জ্বলদর্চি

জ্বলদর্চি বিশেষ ছোটোবেলা সংখ্যা ১৭৪

জ্বলদর্চি বিশেষ ছোটোবেলা সংখ্যা  ১৭৪
সম্পাদক - মৌসুমী ঘোষ 
চিত্রগ্রাহক - রাকেশ সিংহ দেব

জীবজন্তুদের নানা মজার কথা
সুমনা সাহা
পর্ব- ৬
প্রজাপতির দেশে

দেখতে দেখতে বেশ গরম পড়ে গেল। বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ মাস এখন। লোকে কথায় বলে, ‘জৈষ্ঠের গরম কাঁঠাল পাকানো’। মানুষ তো ছাড়, পশুপাখিরাও গরমে হাঁসফাঁস করছে। ভুলু এসে বুকাইদের সিঁড়ির চাতালের ঠাণ্ডা মেঝেতে দুটো পা সামনে ছড়িয়ে শুয়ে থাকে আর জিভ বের করে হ্যা হ্যা করে নিশ্বাস নেয়। বুকাই পড়েছে, একে বলে প্যান্টিং। জিভ থেকে তাপমোচন পদ্ধতিতে শরীরের তাপ বেরিয়ে যায়। রাজিদের বাড়ির মিনির ছানারা এখন সাবালক হয়েছে। তারা বাড়িময় ছোটাছুটি করে। আর মিনি সুযোগ পেলেই রাজির পড়ার টেবিলের নিচে শুয়ে থাকে। ঘরে এসি চলে, মিনির আরাম হয়। বুকাইয়ের মা ছাদে ছোট ছোট প্লাস্টিকের বাটিতে জল রেখে আসে পাখিদের জন্য। দুপুরবেলা পা টিপে টিপে ছাদে গিয়ে বুকাই দেখেছে, মাঝে মাঝে কাক, চড়াই এসে ঐ জলের বাটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে নিচ্ছে। বুকাই, রাজি তো বটেই, মা-বাবারাও বাচ্চাদের স্কুলের সামার ভেকেশনের অপেক্ষায়। এরই মধ্যে একদিন একটা খুশির খবর এল। রাজির মা, শর্বাণী আন্টি ফোন করে বুকাইয়ের মা, মিঠুকে বলল, “আমাদের মামাবাড়িতে, মুর্শিদাবাদে খুব বড় করে বাৎসরিক মনসা পুজো হয়। তুমি তো জানো, আমরা প্রত্যেক বছরই রাজির স্কুলে গরমের ছুটি পড়লে যাই ওখানে। এবার মামা তোমাদের নিয়ে যেতে বলেছেন। বুকাইয়ের সঙ্গে তো মামার খুব ভাব হয়ে গেছে। তাই বিশেষ করে বুকাইয়ের কথা বলেছেন। চলো না, সবাই মিলে কটাদিন বেশ মজা করা যাবে?”
মিঠু বলল, “যেতে তো ইচ্ছে করছে, কিন্তু বুকাইয়ের বাপি ছুটি পাবে কিনা জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। তোমাদের মামাবাড়ির পুজো কবে?”
শর্বাণী আন্টি বলল, “মামাবাড়ির পুজোটার একটা ইতিহাস আছে। মনসা পুজো সাধারণত শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে হয়, কারণ ঐ সময়ে, মানে বর্ষাকালেই তো সাপখোপের উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু আমাদের মামাবাড়ির মনসা পুজো হয় জৈষ্ঠ্য মাসের সংক্রান্তির দিন। এবছর সংক্রান্তি পড়েছে শনিবার। আমরা কয়েকদিন আগে যাব, তাহলে চারপাশটা ঘুরে দেখতে পারব। নবাবের জায়গা, দেখার মত অনেক কিছু আছে। পুজোর আগের দিন আর কোথাও ঘোরাঘুরি চলবে না। পুজোর কাজে হাত লাগাতে হবে। পুজোর দিন গ্রামের প্রায় ১০০ লোক প্রসাদ পায় মামাবাড়িতে। পাঁঠাবলী হয় আজও পুরনো নিয়ম মেনে। মামা নিজে যজ্ঞ করেন। রবিবার বিশ্রাম করে আমরা সোমবার ফিরে আসব। ওদের স্কুল খুলবে পরের সোমবার। বাড়ি ফিরে সব গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাব। তুমি কি বলো?”
জুনের প্রথম সপ্তাহে শুক্রবার ক্লাস হয়ে বুকাইয়ের স্কুলে সামার ভেকেশন আরম্ভ হবে। সুতরাং শুক্রবার রাতের ট্রেনে কিম্বা শনিবার সকালে ওরা বেরিয়ে পড়তে পারে। তাহলে সাতদিনের ভিলেজ ট্যুর হয়ে যাবে। মিঠু বলে, “আমি তোমাকে রাত্রে জানাব।”
রাত্রে খাওয়ার টেবিলে মা যখন কথাটা তুলল, বুকাই আনন্দে একেবারে লাফিয়ে উঠল। বাপির গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করতে আরম্ভ করে দিল, “বাপি চলো না প্লিজ বাপি প্লিজ!” বুকাইয়ের আহ্লাদ দেখে বাপি রাজি হয়ে গেল। রাত্রেই মা শর্বাণী আন্টিকে ফোন করল, “হ্যালো শর্বাণী, এদিকে সিগনাল গ্রিন হয়েছে। কিন্তু ও তো অতদিন ছুটি পাবে না!”
“ঠিক আছে, রাজির বাবারও তো একই অবস্থা। তাতে অসুবিধা নেই। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে আগে চলে যাব। ওনারা না হয় পরে এসে আমাদের জয়েন করবেন?”
ঠিক হল, মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে ভাগীরথী এক্সপ্রেস-এ চাপবে। সাড়ে তিন ঘণ্টায় মুর্শিদাবাদ পৌঁছে যাবে। শর্বাণীর মামাতো দাদা স্টেশন থেকে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবেন।         

মায়েদের আলোচনা চলতে থাকে। ওদিকে বুকাই আর রাজির আনন্দ দেখে কে? বুকাইকে কি কি দেখাবে, রাজি তার অজস্র প্ল্যান করে ফেলে।
আজ ওদের স্কুলের সামার ভেকেশন আরম্ভ হল। ছুটিতে সম্পূর্ণ করার জন্য একটা সায়েন্স প্রোজেক্ট দেওয়া হয়েছে, ‘প্রজাপতির জীবনচক্র’। রাজি আর বুকাই দুজনেই খুব এক্সাইটেড। বাপি বলেছে, গ্রামে গেলে ওরা অনেক প্রজাপতি দেখতে পাবে। ওদের স্ক্র্যাপ বুক-এর জন্য অনেক ফুল, পাতা ইত্যাদি কালেকশনও করা যাতে পারে। রাজি বলেছে, ওদের গ্রামে অনেক রকমের গাছ আছে। আর একটা ছেলে আছে, সে প্রজাপতি, ব্যাঙ আর মাছ ধরতে ওস্তাদ। ব্যাগ ট্যাগ সব গুছিয়ে মিঠু আর শর্বাণী রেডি। রাজির বাবার অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাই বুকাইয়ের বাবা, রণদীপ ওদের স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবেন। তিনি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন। ট্রেন সন্ধ্যা ৬টা পঞ্চাশ-এ। ওরা পাঁচটার সময় বেরিয়ে পড়ল। মিঠু বুকাইয়ের ঠামিকে আর সন্ধ্যা পিসিকে সব কিছু বার বার করে বলে বুঝিয়ে দিয়েছে, ঠামির কখন কোন ওষুধ খেতে হবে, গ্যাস ফুরিয়ে গেলে গ্যাস অর্ডার করতে হবে, ফোন নম্বর, গ্যাসের বই আর টাকা টেবিলের কোন ড্রয়ারে রাখা আছে, আর ভুলুর জন্য ভাত রাখতে হবে, ছাদে পাখিদের বাটিতে জল রাখতে হবে, কামিনী আর বেলি ফুলের টবে জল দিতে হবে, এইসব। ঠিক সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। বাবাকে যতক্ষণ দেখা যায়, বুকাই হাত নাড়ল, তারপর ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দিলে দুজনেই উপরের বাঙ্কের দখল নিয়ে নিল। বাইরে কেবল অন্ধকার, আকাশে জুঁই ফুলের মত তারা। কু উ উ করে হুইসেল বাজিয়ে ঝিক ঝিক করে ট্রেন ছুটে চলল। 

