জ্বলদর্চি

বিশেষ ছোটোবেলা দশম সংখ্যা

ছোটোবেলা || দশম সংখ্যা

দেখতে দেখতে দশম সংখ্যা! স্বনামধন্য ফোটোগ্রাফার সন্তোষ জানা তাঁর আশ্চর্য এক ফোটোগ্রাফি উপহার দিলেন। সেরা ফোটোগ্রাফি তো তাই, যেখানে ফুটে উঠবে সেরা মুহূর্ত। চিত্র স্থির, কিন্তু দুরন্ত গতি। কত কত কথাই ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে! 
এবারের সংখ্যায় আমন্ত্রিত লেখক মুক্তি দাশ ও সুরশ্রী ঘোষ সাহাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা কৃতজ্ঞ, গল্পকার মৌসুমী ঘোষের কাছে। 'ছোটোবেলা' সংখ্যা যাতে সুন্দর হয় ও নিয়মিত প্রকাশ পায় তার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন তিনি।
ছোটোদের আরও বেশি বেশি লেখা ও ছবি পেতে চাই। হোয়াটস অ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

ভুবন ভ্রমণ

নির্মাণ মহান্তী 
(নব নালন্দা হাইস্কুল, দশম শ্রেণি, কলকাতা )

'A thing of beauty is a joy for ever ' কথাখানি কত সত্য , তা বোধ করি আজ উপলব্ধি করা হল আমার। লোকালয়ের এত কাছেই বন্যপ্রকৃতি  লোকচক্ষুর অন্তরালে এমন করে নিজেই নিজের নিবিড় সৌন্দর্যের গোপন পূজারী হয়ে মনের সুগভীর অন্দরে নিবিড় স্বপ্নের মায়াজাল রচনা করতে পারে আর তা যে উদাসী হৃদয়কেও এমন মুগ্ধ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে  ---- তা সত্যিই না দেখলে কেউ জানতেও পারেনা। আজ থেকে বহুদিন আগে শেষ যখন প্রকৃতির পরশ অনুভব করেছিলাম, তখন অলৌকিক সুখ-প্রাচুর্যে মন প্রস্ফুটিত হয়েছিল। আজ পুনরায় এমন স্থানে এসে বড় অদ্ভুত বোধ হচ্ছে। দিগন্তব্যাপী বিপুল শূন্যতা, মাঝে মাঝে নারকেল, সুপারি, সজনে গাছ, দূরে দূরে শ্যামল বনানী ও অপার্থিব পল্লব দোদুল্যকারী মৃদু বাতাস। সামনেই কিছু দূরে গঙ্গার বিপুল জলরাশি বয়ে চলেছে সম্মুখে; সদ্যজাত শিশুর মতোই সে কখনো আত্মহারা, আবার কখনও যেন বিবাগী। বড় অবাক হই । আপন মনে চেয়ে থাকি সেইদিকে ।

কত ফুলের অপরূপ সুগন্ধে সুরভিত বাতাস আমার সমুখে বয়ে যায়। কী অদ্ভুত তার ঘ্রাণ! নিম জাতীয় গাছের ছায়ায় বসলে সেই ঘ্রাণ মনকে কেমন যেন করে দেয়। আম ,লিচু , কৃষ্ণচূড়ার সবুজ সমৃদ্ধি মনকে সুদূর নীলাকাশের মতোই দিগন্ত প্রসারী করে থাকে। না, দিগন্তপ্রসারী বললে ভুল হয়। বলা ভালো---- অশেষ করে থাকে, সীমাহীন করে থাকে। শূন্য রজনীর গভীর তমসার বুকে একাকী জাগরণরত সেই কবেকার পান্ডুলিপি যেমন অবিচলিত স্পন্দনে অজ্ঞাত কোনো এক অনুভূতিকে করে তুলেছিলো বিশ্বমানবের, তেমনি আমিও সেই বিচিত্র  পরম উপাসনায় আর সবার থেকে হয়ে উঠলাম পৃথক। অনুভব করলাম সেই আনন্দ যাকে কবি বলেন,'...the bliss of solitude' । 

