জ্বলদর্চি

অন্তিম বয়ান / ড. কুসুম বিয়োগী

অলংকরণ- রবীন্দ্রনাথ কপাট   


Short story (Final statement)  dr. Kusum Viyogi

অন্তিম বয়ান

মূল হিন্দী রচনা : ড. কুসুম বিয়োগী  

বাংলা ভাষান্তর : চি ন্ম য়  দা শ

সকাল হবে এবার। ভোরের আলো ফুটেছে, কি ফোটেনি। এরই মধ্যে হাল-বলদ নিয়ে খেতে রওনা হয়ে গেছে গাঁয়ের চাষিরা। বস্তির মেয়ে-বউরা রেরিয়ে পড়ল সূর্য উঁকি  দেওয়া মাত্র। শূন্য বালতি-কলসি নিয়ে কুয়ার দিকে রওনা দিল তারা। একটাই কৃয়া তাদের তল্লাটে। সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ে তারা। এই সকালে বিভিন্ন পাড়া থেকে মেয়েরা আসছে। আসছে আলাদা আলাদা সারিতে। সকলেরই গন্তব্য কুয়োতলা। চার দিক থেকে মেয়েদের মিছিল এগিয়ে আসছে সেদিকে। ভোরের  গ্রাম্য পথ মনোহারিণী রূপ ধারণ করেছে চলমান মেয়েদের নিয়ে। নিপুন শিল্পীর হাতে আঁকা জলছবির মত সেই দৃশ্য।
এরপর বেরুল মরদের দল। গায়ে-গতরে খাটা দিনমজুর তারা।
গরু-মহিষের জন্য ঘাস কেটে আনা নিত্যদিনের কাজ। মেয়েরা করে সেটা। অতরো, কমলা আর ভরতরি- তিনবাড়ির তিনটি মেয়ে, বেরিয়েছে সেই কাজে। ঘরদোরে হুড়কো টেনে বন্ধ করে এসেছে তারা। ঘাস আনতে হয়। তিন-চার-পাঁচ জনের ছোট ছোট দল গড়ে কাজে যায় এইসব মেয়েরা।

গোটা বস্তিতে অতরো হল সুন্দরী মেয়ে। কুমারি এবং যুবতী সে। কমলা আর ভরতরি হোল দুটো দুটো করে চারটে বাচ্চার মা। সম্পর্কে অতরো তাদের ননদ। ফুরসৎ পেলেই, অতরোর সাথে খুনসুটি আর হাসি-ঠাট্টা করে দুজনে। সূর্য খানিকটা উপরে উঠে গেছে। রোদের তাতও বেড়ে চলেছে তার সাথে তাল মিলিয়ে।

এদিকে রাজেন্দ্রও রওনা দিয়েছে বাড়ি থেকে। গাঁয়ের মোড়লের ছেলে সে। উচ্চ ঠাকুর বংশের লোক তারা। অতরোর সাথে দেখা করবে বলেই তার বেরোনো। ছেলেটাকে আসতে দেখে, কমলা আর ভরতরি ফোঁস ফোঁস করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করল না অতরো। মেয়েটাকে দেখলেই, দূর থেকে তাকে ডাক দেয় রাজেন্দ্র। কিন্তু শুকনোই  থেকে যায় তার ঠোঁট। এদের তিনজনের দল ঘাস কাটতে বেরুলেই, রাজেন্দ্রকে দেখা যাবে টিলার উপর। লায়লার প্রত্যাশী মজনুর মত এসে যায় সে।

