জ্বলদর্চি

নোবেলবিজয়ী লুইজ গ্লাক / সৌমেন শেখর

Nobel laureate (2020)  Louise Glück

নোবেলবিজয়ী লুইজ গ্লাক

সৌ মে ন  শে খ র


সকালের প্রাতরাশ বানাচ্ছেন বছর সাতাত্তরের এক বৃদ্ধা। ফোনটা বেজেই চলেছে সকাল থেকে। বৃদ্ধার মুখে বিরক্তির ভ্রুকুটি। কফি বানানো শেষ করে টেবিলে কাপটি রেখে ফোন ধরলেন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি, বিরক্ত করছেন কেন?  "ওপ্রান্তে একটি উত্তেজিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো,  " সুপ্রভাত, আমি নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলছি, আপনার সাথে দুমিনিট কথা বলতে চাই। আপনার সময় হবে? প্রশ্নটা শোনার পর বৃদ্ধার মুখে বিরক্তির ছায়া বাড়লো বই কমলো না। বিরক্তি নিয়েই বললেন, "বলুন।"  " আপনাকে ২০২০ সাহিত্যে নোবেলের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এবিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? ”দু এক কথার পর বৃদ্ধা হাত ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন আপনার দু'মিনিট শেষ হয়েছে তাই আমি আর কথা বলতে পারছি না। মাফ করবেন। " বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। ভাবলেশহীন ভাবে গিয়ে বসলেন ব্রেকফাস্ট টেবিলে। 

বৃদ্ধার নাম লুইজ গ্লাক। চলতি বছরে সাহিত্য বিভাগের নোবেল প্রাপক। নোবেল কমিটির সাইটেশন জানাচ্ছে, লুইজ গ্লাক-কে এই পুরস্কার দেওয়া হল
 ‘for her unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal.’ 

জন্মসূত্রে আমেরিকান এই কবি থাকেন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। জন্ম ১৯৪৩ সালে। কবিতা লেখার শুরু ছোট বয়স থেকেই। হাই স্কুলে পড়ার সময় এক অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হন তিনি। রোগটির নাম anorexia nervosa. একটি মানসিক অসুখ। এই অসুখে রোগী সবসময় ভাবে তার ওজন বেড়ে যাচ্ছে ফলে কঠোর ডায়েট কন্ট্রোল শুরু করে,  বিশেষ ধরনের খাওয়ার ছাড়া অন্য কোনো খাওয়ার খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং আস্তে আস্তে অসুস্থ হতে শুরু করে। লুইজ ও একসময় ভেবেছিলেন তিনি বোধহয় মারাই যাবেন। 

যাইহোক উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে একসময় তার এই অসুখ সেরে যায়। তাঁর সাহিত্য জীবনের উপর এর গভীর প্রভাব ছিল।  পরবর্তী কালে তিনি বলেছেন এই অসুখ এবং তার চিকিৎসা তাঁকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। এই অসুখের জন্য তিনি প্রথাগত শিক্ষায় তেমন ভাবে যুক্ত হতে পারেননি তবে তিন বছরের পোয়েট্রি ওয়ার্কশপে ভর্তি হয়েছিলেন 'সারা লরেন্স কলেজে '। তারপর তার বিবাহ, বিচ্ছেদ, কবিতার শিক্ষক হিসেবে কাজ, দ্বিতীয় বিবাহ, সন্তানের জন্ম এসবের মধ্য দিয়ে জীবন বয়েছিল নিজের মতো কিন্তু এসবের মাঝেই চলছিল নিয়মিত কবিতা লেখা,  যা তিনি একদিনের জন্য ও থামিয়ে দেননি।  ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'Firstborn ' দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'The House on Marshland ' প্রকাশ হয় ১৯৭৫ সালে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'Descending Figure'। এই কাব্যগ্রন্থের বেশ সমালোচনা হয়েছিল এবং সমালোচকরা তাকে 'child hater ' আখ্যা দিয়েছিলেন। এইসময় একটি দুর্ঘটনায়(অগ্নিকান্ডে) লুইজ তার সমস্ত সম্পত্তি খুইয়ে বসেন৷ এই ঘটনার কিছু পরেই প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ  ' The triumph of Achilles’ (1985) এরপর ১৯৯২ সালে প্রকাশ পায় গ্লাক এর লেখা সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রশংসিত কাব্যগ্রন্থ ' The Wild Iris ' 
  গ্লাক এর কবিতা সবচেয়ে পরিচিত তার অসাধারণ শব্দচয়ন ও প্রকাশভঙ্গীর জন্য। সমালোচকরা তার বইয়ের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, 'গ্লাক তার শব্দচয়ন নিয়ে এতটাই দক্ষ এবং সূক্ষ যে সারা কাব্যগ্রন্থে তিনি বোধহয় একটিও শব্দ অতিরিক্ত ব্যবহার করেননি। অন্যদিকে গ্লাক কিন্তু আদ্যোপান্ত অটোবায়োগ্রাফিকাল কবি। তার জীবনের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়া খুব সহজ ভাবেই উঠে এসেছে তার কবিতায়। আর গ্লাকের জীবনের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী আর তার প্রভাব আমরা খুব সহজেই লক্ষ্য করতে পারি তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে। 