ডায়মন্ড হারবারের নিকটবর্তী এই স্থানে মূলত বিদ্যালয়ের পিকনিক-কে উপলক্ষ করেই আসা, বন্ধুরাও এই সফরের সাথী বইকি! কিন্তু , সেখানে এসে না চাইতেই এমন করে নিবিড় স্বপ্নের রাজ্য আপনা থেকে এসেই নিজের পরিচয় দেবে তা কে জানত! এ গভীর সৌন্দর্য যত প্রত্যক্ষ করি, ততই আমার যেন মনে হয়... মনে হয় এখানে এসেছি আগেও। জানি না , হয়তো সত্য! হয়তো আজ থেকে একশ বছর আগে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একমনে কোনো এক কালজয়ী গান রচনায় নিমগ্ন ,অথবা হয়তো যখন বিভূতিভূষণ 'পথের পাঁচালী' রচনার কথা ভেবেছেন মাত্র, অথবা যখন বিদ্যাসাগর কোনো এক দরিদ্রের মুখে তুলে দিচ্ছেন অন্ন, সেদিন ভুবনের কোনো এক কোণে এ নশ্বর আমি, দেখেছিলাম বসে, দুচোখ মেলে, এ প্রকৃতির অন্তরের গভীর রূপ, অনুভব করেছিলাম সে বিচিত্র আনন্দ। আজও প্রকৃতি আমাকে তেমনি বিমুগ্ধ করেছে। এ বুঝি  আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে আর এক কোনো ইন্দ্রিয়  ধরা দেয়। তাই হয়তো সে এমন বিশাল ও বৃহৎ করে আসে আমার কাছে।

 আমার কিছু বন্ধুর, অবশ্য এ স্থান ভালো লাগেনি। তারা বলছে এ স্থান নাকি খেলাধুলোর জন্য খুবই ছোট। তা বলুক , তবে আমি তো সেই তখন থেকে মনে মনে বলছি, 'হে অতীত কথা কও' । 
ওই অদূর তারের সীমানায়, কি এই শ্যামল রাজ্যের সীমানা? এই স্থানের বিস্তার যে কত যুগ ব‍্যাপী কে বলতে পারে? হয়তো এই স্থানে শত বৎসর পূর্বেও প্রকৃতিরই রাজ্য ছিল। সেদিন হয়তো এই স্থানে অন্য গাছের সমারোহ ছিল। গাছপালা পাল্টেছে নিশ্চয়ই , কিন্তু স্থানটি তো একই। কত বিশাল এর ব্যাপ্তি, একে এত সহজে বিচার করা যায় ? আজ থেকে এক শতাব্দী বা আরো অধিক কাল পরে, হয়তো আজ যেখানে বসে আমি লিখছি, সেখানেই খেলা করবে কিছু কিশোর কিশোরী। জানি না সেদিনও এর গোপন রূপ কারো দৃষ্টিগোচর হবে কি না, কারো চোখে পড়বে কি না। তবে যদি পড়ে, তাহলে সেও বুঝি আমারই মতন আবার লিখবে বসে সেইদিন। এ যেন এক অনন্ত প্রক্রিয়া, যেমন আমি লিখছি। আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখি সেই কবেকার এক কুঁড়ে ঘর, ছোট একফালি উঠোনটার ছবি, উনুন, অপরাহ্ন বেলায় ঘর-ফেরা কত ক্লান্ত পথিকের চলাচল। 

আজও হয়তো তেমনি অপরাহ্ন নামবে, দিনের সব আলো ফুরালে পথিকেরা ফিরে  যাবে ঘরে , নীরব রাত্রি এসে চোখে ঢেলে দেবে নিদ্রার অক্ষম কালি, পাখি যাবে নীড়ে ফিরে, তরী এসে থামবে তীরে ,দূরে দূরে নিভে যাবে ভুবনের রং , নিবিড় স্বপ্নের বিচরণভূমি হয়ে রবে জেগে এ স্থানের গোপন প্রাণ । দেখবে ধরণী তার রাত্রি জাগার আয়োজন। আর জেগে রব আমি, ওই আকাশের তারা, এ নিশীথের আলো, আর এ অসীম অনন্ত পথ।...
---- বসে দেখবো এই আমি।

 বেশ কিছুদিন পূর্বে যখন ঘাটশিলার কাছে 'ধারাগিরি'তে গিয়েছিলাম তখন সেখানকার এক অনুচ্চ জলপ্রপাত আমার মন টেনেছিল। নিবিড় অরণ্য ও তার মাঝে কত অচেনা লতার পাশ দিয়ে বয়ে চলছে জলপ্রবাহ।পরে জেনেছিলাম স্বয়ং বিভূতিভূষণ ঘাটশিলায় থাকাকালীন প্রায়ই এ স্থানে আসতেন, বসে থাকতেন আর একমনে কী ভাবতেন কে জানে! আমার কেমন যেন ঠেকল, অর্থাৎ যে পাথরটির উপর আমি বসেছিলাম, সেখানে একদিন হয়তো বিভূতিভূষণও বসেছিলেন, ভেবেছিলেন, অনুভব করেছিলেন। কতদিন হয়ে গেল, তারপর এই নশ্বর 'আমি' বসেছিলাম সেখানে। বিভূতিভূষণ না হয় বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু, তিনি ছাড়াও আরো কত কত মানুষ আমারই মত যারা অখ্যাত, তারাও কী এসে বসেনি এ স্থানে? দেখেনি এ প্রকৃতির রাজ্য? পার্থিব পরিধিকে তুচ্ছ করে দেখেনি কি, রচনা করেনি কি স্বপ্নের অমরাবতী? সেদিন যা করেছিলাম এই আমি? এখানেই শেষ নয় হয়তো আরো বহুদিন পর ও এমনি ধারা চলবে। সেই জলপ্রপাতের ইতিহাস অনন্ত। ভাবী ইতিহাস আরো অসীম। তাই বলি কোনও স্থানের পার্থিব ব্যাপ্তি তার মূল্যায়নের নির্দেশক নয়। যা দৃষ্টির অগোচরে, যা অপার্থিব ,তাই প্রকৃত মাপকাঠি। এর বিস্তার প্রত্যক্ষ করা এতোই সহজ?

 আজ থেকে বহুকাল আগে যখন হেঁটেছিলাম ভুবনের পথে, হয়তো তখন থেকেই এই দেখা আমার শুরু। কত মানুষের পরিচিতির অন্তরালে চলেছিলাম , হয়তো কোন একদিন তাদেরই উত্তরপুরুষের কাছে আদৃত হবো বলে, আমার এই অপরিচিতি বিস্মৃত হবে বলে। আজ থেকে বহুকাল আগে সেই যখন হেঁটেছিলাম, তখন থেকেই এই দেখা এই চেনা আমার শুরু। সেদিনও এই নিবিড় প্রকৃতির রূপ আমায় মুগ্ধ করেছিল। আমি বিভোর হয়েছিলাম। সর্ষে, ধানের ক্ষেতে মত্ত হয়ে ঘুরেছিলাম, ঘেঁটুফুলের পানে চেয়েছিলাম, দেখেছিলাম আরো কত!

 কত গহন অরণ্যের পথ, ভূত ভৈরবী ফুল, নিভৃতে বেড়ে ওঠা লতা, মধুপের ক্লান্ত গুঞ্জরণে ফুলের বনে , কিংবা, বসন্তের-শেষে নব সূচনার আগমনী সংগীতে অথবা ঘোর অমানিশার শেষের ভৈরব রাগের সুর-বৈভবে আমি সেই তিমিরাতীত মহাজ্যোর্তিময়কেই উপলব্ধি করেছি।
       
 নিদ্রা ভেঙ্গে উঠে দেখেছি, কত ক্ষুদ্র লতার মতো আমি আমার সমগ্র অন্তর্প্রকৃতি নিয়ে হয়ে উঠেছি আলোকগামী। নিদ্রাবৃত ভুবনের বুকে সেই হলো পরম বিস্ময়। রাত্রিকালে নিদ্রা যাওয়াই যখন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তখন কেমন করে সেই প্রবৃত্তিকে পরাভূত করা গেলো সেইটাই বড় আশ্চর্যের!

