জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /শুভ্রাশ্রী মাইতি

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু  


গুচ্ছ কবিতা
 
শু ভ্রা শ্রী  মা ই তি


চাঁদ

চাঁদ নিয়ে পৃথিবীতে কবিতা লেখা হয়েছে অন্তত হাজারখানেক।
পূর্ণ চাঁদ,ভাঙা চাঁদ,বাঁকা চাঁদ...আরও নানা রকম চাঁদলিপি।
তারও পরে আমার নির্ধারিত কবিতা ভাঁড়ারের বেশ কটি কবিতা
নির্দিষ্ট করে রেখেছি চাঁদেরই জন্য।
লিখব বলে কলম,কালি নিয়ে বসতেই দেখি
জানালা দিয়ে চাঁদটা সোজা ঢুকে এল
আমার লেখার টেবিলের ঠিক পাশটিতে।
 কিছুটা মরা জোছনার বিষণ্ণতা ছুঁয়ে আছে
তার শুকনো মুখের এখানে ওখানে।
চোখের নিচের গাঢ় কালি আর 
ঠোঁটের পাশের জমাট বাঁধা শুকনো রক্তের দাগখানিও
ক্রমশ বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিভে আসা আলোয়।
ঝুলে পড়া ঘাড় আর ভেঙে যাওয়া দুখানি হাত যেন
  রক্তমাখা শরীর জুড়ে আঁকা আছে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে।
বুক,পেট আর পিঠের কালশিটে পোড়া দাগ
যেন পড়া না পারা কোন অপরাধী বালক।
উঁকি মারে ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ীর ফাঁক দিয়ে সঙ্গোপনে।
ঘরের আলো নিভে গেছে কোনকালে
উত্তুরে বাতাস শুধু হু হু বয়ে চলে।
চোখের কোণায় জমে ওঠে টলটলে জল।
ছেঁড়াখোঁড়া চাঁদকে গভীর মমতায় বুকে নিয়ে
আগুন জ্বেলে দিই আমি উত্তরের ঘর জুড়ে।
বড় শীত করে আসছে এখন---
একটু উত্তাপ পাক চাঁদ আগুনের...


বৃক্ষ

একটা কবিতা লিখতে পারলেই
আমার ভেতর উঠোনে এসে পড়ে 
অনেকখানি মেঘ ভাঙা জল-রোদ।
অন্ধকারের কিলবিলে পোকাগুলো
ধীরে ধীরে সেঁধিয়ে যায় মাটির শীতল গর্ভে।
পুরো উঠোন জুড়ে তখন একটা নরম মাটির মাঠ
আর টলটলে জলে ভরা পুকুর।
জল আয়নায় ভাসছে শালুকমেঘের মায়া।
রোদ শরীরে লাগলেই আলোকসংশ্লেষ শুরু হয় আমার।
পা গুলো শিকড়ের মতো জড়াজড়ি করে নেমে যায়
সোঁদা মাটির জলজ আশ্রয়ে।
শরীরের কোষে কোষে তৈরী হয় পাতার মতো রান্নাঘর।
পরমান্নের মিষ্টি গন্ধে ভরে ওঠে একটি নবান্ন সকাল।
ফুল ফোটে,ফল ধরে---
তারপর শাখা-প্রশাখা মেলতে মেলতে
গাছ হয়ে উঠি আমি অবশেষে।


হেঁটে গেছি বহুদূর...

নিজের জন্মের চিহ্ন আঁকব বলে
আঁতুড়ঘর থেকে শ্মশান অবধি
তুলোট কাগজ বিছিয়েছি ধুলোর।
পুষ্পের অনন্ত রঙে চুবিয়ে নিয়েছি তুলি।
তবু ধুলোমুঠি সোনা হয় না কিছুতেই।
কারা যেন চলাফেরা করে চুপিসারে
অন্ধকার আর রাতের গল্প শোনায় ফিসফিস।
রোদের,আলোর আর উষ্ণতার গল্প শুনব বলে
ধুলোর ওপর হেঁটে গেছি বহু,বহুদূর...


গৃহমন্দির

রান্নাঘরের আগুন তাতে তেতে পুড়ে রোজ ভোগ রাঁধেন মা।
ঘামে ভেজা কপালে লেপটে যায় স্নান সেরে পরা গোল সূর্যসিঁদুর টিপ।
উঠোন নিকিয়ে জলছড়ার আলপনা দিয়ে 
ভক্তিভরে পেতে দেন পুজোর আসন।
বাবা এসে বিগ্রহের পবিত্রতায় বসেন আসন আলো করে।
মা নিবেদন করেন অন্ন,জল আর বৃক্ষের 
উপাচারে সাজানো নৈবেদ্যর ভরা থালা।
বাবা হাত রাখেন অন্নের ওপর। উচ্চারণ করেন আলোমাখা বেদমন্ত্র।
সংসারের দৈন্য-কষ্ট-গ্লানি এসে জমা হয় তাঁর ঠোঁটের ডগায়।
গ্লানি মেখে সামান্য অন্ন মুখে ফেলেন তিনি অমৃতের পবিত্রতায়।
হাত রাখেন জলে।ত্যাগের অশ্রু এসে ভিজিয়ে দেয় তাঁর শান্ত,দৃঢ় চিবুক।
হাতের গন্ডুষে গ্রহণ করেন জল।
বৃক্ষের ওপর হাত রাখতেই একরাশ স্নেহ নরম সবুজ পাতার মতো
ঝলমলিয়ে ওঠে ভালোবাসার সোনা রোদে।
সেটুকু গ্রহণ করে উঠে দাঁড়ান তিনি ঈশ্বরের মতো।
মা গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম জানান আরাধ্য ঈশ্বরকে।
সংসারের মঙ্গলেচ্ছায় মাথায় ঠেকান পুজার উপাচার।
তারপর সেই মহাপ্রসাদ বিলিয়ে দেন আমাদের পরম স্নেহভরে।
তেলে-ঘামে ভেজা মায়ের মুখটা যেন গর্জন তেলে মাজা
প্রতিমার মুখের মতো চকচকে করে ওঠে আমাদের চোখে।
আমরা অবাক হয়ে দেখি
ঈশ্বর আর ঈশ্বরী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন
আমাদের ভাঙাচোরা গৃহমন্দিরে।



অগ্নিস্পর্শ

 চিতাকাঠ প্রদক্ষিণ করে চলেছি একমনে।
হাতে ধরা জ্বলন্ত পাটকাঠির গুচ্ছ 
 আগুন উঠে আসছে ক্রমশঃ শরীর আর মনে।
চিতার গর্ভে শোয়ানো মায়ের তুলসীপাতা ছোঁয়ানো মুখ।
আগুন ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় স্হির।
সেই কোন ছোটবেলা থেকে মুখে তুলে দিয়েছে
তিন গন্ডুষ অমৃত,এক গরাস বাৎসল্য আর অনেকটা স্নেহ।
আজ আমি কি ছোঁয়াব? আগুন!
অবশ্য আগুনই তো ছুঁইয়ে এসেছি বার বার
সেই জন্মঘর থেকেই---
আঁতুড়ের আগুন, সন্তান মানুষ করার আগুন,
নিজের ইচ্ছে বিসর্জনের আগুন,এমনকি মমতার আঁচল ছিন্ন করার আগুনও।
এত আগুন ছোঁয়ানোর পরেও তোমার ভাঙাচোরা মুখ জুড়ে 
হাজার পদ্মের সুরভিত প্রফুল্লতায় ভাটার টান আসে নি কখনো।
তবু সে সৌরভে সেভাবে ফুটে উঠল কোথায় মনের সমস্ত পাপড়িগুলো!
অনুতাপ যেন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি 
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে আমার সমস্ত অস্তিত্ব সর্পিল ভালোবাসায়।
পোড়া চোখে শুধু জলের অনন্ত প্রবাহ...
ও মুখে কি আগুন ছোঁয়াতে পারি আমি!
ও মুখে কি আগুন ছোঁয়ানো যায় কখনো!


Post a Comment

0 Comments