জ্বলদর্চি

গ্যালারি থেকে Arena - 2/ অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

 
Arena from the gallery -2
গ্যালারি থেকে Arena - 2

৩ রানের দূরত্ব

অ ভি ন ন্দ ন  মু খো পা ধ্যা য়
 
রোদ ঝলমলে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। তারিখ ২৪শে জুলাই ১৯০২। শুরু হলো ৫ টেস্ট সিরিজের চতুর্থ টেস্ট। তিন দিনের ম্যাচ। ইতিমধ্যেই অষ্ট্রেলিয়া সিরিজে এগিয়ে গিয়েছে ২-০-তে। এটা জিততে পারলেই সিরিজ পকেটে। দেশের মাটিতে এইরকম প্যাঁচে পড়ে গিয়ে ইংল্যান্ডও মরিয়া সম্মান উদ্ধারে।

টসে জিতে ব্যাট নিয়ে প্রথম ইনিংসে অষ্ট্রেলিয়া শেষ করলো ২৯৯ রানে। ট্রাম্পার ১০৪, ডাফ ৫৪, হিল ৬৫ আর ক্যাপ্টেন জো ডার্লিং ৫১ রান। আর কেউই তেমন দাঁড়াতে পারলো না। ইংল্যান্ডের ডানহাতি ফাস্ট বোলার বিল লকউড ৬ টা এবং অলরাউন্ডার উইলফ্রেড রোডস ৪ টে উইকেট নিয়ে শেষ করলো। এই উইলফ্রেড রোডস আবার ইংল্যান্ডের প্রথম ক্রিকেটার যিনি ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের ডাবল করে ছিলেন।

ইংল্যান্ড কিন্তু আবারও সমস্যায় পড়লো। ৪৪/৫ হয়ে গেল খুব দ্রুতই। সেখান থেকে খেলা ধরলো স্ট্যানলি জ্যাকসান আর লেন ব্রাউন্ড। প্রথম দিন ইংল্যান্ড শেষ করলো ৭০/৫ এ। দ্বিতীয় দিনের শুরু থেকে লড়াই চালিয়ে গেল এই দুই নট আউট ব্যাটসম্যান। দলের ১৮৫ রানের মাথায় ব্রাউন্ড আউট হয়ে গেল ৬৫ রানে। সেখান থেকেও কিন্তু জ্যাকসান টেলএন্ডারদের নিয়ে মরিয়া লড়াই ছাড়লো না। এ লড়াই তো আসলে নিজ দেশে অসম্মানের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার লড়াই। শেষ পর্যন্ত যখন জ্যাকসানের লড়াই থামলো দলীয় রান তখন ২৬২ আর জ্যাকসান একাই ১২৮। অন্য দিকে ৫ রানে অপরাজিত রয়ে গেল এই ম্যাচে ডেবিউ করা সাসেক্স মাঠের ডান হাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার ফ্রেড টেট যার এই ম্যাচটিই প্রথম এবং শেষ ম্যাচ হয়ে থেকে গেছে ইংল্যান্ডের পক্ষে। হিউ ট্রাম্বল ৪টে ,জ্যাক সন্ডার্স ৩টে এবং মন্টি নোবেল ২ টে উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ড ইনিংস ভাঙলো।  

৩৭ রানে এগিয়ে থাকা অবস্থায় অষ্ট্রেলিয়া শুরু করলো দ্বিতীয় ইনিংস। একে তো লিড, তায় সিরিজ জয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্যাট হাতে নামলো ভিক্টর ট্রাম্পার আর রেগি ডাফ। নিজের দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডও খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো গরগর করছে। লকউড শুরু করলো ভয়ঙ্কর ভাবে। মাত্র ১০ রানের মধ্যে তুলে নিল প্রথম তিন ব্যাটসম্যানকে। তার মধ্যে ডাফ আর কেম হিল ক্লিন বোল্ড। ট্রাম্পার ক্যাচ। ইংল্যান্ড বোলাররা রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। দু’দিক থেকে নাস্তানাবুদ করছে ব্যাটসম্যানকে। একে ইংলিশ ওয়েদার, তায় আঢাকা পিচ। মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ছে সবুজ মাঠে। ক্রিজে গার্ড নিল ব্যাগি গ্রিনের ন্যাটা ক্যাপ্টেন ডার্লিং। সঙ্গী গ্রেগরি। একের পর এক ইংলিশ আক্রমণ রুখে দিত লাগলো স্কিপার। তখন যেন তার ব্যাট হয়ে উঠেছে তরবারি। কিন্তু সামান্য ভুল হয়ে গেল নিজের ১৭ রানের মাথায়। একটা শট উঁচু হয়ে চলে গেল মেঘকে চুম্বন করতে। আর কপাল এমনই যে সেই বল নেমে আসতে লাগলো ডেবিউ প্লেয়ার টেটের দিকে। সে এই টেস্টে চান্স পেয়েছে জর্জ হার্স্টের পরিবর্তে। আর ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে গ্যালারিতে কথা উঠে গেছে- ‘এই প্লেয়ার এই স্কোয়াডে কী করছে?’

টেট ক্যাচটা ফেললো। এতটাই খারাপ ভাবে ফেললো যেন মনে হলো ক্যাচটা ধরার ইচ্ছেই ছিল না। ডার্লিং শেষ পর্যন্ত আউট হলো ৩৭ রানে। গ্রেগরি করলো ২৪।দ্বিতীয় দিন অষ্ট্রেলিয়া দিন শেষ করলো ৮৫/৮ এ। শেষ দিন আর মাত্র ১ রান যোগ করে সকাল সকাল অলআউট। দুজন বাদে বাকিরা কেউ ৫ রানের গণ্ডি পেরোতে পারলো না। অষ্ট্রেলিয়া শেষ হলো ৮৬ রানে। লকউড ৫ টা, রোডস ৩ টে, আর ক্যাচ ফেলে অষ্ট্রেলিয়াকে কিছুটা সুবিধা দেওয়া টেট প্রায়শ্চিত্ত করলো ২ টো উইকেট নিয়ে।

১৯০২ সালের ২৬শে জুলাই, শনিবার। ক্রিকেট ইতিহাসে চিরকালের জন্য লেখা হয়ে যাওয়া একটা তারিখ। মাত্র ১২৪ রান করলেই টেস্ট সিরিজে ফিরে আসবে ইংলিশম্যানরা। জয়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে। দারুণ দারুণ ব্যাটসম্যানে সজ্জিত ইংল্যান্ডের রণতরী। আগের রাতে যদিও ঘন্টা পাঁচেক বৃষ্টি হয়ে পিচ ভিজে গেছে এবং অষ্ট্রেলিয়ার হাতে হিউ ট্রাম্বল এবং জ্যাক সন্ডার্সের মতো দুজন সিম বোলার আছে তবু ইংল্যান্ডের আত্মবিশ্বাসের অভাব হলো না। কারণ জয়ের জন্য রান মাত্র ১২৪। প্রায় পুরোটা দিন পড়ে আছে। আরামে বিকেলের চা খাওয়া যাবে। কিন্তু ক্রিকেট দেবতা যে অন্যরকম ভেবে রেখেছিলেন তা জানার কোনো উপায়ই ছিল না ইংলিশম্যানদের।
মেঘলা ওয়েদারে অসাধারণ শুরু করলো ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেন এবং এই ম্যাচে ইংল্যান্ডের হয়ে ডেবিউ করা লিওনেল প্যালাইরেট-এর ব্যাটে। লাঞ্চ অবধি ৩৬/০। আর এখান থেকেই শুরু হলো অন্য ইতিহাস লেখার কাজ। লাঞ্চের পরে সন্ডার্সের বলে বোল্ড হয়ে গেল প্যালাইরেট। ব্যক্তিগত রান তখন ১৭। দলের ৪৪। টিল্ডেসলি এসে ক্যাপ্টেনের সাথে জমে গেল উইকেটে। একদিকে ম্যাকলারেন ধরে রাখলেও অন্যদিকে টিল্ডেসলি চালিয়ে খেলতে শুরু করলো। জয় যখন প্রায় নিশ্চিত লাগছে তখনই আরেকটা আঘাত হানলো সন্ডার্স। তার বলে ১৬ রানের মাথায় স্লিপে ধরা পড়লো টিল্ডেসলি। ইংল্যান্ড ৬৮/২। এখনও দরকার ৫৬। চার রান বাদে ট্রাম্বলের বলে ডাফের হাতে ধরা পড়লো ক্যাপ্টেন স্বয়ং নিজের ৩৬ রানের মাথায়। ইংল্যান্ড ৭২/৩। জিততে আর ৫২ রান। ক্রিজে এলেন রঞ্জিত সিংজি। এই সেই ব্যাটসম্যান যিনি ৬ বছর আগে এই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই অষ্ট্রেলিয়ানদের পিটিয়ে ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু দর্শকরা বুঝতে পারছিল বর্তমানের রঞ্জিত সিং সেই সময়ের ছায়া মাত্র। তারা বরং ভরসা রাখছিল ববি আবেলের উপরেই।আবেল দর্শকদের হতাশ করছিল না। হিল এর মাথার উপর দিয়ে একটা দুর্দান্ত বাউন্ডারিও মারলো। পুরো স্টেডিয়াম চেঁচিয়ে উঠলো ‘ব্রাভো ববি’। দলের ৯২ রানের মাথায় সিংজিকে এল বি ডব্লিউ করলো ট্রাম্বল। ৫ রান বাদে ট্রাম্বল আবার আঘাত হানলো ইংলিশ রণতরীতে। এবার ব্যক্তিগত ২১ রানে বোল্ড আবেল যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সমস্ত দর্শক। ৯৭/৫। বাকি ২৭ রান। অষ্ট্রেলিয়া হঠাৎ যেন কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। যদি এখনও ঠিকঠাক চেষ্টা করা যায়, তাহলে হয়তো…।

প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান জ্যাকসান যখন আউট হলো ইংল্যান্ডের স্কোর ১০৭।বাকি ১৭ রান। হাতে ৪ উইকেট। পুরো গ্যালারি থমথমে। আচমকা যেন বজ্রপাত ঘটেছে মাঠের মধ্যে। যদিও কেউ কেউ তখনও পূর্ণ আশা নিয়ে বসে। ১০৯ রানে গেল ব্রুনাড। লকউডও প্যাভেলিয়নে ফিরলো কোনো রান না করেই। লিলি উন্মত্তের মতো ব্যাট আছড়ালো হাওয়ায়। দলের রান ১০৯/৮।

পরের ওভারে লিলি উঁচু করে একটা অসাধারণ ড্রাইভ মারলো ডিপ মিড উইকেটের উপর দিয়ে। সোজা বাউন্ডারির দিকে ছুটছে বল। চিৎকার করে উঠলো ভিড় ‘ওয়েল হিট স্যার’। কিন্তু কেউ লক্ষ করেনি বলটিকে তাক করে তিরবেগে ছুটে আসছে হিল। মাটিতে পড়ার আগেই প্রায় কুড়ি গজ দৌড়ে হাওয়ার বুক থেকে একহাতে ছোঁ পেড়ে নিল বলটাকে। মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো ক্যাচ। মাঠে উপস্থিত সমস্ত দর্শকদের চোখে মুখে কেউ যেন আলকাতরার এক পোঁচ কালি মাখিয়ে দিয়েছে। ১১৬/৯।

জিততে বাকি ৮ রান। ক্রিজে এলো শেষ ব্যাটসম্যান ফ্রেড টেট। সাসেক্সের হয়ে যার ব্যাটিং এভারেজ ১৬। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ভালই বলতে হয়।
ক্রিজের অন্যদিকে রোডস ট্রাম্বলের তিনটে বল কোনো রকমে ঠেকিয়ে দেওয়ার পরেই শুরু হলো বৃষ্টি। প্রায় চল্লিশ মিনিট বাদে যখন বৃষ্টি থামলো পিচ আবার ভিজে স্যাঁতসেতে গেছে। ক্রিজে শেষ দুই ব্যাটসম্যান, অথবা বোলারও বলা যায়। জিততে বাকি আট রান। সন্ডার্স রান আপ নিল। টেটের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রায় সাদা। হাত থেকে বল বেরোনোর পর টেট দেখতে পেল কিছু একটা মাটিতে পড়েই তার দিকে আগুনের মতো ছুটে আসছে। কুইক রিফ্লেক্সে ব্যাট বাড়াতেই ‘খুচ’ করে একটা শব্দ। ভেজা ঘাসের বুকে জল কেটে ছোটা নৌকার মতো বল ব্যাটের কানা ছুঁয়ে সোজা বাউন্ডারিতে। আবারও হৈ হৈ করে উঠলো ভিড়। বাকি আর মাত্র ৪ রান। হাতে ১ উইকেট। ডার্লিং নতুন করে ফিল্ডিং সাজিয়ে নিল। সামান্য ঝুঁকে ছোটা শুরু করলো সন্ডার্স।টেটের বুকের ধুকপুকুনি যেন শুনতে পাচ্ছে পুরো দর্শককুল। ক্রিকেট দেবতা কী রেখেছেন টেটের ভাগ্যে! বল পিচ করলো। লাল আগুনের গোলা ছিটকে এলো টেটের দিকে। হাওয়া কেটে নেমে এল ব্যাট।

একটা শব্দ হলো ‘ঠক’ করে। না, এই শব্দ উইলো কাঠের সাথে বলের ঘর্ষণের শব্দ নয়। সবাই দেখলো ব্যাট পেরিয়ে পেছনের উইকেট নিয়ে চলে গেছে একটা বুলেট। মাত্র ৩ রান দূরে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে ইংল্যান্ডের জয়ের স্বপ্ন।
ক্রিকেট দেবতা কিন্তু আরেক হাস্যকর মজা লিখে রেখে ছিলেন অন্য খাতায়। এক সপ্তাহ পরে অষ্ট্রেলিয়ার সাথে সাসেক্সের খেলায় টেট অপরাজিত থাকলো ২২ রানে এবং এটি ছিল অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।

Post a Comment

0 Comments