্ল্যাটে একা থাকলে তার আবার ডিপ্রেসন হয়। এই ভাল অমর ইচ্ছেমতো কোডিং করে আর গেম খেলে আর অনলাইনে খাবার অর্ডার দেয়। উইকেন্ডে ট্রেন চেপে যায় নিজের শহরে, সেখানে বৌ আছে। কোন অসুবিধে হয় না।
সুমন ব্যস্ত ইনস্টাগ্রামে ফার্নিচার মেকারের প্রেজেন্টেশন নিয়ে। এই সপ্তাহেই ডেলিভারী, শেষ করতেই হবে । এটা তার সাইড বিজনেস, অফিসের মাইনেকে বিট করে দেয়। তবু চাকরি মানে মাসে নির্দিষ্ট টাকা, আরামদায়ক অফিস, পেটভরা লাঞ্চ। অফিসের কাজ গুরুত্ব দিয়ে করে , শুধু যেদিন বাড়ি থেকে ইনস্টাগ্রাম শেষ করতে হয়, সেদিন বাদে।
পৃথা মেসেজ পেল, তখন শেয়ার্ড ট্যাক্সি করে অফিস যাচ্ছিল। সকাল সকাল রান্না করে মেয়ে ঋদ্ধিমাকে কলেজে পাঠিয়েছে। ঋদ্ধিমা আবার মন খারাপ, পৃথাকে অনেকক্ষণ বোঝাতে হয়েছে, বেশিরভাগই শোনেনি, বিরক্ত হয়ে গেছে, শেষে ঠিক করেছে, কলেজ যাওয়াই ভালো, এই বুড়ি মার কথা অল জাংক। ও চায় খানিকটা rizz, এই 6-7 জীবন ওর ভাল লাগে না। পৃথা ওর জেন জি মার্কা কথা বুঝতে পারে না। এদিকে মিটিং এর জন্য সময়মতো অফিস পৌঁছাতে পারবে না, উল্টোডাঙ্গা মোড়ে গাড়ির লম্বা লাইন। সে ফোন বের করে, মিটিং সফটওয়্যারে লগইন করে। পাশে আরেকজন মহিলা, সম্ভবত এইচআর ম্যানেজার, সেও কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছে—সম্ভবত কোনো ক্ষুব্ধ কর্মী, যাকে ছাঁটাইয়ের আগে ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি, সে মামলা করার হুমকি দিচ্ছে। এসব আবার শুরু হবে না তো, পৃথা ভেবে একটু শিউরে ওঠে।
🍂
মিটিঙ্গে হিকোমা সোজাসাপটা জানিয়ে দিল, পাঁচজনকে ছাঁটাই করতে হবে। কোনো প্রশ্ন নয়। অমর চুপ, সুমন বলল, অন্তত স্বপনকে রাখা দরকার। ও ছাড়া অফিস চলবে না।
—ঠিক আছে, দেখি ও কী কী করে, হিকোমা তার জাপানি নিখুঁততায় বিশ্লেষণ শুরু করলেন।
—চা-কফি বানায়? তোমরা মাইক্রোওয়েভে নিজেরা চা-কফি বানাতে পারো না?
—ও অফিসের দরজা খোলে।
—সহজ, তোমরা তিনজনের কাছে চাবি থাকবে, যে আগে আসবে সে খুলবে, যে পরে যাবে সে বন্ধ করবে।
—ও ঘর ঝাড়ু দেয়, টয়লেট পরিষ্কার করে।
—এটাই জাপানিদের থেকে শেখার বিষয়। কেন এমন নোংরা করবে যাতে অন্যকে পরিষ্কার করতে হয়? সবাই মিলে পরিষ্কার রাখবে, টয়লেটও। অকর্মণ্য লোকেরা শুধু টাকা নিচ্ছে। তোমরা কত পরিশ্রম করো ডেভেলপমেন্টে, এদের বাদ দিলে আরও বেশি আয় করতে পারো ভেবে দেখেছ? আমি তো শকড। ড্রাইভার বুড়োটা ইঞ্জিনিয়ারের চেয়েও বেশি বেতন পায়, এটা কীভাবে সম্ভব? এটা কি কমিউনিস্ট অফিস নাকি?
পৃথা চুপ। এদিকে গাড়ী চলছে, অন্য লোক রয়েছে, সেখানে কিছু বলে আবার হিকোমার কাছে ঝাড় না খায়। চুপ করে থাকাই ভাল।
সুমন তাও বোঝানোর চেষ্টা করল,
ড্রাইভার ২৫ বছর ধরে কাজ করছে, তাই বেতন বেড়েছে। আর ইঞ্জিনিয়ার নতুন, কয়েক মাস হলো যোগ দিয়েছে।”
—এইসব বাজে কথা বন্ধ করো। উন্নত দেশে এমন হয় না। ওকে বাদ দাও। আউট। নো মোর ডিস্কাসান।
পৃথা দেখল হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে সব। সাহস করে ওও এবার বোঝানোর চেষ্টা করল,
- স্বপন স্টোর ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটার মেরামতও করে। আর স্বপনের বড় পরিবার, এখন হঠাৎ চাকরি গেলে ভীষণ বিপদে পড়বে। একটু কন্সিডার কি করা যায় না?
হিকোমা এবার স্পষ্ট বিরক্ত। বেড়ালের মত বাঁ হাত তুলে মিটিং শেষ করে বলল,
—বন্ধুরা, কোম্পানি কোনো দাতব্য সংস্থা নয়। ওরা কী করবে, সেটা সরকারের, সমাজের সমস্যা, কোম্পানির নয়। আর এত সহানুভূতি থাকলে, তোমাদের বেতন থেকে ওর বেতন দাও, আমি ঠিক আছি। আমি ওদের মাইনে বাদ দিয়েই বাজেট করব। ব্যাস। এটাই চূড়ান্ত।
পৃথা অফিসে পৌঁছেই স্বপনের একবারে সামনে। স্বপন কি জানত মিটিং হবে আজ? উন্মুখ হয়ে তাকাল ওর দিকে তারপর জিজ্ঞেস করল,
-কিছু খবর আছে ম্যাডাম? ওর গলাটা ঠান্ডা লেগে বা সারা রাত না ঘুমিয়ে বেশ ধরা ধরা।
পৃথা একেবারে না জানার ভান করল,
“আমি কী করে জানব কোনো খবর? চন্দন স্যারের কাছে জিজ্ঞেস করো, উনি তো এইচআর।”
ওদিকে হিকোমার আজ জাপানে এক মার্কেটিং এজেন্টের সঙ্গে মিটিং ছিল। ইন্টারভিউএর উদ্দেশ্য ছিল হিকোমাকে ডেটা প্রোটেকশন ও এনক্রিপশনের পথিকৃৎ হিসেবে তুলে ধরার কথা ছিল। ভারতীয় মিটিং শেষ করে হিকোমা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে, চুলে জেল দিয়ে, নিখুঁত পোশাক পরে বেরোল, আজ ইম্প্রেস করতেই হবে কোন ভাবে।
ঠিক তখনই ফোন এল—
—দুঃখিত হিকোমা সান, ইন্টারভিউ বাতিল হয়েছে।
এটা অস্বাভাবিক। জাপানে এরকম হয় না। হিকোমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—কেন? কেউ অসুস্থ?
না হিকোমা সান, আমাদের ডিরেক্টর ঠিক করেছেন, আপনার টেকনলজির বাজার ভাল না, আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস একটু ওল্ড ফ্যাশান্ড, বাজারে আর আকর্ষণীয় নয়। এখন এই আইএর যুগ। আপনার কোম্পানীর যদি কোনো এআই প্রোডাক্টের প্রেজেন্টেশন থাকে, তাহলে আগ্রহী। দুঃখিত। mōshiwake gozaimasen. We are very sorry.
হিকোমা বুঝলেন, সময় বদলাচ্ছে। তার ছেলে র্যু বেশিরভাগ সময় বাড়িতে বসে থাকে, কিছুতেই আগ্রহ নেই। গ্রীনওয়্যার কোম্পানিকে ভালো করতেই হবে। অন্তত ওদের মধ্যে অনেক এনার্জি আছে। সবে টেক ওভার করেছে, কিছুদিন সময় লাগবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
2 Comments
🙏
ReplyDelete👍
Delete