জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক-১৪/অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ১৪

অসীম ভুঁইয়া

বাংলা উক্তি ও উক্তি-পরিবর্তনের মুক্তি-পথ

বাংলা ভাষায় উক্তি ও উক্তি পরিবর্তন নিয়ে হয়তো কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। আসলে মুখের ভাষা লেখার ভাষায় উঠে আসার পরই বাংলা বাক্য গঠন অনেক নমনীয় হয়ে পড়েছে। যাইহোক, আজকে উক্তি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

    বক্তার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে হুবহু প্রকাশ করা অথবা তার বক্তব্য বিষয়কে ঠিক রেখে পরিবেশকের নিজের মতো করে প্রকাশ করাকেই উক্তি বলে। 

যেমন - ১। লোকটি বলল, "আপনি বোধহয় আমার হীরার  ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করছেন না।"
২। লোকটি বলল যে, তিনি বোধহয় তার( লোকটি) হীরার ব্যাপারটি ঠিক বিশ্বাস করছেন না।
 ১ এবং ২ নম্বর বাক্যের মূল বিষয় কিন্তু একই। অথচ তা দুভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।  এই হিসেবে উক্তিও দু ধরনের-  i. প্রত্যক্ষ উক্তি এবং ii. পরোক্ষ উক্তি। 
 
প্রত্যক্ষ উক্তি:
বক্তার বক্তব্য বা কথাকে উদ্ধৃতি দিয়ে হুবহু প্রকাশ করা বা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতভাবে প্রকাশ করাকে প্রত্যক্ষ উক্তি বলে।
 যেমন:  ১। আমি বললুম, "হরিদাস মজুমদার..." ২। রমেনের মা ভয়ে ভয়ে বললেন, " আহা আবদার করেছে, খাওয়াক না।" 

   উদাহরণগুলিতে উদ্ধৃতির মধ্যে থাকা কথাটিই বক্তা বলেছে এবং আমরা তা হুবহু একইভাবে প্রকাশ করেছি।

   পরোক্ষ উক্তি: বক্তার বক্তব্যকে হুবহু প্রকাশ না করে, মূল বিষয়কে ঠিক রেখে পরিবেশকের নিজের মতো করে প্রকাশ করাকেই পরোক্ষ উক্তি বলে।
 যেমন: ১। আমি বললুম যে, হরিদাস মজুমদার।
২। রমেনের মা ভয়ে ভয়ে অথচ সহানুভূতির স্বরে বললেন যে, আবদার করেছে তো খাওয়াক না।

    এখানে মূল বিষয় ঠিক রেখে কিছুটা পরিবর্তিত করে প্রকাশ করা হয়েছে।

   উক্তি পরিবর্তন:
 প্রত্যক্ষ উক্তিকে পরোক্ষ উক্তিতে বা পরোক্ষ উক্তিকে, প্রত্যক্ষ উক্তিতে পরিবর্তন করাকেই উক্তি পরিবর্তন বলে।

    উক্তি পরিবর্তনের রীতি:
 
১।   প্রত্যক্ষ উক্তিতে বক্তার বক্তব্য যে উদ্ধৃতি চিহ্নের (" -") মধ্যে থাকে, পরোক্ষ উক্তিতে তা তুলে দিতে হয়।

২। প্রত্যক্ষ উক্তির উদ্ধৃতি চিহ্নের আগে যে খণ্ডবাক্যটি থাকে তার শেষে থাকা হাইফেন বা কমাচিহ্ন তুলে দিয়ে সেই স্থানে সংযোজক হিসেবে "যে" এবং তারপর কমাচিহ্ন বসিয়ে পরোক্ষ উক্তি গঠন করতে হয়।  তবে "যে" বা কমাচিহ্ন সবক্ষেত্রে বসানোর প্রয়োজন হয় না। যেমন:  সে বলল, "আজ মেঘ করেছে।"
সে বলল যে, সেদিন মেঘ করেছে।

৩।  আবেগ, উপদেশ, আদেশ, অনুরোধ প্রভৃতি অনুজ্ঞা বা আবেগসূচক প্রত্যক্ষ উক্তিকে পরোক্ষ উক্তিতে পরিণত করার সময় সাধারণত নির্দেশক বাক্যের সাহায্য নেওয়া হয়। অর্থাৎ অনুজ্ঞা বা আবেগের ভাবটি সরাসরি প্রকাশ করে দিতে হয়। যেমন: 
ক।  রুহি বলল, "বইটি আমাকে দিন।"- প্রত্যক্ষ উক্তি।
খ। রুহি বইটি তাকে দেওয়ার অনুরোধ করল।- পরোক্ষ উক্তি।

   কখনো আবার এধরনের বাক্য "ইছাসূচক বাক্য"  হিসেবেও পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন: রুহি বলল যে, বইটি  তাকে দেওয়া হোক।- পরোক্ষ উক্তি।

৪।  প্রত্যক্ষ উক্তি থেকে পরোক্ষ উক্তিতে পক্ষ ও তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ক্রিয়ার পরিবর্তন হয় এইভাবে:

প্রত্যক্ষ উক্তি ( পক্ষ ও ক্রিয়া)
------------------
 আমি যাব
 আমরা যাই
 তুমি বলেছ
 তোমরা এনেছ।
 আমাদের আছে
আপনারা বলুন

পরোক্ষ উক্তি( পক্ষ ও ক্রিয়া)
---------------------
 সে যাবে 
তারা খায় 
সে বলেছে 
তারা এনেছে 
তাদের আছে
তারা বলুক।