রাজিদের মামাদাদুর গ্রামটা কি সুন্দর! রাত্রে পৌঁছে কিছুই দেখা হয়নি। এখানে অনেক বাড়িতেই ইলেকট্রিক আলো নেই। রাত্রে লণ্ঠনের আলোতেই কাজকর্ম সারা হয়। এই বাড়িতে সোলার বিদ্যুৎ আছে। তাই আলো জ্বলে, পাখাও চলে বটে, তবে আলো খুব উজ্জ্বল নয়। পাখাও আস্তে ঘোরে। কিন্তু পাখা না চালালেও হয়। ভারি মনোরম আবহাওয়া, বাতাসে স্নিগ্ধ ভাব। মায়েরা এইসব আলোচনা করছে। ছোটরা এতসব বোঝে না। তারা এই বিশাল বাড়ির নানা রহস্যময় আনাচ কানাচ আবিষ্কারে মেতে উঠল। রাত্রে শর্বাণী আন্টির মামাতো দাদার বৌ, অর্থাৎ বৌদি, আর বাচ্চাদের মামীমা অনেক পদ রান্না করেছিলেন—থোর ঘণ্ট নারকোল কোরা দিয়ে, কুচো চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ পাতার চচ্চড়ি, চুনো মাছের ঝাল, কাতলা মাছের ঝোল আর ঐ মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, কুলের চাটনি, পায়েস। ছোটরা এতকিছু খেতে পারেনি। ওরা শুধু মাছের ঝোল দিয়ে অল্প ভাত মেখে খেয়েছে আর চাটনি আর পায়েস খেয়েছে। মামাদাদু ওদের খাবার সময় দাঁড়িয়ে থেকে “বৌমা ওকে এটা দাও, ওটা দাও” করে ওদের সব কিছু পেট ভরে খাওয়ার জন্য বার বার বলছিলেন। উনি বললেন, সকালে পিছনের পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হবে। অতিথিকে গ্রামে বলে কুটুম। কুটুম এলেই নাকি পুকুরের মাছ ধরে খাওয়ানোই অতিথি সৎকারের রীতি। বুকাই মাছ ধরা দেখার উত্তেজনায় সকাল সকাল উঠে পড়েছে। একটা বিশাল বড় ঘরে, পেল্লাই একটা সেগুন কাঠের পালঙ্কে ওদের বিছানা করে দিয়েছিলেন মামীমা। সকালে ঘুম ভাঙতেই একটা মিষ্টি পাখির ডাক কানে এল। বুকাই দেখল মা বিছানায় নেই। ও গুটি গুটি পায়ে বাইরে বেরোতেই দেখতে পেল, উঠোনে একটা কাঁঠাল গাছের ছায়ার দড়ির খাটিয়ায় মামাদাদু বসে আছেন, আর গ্রামের কিছু লোক এসেছে, তাদের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন। বুকাইকে দেখেই দাদুর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, ডাকলেন, “এসো ভাই অর্কদীপ! তুমি এসেছ, আমি কি যে খুশি হয়েছি! আজ কি খাবে বলো। এরা সব এসেছে, বাজার থেকে আনাজ নিয়ে আসবে, মাছ ধরবে, তোমার পছন্দ মত রান্না হবে।” বুকাই অবাক হয়ে যায়। তার পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে বাড়িতে খুব কম দিনই রান্না হয়। একমাত্র বার্থ ডে-র দিন বাবা-মা-ঠামি সবাই তাকে খুব পাত্তা দেয়, আর জিজ্ঞেস করে, “বুকাই তোর কি চাই বল?” বুকাই একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলে, “তোমরা যা দেবে, আমি তাই খাব। স্পেশাল কিছু লাগবে না।” দাদু এই কথায় ভীষণ খুশি হন, সবাইকে ডেকে ডেকে বলেন, “শোন, এইটুকু ছেলের কেমন বিবেচনাবোধ! বলে তোমরা যা খাবে, আমিও তাই খাব! বাঃ দাদুভাই, সাবাশ! এমনই থেকো ভাই। তবে আমি তোমাকে আমার পছন্দের জিনিস খাওয়াব, কেমন?” বুকাই সাহস পেয়ে বলে, “আমি মাছ ধরা দেখতে যাব দাদু?” 
“নিশ্চয় যাবে। তোমার বন্ধুকে ডেকে নাও। আমরা এখনই বেরবো।” 
