জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /দ্বাদশ পর্ব/মলয় সরকার

কিয়োটো রেলওয়ে স্টেশন

উদয়ের পথে
দ্বাদশ পর্ব
মলয় সরকার


পরদিনই আমাদের হাকোনে ছেড়ে যাওয়া। মনটা তো খারাপ হয়ই। একদিনের মায়াতেই কষ্ট হচ্ছে।হায়া নদী যখন পেরিয়ে আসছি তখন যেন তার চোখেও জল দেখলাম, ঝরে চলেছে অনবরত। পিছনে পড়ে রইল জাপানের শৈলপুরী ছোট্ট পুতুলের মত হাকোনে। আর ধরা রইল আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় তার কিছু সুন্দর ছবি।

হাকোনে থেকে আসা হল সেই জংশন ওডাওরাতে। সৌভাগ্য, রেলের টাইম টেবল বা কিছু কিছু লেখা ইংরাজীতেও দেয়।সেই দেখেই আমাদের যা কিছু দৌড়। এখান থেকে যেতে হল আলাদা প্ল্যাটফর্মে , একটু আলাদা জায়গায়। আসলে, এখানে তো স্পীডি ট্রেন, আর সাধারণ ট্রেনের লাইন সম্পূর্ণ আলাদা, তাতে শুধু ঐ ট্রেনই চলে, তাই সেই ট্রেন ধরতে গেলে তাদের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মেই যেতে হবে।
হাকোনের ধার ঘেঁসে চলা হায়া নদী

আর এই বুলেট ট্রেনগুলো একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে চলে, একটু এ[পাশ ওপাশ হওয়ার যো নেই।এই ট্রেনে সর্বোচ্চ গতি ওঠে ৩২০ কিমি প্রতি ঘণ্টায়।শুনেছি ট্রেন অল্প দেরী হলেও তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হয় যাত্রীদের ,এই ট্রেন কোম্পানীর পক্ষ থেকে। সঠিক জানি না।

নটি রুটে চলে এই ট্রেন । এদের বলে শিঙ্কান্সেন লাইন।১৯৬৪ সালের ১ লা অক্টোবর, এই ট্রেন প্রথম এখানে চালু হয়। টোকিও আর ওসাকার মধ্যে।তবে শুনলাম, এটাও নাকি ওদের দেশের সর্বোচ্চ ট্রেনের গতি  নয়। তার গতি এরোপ্লেনের সমান ৬০৩ কিমি প্রতি ঘন্টায়। শুনেই চমকে উঠলাম। তার নাম নাকি ম্যাগ্লেভ ট্রেন (Maglev)। চীনের সাংহাইতেও চলে ওই ম্যাগ্লেভ ট্রেন। যদিও সাংহাই গিয়েছি, তবে সেই ট্রন দেখার সৌভাগ্য হয় নি।সেগুলি অবশ্য আমাদের বাঁধা ধ্যানধারণার সাধারণ ট্রেনের মত নয় , অনেক তফাত তার সঙ্গে।

চোখের পলক ফেলতেই ট্রেন এসে হাজির হয় প্ল্যাটফর্মে। আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ট্রেন ভ্যানিশ।

আমাদের ট্রেনের (হিকারী এক্সপ্রেস)সর্বোচ্চ গতি দেখলাম ২৮৫ কিমি প্রতি ঘণ্টায়।ঝড়ের গতিতে কথাটা আমরা যে বলি, সে তুলনা এখানে ‘ফেল’ করে যায়। ঝড় বা বাতাস এত গতিতে যায় না কখনও। এদের জন্য তুলনা দিতে বলতে হবে শব্দের গতির মত।
কিয়োটো টাওয়ার