 ৫। প্রত্যক্ষ উক্তির সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ প্রভৃতিও পরিবর্তিত হয়। 

সর্বনাম: 
প্রত্যক্ষ উক্তি ( প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উক্তি পাশাপাশি রেখে দেখতে হবে)
 আমি, আমরা, আপনারা, তুমি, তোমরা, তারা, ইনি।

পরোক্ষ উক্তি:
 সে, তারা, তাঁরা, সে, তারা, তাঁরা, তিনি।

বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণ:
প্রত্যক্ষ উক্তি:
 এই, এখানে, গতকাল, ওই,  আজ, আসা হবে।

পরোক্ষ উক্তি:
 সেই, সেখানে, আগের দিন, সেই, সেদিন, যাওয়া হবে।

৬। সাধু ও চলিত ভাষার ক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষ উক্তি যে ভাষায় থাকবে পরোক্ষ উক্তি সেই ভাষায় পরিবর্তন করতে হয়। তবে যেহেতু সাধু ভাষার চল নেই, তাই এই বিষয়টি তত গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 নানা ধরনের বাক্যের উক্তি  পরিবর্তন দেখে নেওয়া যাক।
i. নির্দেশক বাক্য
প্রত্যক্ষ উক্তি:
সুনীতা জানাল, "আমি আর কোনো কাজ করতে পারব না।"
 পরোক্ষ উক্তি:
সুনীতা জানাল যে, সে আর কোনো কাজ করতে পারবে না। অথবা,
সুনীতা আর কোনো কাজ করতে পারবে না বলে জানাল।
 সে বলল, "এখানে বসে থেকে আর কোনো লাভ নেই।"- প্রত্যক্ষ উক্তি।
 সে বলল যে, সেখানে বসে থেকে আর কোনো লাভ নেই।- পরোক্ষ উক্তি।

 এবার প্রশ্নসূচক বাক্য:
 প্রত্যক্ষ উক্তি:
বাসায় পা দিয়েই বললেন, "তোদের ঘর - দোরে একটা আঁশটে গন্ধ কেন রে?"- পরোক্ষ উক্তি:
বাসায় পা দিয়েই তিনি তাদের ঘর - দোরে একটা আঁশটে গন্ধের কারণ জানতে চাইলেন। 
একইভাবে,

দিদিমা অবাক হয়ে বলেন, "এসব কী বলোতো মাসিমা?" দিদিমা অবাক হয়ে সেসব কী মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
 
এবার অনুজ্ঞাসূচক বাক্য:
 প্রত্যক্ষ উক্তি:
 বৃদ্ধটি বলল, "কাজটি আজই সেরে ফেল।"
পরোক্ষ উক্তি:
 বৃদ্ধটি কাজটি সেদিনই সেরে ফেলার আদেশ করলেন। অথবা
 বৃদ্ধটি আদেশ করলেন যে, কাজটি সেদিনই সেরে ফেলা হোক।
একইভাবে,
 "দয়া করে এক গ্লাস জল দাও।"
 এক গ্লাস জল দেওয়ার অনুরোধ করল।
 সদশয় বলল, "এভাবে কাউকে প্রতারণা করো না।"
সদাশয় সেভাবে কাউকে প্রতারণা না করার উপদেশ দিলেন। অথবা 
সদাশয় উপদেশ দিলেন যে, সেভাবে কাউকে যেন প্রতারণা না করা হয়।
 বিস্ময়সূচক বাক্যের ক্ষেত্র:
প্রত্যক্ষ উক্তি:
 সুমিত বলল, বাঃ! ফুলটি কী সুন্দর!
 পরোক্ষ উক্তি:
সুমিত বলল যে, ফুলটি ভারি/ খুব সুন্দর।
 অথবা 
সুমিত ফুলটিকে খুবই সুন্দর বলে বিস্ময় প্রকাশ করল।
 লোকটা চিৎকার করল,"সাবাস! ছেলেটি কী খেলাই না খেলল!"
লোকটি প্রশংসাসূচক চিৎকার করে বলল যে, ছেলেটি খুব ভালো খেলাই খেলল।

 ইচ্ছা সূচক বাক্য:
প্রত্যক্ষ উক্তি:
 আচার্য বললেন, "ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।"
পরোক্ষ উক্তি:
 আচার্য আশীর্বাদ করে বললেন যে, ভগবান যেন তার মঙ্গল করেন।
 অথবা
আচার্য, ভগবানের কাছে তার মঙ্গল কামনা করলেন। 

   একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, প্রশ্নসূচক, বিস্ময়সূচক, প্রার্থনাসূচক প্রভৃতি বাক্যের ক্ষেত্রে অর্থ ঠিক রেখে পরোক্ষ উক্তিতে পরিবর্তিত করতে হয়। পরোক্ষ উক্তিতে এই বাক্যগুলি সাধারণত  নির্দেশক বাক্যে পরিণত হয়। তাই অনুজ্ঞা, প্রশ্ন বা বিস্ময়ের প্রত্যক্ষ ভাবটি পরিবর্তিত হয়ে পরোক্ষে নির্দেশকের মতোই আচরণ করে।
 
   আরেকটি বিষয়: বাংলা বাক্য গঠনের বৈচিত্র্যে এবং মুখের ভাষা লেখার ভাষায় চলে আসার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উক্তির প্রথাগত ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যায়। চালু ব্যাকরণে কেউ কেউ একে ভুল প্রয়োগ বললেও বাস্তবে কিন্তু তা নয়। কারণ প্রচলিত বাস্তবতা নিয়ম ভাঙতেই পারে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments