জ্বলদর্চি

গ্যালারি থেকে Arena - 3/ অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

গ্যালারি থেকে Arena 
 পর্ব - ৩

সাদা কালো ব্রিগেডের একটি জয় এবং জবাব

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায় 

সাদা কালো ব্রিগেডের একটি জয় এবং জবাব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবে দ্বিতীয় বছর। সাল ১৯৪০। পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়েছে হাহাকার, মৃত্যু মিছিল। ধীরে ধীরে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বজুড়েই।  সে বছর প্রখর গ্রীষ্মের সময়েও ভারতীয় ব্রিটিশ রাজধানী সিমলায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি যুদ্ধের কারণে। আগের বছর ডুরান্ড কাপ বাতিল হয়েছে সেই যুদ্ধের কারণেই। তাই সে বছর দিল্লিতে বসলো ডুরান্ড কাপের আসর।  ১৮৮৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ডুরান্ড কাপ ব্রিটিশদের ফরেন সেক্রেটারি ইন চার্জ মর্টিমার ডুয়ান্ডের নামে নামাঙ্কিত। এই মর্টিমার ডুয়ান্ড একবার অসুস্থ অবস্থা থেকে সিমলার পাহাড়ি অঞ্চলের আবহাওয়ার গুণে আরোগ্য লাভ করেন। এরপরেই উনি সুস্থ থাকার জন্য খেলাধূলার গুরুত্ব বুঝে একটি পুরস্কারের বন্দোবস্ত করে ফেলেন। শুরু হয়ে যায় ডুরান্ড কাপ। প্রথম থেকেই যদিও এই টুর্নামেন্ট শুধুমাত্র আর্মি টিমদের জন্যই খোলা ছিল। পরবর্তীতে বিপুল সাড়া পড়ার পরে অনান্য টিমদের জন্যও এই টুর্নামেন্ট খুলে দেওয়া হয়।

সিমলায় রাজধানী সরিয়ে না নিয়ে যেতে পারার কারণে ১৯৪০ সালে বাধ্য হয়েই দিল্লিতে আয়োজন করা হলো ডুরান্ড কাপের। সিমলার বাইরে সেই প্রথম ডুরান্ড কাপ আয়োজিত হলো। এই সময় দিল্লির জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। তাদের মধ্যে খেলাধূলা বিষয়ে প্রবল আগ্রহ তো ছিলই, একই সাথে এটাও গর্বের ছিল যে কোনো স্থানীয় ক্লাব ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে চ্যালঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার সাহস দেখাচ্ছে। সেবার তাই এই ডুরান্ড কাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল উল্লাস দেখা যাচ্ছিল।

মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব শুরু করলো অসাধারণ ভাবে। কলেজিয়ান্স স্পোর্টস ক্লাবকে ৫-০ গোলে উড়ি্যে দিল প্রথম ম্যাচে। রশিদ এবং সাবু ২টো করে গোল। রশিদ খান এর একটা। দ্বিতীয় ম্যাচে হুসারস ক্লাব কে হারালো ৩-০ গোলে সাবু, করিম এবং রশিদের গোলে। ২-৩-৫ ফর্মেশানে খেলা মহামেডান এর এই আগুনে রূপ বজায় থাকলো কো‍য়ার্টার এবং সেমিফাইনালেও। কোয়ার্টার ফাইনালে ইউনিয়ন ক্লাবকে হারালো ২-০ গোলে। সেমিফাইনালে শক্তিশালী ওয়েলস রেজিমেন্টকে ৩-১-এ মারলো। এই প্রথম টুর্নামেন্টে গোল খেল মহামেডান। আসলে মহামেডান ডিফেন্সে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল দুই ডিফেন্ডার। জুম্মা খান এবং বাচ্চি খান যাদের ট্যাকল সামলানোই ছিল খুব কঠিন। যদি বা তাদের পরাস্ত করা যায় তাহলে লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স, গোলকিপার হিসেবে উড়ন্ত বাজ পাখি হয়ে পাহারা দিচ্ছে উসমান জান, যার বল ধরা, অনুমান ক্ষমতা এবং সাহস ছিল অসামান্য। মাঝমাঠে নুর মহম্মদ (সিনিয়ার), নুর মহম্মদ (জুনিয়ার) এবং আব্বাস। ফরোয়ার্ড লাইন ছিল সোনায় মোড়া। রহিম, রফিম, হাফিজ রশিদ, সাবু আর মেহমুদ।
১২ই ডিসেম্বর, ১৯৪০। ডুরান্ড ফাইনাল। মহামেডানের প্রতিপক্ষ রয়েল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্ট। সেই সময়ে দিল্লির জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। দশ লাখের কাছাকছি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাও এত ভাল ছিল না। তবু দলে দলে মানুষ হেঁটে, সাইকেলে কিংবা বাসে গাদাগাদি করে এসে আরউইন অ্যাম্ফিথিয়েটার যেটি এখন মেজর ধ্যানচাঁদ ন্যাশনাল স্টেডিয়াম নামে পরিচিত, ভরিয়ে ফেললো। প্রথম ম্যাচের পর থেকেই এই প্রথা শুরু হয়ে গেছিল। ফাইনালেও তার অন্যথা হলো না। কিন্তু খেলা শুরুর আগে দেখা দিল এক অদ্ভুত সমস্যা। ফাইনাল পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল ভারতীয় রেফারি হরমন সিং-এর কাঁধে। কিন্তু দুই লাইন্সম্যান অলিফ্যান্ট এবং গ্রিন মাঠে নামতে অস্বীকার করে বসলো। কারণ হিসেবে তারা দেখালো, বয়সে ছোট এই রেফারির সহযোগী হতে তারা মোটেই সম্মানিতবোধ করছে না। ডুরান্ড কমিটি তাদের বোঝাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছে দেখে ফাইনাল উদ্বোধন করতে আসা ভাইসরয় যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন পরিস্থিতি, উনি দুই রেফারিকে কড়া ভাষায় কোর্ট মার্শালের ভয় দেখালেন। উপায়ন্তর না দেখে দুই ব্রিটিশ লাইন্সম্যান ভারতীয় রেফারিকে সহযোগিতা করতে নেমে পড়লো। প্রাথমিক জয় যেন শুরু হয়ে গেল এখানেই।
মহামেডান ড্রেসিং রুমে উসমান জান, জুম্মা খানের মতো সিনিয়ার প্লেয়াররা ১৯১১ সালের মোহনবাগানের ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের কথা বলে ক্রমাগত উৎসাহিত করে চলেছে তরুণ প্লেয়ারদের। এ তো শুধু ফুটবল খেলা নয়। যদি জেতা যায় তবে এই জয় হবে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জয় যা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিশ্চিত ভাবে প্রেরণা জোগাবে। ১১ জন উদ্বুদ্ধ খেলোয়াড় নেমে পড়লো মাঠে। যেন এগারোজন সৈনিক নেমেছে অপমানের জবাব দিতে।

রয়েল ওয়ারউইকশায়ার শুরু করলো প্রচন্ড গতিতে। মহামেডানের দুই স্তম্ভ জুম্মা খান এবং বাচ্চি খান একের পর এক রুখে দিতে লাগলো তাদের আক্রমণ। মহামেডানও প্রত্যাঘাত করতে লাগলো বিপক্ষ শিবিরে। বল মাঠের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যাতায়াত করতে লাগলো ঝড়ের গতিতে। খেলা শেষের বাঁশি যখন বাজলো গোটা মাঠ উল্লাস করছে। খেলার ফলাফল মহামেডানের পক্ষে ২-১। হাফিজ রসিদ এবং সাবু-র গোলে তারা জিতে গেছে। তারা জিতে গেছে শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও। রেফারি হরমন সিংয়ের অপমানের যোগ্য জবাব দেওয়া গেছে। জবাব দেওয়া গেছে ভারতীয়দের উপর অন্যায়-অত্যাচারের। এর আগে ১৯৩৪-১৯৩৮ টানা কলকাতা লিগ জয় করে দিল্লিতে পৌঁছনো মহামেডান যে আশার আলো জ্বলিয়ে নিয়ে গিয়ে ছিল তা তারা নিভতে দেয়নি ডুরান্ডেও। সেই প্রথম কোনো ভারতীয় দল জিতলো ডুরান্ড কাপ আর সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে গেল ইতিহাস।
------------------
আরও পড়ুন 
রোদ ঝলমলে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। তারিখ ২৪শে জুলাই ১৯০২। শুরু হলো ৫ টেস্ট সিরিজের চতুর্থ টেস্ট। তিন দিনের ম্যাচ। ইতিমধ্যেই অষ্ট্রেলিয়া সিরিজে এগিয়ে গিয়েছে ২-০-তে। এটা জিততে পারলেই সিরিজ পকেটে। দেশের মাটিতে এইরকম প্যাঁচে পড়ে গিয়ে ইংল্যান্ডও মরিয়া সম্মান উদ্ধারে।

গ্যালারি থেকে Arena 
 পর্ব - ২

Post a Comment

0 Comments