এত বড় বাড়ি। বুকাই একটু দিশেহারা বোধ করে। রাজি এখন কোথায় কে জানে? ও কিছু না জেনেই এগোয় ভিতর বাড়ির দিকে। টানা একটা বারান্দা, তার সামনে সারি সারি ঘর। একজন মহিলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বারান্দায় ঝাঁট দিচ্ছিল। পাশে রাজিরই বয়সী একটা ফ্রক পরা মেয়ে, লাল ফিতে দিয়ে চুল বাঁধা। তাকে বুকাই জিজ্ঞেস করে, “ঘরের সব লোকজন কোথায়?” বৌটা হাসিমুখে বুকাইকে দেখে বলে, “তোমরা বুঝি কাল কলকেতা থেকে এইয়েচো? সবাই রান্নাশালে। যাও না, যাও। অ্যাই গিনি, নিয়ে যা না দাদাকে।” সেই লাল ফিতে দিয়ে বিনুনী বাঁধা মেয়েটার নাম তাহলে গিনি? বুকাই গিনির পিছন পিছন অনেকটা হেঁটে বাড়ির শেষ প্রান্তে একটু দূরে আরেকটা বড় হলে পৌঁছল। এখানে কিচেন ঘরের ভিতরে নয়, বুকাই মনে মনে ভাবল। গিনির সঙ্গে সেই বড় ঘরে ঢুকে দেখল, মা, আন্টি, মামীমা সবাই রয়েছে, রাজিও। কাঠের পিঁড়িতে বসে তারা স্টিলের গ্লাসে চা খাচ্ছে। বুকাই বলল, “মা আমাকে ডাকলে না কেন?” মা বুকাইয়ের মাথার চুল আঙুল দিয়ে বিলি কেটে আঁচড়ে দিয়ে বলল, “এই তো এসে গেছিস, আয়, বোস।” দিদিমা লুচি বেলছে, মামীমা কড়াইতে লুচি ভাজছে। আরও দুজন মহিলা কুটনো কুটছে, বুকাই তাদের চেনে না। রাজি বলল, “তুই এখানে একা একা এসে গেলি?” দিদিমা বলল, “ঝিনির মেয়ে নিয়ে এসেছে ওকে।” একটা কাঁসার থালায় করে বড় বড় ফুলকো লুচি গরম গরম ভেজে বুকাই আর রাজিকে দিল মামীমা, সঙ্গে ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর তরকারি, আর ইয়া বড় বড় রাজভোগ। বুকাইয়ের মনে হল, ও যেন হিস্ট্রি বইতে যেমন জামিনদারের ছবি থাকে, সেইরকম হয়ে গেছে। দিদিমা বুকাইয়ের চোখে বিস্ময় লক্ষ্য করে বলল, “এঁদের পূর্বপুরুষ নবাবের সেরেস্তায় কাজ করতেন কি না, তাই নবাবী চলে গেলেও নবাবী চাল মরেনি। এমন কাঁসার থালায় তো তোমরা কলকাতায় খাও না, তাই না? তোমাদের সব হালকা বাসন। সেই ভাল। এত ভারি বাসনকোসন শহরে কেউ ব্যবহার করে না।” বুকাই খেতে খেতে রাজিকে ফিসফিস করে বলল, “মামাদাদুরা মাছ ধরতে যাচ্ছে, আমরাও যাব সঙ্গে, চটপট খেয়ে নে।” খাওয়া শেষ করতেই মামীমা ওদের হাতে ধরিয়ে দিল এক গ্লাস চা। মিঠু বলল, “ওরা ছেলেমানুষ। ওদের চা দেবেন না।” মামীমা হেসে বলল, “চা প্রায় দুধই বলতে পারো। একদম খাঁটি গরুর দুধে চা, এক আধবার খেলে কিচ্ছু ক্ষতি হবে না।” বুকাই আর রাজি খুব খুশি, নিজেদের কেমন অ্যাডাল্ট মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সেই মহিলা, গিনির মা ঝিনি এসেছে, গিনি মায়ের কানে কানে বলছে, “মা আমিও যাব ওদের সাথে?” দিদিমা পারমিশন দিল, “গিনিও যাক ওদের সঙ্গে। গিনি, ওদের বাড়ির আশপাশ ঘুরিয়ে দেখাস তো মা! বেশিদূর যাবি না কিন্তু। 
মিঠু একটু আপত্তি তুলল, “সবে কাল রাত্রে এসেছি, বুকাই একটু ঘরে থেকে বিশ্রাম করো না? এখন আবার রোদের মধ্যে কোথায় ঘুরে বেড়াবে?” শর্বাণী আন্টি ছোটদের সহায় হল, “চিন্তা কোরো না মিঠু, চারদিকে চেনা লোকজন আছে। গিনি সঙ্গে আছে, মামাদের সঙ্গেই থাকবে ওরা। রোজ রোজ তো আসা হবে না। একটু গ্রাম ঘুরে দেখুক না? এই কদিন আর বেশি শাসন কোরো না।”
তিনটে বাচ্চা প্রজাপতির মত উড়ে গেল। যেতে যেতে বারান্দার পাশে পেয়ারা গাছের ডালে বুকাই দেখল সুন্দর একটা হলদে ডানার পাখি। আর পাখিটা ওদের দেখে ডেকে উঠল, “টি ট্টিটিউ টিউ টিউ!” বুকাই মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওটা কি পাখিরে?” গিনি পাকা গিন্নির মত বলল, “জানোনি? ও তো ইষ্টিকুটুম পাখি। বাড়িতে কুটুম এয়েচে না? তাই তো ডাকচে অমন করে!”
(ক্রমশ)