 উপনিষদে আছে:
   'আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।
ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান্ ।
আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্ত ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ।।

অর্থাৎ, এই দেহ যদি রথ হয় তবে জীবাত্মা হল সে রথের আরোহী এবং বুদ্ধি(বা বোধ)সে রথেরই সারথি। মন তার বলগা আর ইন্দ্রিয়গুলি তার চালিকাশক্তি অর্থাৎ অশ্ব। এইভাবেই  মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহচর্যে সুখ ও দুঃখ অনুভব করে থাকে আত্মা। এই রূপ চিন্তাই  করেন চিন্তাশীল মনীষীরা।

 দুঃখের কথা নাহয় এখন থাক, কিন্তু বোধ যে কীভাবে মনে সুখের সঞ্চার ঘটাতে পারে তা চেতনাপূর্ণ ব্যক্তি না হলে বোঝা একপ্রকার অসম্ভব। আজ এ স্থানে এসে তা উপলব্ধি করেছি আমি। এ আনন্দ , পথ- খোঁজার আনন্দ,পথ-চলার  আনন্দ, বিশ্বকবি যাকে বলেন : '... পথ-চাওয়াতেই আনন্দ...'

 অনেক হল পথ চলা। আরো বহু, আরো সহস্র, আরো অসংখ্য পথ। তার সীমা নেই, তার আদি অন্ত কিছু নেই। কিংবা হয়তো বিস্মৃত।
           
  এই বিচিত্র আনন্দ মকরন্দের মতোই সুপেয়। আর সেই মহাজীবনের পথই যে আমার গন্তব্য ,আর সেই মহাপথের গন্তব্য হোক আমার চিরপথ চলার সেই সুন্দর বিচিত্রতা, সেই অশেষ প্রাচুর্য। পথিক কোন কালের সেকথা অজ্ঞাত, তবু তো পথিক এ প্রাণ, কত পথ আরো পার হবে সে। হে মহাপথ, তাকে মহাপথিক কর বিশ্বমানবের কাছে। আর গন্তব্য করো আমারই কাছে। সেই হোক তার পরম জয়।

 রবার্ট ফ্রস্টের মতো আমিও বলবো:
... I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.

সাগর রানী

পৃথ্বীশকুমার দাস
(অষ্টম শ্রেণি, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন, মেদিনীপুর) 
       
আনমনেতে সাগর পারে-
চেয়ে দেখি বহুদূরে,
সাদা মেঘের পালকিতে করে
পাখিরা যায় উড়ে উড়ে।
সাগরে আজি ঢেউ উঠেছে
নৌকাগুলি পাল তুলেছে।
তাইতো আমার মনের মাঝে,
আনন্দেরই সুর বাজে।
সূয্যিমামা প্রজ্বলিত
দিগন্তে প্রায় নিমজ্জিত।
আঁধার তাই এসেছে নেমে
কোলাহলও গেছে থেমে।
পাখিরা এবার আপন কুলায়-
ফিরছে যেন মেঘের ভেলায়,
চারিদিকের নিস্তব্ধতায়
সাগর মেতেছে ঢেউয়ের খেলায়।
কি মহিমা তোমার সাগর রানী!
আসবো ফিরে দেখতে আবার এরূপখানি।।
               

 চোর

শ্রীনীলা অধিকারী  
(চতুর্থ শ্রেণি, সরোজিনীদেবী সরস্বতী শিশু মন্দির,বীরভূম)

মাখনের একটা নতুন জামা চুরি হয়ে গেছে। তাই তার মনে খুব দুঃখ। একদিন দুপুরে সে বারান্দায় বসে আম খাচ্ছে, তখন দেখতে পেল একটা কালো রোগা  লোক  সামনের পাঁচিলে উঠছে। লোকটার গায়ে তার সেই চুরি যাওয়া জামাটা। সে দেখেই চিনতে পারল। দৌড়ে সে মা’কে খবর দেয়। অমনি তার মা বাবা লোকটাকে ধরে নিয়ে আসে। তারপর মাখনের মা বাবা লোকটাকে রাজামশাইয়ের কাছে নিয়ে গেল। রাজামশাই লোকটির  নাম জিজ্ঞাসা করল  --তোমার নাম কী?  
    সেই রোগা লোকটা দাঁত বের করে খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলে, এখন দুপুরবেলা তাই --আমার নাম সোহাগ। রাজামশাই অবাক। বলে সে রকম আবার হয় নাকি! 
লোকটা আবার বলল, এখন দুপুর বেলা তাই আমার নাম সোহাগ। 
রাজা মশাই – তাহলে রাতের বেলা তোমার নাম কী? 
লোকটা – রাতে আমার নাম আদর। 
রাজামশাই – সকালবেলা? 
লোকটা – আজ্ঞে   আলিঙ্গন!
রাজামশাই – তোমার তো অনেক নাম আছে দেখছি। 
লোকটা – হ্যাঁ রাজামশাই। এই তো সেদিন খেঁদি পিসির বাড়ি থেকে দুপুরের রোদটা সুড়ুৎ করে নিয়ে এলাম যখন খেদি পিসি ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ  দেখি আওয়াজ পেয়ে উঠে বললে, এই ক্যারে? আমার ঘর থেকে রোদ  চুরি  করিস! অমনি কেউ না গো আমি আরাম! বলেই দে দৌড়।   
রাজা মশাই – মানে ! 
লোকটা ---  তারপর রাতের বেলা, মোড়ের মাথায়  মণ্ডল মশাইয়ের বাড়ি থেকে যেই একটুকরো খিদে চুরি করেছি তখনই মণ্ডল মশাই বাইরে এসে বললে , কে রে তুই হতচ্ছাড়া আমার অরুচি ধরিয়ে গেলি ! বলেই আমাকে ধরে ফেলল। আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম আমি হতচ্ছাড়া নই, আমি প্রফুল্ল। 
 তা  রাজা মশাই আমি আপনাকে আজ অনেক সত্যি কথা বললাম। অনেক চুরির কথা স্বীকার করলাম , দোষ নেবেন না। 
রাজা মশাই – সে না হয় ঠিক আছে । কিন্তু এবার তো বলো  তোমার আসল নামটা কী?  
লোকটি – এটাই তো মহা সমস্যা মহারাজ। অ্যাতো  নাম বলতে বলতে আসল নামটাই চাপা পড়ে গেছে। তবে আপনি আমাদের মা বাপ। আপনি যা  নাম দেবেন সেটাই  হবে আমার আসল নাম। 
রাজামশাই – হো হো করে হেসে ফেললেন। -- আমারও ছেলেবেলায় নাম ছিল রাজপুত্র।  তারপর সকাল থেকে বিকেল শুধুই  রাজামশাই। এখন তো আমি আমার নিজের নামটাই হারিয়ে ফেলেছি ।  এখন শুধু আমি রাজা। 
তারপর  রাজামশাই বেশ উৎসাহে বলে,  দেখি তো  কেমন বলতে পারো – আমার আসল নামটা কি?  
তখন ঐ রোগা লোকটা দাঁত বের করে খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলে, এ আর এমন কি শক্ত কাজ। দু’দিন সময় দিন আপনার নাম আপনাকে ঠিক এনে দেব।  বলেই লোকটা চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল।  

অক্কা
প্রবাহনীল দাস
(ষষ্ঠ শ্রেণি, একমি একাডেমী, কালনা, পূর্ব বর্ধমান)
 

ভিয়েতনামের ভিঞ্চিপাড়ার 
                               ভুবনমোহন ভট্ট
এবং চিনের চিন্তাপুরের 
                                চরমবিপদ চট্ট,
ভুবনজোড়া খ্যাতি তাদের 
                                জ্যোতিষ তারা মস্ত,
ভবিষ্যৎটা দেখতে তারা
                                 দারুণ সিদ্ধহস্ত৷
লোকের ভাগ্য দেখতে পেতেন,
                                 নিজের বেলায় ফক্কা!
গ্রহের ফেরে একসঙ্গেই 
                                  দু'জন পেলেন অক্কা৷

আমন্ত্রিত লেখক 
---------------------

দাদুর মাদুর 

মুক্তি দাশ 

খেলার মাঠে চলেন দাদু
মাদুর নিয়ে বগলে, 
দেখতে হবে মোহনবাগান 
জিততে পারে ক' গোলে। 
মাদুর দেখেই ধরলো ঘিরে 
পাড়াতুতো নাতির দল, 
বলল : "মাঠে দাদুর সাথে 
মাদুরেতে বসবো চল।"
"বকিস নে আর" বলল দাদু-
"বুঝিস কিই বা খেলারই,
তোদের জন্য বরাদ্দ তো
আছেই মাঠের গ্যালারি। 
চোখে ঠাহর হয় না যে আর, 
মাঠটা আবার যা দূরে! 
টেলিস্কোপে ভাবছি খেলা 
দেখবো শুয়ে মাদুরে! 