     গ্লাক তার কাজের জন্য বহু সম্মান পেয়েছেন। নোবেল পাওয়ার আগে তিনি পেয়েছেন পুলিৎজার প্রাইজ এবং একবছর কাজ করেছেন Poet laureate of U.S.A হিসেবে। কিন্তু এই সব পুরস্কার তার জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। তিনি বরাবরই আড়ালকামী এবং নিভৃতচারী। তার কবিতার অনুবাদ করে এই বাংলাবাজারের কয়েকজন কবির লাফালাফি দেখতে পেলে তিনি হয়তো মুচকি হাসতেন মাত্র। 

গ্লাকের একটি কবিতা অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম। পড়ে দেখতে পারেন৷ 

আদরের পৌরাণিক গাথাগুলি

 লুইজ গ্লাক

যখন হেডিস স্থির করলেন তিনি এই মেয়েটিকে ভালোবাসেন 

তিনি তার জন্য পৃথিবীর নকল তৈরি করলেন,
 নিচু তৃণভূমি পর্যন্ত সবকিছু একই রকমের 
 তবে যোগ করা হয়েছিল একটি বিছানা। 

সূর্যের আলোটুকুও ছিল হুবহু এক

কারণএকটি অল্প বয়সী মেয়ের ক্ষেত্রে খুবই কঠিন হবে একেবারে উজ্জ্বল আলো থেকে অন্ধকারে যেতে। 

ধীরে ধীরে, তিনি ভেবেছিলেন, তিনি রাতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন মেয়েটির। 
 প্রথমে পাতার ছায়া হিসাবে। তারপরে চাঁদ, তারপরে তারা।  
তারপরে কোনও চাঁদ থাকবে না, থাকবে না কোনো তারাও।
 
তিনি ভাবলেন এভাবেই পার্সেফোন আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। 

কিন্তু পৃথিবীর এই প্রতিরূপের মধ্যে সব ছিল, একমাত্র ভালবাসা ছাড়া। 

সবাই কি ভালবাসা চায় না?

 তাই হেডিস অপেক্ষা করলেন অনেক বছর 
 বিশ্ব নির্মাণ করতে করতে,
দেখলেন পার্সেফোন কে সবুজ মাঠের মাঝে, ধীরে ধীরে বুঝে নিচ্ছে স্বাদ ও গন্ধ। 
মনে মনে ভাবলেন,  ও মেয়ে তোমার যদি একটি খিদে থাকে তবে তোমার সব খিদেই আছে। 

সবাই কি রাত্রে অনুভব করতে চায় না তার ভালবাসার প্রিয় দেহ, কম্পাস আর ধ্রুবতারা? 
নিঃশব্দ নিঃশ্বাস শুনতে শুনতে বুঝতে চায় সে বেঁচে আছে,তারা বেঁচে আছে। একজন পাশ ফিরলে, অন্যজনও ফেরে। 

পার্সিফোনের জন্য তৈরি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে অন্ধকারের দেবতা এরকমই ভাবতেন। তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি এখানে আর কোনো গন্ধ, খাদ্য কিছুই থাকবে না আর। 

অপরাধবোধ? সন্ত্রাস? প্রেমের ভয়?
এই বিষয়গুলি তিনি কখনো কল্পনা করতে পারেননি 
কোনও প্রেমিক কখনও তাদের কল্পনা করে না।

হেডিস স্বপ্ন দেখেন এবং অবাক হয়ে ভাবেন তিনি জায়গাটির নাম কী দেবেন? 
 
প্রথমে তিনি ভাবলেন: নতুন নরক, তারপরে: উদ্যান, এবং শেষ পর্যন্ত, তিনি ঠিক করলেন এর নাম হবে : পার্সিফোনের বালিকাবেলা। 

একটি নরম আলো উঠে এলো বিছানার পেছনে। 

হেডিস পার্সিফোন কে তার বাহুবন্ধনে নিয়ে বলতে চান " আমি তোমাকে ভালোবাসি, কোনোকিছুই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না "

কিন্তু তিনি ভাবলেন এটি মিথ্যা, তাই তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, 
"তুমি মারা গেছো, কোনোকিছুই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না " 

এবং এটিই তার মনে হলো 
 আরও আশাব্যঞ্জক সূচনা, আরও সত্য।


Post a Comment

0 Comments