বোশেখ এলো
সুব্রত চৌধুরী

বোশেখ এলো, বোশেখ  এলো বাজে কাঁসর ঢাক
নতুন দিনের ছোঁয়ায় সবাই খুশির রেণু মাখ।
গাছের ডালের ফাঁকটি গলে সূর্যি মারে উঁকি
নববর্ষে খোকার  মনে খুশির উঁকিবুকি।
নতুন জামা গায়ে খুকু ফুলের মালা গলে
ঝুমুর ঝুমুর নেচে বেড়ায় পায়ে রুপোর মলে।
নাগরদোলায় চড়ে খুকু শূণ্যে ওঠে দোলে
হাততালিতে মেতে ওঠে ধিতাং ধিতাং বোলে।
বোশেখ এলো, বোশেখ এলো আম কাঁঠালের গন্ধে
মধুর লোভে মৌপিয়াসি উড়ে বেড়ায় ছন্দে।
বাড়ি বাড়ি রান্নার হাঁড়ি পান্তা ইলিশ সর্ষে
তাক ডুমা ডুম ঢাকের তালে মাতে সবাই হর্ষে ।
শুভশ্রী সরকার
শতদল বালিকা বিদ্যায়তন
নবম শ্রেণি
উত্তর ২৪ পরগণা
উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে বাসবদত্তা কদম

শেষ পর্ব ওয়াশিংটন মনুমেন্ট কে দেখে আমরা এগিয়ে চললাম- আমাদের এবারে দেখার লিস্ট ছোট হয়ে আসছে।
এরপর লিঙ্কন মেমোরিয়াল। 
ওয়াশিংটন মনুমেন্ট আর লিংকন মেমোরিয়াল যেন একটি উঠোনের দুটি প্রান্ত। যার মাঝখানে একটি জলাশয়। এখানে শুনলাম যাকে বলা হয় রিফ্লেকশন লেক। যখন ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালকে ছাড়িয়ে এগিয়ে আসছি লিংকন মেমোরিয়ালের দিকে, রিফ্লেকশন লেকের জলে তখন লিংকন মেমোরিয়াল।
সাদা ধবধবে মার্বেল পাথরে তৈরী লিংকন মেমোরিয়ালে তখন অজস্র মানুষ। সিঁড়ি বেয়ে বেশ খানিকটা উঠতে হয়। আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট লিংকন সেখানে বসে আছেন জর্জিয়ার মার্বেল পাথরের সিংহাসনে। 
শোনা যায় অতি দরিদ্র ঘরে জন্ম লিংকনের। নিজের প্রচন্ড চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিলেন। ১৮৬১ সালে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৮৬৫ তে আততায়ীর হাতে তাঁর মৃত্যু। 
এই মেমোরিয়ালের সামনের যে উঠোন, যাকে আমেরিকার মানুষ বলেন প্লাজা, সেখানে দাঁড়ালেই দেখা যায় সেই রিফ্লেকশন লেকে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের ছায়া। তখন সূর্য মাথার উপর থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলছে। জল ছেড়ে রাজহাঁসগুলো উঠে আসছে ডানা ঝাড়তে ঝাড়তে। ওদের বাড়ি যাবার সময় হয়েছে মনে হলো। যদিও লিংকন মেমোরিয়ালের মেমোরিয়াল রুম থেকে সিঁড়ি তখনো লোকে লোকারণ্য। 
এ শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র সরকারি দপ্তর, ট্রেজারি হাউস, বিভিন্ন মিউজিয়াম। 
এবার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আমাদের ফিরতে হবে।
ফেরার পথে দাদা তার ইউনিভার্সিটি চত্তরে নিয়ে গেল। মারিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি চত্তরে একটি কফিশপে কফি আর ক্রোশেন্ট খেয়ে আমাদের পেট খানিকটা ঠান্ডা হল। বাইরে অবশ্য তখন বেশ হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। 
কিং অব প্রাসিয়ায় ফেরা হলো যখন, তখন বেশ রাত। হাতে আর মাত্র তিনদিন সময় তখন আমাদের। তারপরেই ফেরার পালা। মাঝের দুদিন আড্ডা আর মার্কেটিং করেই কেটে গেল। লম্বা ছুটির পর হিউস্টনে ফেরার পালা। 
আবার দাদা আমাদের নিয়ে সওয়ারি হল। আমরা ফিলাডেলফিয়া পৌঁছে এয়ারপোর্টে ঢুকলাম। দাদাও সঙ্গে সঙ্গে বেশ খানিকটা এলো। আমেরিকায় যারা সি অফ করতে আসেন তারাও যাত্রীদের সঙ্গে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত আসতে পারেন। 
এরপর আমরা একেবারে সুরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়লাম যখন, সেখানে দাদার যাওয়ার অনুমতি নেই। প্লেনে উঠে বসার পর বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে প্লেন আর ছাড়ছে না, তারপর এক মারাত্মক ঘোষণা, ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্টে আগুন ধরে গেছে তাই সব প্লেনকে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো অনেকক্ষণ পর্যন্ত। যাত্রী সুরক্ষার স্বার্থে, আমাদের ফোন অন করার কোনো অনুমতি নেই। কিছুতেই বুঝতে পারছি না দাদারা কেমন আছে, সুস্থভাবে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে পেরেছে কিনা! এর বেশ খানিকক্ষণ পর প্লেন চালু হল। হিউস্টন পৌঁছাতে কয়েক ঘন্টা। পৌঁছে প্রথম কাজ ছিল, দাদাকে ফোন। শুনলাম ওরা বেরিয়ে গেছে জানতেও পারেনি আগুন লাগার ঘটনা। বাড়ি গিয়ে শুনেছে, কিন্ত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি কিছুতেই। 
এর ঘন্টাখানেক পর এয়ারপোর্ট ট্যাক্সি আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিল। এভাবেই শেষ হল নায়েগ্রা, ফিলাডেলফিয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন বেড়ানো। এরপর গেছিলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, কলোরাডো, লাস ভেগাস। সেসব অন্য বেড়ানো, তার গল্প আবার হবে অন্য কোনো সময়।
চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা

ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
শ্রীকান্ত অধিকারী
পর্ব - ৪৩


এরপর চোখের সামনে যা ঘটল জন্ম জন্মান্তরেও ওরা ভুলবে না। একটা পরিকল্পনা করেছিল বটে, তবে সেটা অফিসিয়ালি বিভিন্ন জেনারেল রেড বা কোনো স্পেশাল অভিযানের ক্ষেত্রে যেমন করতে হয় সেই রকমই ছেত্রী ম্যাডাম এবং সেরগিল সাহেব করে ছিল। লোকাল লেপচা লেবার এবং কিছু চাষি জোগাড় করে ছিল। মেষ বা চমরীপালকের দলকে, যারা এই পাহাড়ি বুনো এলাকায় খোলা ঘুরে বেড়ায়, তাদেরকেও বাদ দেয়নি। নেকড়ে ভল্লুক বা লেপার্ড কিংবা বুনো কুকুরদের আক্রমণকে থোরাই কেয়ার করে। তাদের কাছে হিমালয়ন রেঞ্জের ভয়ঙ্কর পাহাড় কিছু না। ভূমিপুত্র হিসেবে বন্য প্রাণীগুলোও সমঝে চলে। 
ফারমিং নেকড়ে কিংবা বাইরে থেকে নিয়ে আসা নেকড়েদের এক প্রকার জাত চেনার জন্যই এতক্ষণ ধরে এই ধুসর বিভীষিকার আতঙ্ককে সামনে থেকে দেখতে হবে এটাই পূর্বনির্ধারিত। তাই সবাই সজাগই ছিল। তবে একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল যতক্ষণ না আক্রান্ত হচ্ছে ততক্ষণ যেন গুলি চালানো না হয়। অর্থাৎ কোনক্রমে জীবন্ত ধরতেই হবে। সিক্কিমকে তার কলূষিত মুক্ত করতেই হবে। তা না হলে একদিকে সেরগিল ছেত্রী ম্যাডাম তথা সিক্কিম পুলিশের  মাথা কাটা যাবে সারা ভারতবর্ষের কাছে, অন্য দিকে ইতিহাস বিমুগ্ধ লেপচা জনজাতির ঐতিহ্য কালিমালিপ্ত হবে। 
এর জন্য কোনো ভাবেই আলগা করে নেননি সেরগিল সাহেব। রেখেছেন দীপকবাবুকে , রেখেছেন মঙ্গন পুলিশ স্টেশনের কয়েকজন প্রশিক্ষিত রিজার্ভ ফোর্স কনস্টেবলকেও। 
কিন্তু তাদের সবার চিন্তা ভাবনা এবং বিশ্বাসকে চমকে দিয়ে রাতের ঘন অন্ধকারে যা ঘটে গেল তাদের ধারণার বাইরে। 
সেরগিল সাহেব শবনম ছেত্রী ম্যাডাম এবং দীপকবাবু সকলেই যখন উৎকণ্ঠায় নিজেদের মধ্যে এক স্তব্ধ মুহুর্তের জন্য সচকিত, ঠিক তখনই সেরগিল সাহেব হিসহিসিয়ে বলেন -চুপ। তারা আসছে। 
বলতে না বলতেই খুব বেশি দূরে নয় সামনের এলাচ ঝোঁপের পাশে রুমেক্স গাছের আড়াল থেকে এক জোড়া আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসে,- ধীরে ধীরে। ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সেরগিল সাহেব প্রথমে বুঝতে পারেন নি-কি এটা ? একটা চলন্ত পাহাড়! ধুমসো আকৃতির। এ তো বিশাল আকারের নেকড়ে! কিংবা ভালুকও হতে পারে। 
দম বন্ধ করে থাকে, প্রাণীটির নড়ন চড়ন লক্ষ করে আরো কিছুক্ষণ। 
কিন্তু না,প্রাণীটি কোনো ভাবেই এগিয়ে আসছে না। এমন কি কোনো ভয়ঙ্কর ডাকও ডাকে না। দীপকবাবুর এই বুনো জন্তুদের মুখোমুখি অভিজ্ঞতা একবারেই নেই। সেরগিল সাহেবের কথার টানে এবং কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের লোভে এসেই পড়েছে, কিন্তু এমন হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। সামনের প্রাণীটিকে একবার ভল্লুক জাতীয় বা গন্ডারের সম গোত্রীয় মনে হল, কিন্তু সেরগিল সাহবে বার বার বলে দিয়েছেন, এখানে ঐ সব জন্তু জানোয়ারের উপস্থিতির কোনো রিপোর্ট এখনো পর্যন্ত সিক্কিম বন দপ্তর এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশানাল পার্কের তরফ থেকে আসেনি। কাজেই আবার অপেক্ষা এবং উৎকণ্ঠা! 

🍂

কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আগেই আরো কয়েক জোড়া ঐ আগুনে তীব্র ভাটাগুলো এক এক করে ওই বিশাল আকারের ভাটার কাছাকাছি এসে পড়ে। তারপর চোখের নিমেষে সেই আগুনে বিন্দুগুলোর বীভৎস কারিকুরি আঁকাআঁকি শুরু হয়। কখনো চারটে তো কখনো আরো বেশি ফুটকিগুলো সেই বড় বিন্দুদুটোর কাছাকাছি এসে চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। 
হতভম্ব হয়ে সেই আঁকা আগুনের রৈখিক চিত্রের কারসাজি দেখতে দেখতে ওরা খেয়ালই করেনি যে ঐ আগুনে বিন্দুগুলো ওদের খুব কাছেই এসে পড়েছে। ভাল করে দেখতে পাওয়ার জন্য জোরালো আলো ফেলবে কিনা, এক কনস্টেবল জিজ্ঞেস করার আগেই ওদের বুক চিরে শাক্যং পেন্টঙ্গের গাঁ থেকে আপার জঙ্গু ছাড়িয়ে থোলুঙ শৃঙ্গের চার দিকে ভেসে বেড়ায় সেই প্রাণ সংশয়ী জান্তব উল্লাস—খ্যাক খ্যাক খ্যাক ক্ক ক্কু কুকু---। সঙ্গে আরো হিংস্র উল্লাসের ভিন্ন ভিন্ন চিৎকার। মাঝে মাঝে আতঙ্কিত এবং যন্ত্রনাদীর্ণ ডাক-উম উম উম্ব! 
একসঙ্গে এতগুলো বীভৎস কান্ড ঘটে চলেছে অথচ সেভাবে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। পাহাড়ের আড়ালে থাকা সেই সব আতঙ্কিত মানুষগুলোর চেতনার জ্ঞান ধারণার বাইরে। অথচ এটা অলৌকিক কিছু নয়, একেবারে বাস্তব। 
কেউ কারোর সঙ্গে কোনো কথা নেই। শুধুই থ্রিলার সিনেমার পৈশাচিক উল্লাসের দর্শক! কিন্তু সেখানে নিজের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই, কিন্তু এখানে পলে পলে বিপদ। যে কোনো মুহুর্তে ওই হিংস্র জন্তুগুলো …আবার আবার সেই চিৎকার। ভিন্ন ভিন্ন। দীপকবাবু খেয়াল করেন,  কোনো এক ধরনের জন্তু নেই, আছে তিন বা তারও বেশি প্রকারে। তবে একটা মাত্র বড় আকারে জন্তুর চোখগুলো বেশি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে হুম হুম্ব হুম্ব করে চাপা গোঙানিও পরিবেশকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। 
বাতাস ক্রমে তীব্র হচ্ছে। গাছের শাখা প্রশাখা দুলে উঠছে। এরই মাঝে চলছে সেই মহা যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আরও বেশ কয়েক নারায়নী সেনা, প্রধান সেনাপতির আদেশের অপেক্ষায়। -বন্দুক চালাও! তির চালাও! বর্শা ছোঁড়ো। পাকড়াও সব কো। জানে না পায়! 
কতক্ষণ এমন বীভৎস কান্ড চলত কে জানে, হঠাৎ এক ঝাঁক পাথর গড়িয়ে পড়তে শুরু করে ঐ জন্তুগুলো যেখানে ছিল সেই দিকে। 
সেরগিল সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আরেক উপদ্রব! কী করবেন, ওই লেপচা লেবার বা চাষিদের লেলিয়ে দেবেন, না বন্দুকধারী কনস্টেবলদের। না ওরা নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের ওপর। যেন তেন প্রকারে ধরতেই হবে।
(ক্রমশ)
জয়দীপ সাহা
অষ্টম শ্রেণি, সোদপুর হাই স্কুল, উত্তর ২৪ পরগণা

Post a Comment

0 Comments