বন্ধন
সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

সেদিন আমার স্কুল ছুটি ছিল। স্কুল ছুটি থাকলেই আমি সারাটা দুপুর ছাদের ঘরে গিয়ে বসে থাকি। বই পড়ি। রেডিওতে গান শুনি। পাড়া দিয়ে কত ফেরিওলা যায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। আর একটা জিনিস করি যেটা কেউ জানে না। আমি একটা কবিতার ডায়েরি করেছি। তাতে কবিতা লিখি। যখন যা মনে আসে তাই নিয়ে লিখে চলি। অনেক কবিতা ভরে গেছে তাতে। কাউকে পড়তে দিইনি এখনও। আসলে খুব লজ্জা লাগে। তবে দুপুরটা আসলেই আমার খুব ভাল লাগে। ঐ সময়টাকে আমার একান্ত নিজের বলে মনে হয়। 

আজও খাওয়া দাওয়া সেরে আমার একলা থাকার ঘরে বসে ডায়েরিতে কবিতা লিখছিলাম। হঠাৎ দেখি ছাদে কোথা থেকে দুটো বীর হনুমান এসে হাজির। হনুমান প্রায় দিনই আসে। তবে দল বেঁধে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। ছাদ জুড়ে বাচ্চারা কত খেলা করে। বাগানের গাছের ফল পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। আমি কখনো চুপি চুপি রান্না ঘর থেকে আলু, বিস্কুট, কলা থাকলে নিয়ে এসে বাচ্চাগুলোকে খেতে দিই। কিন্তু আজ শুধু দুটো হনুমানই এসেছে, তাদের ফ্যামিলির আর কেউ নেই।

একটা হনুমান পাশের বাড়ির গাছে যেতে গিয়ে খোলা হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক তারটা গায়ে ঠেকে যায়। আর তৎক্ষণাৎ বিশাল কারেন্ট খেয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। তার অন্য সঙ্গীটা হয়ত তার দাদা, ভাই কিংবা কাছের বন্ধু। এক লাফে সে গিয়ে পাশে বসে কাঁদতে শুরু করে। তার কান্নার সাথে যেন মানুষের কান্নার কোন তফাৎ নেই। মানুষের মত হাতে পিঠে হাত বোলাতে থাকে। কানে, গালে, হাতে নিজের মুখ ঠেকিয়ে ডাকতে থাকে সমানে। খাঁ খাঁ ফাঁকা দুপুরে আশপাশে তখন কেউ নেই। কেউ দেখেনি এই বিপদের দৃশ্য। আমি চিৎকার করে পাড়া প্রতিবেশীদের ডাকতে থাকি। এক এক করে অনেক ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। হনুমানের মুখে জল দেবার চেষ্টা করা হয় কত। কিন্তু অসাড় দেহটা নিয়ে পড়ে থাকে হনুমানটা। বোঝা যায় সে মারা গিয়েছে। 

একটা ট্রলি ডেকে মৃত হনুমানটাকে তোলা হয়। অন্যটা তার সঙ্গ কিছুতেই ছাড়তে চায় না। তার দু'গাল বেয়ে নেমে আসতে থাকে কান্নার জল। পাড়ার বড় মাঠের ধারে একটা গর্ত খুঁড়ে মৃত হনুমানটাকে পুঁতে মাটি চাপা দেয় পাড়ার কাকু দাদারা। সবাই ফুল ছড়িয়ে দেয় সেখানে। আর অন্য হনুমানটা সব দেখে বুঝে কাঁদতে কাঁদতে সম্পূর্ণ মানুষের মত দু' হাত জড়ো করে নমস্কার জানায় উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে। এক চারপেয়ে প্রাণীর মানুষের মত আচরণ দেখে অবাক হয়ে যাই আমরা। 

চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরতে থাকি বাড়ির দিকে। ঠিক যে বাড়িটায় কালু মিলু দুইভাইয়ের সম্পর্ক নেই বহু বছর... মুখ দেখাদেখি - কথা বলাও নেই কতকাল, তারা দেখি একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। 

ডায়েরিটা কোলে নিয়ে লিখে রাখি - 

পশুরা নয়, মানুষ আজ সবাই বড় একা 
পশুকে দেখে মানুষ শিখুক হৃদয় বেঁধে থাকা।


জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 
কিশোরকিশোরীদের লেখা ও আঁকা ছবি পাঠান। mail- jaladarchi@yahoo.in


Post a Comment

0 Comments