টিলার পাশ দিয়েই গেছে রাস্তাটা। রাস্তার গা থেকে যতটা দেখা যায়, সব তাদেরই খেতি জমি। তবে সেসব জমি কি রাজেন্দ্রর বাপ-ঠাকুরদার জমি নাকি ? কখনো হয়তো  অভাবে পড়ে দেনা করে বস্তি আর দলিত টোলির লোকেরা। বেশি নয়, বিশ-পঞ্চাশ টাকা মাত্র। সেই দেনাই আর শুধতে পারে না অভাবী মানুষগুলো। মাঝখান থেকে তাদের দু'-চার কাঠা করে জমি মোড়লের পেটে ঢুকে যায়। মোড়লের নাম উঠে যায় সরকারের খতিয়ানে। 
মেয়েদের দলটা টিলার কাছে আসতেই রাজেন্দ্র বলল-আরে, ভাবি! আজ এত দেরি করে এলে যে?
গাঁয়ের নিয়মই আলাদা। গরীবের ঘরের বউ, মানে গোটা গাঁয়ের সে ভাবি। ষাট বছরের বুড়োরাও বিশ বছরের মেয়েকে ভাবি বলতে, মস্করা করতে কিন্তু করে না। শুনে আগুন জ্বলে ওঠে মেয়েদের মনে। কিন্তু রা কেড়ে আপত্তি করবে, সে দুঃসাহস নাই কারও। রাজেন্দ্র হল মোড়লের একমাত্র ছেলে। ভগবানের অনেক কৃপা। তা নইলে, বিশ বছর বাদে মোড়লের বউ মা হয় ? তার আগে তো 'বাঁজ' শুনবার ভয়ে ঘর থেকে বেরুতেই না বেচারি। 

তিনটি মেয়ে ঘাস কাটতে এসেছে আজও। নিত্যদিন যেমনটি আসে তারা। দেখেই আর থাকতে পারল না রাজেন্দ্র। এখন তাদেরই জমি পার হয়ে যাচ্ছে মেয়েগুলো। রাজেন্দ্র ডাকল- “আরে ভাবি, আমার খেতে ঘাস কাটবে না আজ ?

ভরতরি ভাবিকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল মোড়লের বেটা। ভরতরির নাক দিয়ে আগুনের হলকা বেরুচ্ছে যেন। এসব দেখে শুনে যখন আর স্থির থাকতে পারছেনা অতরো, কমলা বলে উঠল- “ঠিক আছে। বলছ যখন, কেটে নিচ্ছি।" কমলার ভালমানুষি সহ্য হয় না অতরো আর ভরতরির। রাজেন্দ্রর লোভের চাউনির আগুনে যেন ঝলসে যাচ্ছে দুজনে।

ঘাস কাটার কাজ বেড়ে চলেছে। তিনটি মেয়ের দেমাক দেখে বিশ্বাস করতে পারছে না রাজেন্দ্র। এটা নিশ্চয় গতর খাটা পরিশ্রমের কারণেই ঘটছে, এমনটাই ভেবে নিল সে।

আগের একদিনের কথা। রাজেন্দ্রদের খেতে ঘাস কাটার কাজ তখন শেষ। মেয়ে তিনটি এবার ঘরে ফিরবে। রাজেন্দ্র পথেই অপেক্ষায় ছিল। সামনে এগিয়ে এসে বলল- “ভাবি, তুই আর কমলাভাবি ঘর চলে যা। অতরোর সাথে কথা আছে আমার।”কমলা আর ভরতরি কেঁপে উঠেছিল  রাজেন্দ্র কথা শুনে। বলেছিল -“আজ না। অন্য একদিন।তাড়া আছে আজ।” ছেলেটা এদের কথা শুনল কি শুনল না, তার হাত থেকে বাঁচতে, চটপট সেখান থেকে সরে এসেছিল মেয়েরা।

মাথায় ঘাসের বোঝা। পথে যেতে যেতে একই কথা আলোচনা করছে তিনজনে। সাপিনীর মত ফুঁসে উঠল অতরো- "এই তোমাদের বলে রাখছি ভাবি, কোনদিন যদি হারামজাদাটা কিছু বলে বসে আমাকে, আমিও ছেড়ে কথা বলবনা। গমের গোছার মত হারামখোরটাকে কেটে ফেলে রেখে দেব আমি। দেখে নিও তোমরা। গাঁশুদ্ধ লােকও দেখবে সেদিন। “অতরো!”-- কমলা আঁতকে উঠল তার কথা শুনে। - “আরে, এ কী বলছিস তুই ? কিছু হয়ে গেলে, আস্ত বাজ পড়ে যাবে গোটা গাঁয়ের মাথায়। সেটা জানিস তো?
"তো, করবটা কী ? কাপড় খসিয়ে দেব হারামজাদার সামনে?" ফুঁসে ওঠে অতরো। 
"হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই করবি। এ ছাড়া আর কী করার আছে আমাদের ?" 
শুনে আগুন ঠিকরে বেরুতে লাগল অতরোর চোখ দিয়ে। না কি, ফিনকি দিয়ে রক্ত ? ভরতরি বলল-- "অতরো, কাল থেকে ঘাস কাটতে অন্য রাস্তায় যাব আমরা।
অতরো জবাব দিল-- "কেন?"
কমলা ঝট করে বলল-- "ভাবি তো ঠিকই বলেছে, অতরো।"
-- "কী চুলোর ঠিক বলেছে?  ভয় পাসনি তোরা। কার কত দম, আমি সব বুঝে নেব। ঠাকুরের বেটা, তো কী হয়েছে? তার তো আর চারটা হাত নাই।"
প্রতিদিনের মত, আজও তিনজন এসেছে ঘাস কাটতে। রাজেন্দ্রর শরীর মন চঞ্চল হয়ে উঠল অতরোকে দেখে। রাস্তা থেকে নেমে, তিন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তিনটি মেয়ে। শকুনের চোখ রাজেন্দ্রর। অতরোকে অনুসরণ করে চলেছে তার লোলুপ দৃষ্টি।
ঘাস কাটার কাজ সারা হয়েছে। ঘরে ফিরছে তিনজনে। মাথায় ঘাসের বোঝা। তিনজনেরই  চোখে পড়ল টিলা থেকে নেমে এসেছে ছেলেটা। একটা 'কট্টা ' (দেশি পিস্তল) হাতে নিয়ে পথের গায়েই বসে আছে মোড়লের পো। একবার নল সাফ করছে তো একবার যন্ত্রটা খুলছে আর টোটা ভরছে।
ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল ভরতরি। নিশ্চয় ভারি কিছু একটা ঘটে যাবে আজ। সাথে সাথে অতরোর কালকের কথাগুলো মনে পড়ল তার. তেজে ভরা কথাগুলো যেন সাহস এনে দিল মনে। 
"আরে ভাবি, হয়ে গেল ঘাস কাটা?" গায়ে পড়া কথা। একেবারে গায়ের উপরে এসেই বলা।  কোন রকমে 'হ্যাঁ' বলে, পা চালাল ভরতরি। 
"আরে অতরো, শুধু গরু-মোষের পেট ভরাবি? আমার পিয়াস মিটাবি না?"   
ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠছে মেয়েটা। বাম হাতে ঘাসের বোঝা ধরা। মনের অস্থিরতায় ডান হাতের দা খানা ঘোরাতে লাগল আঙুলের প্যাঁচে।
সবটাই দেখছে কমলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ভয়ে কথা সরছে না তার মুখ দিয়ে। 
কুৎসিত একটা হাসি হেসে রাজেন্দ্র বলল-- "তোরা চলে যা ভাবি। অতরো একটু বাদে যাবে।"
অস্থির হয়ে উঠেছে কামুকটা। হাতের অস্ত্রটায় একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে, ডাকল-- "অতরো?" 
"হ্যাঁ।" 
"বোঝাটা নামা না মাথা থেকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থকে যাবি যে।" 
অতরো যেই বোঝা নামাতে গেল, সাহায্য করবার অছিলায় হাত বাড়িয়ে, এক হ্যাঁচকা টান লাগল ছেলেটা। জমিতে গড়িয়ে নেমে গেল অতরোকে নিয়ে।

চলে আসতে হল বটে, পা যেন এগোতে চাইছে না বউ দুটোর। কে জানে, কিছু ঘটে গেল কি না! অনাগত কী এক অনর্থের বোঝা চেপে বসেছে দুজনের মনেই।

এদিকে কথায় কথায় অতরোকে ফুসলাতে চেষ্টা করে চলেছে রাজেন্দ্র। তারই ফাঁকে, যেই নিজের কাপড় আলগা করেছে ছেলেটা, তার উ্থিত পুরুষাঙ্গটা ছিটকে বেরিয়ে এল যেন।

খানিক বাদে দেখা গেল, মাথায় ঘাসের মোট চাপিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে অতরোও। কিছুটা পথ এসেই, কমলা আর ভরতরির সাথে দেখা হয়ে গেল তার। তারই অপেক্ষায় পথের ধারে বসে ছিল দুজনে।

-- "অতরো!" কেবল এটুকুই বলতে পারল ভাবি। ঘাম মুছছে কমলা। দুর্বল মন তার। দুর্ভাবনায় আতঙ্কে মুখে কথাটি নাই। দেখল, অতরোর চোখ দুটো যেন আগুনের গোলা। সেদিকে চোখ পড়ে কিছু বলার সাহস হল না কমলার। "অতরো!" আবার বিমূঢ় গলা ভরতরির।

-- "আরে ভাবি, তোমরা এখানে বসে আছ কেন? ঘরে চলো।"

-- "পা চলছে না রে।"

--  “আরে,চলো না। ঘাবড়াচ্ছ কেন ? সব ঠিক আছে।

শুনল বটে, কিন্তু ঘাসের বোঝা আজ যেন একটু বেশিই ভারি লাগছে দুজনের। এভাবে ঘরে ফিরে এল একসময়। তারপর নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তিনজনেই।

কিন্তু কমলার চোখে ঘুম নাই। শুয়ে শুয়ে ঝুপড়ির ফুটো গুনে কেটে গেল সারা রাত। ঘুম যেন উবে গেছে দু’চোখ থেকে।

ভরতরি সারারাত ধরে ভাবতে লাগল অতরোর কথা। কী মরদের মত তেজ মেয়েটার গলায়! তবুও কালকের ঘটনা নিয়ে 'হাঁ-না'র দোলায় আন্দোলিত হতে থাকল রাতভর।

পরদিনও তিনজনে চলল ঘাস কাটতে। সব কিছু শান্ত, স্বাভাবিক। ঘাসের বোঝা মাথায় নিয়ে এক সময় ফিরেও এল ঘরে। এভাবে দিন দু-তিন কাটল। কিন্তু রাজেন্দ্রর সাথে একদিনও দেখা হল না তাদের।

সেদিন কমলা জিজ্ঞেস করে বসল-- "ভাবি, কদিন হল, রাজেন্দ্রকে দেখা যাচ্ছে না তো?"

– “গেছে নিশ্চয়ই কোথাও। মরে তো আর যায়নি!" অতরোর কোনও সাড়া নাই। দেখলে মনে হবে, সমুদ্রের কোন অতলে ডুবে আছে মেয়েটা।

দু'-তিন দিন ঘরেও ফেরেনি রাজেন্দ্র। আলোচনা শুরু হল গ্রামে। গেল কোথায় ছেলেটা ? গেল কোথায় ?

অগত্যা থানায় গেল মোড়ল। নিরুদ্দেশ ডায়েরি লিখিয়ে এল ছেলের জন্য। হাজারো ভাবনায় প্রতিটি রোমকূপ কেঁপে কেঁপেউঠছে বউ দুটোর। অথচ কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেনা।
চতুর্থ দিন। রোদ ফুটেছে কি ফোটেনি। সারা গ্রাম তোলপাড়। খবর ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুতের মত। জল নিতে আসা মেয়েরা দেখেছে প্রথম। একটা লাশ ভেসে আছে কূয়ায়। হুলুস্থুল পড়ে গেল সারা গাঁয়ে।

পুলিশের গাড়ি এসে ঢুকল সাইরেন বাজাতে বাজাতে। তার শব্দে প্রতিটা বাড়ির ভিত পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠল গ্রামের।

সারা গ্রাম এসে ভেঙে পড়েছে কূয়াটার পাড়ে। সরপঞ্চ আর মোড়ল  সেখানে এসে হাজির হল পুলিশকে সাথে নিয়ে। থানায় খবর দিয়েছিল চৌকিদার। সেও এখন এদের পিছনে। কুয়া থেকে লাশ তোলা হল। মোড়লের ছেলে রাজেন্দ্র। ছেলের লাশ দেখে, সেখানেই আছাড় খেয়ে পড়ে গেল মোড়ল । মূর্ছা গেছে মানুষটা, বেহুঁশ। ভীড় হঠাতে লাঠি চালাতে হল পুলিশকে। শোরগোল আরও বেড়ে গেল তাতে।

ঝড়ের গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ঘটনা শুনে ঘণ ঘণ মূর্ছা যেতে লাগল মোড়লের বউ। কেউ জল দিতে লাগল তার মুখে। কেউ হাওয়া করতে লাগল নিজের আঁচল ঘুরিয়ে। পরণের শাড়ি তখন পাখা। ভয়াণক পরিস্থিতি।

এসব শুনে কমলা আর ভরতরি যেন পাথর হয়ে গেছে। মুখে কোনও কথা নাই তাদের। কিন্তু অতরো একেবারে স্বাভাবিক। অভ্যাসমত ঘরসংসারের কাজ করে যাচ্ছে। যেমনটা করে নিত্যদিন।

লাশ তোলার জন্য কাঁটা নামানো হয়েছিল কুয়ায়। রাজেন্দ্র উপরে উঠেছে বড়শির কাটায় আটকে পড়া মাছের মত ঝুলতে ঝুলতে। লাশ ওঠার সাথে সাথে গোটা এলাকার বাতাস দুর্গন্ধে ভরে উঠেছে। নিজের নিজের নাকে-মুখে কাপড় টেনে চাপা দিয়েছে সবাই।

লাশ সনাক্ত করার জন্য কূয়ার দিকে এগোলেন দারোগাবাবু।ভীড়ও চলল তার পিছু পিছু। সিপাই লাঠি হাতে তেড়ে আসতে, পিছু হটে গেল ভীড়টা। ঘড়ির কাঁটাও যেন থমকে গেল লাশ দেখে। থমকে গেছে গোটা গ্রামটাই।

কূয়ার গা ঘেঁষে একটা নিমগাছ। তার ডালে বসে একটা কাক কা-কা করে ডেকে উঠল। পুরো বাতাবরণটা যেন আরও কর্কশ হয়ে উঠল তাতে।

তিন-চারজন সেপাই হাত-পা ধরে জীপের পিছনে ছুঁড়ে দিল লাশটাকে। গোটা গ্রাম স্তব্ধ হয়ে আছে। জীপে লাশ চাপিয়ে সিভিল হাসপাতালের দিকে রওনা দিলেন দারোগা। জীপের ধোঁওয়া আর পথের ধুলা উড়ে বেড়াতে লাগল গ্রামের পাকদণ্ডী বেয়ে। তার পিছন পিছন ছুটে চলল গ্রামের লোকজন। সবাই নিজের নিজের যানবাহন নিয়েছে। সবাই দৌড় লাগিয়েছে হাসপাতালের দিকে। হাসপাতাল গ্রাম থেকে এক মাইল দূরের পথ। ধীরে ধীরে ভিড় জমতে শুরু করল হাসপাতালের সামনে। যাদের কিছু নাই, পায়ে হেঁটে এসে হাজির হচ্ছে তারা।

ছেলে-বুড়ো জোয়ান-মদ্দ যে যার নিজের মত করে আলোচনা করছে ঘটনাটার। কেউ আত্মহত্যা বলছে, তো কেউ হত্যা। যত মুখ, তত রকম মন্তব্য। সকলেই ব্যস্ত নিজর নিজের বিচার প্রতিষ্ঠায়।
সরপঞ্চ প্রধানও এসেছে। তাকে ঘিরেও একটা জটলা। গম্ভীর আলোচনা  চলছে সেখানেও। দেখেশুনে পুরো ব্যাপারটা আরও গম্ভীর মনে হতে লাগল গ্রামবাসীদের কাছে। কী এমন হোল রাজেন্দ্রর, যে কুয়ায় পড়ে মারা গেল!

সারাটি দিন ছোটাছুটি, হয়রানি। তার উপর দানা পড়েনি পেটে। ধীরে ধীরে অস্থিরতা শুরু হয়েছে সকলের মধ্যে। লুকিয়ে চুরিয়ে এক-একজন করে সরে পড়তে লাগল কেউ কেউ। টুকটাক কিছু মুখে দিয়ে, ফিরে এসে বিড়ি-চুটা ফুঁকতে লাগল। সিভিল হাসপাতালের সামনে তিন-চারটা বিড়ির দোকান। সেগুলোর সামনে আজ বেশ ভীড়। দোকানদের ভারি মজা। হবেনা-ই বা কেন? পুরো গ্রামটাই যে হাজির হয়েছে আজ এখানে।

পোস্টমর্টেম শেষ। গ্রামের লোকেদের হাতে লাশ তুলে দেওয়া হল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেয়ে এক মুহুর্তের জন্য শ্বাস আটকে গেল দারোগার।

“অচানক!” একটা কোণের দিকে সরে গিয়ে সরপঞ্চকে হাঁক পাড়লেন দারোগা। হন্তদন্ত হয়ে দারোগার দিকে এগিয়ে এল লোকটি। অন্যরাও কেউ কেউ এগোল সেদিকে। দেখে, জোর এক ধমক লাগালেন দারোগা- "কী আছে এখানে ? ভীড় করে এসেছ কেন ? যাও সব। ওদিকে গিয়ে বাসে।"

সেসময় একটা লোক এসে হাজির হল কোথা থেকে। সেলাই করা লাশটা একটা মোষের গাড়িতে চাপিয়ে, গ্রামের দিকে রওণা দিল লোকটা।

পুরো ভীড়টা চঞ্চল হয়ে উঠল। চলতে শুরু করল গাড়ির পিছন পিছন। আশপাশের গ্রাম থেকেও লোক এসে জড়ো হয়েছিল খবর শুনে। কেউ এসেছে লাশ দেখবার কৌতুহলে, কেউ বা মোড়লকে দুটো সান্তনা দেবে বলে। এদিকে ফিসফিস আলোচনা চলছে গ্রামের মেয়েদের মধ্যে। কী সর্বনেশে ব্যাপার। একেবারে মোড়লের ঘাড়ে পা! কেঁদে কেঁদে পাথর হয়ে গেছে মোড়লের বউর চোখ দুটো।

চিতায় তুলবার আগে ধোয়া মোছা করা দরকার, স্নান করাতে হবে লাশকে। কাপড় সরাতেই, সকলের বিস্মিত দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল লাশটার উপর। মোড়লের দু’চোখে আবার অন্ধকার। মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল তার বেহুশ দেহটা। দু'-তিনজন লোক দৌড়ে গিয়ে এক লােটা জল নিয়ে এল। ছিটা দিতে লাগল তার চোখেমুখে। অচেতন হয়েই পড়ে রইল মানুষটা। ভীড়ের ভিতর এখন কয়েকটা নতুন নতুন মুখ। তারা পুলিশের লোক। সাদা পোশাকে মিশে আছে ভীড়ভাট্টার ভিতর।
.............................
শ্মশানে চলেছে সবাই লাশ পোড়াতে। উলঙ্গ দেহটা দেখে আহা-উহু করতে লাগল লোকে। এক সময় গ্রামেরই শ্মশানে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রাজেন্দ্র। 

পুলিস ধন্দে পড়ে গেছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখে। ঘটনাটা হত্যা, না আত্মহত্যা? এই প্রশ্নেই জট পাকিয়ে উঠছে চিন্তাভাবনা।

পুলিশের নাক কুকুরের নাকের চেয়েও তীক্ষ্ণ। কিন্তু ব্যাপারটা নাকের আওতায় এলে, তবে তো? তা না হলে, রিপোর্ট বানাতে কীসের পরোয়া ?
একে বিষয়টা গম্ভীর। তার উপর মোড়ল। ঠিকঠাক কাজ করতেই হবে পুলিশকে। গ্রামের প্রতিটা লোক এখন সন্দেহের আওতায়। পাতার মত ঠকঠক করে কাঁপছে সবাই। একটা তরতাজা জোয়ান ছেলে মরেছে। সেটাও তো মানতে হবে। অনুসন্ধান, বাছাই করতে করতে, পুলিশের চোখ এসে খাড়া হল অতরো নামের মেয়েটার উপর।

অতরোকে নিজেদের হেফাজতে নিল পুলিশ।

থানায় গিয়ে বয়ান দেওয়ার জন্য বলা হল অতরোকে। গ্রামের মেয়েকে থানায় যেতে হবে শুনে, গোটা টোলির সবাই একজোট হয়ে দাঁড়াল। এক সুরে বলল-"দারোগাজী, বয়ান যা নেবার, এখানে গ্রামের সামনেই নিন। সাঁতো জমাটের মেয়ে, গ্রামেরই মেয়ে।” দারোগা শান্ত গলায় বললেন-- "চিন্তা কোর না। বয়ান নিয়েই ছেড়ে দেব। যেতে চাও তো, দু-চারজন সঙ্গে যেতে পার।” 
"কিন্তু দারোগাজী, গ্রামে আজ পর্যন্ত এরকমটা কোনদিন হয়নি যে বয়ান দেবার জন্য ঘরের মেয়ে থানা বা কাছারি যাবে।”

“বোন মেয়ে তো সকলের ঘরেই আছে।"

“এমনটা হওয়া যাবে না।" নানান মুখ, নানান মন্তব্য চলতে লাগল। এতক্ষণ নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। সবাইকে চমকে দিয়ে, অতরো বলে উঠল-- "দারোগাজী, বয়ান নেবেন?"
গোটা জমায়েত যেন পাথর হয়ে গেল অতরোর কথা শুনে। ভরতরি আর কমলার তো লেহাঙ্গা ভিজে যাওয়ার জোগাড়!

কিন্তু অতরো গলা তুলে বলল- "শুন গাঁওবালো, আর সেপাইজীরা, তোমরাও শুন। বয়ান দরকার ? জরুর দেব। সবার সামনেই দেব। একটু দাঁড়াও।” ঝুপড়ির দিকে দৌড় লাগাতে, পুলিশ ছুটল মেয়েটার পিছন পিছন। পালায় যদি ?

তখন সরপঞ্চও ছিল সেখানে। বলল-- "দারোগাজী, পিছনে দৌড়বেন না।"
সরপঞ্চের গলায় কী ছিল, পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল দারোগা।

অতরো ফিরে এল ঘর থেকে। হাতে একটা কাগজের মোড়ক। তাকে দেখে, স্বস্তি ফিরে এল দারোগার। জনসমুদ্রের দিকে চেয়ে অতরো বলল-- "গাঁওবালো, তোমরাও দ্যাখো। দারোগাজী, বয়ান চাই ? তো, নিন। এই আমার বয়ান।"  
হাতের মোড়কটা খুলে ধরল অতরো। শুকিয়ে চিমসে কালো একটা মাংসের টুকরো। রাজেন্দ্রর কাটা পুরুষাঙ্গ!

(লেখক পরিচিতি : ড. কুসুম বিয়ােগী একজন প্রখ্যাত দলিত চিন্তক এবং সাহিত্যিক। বহুজন সাহিত্য মঞ্চ-এর অগ্রণী সৈনিক এবং একজন রাষ্ট্রীয় বহুজন কবি। দলিত সমাজকে নতুন উচ্চতা দিয়েছে তাঁর কবিতা। তাঁর গদ্যে দর্পনের মত প্রতিফলিত হয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের সমগ্র জীবনচর্যা। নিজের কাব্য এবং গল্পগ্রন্থের পাশাপাশি, 'দলিত মহিলা কথাকারোঁকি চর্চিত কাহানিয়া' নামের বিখ্যাত গ্রন্থটি তাঁরই সম্পাদিত। দলিত লেখক সংঘ' এবং ভারতীয় দলিত সাহিত্য মঞ্চ-এর প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে দলিত লেখক সংঘের-সহ-সভাপতি তিনি। ধর্মমতে আম্বেদকরপন্থী বৌদ্ধ এই লেখক বর্তমানে দিল্লির অধিবাসী।)

Post a Comment

0 Comments