জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস- ১৮ / শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৮

শ্যামল জানা

ফিউচারইজম

ইতালির কবি ফিলিপ্পো টমাসো ম্যারিনেত্তি ১৯০৯ সালে ইতালির মিলান শহরে ফিউচারইজম-এর সূত্রপাত করেন লিখিতভাবে “ম্যানিফেস্টা অফ ফিউচারিজম” প্রকাশ করে৷ এটি আর্টিকেল হিসেবে প্রথম প্রকাশ হয়— ৫ ফেব্রুয়ারি “লা গ্যাজেটা দেলএমিলিয়া”(La gazzetta dell'Emilia ) তে৷ এরপর এটি ২০ ফেব্রুয়ারি ফরাসি দৈনিক সংবাদপত্র “লা ফিগারো”-তে পুনর্মুদ্রণ হয়৷ এবং খুব সাডা পড়ে যায়৷ ম্যারিনেত্তির সঙ্গে যুক্ত হন— উমবের্তো বচ্চিওনি, কার্লো কারা, গিয়াকোমো বালা, জিনো সেভেরিনি ও লুইজি রাসোলো(ককম্পোজার) প্রমুখ শিল্পীরা৷ ফিউচারইজম-এর ইস্তাহারে(Manifesto) মোট ১১দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল৷ সেখানে ম্যারিনেত্তি যা ঘোষণা করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর ছিল ৯ ও ১০ নম্বর পয়েন্ট দুটি৷

ইস্তাহারের ৯ নম্বর পয়েন্টে বলা হচ্ছে— “পৃথিবীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার একমাত্র সত্য হল— যুদ্ধ৷ সেইসঙ্গে সামরিকতাবাদ, দেশপ্রেম, নৈরাজ্যবাদীদের ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম৷ আমরা এগুলিকে মহিমান্বিত করব৷ আর, সেইসব সুন্দর আদর্শ, যা হত্যা করে, এবং নারীদের ঘৃণা করে, আমরা সেগুলিকেও মহিমান্বিত করব৷”

১০ নম্বর পয়েন্টে বলা হচ্ছে— “অতীতের সাখ্য বহন করে, এমন যা কিছু, যেমন জাদুঘর (Museum) গ্রন্থাগার(Library), এগুলিকে আমরা ধ্বংস করব! যা স্বাভাবিক বা গতানুগতিক, নারীবাদ, যে সব ভীরুরা সব সময় অনুকূল পরিস্থিতির সঙ্গে থাকে— এই সব কিছুর বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করব৷”

এ দুটি ছাড়াও আরও কিছু কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি৷ তাহলে স্পষ্ট বোঝানো সম্ভব হবে তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল৷

“আমরা ভয়ঙ্করভাবে লড়াই করতে চাই এতদিন ধরে চলে আসা অসচেতনতা, ধর্মান্ধতা, এবং উন্নাসিক ধর্মাচারণের বিরুদ্ধে, যা কিনা জাদুঘরের অশুভ প্রভাব দ্বারা পরিপুষ্ট৷ আমরা বিদ্রোহ দেখাতে চাই অলসভাবে প্রশংসা করা হয়েছে এমন সব পুরোনো ছবির বিরুদ্ধে, জোর করে চালু রাখা পুরোনো অচল অবস্থার বিরুদ্ধে, পুরোনো বস্তাপচা বিষয়-সামগ্রীর বিরুদ্ধে৷ আমরা উদ্দামতার সঙ্গে বিরোধিতা করি সেই সবকিছুর, যা পোকা-খাওয়া, নোংরা, সময়-জারিত! এই যে, তরুণদের সবকিছুকেই অবজ্ঞা করা৷ যে সব নতুনরা, জীবনে চলতে গিয়ে নিয়মকে তোয়াক্কা করে না, তাদের ঘৃণা করা— এগুলোকে আমরা মনে করি অন্যায্য, এবং অপরাধ!”(ছবি-১)

ইস্তাহারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল— “ইতালিতে আমরা এখন অদম্য, এবং জ্বলন্ত হিংসার সাথে ফিউচারইজমকে প্রতিষ্ঠা করছি৷ কারণ, আমরা এর পুতিগন্ধময় পচনশীল অধ্যাপক, প্রত্নতাত্ত্বিক, পুরা সংগ্রাহক এবং অলংকার শাস্ত্রীদের হাত থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে চাই৷”

বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই, যে, ফিউচারিজম বিষয়টি একটি বৃহত্তর ব্যাপার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ইতালি তথা পৃথিবীর ইতিহাসে৷ বিভিন্ন দেশে এর প্রভাব পড়েছিল৷ রাশিয়ায় তো আলাদা করে “রাশিয়ান ফিউচারিস্ট” গড়ে উঠেছিল৷ শুধু তাইই নয়, সেই সময় শিল্পের যতগুলি মাধ্যম ছিল, প্রত্যেক মাধ্যমের শিল্পীরা ফিউচারিজম-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল— সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সিরামিকস, গ্রাফিক ডিজাইন, ইন্ড্রাস্টিয়াল ডিজাইন, ইনটিরিয়র ডিজাইন, আরবান ডিজাইন, থিয়েটার, ফিল্ম, ফ্যাশন, টেক্সটাইলস, মিউজিক, আর্কিটেকচার, এমন কি রন্ধনশিল্প পর্যন্ত!

শুধু তাইই নয়, এটি এত বৃহত্তর আকার ধারণ করেছিল যে, প্রতিটি শিল্প-মাধ্যমের জন্য আলাদা আলাদা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল৷
ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চিত্রশিল্পের পক্ষে ফিউচারিস্টদের আলাদা একটি ঘোষণাপত্র— “ম্যানিফেস্টো অফ ফিউচারিস্ট পেন্টার্স” প্রকাশিত হয়৷ এর পরে পরেই ওই বছরেরই ১১ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়— “ফিউচারিস্ট পেন্টিং : টেকনিক্যাল ম্যনিফেস্টো”৷ এখানে ওই একই কথা বলা হয়৷ অতীতে মহৎ বলে কিছু থাকতে পারে না৷ অতীত মানেই সম্পূর্ণ বাতিলযোগ্য৷ তুমি যে সময়ে বাস করছ, সেটিই একমাত্র সত্য৷ এখান থেকে তুমি কত তাড়াতাড়ি ভবিষ্যতকে ধরতে পারছ, সেটিই বড় কথা৷ বিশ শতকের শুরু মানেই গতির যুগ৷ ওই গতির যুগের পরিস্থিতিকে ভিত্তি করেই সবকিছু নতুন করে গড়তে হবে৷ যাকে তারা এইভাবে বলেছিল— “Based on the Myth of the motor car and velocity” (ছবি-২) ৷

স্বভাবতই এঁদের কাজের মধ্যে মানবিক ও সুকুমার বৃত্তির চেয়ে যান্ত্রিক ও আঙ্গিকবাদী উপাদান তথা বিমূর্ত বিষয়েরই প্রাধান্য ছিল৷ ১৯১১ সালে মিলান-এর এক প্রদর্শনীতে এঁদের কাজের সূচনা হয়৷ এরপর ১৯১২ সালে ফিউচারিস্টদের এক বিশাল প্রদর্শনী হয় প্যারিসে৷ এখান থেকেই ফিউচারইজম ও তার তত্ত্ব সারা ইয়োরোপে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে৷     (ক্রমশ)
---------------
আরও পড়ুন 

মানুষের দ্বারা মানুষের আকস্মিক ও চরম সর্বনাশ ঘটানো হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে৷ এরই নগ্ন রূপ বিভিন্নভাবে ক্যানভাসে তুলে ধরাই এদের উদ্দেশ্য ছিল৷ তাই, তাঁরা ছবিতে প্রাকৃতিক দৃশ্য(Landscape)ও শারীরিক নগ্নতা(Nudity)আঁকতেন না, বর্জন করেছিলেন৷ 

Post a Comment

2 Comments

  1. ফিউচারইজম এর জন্ম ও ফিউচারিস্টদের কর্মকাণ্ডের ফলে
    উদ্ভুত পরিস্থিতি কিভাবে প্রভাবিত
    করেছিল বিশ্বকে পড়ে অবাক হতে হয়! ফিউতারইজম এর প্রভাবে সমগ্র ইউরোপ প্রভাবিতও হয়েছিল।
    আঙ্গিকবাদী উপাদান আর বিমূর্ততা
    নির্ভর যে শিল্প, যা ফিউচারইজম, তা
    কি আজও আধুনিক শিল্পের উপজীব্য। জানার অপেক্ষায় থাকলাম। চমৎকার এগোচ্ছে।

    ReplyDelete
  2. ফিউচারইজম এর ইস্তাহারে ১১ দফা কর্মসূচির যে ঘোষণা করা হয়েছিল,সেখানে ম্যারিনেত্তির ঘোষিত ৯ ও ১০ নম্বর পয়েন্ট দুটি সত্যিই বিস্ময়কর।

    ReplyDelete