যাই হোক, এরা যে সূর্যের আলোকেও পায়ে শেকল পরিয়ে কাজ আদায় করছে, তারও নমুনা দেখলাম, সারা রাস্তায়।সোলার প্যানেলে ভর্তি।যে দেশ প্রকৃতির কাছ থেকে যত কাজ আদায় করতে পারবে, সেই দেশ তত এগিয়েই তো যাবে।এই রাস্তায় প্রচুর ফ্যাক্টরী দেখতে পেলাম।এই সমস্ত ফ্যাক্টরীর তৈরী জিনিসপত্রেই সারা পৃথিবী কাঁপাচ্ছে ওরা।আর একটা জিনিস এখনও দেখতে পাই নি, তা হল খোলা ট্রাক এখানে নেই। অবশ্য আমি আমেরিকা ছাড়াও আর কোন দেশেই এই খোলা ট্রাক দেখেছি কিনা মনে পড়ে না। অথচ আমাদের দেশে ঢাকা ট্রাকই চোখে পড়ে না, খোলা ট্রাক দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। 

কেন এটা হয়? ওরা পারলে আমরা পারি না?  না, এগুলোতেও আমরা কেন পিছিয়ে!

রাস্তায় দেখলাম অদের দেশের সব বাড়ির মাথা ঢালু। হয়ত, দেশে অনেক জায়গাতেই বৃষ্টি আর বরফ পড়ে , তাই হয়ত এই ব্যবস্থা।
রাস্তায় যেতে যেতে দেখি, প্রচুর সরু সরু বাঁশের ঝাড়।এখানে তিন রকমের বাঁশ বেশি বিখ্যাত Hachiku, mōsōchiku,এবং madake।এর মধ্যে মাডাকে বাঁশই সবচেয়ে শক্ত। এখানে বাঁশকে শক্তি, সমৃদ্ধি ও সরলতার প্রতীক বলে মনে করা হয়।কিয়োটোর আরাসিয়ামায় বাঁশের ঝাড় পৃথিবী বিখ্যাত। সেখানে ছবি তোলার জন্য বহু মানুষ যায়।

৪ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটে ৩৮০ কিমি রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছালাম কিয়োটো। এখানে সমস্যা, স্টেশন থেকে বেরোনোর পথ অনেক।তাই চিন্তা হচ্ছিল। কারণ ছেলে বলেছিল, একদিক দিয়ে বের হলে, হোটেল একেবারে কাছেই, আর একদিক দিয়ে বের হলে হোটেল বেশ দূরে। তাই একটু খুঁজে নিয়ে সঠিক গেট দিয়ে বের হলাম। কিন্তু ,যদিও হাঁটা পথ, মালপত্র নিয়ে তো আর হেঁটে যাওয়া যাবে না।টোকিও, হাকোনের পর এই কিয়োটোই আমাদের জাপান ঘোরার শেষ পর্ব।আসলে আমাদের লক্ষ্য ছিল জাপানের তিন যুগের তিন রাজধানী দেখা। প্রথমটি হল কিয়োটোর কাছে নারা, দ্বিতীয়টি কিয়োটো আর তৃতীয়টি বর্তমানের টোকিও।তার মধ্যে প্রথমটি দেখে আমরা দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি দেখতে এসেছি।

এখানে যে হোটেলটায় উঠেছি সেখানে সবই অটোমেটিক ব্যবস্থা। তার রিসেপশনেও কেউ ইংরাজী বোঝে না। সবাই ওই ট্রান্সশ্লেটরের মাধ্যমে কথা বোঝে।সত্যিই একটা দেশ ইংরাজীকে সম্পূর্ণ বর্জন করে কেমন তরতর করে এগিয়ে চলেছে, আর আমরা স্বদেশী ভাষা বিসর্জন দিয়ে গোটা দেশকে আবার সেই বিদেশী ভাষা শেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছি, এবং নিজের ভাষাকে ভুলে যাওয়ার মধ্যে আনন্দ প্রকাশ করছি। হায়রে পোড়া ভারত!  এ দেশটা যেন পৃথিবীর পদতলে থাকার জন্যই জন্মেছে।আজও রাষ্ট্রনেতারা জোর করে দেশকে সকলের পদানত করে রাখার চেষ্টাতেই ব্যস্ত।যারা এর বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের হারিয়ে যেতে হবে নেতাজীর মত ভাগ্যহত হয়েই!

🍂

এখানে রুমে চা কফি তৈরীর কেটলি দেওয়া আছে, আর ঢোকার মুখে যত খুশি চা, কফি পাউচ বা আইসক্রিম খাওয়ার জায়গা আছে।তবে তাদের মান কিন্তু মোটেই খুব নিম্ন মানের নয়,বরং বেশ ভালই।


আমরা আজ সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলাম।স্টেশনটা সত্যিই সামনেই। বিশাল স্টেশন। এদের এখানে সমস্ত কিছুই যেন কেমন স্টীল দিয়ে তৈরী মনে হয়। স্টেশনটাও তাই যেন।যাই হোক, আমরা স্টেশনের কাছেই কিয়োটো টাওয়ারে উঠলাম, বেশি উঁচু নয়।মোট ১৩১ মিটার উঁচু এই টাওয়ার। ১৯৬৪ সালে , যে বছর টোকিও ওলিম্পিক খেলা হয়, যে বছর প্রথম শিঙ্কানসেন বা বুলেট ট্রেন চালু হয়, সেই বছরেই এটি চালু হয়। এটি শুধু টাওয়ার নয়। এর ভিতর অনেক খাওয়ার দোকান, পাবলিক বাথ, নানা ধরণের দোকান ইত্যাদিও রয়েছে। এতে একটি অবজারভেশন ডেক আছে, যা টাওয়ারকে চারিদিকে ঘিরে রয়েছে। এর আগে অবশ্য অনেক টাওয়ারেই উঠেছি, যেমন, আইফেল টাওয়ার বা ভেনিসের সেন্ট মার্কোস স্কোয়ারের টাওয়ার, বা সিয়াটেল টাওয়ার বা ক’দিন আগের টোকিওর গভর্ণমেন্ট বিল্ডিং টাওয়ারে। তবে এগুলোতে উঠলে একটা অন্য রকম বোধ হয়। এখান থেকে চারিদিকে শহরটাকে দেখতে বেশ ভালই লাগে।
জাপানের হোটেলের ট্র্যাডিশনাল নিয়মে খেতে বসার নীচু টেবিল ও বেঞ্চ

এখানেও একই কথা রাস্তায় কোথাও ডাস্টবিন দেখিইনি প্রায়, আর তা সত্বেও চারিদিক ঝকঝকে পরিষ্কার।
এখানে কিন্তু বিদেশী পর্যটকও দেখলাম বেশ কিছু। ভারতীয়ও দেখলাম ঘুরছে, তবে তারা সবই দক্ষিণ ভারতীয়।

রাতে খেতে গেলাম একটি হোটেলে।  সেখানে খাবারের দাম মেনু কার্ডে দেওয়া আছে।আমরা খাবার পছন্দ করে চাইলাম। ওরা আমাদের আপ্যায়ণ করে খাবারের আগে এপেটাইজার হিসাবে কিছু খাবার দিল।বাকী খাবার মোটামুটি।
 দাম দিতে গিয়ে দেখি চোখ কপালে। তারা এপেটাইজারের বিশাল এক দাম জুড়ে দিয়েছে। দেখে তো আমাদের খুব রাগ হল। আমরা বললাম, আমরা যা চাই নি , তোমরা দিলে কেন, বা যদি দাম জুড়বে, কোথাও দাম উল্লেখ কর নি কেন?ওরা বলল, খেয়েছেন যখন দাম দিতে হবে। শেষে আমরা বললাম, আমরা তোমাদের নামে কমপ্লেন করব। তাদের ম্যানেজার তখন দৌড়ে এসে, সব দাম বাদ দিয়ে দিল আর খুব ক্ষমা চাইল। 
ভাবলাম, তাহলে চুরি এখানেও হয়।চোখ কান খোলা না থাকলেই, মানুষ ঠকাবে। আসলে খারাপ আর ভালর এই মিশ্রণ সারা পৃথিবীতেই আছে।কোথাও বেশি কোথাও কম।নিছক ভাল কি আর কেউ হতে পারে! দেশের খারাপ ভাল দুটো দিকই দেখতে হবে।

আরও এগিয়ে চলুন আমার সাথে। শেষের পর্ব হলেও এখনও রয়েছে অনেক বাকী। সঙ্গে থাকুন-

ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments