Sixty-four yoginis
চৌষট্টি যোগিনী
চৈ ত ন্য ম য় নন্দ (ভক্তিশাস্ত্রী, সাহিত্যাচার্য, নিবন্ধরত্ন)
মহামহিমাশালিনী মহত্তমা মহাজননী মহামায়ার মহাপুজায় সমগ্র বাঙালি জাতি ব্রতী। দিব্যদীপ্তিমালিনী দনুজদলনী ভদ্রা ভগবতী শ্রীশ্রী শ্রীশ্রীদুর্গাদেবী আসন জুড়ে বসে আছেন মণ্ডপ আলো করে। মাতৃমূর্তি যেন সংহতিরই বিজয়ােৎসব।
এই বেদবন্দিতা বিশ্বপালিনী পরব্রহ্ম পরমাশক্তি নামভেদে ও রূপভেদে বহু পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ভক্তজনের অনুগ্রহ করার নিমিত্ত প্রকাশিত হন। দেবী ভাগবতে ব্যাসদেব রাজা জন্মেজয়কে মহামায়ার স্বরূপ বিবৃত করতে গিয়ে বলেছেন,-"একই নট যেমন লোকরঞ্জন নিমিত্ত বেশ পরিবর্তন করে রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন ভূমিকা অভিনয় করে থাকে, সেইরূপ এই অদ্বিতীয়া ভগবতী চণ্ডিকা দেবতাদের কার্য সম্পাদনের জন্য স্বলীলায় বহুমূর্তি ধারণ করেন।"
দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার বহুবিধ ও বিচিত্র বরণা দিব্যমূর্তির মধ্যে দশমহাবিদ্যা রূপে দশবিধ মূর্তিতে যে আত্মপ্রকাশ তা বিভিন্ন শাক্ত শাস্ত্রে দৃপ্ত কণ্ঠে বিঘােষিত। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে জগন্মাতা নানাভাবে নানারূপে সাধকের উপলব্ধিতে বিভাসিতা। অর্গলা স্তোত্রে মহাশক্তির দশটি রূপের আরাধনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এইসব দেবী মূর্তি দশরূপে দশদিকে ব্যাপ্ত হয়ে চতুবর্গ ফল প্রদান করেন। দেবীর দিবা শক্তির স্বরূপ আভাষিত দেবী কবচের শ্লোকে মহাবিদ্যার এই নয়টি রূপ সমষ্টিগতভাবে নবদুর্গা নামে বিশেষ প্রসিদ্ধ। চণ্ডীর অষ্টম অধ্যায়ে ব্রহ্মাণ্যাদি অষ্টশক্তির কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। দুর্গাপূজার মহাষ্টমী তিথিতে এইসব দেবীর আহবান করে যথাবিহিত উপচার প্রদানের পর চতুঃষষ্ঠী যোগিনীর পূজা করতে হয়।
চিন্ময়ী দুর্গার নানা মূর্তির ভিতরই এই যোগিনীদের আত্মপ্রকাশ। দুর্গাঘটের নিম্নে যে অষ্টদল পদ্ম অঙ্কিত হয় তার প্রতি দলে আটটি করে মোট চৌষট্টি যোগিনী পূজার বিধান আছে। কালিকা পুরাণে দেখতে পাই চৌষট্টি যোগিনীর বিভিন্ন নাম, যথা--১। ব্রহ্মাণী। ২। চণ্ডিকা ৩। রৌদ্রী ৪। গৌরী। ৫। ইন্দ্রাণী ৬। কৌমারী ৭। ভৈরবী ৮। দুর্গা ৯। নারসিংহী ১০। কালিকা ১১। চামুণ্ডা ১২। শিবদুতী ১৩। বারাহী ১৪। কৌশিকী ১৫। মাহেশ্বরী ১৬। শঙ্করী ১৭। জয়ন্তী ১৮। সর্বমঙ্গলা ১৯। কালী ২০। করালিনী ২১। মেধা ২২। শিবা ২৩। শাকস্তুরী ২৪। ভীমা ২৫। শাস্তা ২৬। ভ্রামরী ২৭। রুদ্রাণী ১৮। অম্বিকা ২৯। ক্ষমা ৩০। ধাত্রী ৩১। স্বাহা ৩২। স্বধা ৩৩। অপর্ণা ৩৪। মহােদরী ৩৫। ঘোররুপা ৩৬। মহাকালী ৩৭। ভদ্রকালী ৩৮। কপালিনী ৩৯। ক্ষেমঙ্করী ৪০। উগ্রচণ্ডা ৪১। চন্ডা ৪২। চণ্ডনায়িকা ৪৩। চামুণ্ডা ৪৪। চণ্ডবতী ৪৫। চণ্ডী ৪৬। মহামােহা ৪৭। প্রিয়ঙ্করী ৪৮। বলবিকরিণী ৪৯। বলপ্রমথিনী ৫০। মদনােন্মথিনী ৫১। সর্বভূতদমনী ৫২। উমা ৫৩। তারা ৫৪। মহানিদ্রা ৫৫। বিজয়া ৫৬। জয়া ৫৭। শৈলপুত্রী ৫৮। চণ্ডিকা ৫৯। চন্দ্রঘণ্টা ৬০। কুষ্মাণ্ডা ৬১। স্কন্দমাতা ৬২। কাত্যায়নী ৬৩। কালরাত্রি ৬৪। মহাগৌরী।
দেবী ভাগবতে আছে, দক্ষ যজ্ঞে শিবপ্রাণা সতী দেবীর দেহত্যাগের পর আশ্বিনের শুক্লাষ্টমীতে জগন্মাতা কোটিযােগিনী বৃন্দের দ্বারা পরিবৃতা ষোড়শ প্রলয়ঙ্করী ভদ্রকালী রূপে আবির্ভূতা হয়ে দক্ষযজ্ঞ বিনাশ করেন। তাই জগদম্বিকা দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী রূপেও বন্দিতা। আজও শারদীয়া মহা পূজা প্রাঙ্গণে ধ্বনিত হয় —" ওঁ দক্ষযজ্ঞ বিনাশিনীমহাঘােরায়ে-যােগিনীকোটি-পরিবৃতায়ে ভদ্রকাল্যৈ হ্রীং ওঁ দুর্গায়ৈ নমঃ। "
ভুবনেশ্বর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে হীরাপুরে এক মনোরম পরিবেশে দিঘির পাড়ে বিদ্যমান চৌষট্টি যোগিনী মন্দির আজও অনেকের নজর কাড়ে। গবেষকদের মতে এর নির্মাণকাল নবম শতাব্দীতে। এই প্রাচীন সুদৃশ্য মন্দিরের দেওয়ালের ছােট ছােট কুলুঙ্গিতেই যোগিনীদের ভদ্রাসন। অধিষ্ঠিতা এই সব যােগিনীদের দর্শন মেলে দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা ও দশভুজারূপে। শক্তিরূপা দশভুজা মূর্তি মহামায়া আরাধিতা। মন্দিরের মাঝখানে বাঁধানাে বেদিটি চণ্ডীমণ্ডপ নামে আখ্যায়িত। মণ্ডপ পেরিয়ে সম্মুখে বিশাল প্রাঙ্গণে আছে দেবী কাত্যায়নীর নয়টি দণ্ডায়মান মূর্তি। বাহিরের আলােতে এইসব উজ্জ্বল মুর্তি উদ্ভাসিত। এইসব যোগিনী মাতৃকাদের আরাধনা যে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত তার সাক্ষ্য বহন করে আসছে ইলােরার বিখ্যাত কৈলাস মন্দিরের পাথরের গুহায় খােদাই করা মাতৃ মূর্তিগুলো।
0 Comments