জ্বলদর্চি

সূর্য নন্দী (শিক্ষক, সম্পাদক, কবি, প্রবন্ধকার, দাঁতন) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৪
সূর্য নন্দী (শিক্ষক, সম্পাদক, কবি, প্রবন্ধকার, দাঁতন) 

ভাস্করব্রত পতি

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার দাঁতনের তকিনগর গ্রামে কবি সম্পাদক সূর্য নন্দী'র জন্ম ১৯৫৫ সালের ১ মে। বাবা হীরালাল নন্দী এবং মা শান্তবালা দেবী। সূর্য নন্দীর শৈশব কৈশোর কেটেছে গ্রামে। সাত ভাই এক বোনকে নিয়ে তাঁদের পরিবার। ১৯৭৩ এ বাবার প্রয়াণ ঘটে। প্রচও অর্থাভাবে জেরবার গোটা পরিবার। বাবার প্রতিষ্ঠিত হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট থেকে উপার্জনই একমাত্র সম্বল সংসারের ঘানি টানার রসদ হিসেবে। একদিকে দোকানের কাজ। অন্যদিকে ছড়া লেখার মরিয়া প্রয়াস। যে হাতে স্ক্রচ বাইট দিয়ে দোকানের এঁটো বাসন ধোওয়ার কাজ করতেন, সেই হাতেই উঠে আসতো কলম তুলি, রঙ, পেনসিল। কবিতা লিখতেন, ছড়া লিখতেন, ছবি আঁকতেন। এসবের মধ্যেই চলত দেদার পড়াশুনা। স্কুলজীবন থেকেই কবিতায় হাতেখড়ি। ১৯৭২-১৯৭৩ সালেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে লেখা। জেলা বা রাজ্যব্যাপী প্রতিযোগিতায়, এবং স্কুলেও লেখার জন্য পেতে শুরু করেন পুরস্কার। এ এক অনন্য কৃতিত্বের প্রদর্শন। এরকম অনুপ্রেরনা পেতে পেতে সৃজনমুখী হয়ে উঠতে শুরু করলেন কিশোর কবি। তখনকার দুঃসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের কথা ভাববার, দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করবার উৎসাহ ও প্রেরণা পেতেন বাবার কাছ থেকে। পাশাপাশি বামপন্থী চিন্তাধারায় প্রানিত হতে থাকেন। নিজস্ব চিন্তা ভাবনায় বামপন্থী রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে অচিরেই। পাশেই সুবর্ণরেখা। ছলাৎ ছলাৎ জলের ঢেউয়ে কবির কলমে উঠে আসে --
'চেয়েও ছিলাম আমি 
সুবর্ণরেখার জলে ভেসে যেতে, 
মাটিতে মানুষে মিশে যেতে ওই যে একটি দুটি পাখি তাদের মতো আকাশটা ছুঁতে, দ্যুলোকের দিকে যেতে'। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ, বি এড করেছেন। এরপর দাঁতন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য যোগ দেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। কিন্তু কাজে ফাঁকি নেই। নিজের সম্পাদিত 'এবং সায়ক' পত্রিকার ৫০ তম বর্ষের সংখ্যা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত। যে পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় উঠে এসেছে মেদিনীপুরের কথা। এখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্যের কথা। নিজের কাজ সম্পর্কে সূর্য নন্দী বলতে পারেন, 'আমি ইতিহাসকার বা ঐতিহাসিক নই। বলা যায় ইতিহাসপ্রেমী। আমার জন্মভূমির ইতিহাস খুঁড়ে খুঁজে পেতে আমি খুবই আগ্রহী। আমি যেখানে বাস করি, তার অতীত মাহাত্ম্য জানতে পারা আমার কাছে আনন্দের ও তৃপ্তির ব্যাপার। তাই স্বদেশকে জানার চর্চা আমার বহুদিনের। ইতিমধ্যে লোককৃতি, লোকসংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক কিছু লেখা লিখেছি। লিখতে পেরে নিজে যেমন অতীতের গৌরব আস্বাদন করেছি, তেমনি সন্তোষ লাভ করেছি পাঠক সমীপে ইতিহাস নির্ভর তথ্যগুলি পরিবেশন করতে পেরে'।

অবশেষে কয়েকজন বন্ধু মিলে 'সায়ক' সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ শুরু করলেন। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। পরবর্তী সময়ে পত্রিকার নাম বদল করে হল 'এবং সায়ক'। চলতি বছরে তা পা দিতে চলেছে ৫০ তম বর্ষে। নিয়মিত এবং নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশ হচ্ছে সেই শুরু থেকেই। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা নিয়ে প্রস্ফুটিত 'এবং সায়ক'। সম্পাদক সূর্য নন্দী কিন্তু তাঁর এই হাফ সেঞ্চুরি করা বান্মাসিক পত্রিকাটির ব্যাটিং আর এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক নয়। আসলে এখানেই তিনি অবসর নিতে বদ্ধপরিকর। তাই যেন তিনি লেখেন --
'এতদূর এসে ফিরে যাওয়া? 
আবার ঘুরপথ, জটিল হাওয়া
কেউ ছুঁড়ে দেবে তীব্র শব্দবাণ
কেউ বা শোনাবে অধৈর্যের গান। 
সর্বস্ব হারিয়ে নির্জিত আমি আজ
বিফল সাধনার পর খুলেছি সাজ
শেষের সীমানা, না ছুঁতে পারিনি
তবু তো আছি প্রাণের কাছাকাছি'। 
ওড়িশার রাইবনিয়া দুর্গে সূর্য নন্দীর সাথে লেখক

কোনও কোনও বছরে ২ টি করে না হলেও, কোনও কোনও বছরে অন্তত একটি করে সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছেই 'এবং সায়ক'য়ের।। প্রথম থেকেই তিনিই সম্পাদক। 'এবং সায়ক' পত্রিকায় তাঁর সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। যা আপামর পাঠক সমাজে এবং গবেষকমহলে রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। মোগলমারি বৌদ্ধবিহার, পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, বিষ্ণুপদ পণ্ডা, বঙ্কিমচন্ড মাইতি, রামেশ্বর পানিগ্রাহী সংখ্যাগুলি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে বিপুলভাবে। এছাড়া 'অভিজ্ঞান', 'অনুবর্তন সাহিত্য পত্রিকা', দাঁতন গ্রামীন মেলার স্মারক পত্রিকা 'মৈত্রী', যুব উৎসবের স্মারক পত্রিকা সহ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। 

১৯৭৫ সালে 'দাঁতন সংস্কৃত সংসদ' নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন সহ সম্পাদক। ঐ বছর ২২-২৪ শে ফেব্রুয়ারি টানা ৩ দিন সাহিত্য সম্মিলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনীর আয়োজনের মুখ্য কর্মকর্তা ছিলেন তিনিই। সেবারই প্রথম এত বড় কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন সফলভাবে। সেই সাথে বাংলা ও ওড়িশার বহু কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে সাহিত্যসেবার মাধ্যমে। ১৯৭৫ - ১৯৮৯ প্রায় ১৫ বছর ধরে 'অগ্নিবীনা' গোষ্ঠীর সম্পাদক পদে থেকে নানা ধরনের ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কাজকর্ম করেছেন। ১৯৭৭ - ১৯৭৯ পর পর তিন বছর দাঁতন ভট্টর কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক থাকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৮৭ - ২০০৫ দাঁতন টাউন লাইব্রেরীর সম্পাদক, ১৯৮৬ - ২০০৬ পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের আঞ্চলিক সম্পাদক ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। দাঁতন গ্রামীণ মেলার প্রথম ১৫ বছর সম্পাদক এবং পরবর্তী ২২ বছর সক্রিয় সদস্য বা উপদেষ্টামণ্ডলীর দায়িত্বে যুক্ত থেকে গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষী থেকেছেন। গর্বিত করেছেন দাঁতনকে। 

আই, পি, টি, এ'র নাটক ও গানের দল নিয়ে মেদিনীপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। ১৯৯১ থেকে প্রায় ৮ বছর রাজ্য সরকারের সাক্ষরতা মিশন অভিযানের মাস্টার ট্রেনার হিসাবে কাজ করেছেন। সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক সাহিত্যের নানা কাজ, নানাবিধ কর্মকান্ডের সঙ্গে সারাজীবন জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছেন এই মানুষ রতনটি। এখনো করে চলেছেন নিরলসভাবে এবং নির্লিপ্তভাবে। ২০১৭ সালে দাঁতন গ্রামীন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়। সেদিন সঞ্চালনার দায়িত্বে মঞ্চে ছিলেন তিনিই। 
ক্ষেত্র গবেষণার কাজে সূর্য নন্দী

দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের এই এলাকার নানা প্রান্ত থেকে লোকসাহিত্য চড়িয়া চড়িয়ানীনী, ললিতা শবর পালা, কৃষ্ণযাত্রার নানা পালা, যুগীযাত্রার পালা, শীতলামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল প্রভৃতি বেশকিছু পালাগান সংগ্রহ করেছেন। এসব নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে গিয়েছেন। আর বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন মেদিনীপুরের হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি, পুরাতত্ব এবং আঞ্চলিক ইতিহাসকে। ললিতা শবর পালা মঞ্চস্থ করানোর জন্য স্থানীয় একটি দলকে পুনর্গঠন করিয়েছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ (২০০৬), বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ (২০১৭) থেকে ঐ পালাগান রেকর্ডিং করে নিয়ে গেছে। দাঁতন-১ ব্লকের মোঘলমারি গ্রামে আবিষ্কৃত সুপ্রাচীন বৌদ্ধবিহারের প্রত্নখনন কালে প্রথম ১০ বছর প্রত্নবিদ ড. অশোক দত্তের সাহায্যকারী সঙ্গী হিসেবে কাজ করেছেন। আজ মোঘলমারি বৌদ্ধবিহারের নাম বিশ্বজুড়ে প্রচারিত এবং প্রসারিত। মোগলমারি সহ দাঁতনের আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল ও প্রত্নসামগ্রী নিয়ে এখনো তাঁর আগ্রহ কমেনি। নিরন্তর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইচ্ছে রয়েছে দাঁতনের এই গৌরবজনক সাংস্কৃতিক ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ রচনা করার। ওড়িশা সংলগ্ন সীমান্ত বাংলার শীতলামঙ্গল ও ষষ্ঠীমঙ্গল গান বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গীত ও নাটক আকাডেমির একটি প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ করে জমা দিয়েছেন। 

দাঁতন থানা বলতে বর্তমান দাঁতন ১ ব্লকের ৯ টি অঞ্চল, দাঁতন ২ ব্লকের ৭ টি অঞ্চল ও মোহনপুর ব্লকের ৫ টি অঞ্চল। এই নিয়ে ছিল তখন দাঁতন থানা। দাঁতন মোহনপুর অঞ্চলের মানুষ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কেমন ভূমিকা নিয়েছিলেন, কতটা ও কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তা উল্লেখ করেছেন এই গ্রন্থে। স্বাধীনতার লড়াইতে মেদিনীপুর জেলার মানুষের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা  সবাই জানে। বিশেষ করে মেদিনীপুর শহর, তমলুক ও কাঁথি মহকুমার ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে ওড়িশা সংলগ্ন প্রান্তিক অঞ্চল দাঁতন মোহনপুরের মানুষের কি কোনো ভূমিকাই নেই? এখানকার সকলে কি নীরব ছিলেন? প্রবল আগ্রহ নিয়ে সেই ইতিহাস খোঁজা শুরু করেন ২০১৮ সালে। বিভিন্ন থানা ও মহকুমা ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রন্থ বেরিয়েছে। কিন্তু দাঁতন থানা নিয়ে কোনো গ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তিনি প্রায় ৭০ টি গ্রামের ২০০ টি পরিবারে গিয়েছেন যাঁদের পূর্বপুরুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান সময়ে এই এলাকায় একজন ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামী কেউ জীবিত নেই। তাঁদের স্ত্রী, ভাই, ছেলে, মেয়ে, ভাইপো বা নাতি প্রমুখের মুখের কথায় বলা ইতিহাস থেকে নির্যাসটুকু সেঁচে নিয়ে নিরপেক্ষ তথ্যটুকু গ্রহণ করতে হয়েছে। তাম্রফলক, ছবি, বুলেটিন, নথিপত্র প্রভৃতি যা পাওয়া গেছে তাও গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী সেগুলি সোৎসাহে ও সানন্দে প্রদান করেছেন। সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে পাঠকদের উপহার দিয়েছেন এক অমূল্য রতন -- 'স্বাধীনতা সংগ্রামে দাঁতন মোহনপুর'। গবেষক শান্তিপদ নন্দ সূর্য নন্দীর এই অসাধারণ কাজ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, 'স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মানুষের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গৌরবময়। জেলার সব অংশের মানুষ সেই আন্দোলনে স্পন্দিত হতেন। সর্বত্রই আন্দোলনের কমবেশি বিকাশ ঘটেছে। আঞ্চলিক স্তরের সেইসব ইতিহাস থানা ভিত্তিক বা মহকুমা ভিত্তিক গ্রন্থভুক্ত হয়েছে ও হচ্ছে। ওড়িশা সংলগ্ন প্রান্তিক অঞ্চল দাঁতন থানার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সংরক্ষনে ব্রতী হয়েছেন সূর্য নন্দী। জেলা রাজ্য বা জাতীয় স্তরের আন্দোলনগুলির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দাঁতন মোহনপুরের স্থানীয় আন্দোলন কর্মসূচির কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া সেই সময়কালের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আলোচনা যুক্ত হয়েছে এ গ্রন্থে। এক. দাঁতন মোহনপুর প্রভৃতি অঞ্চলকে ওড়িশাভুক্তির চেষ্টা ও তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন। দুই. ৪২ এর ঝড়, ৪৩ এর মন্বন্তর। এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকা, সংক্ষিপ্ত জীবনী ও আনুষঙ্গিক ছবি গ্রন্থটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে'।

সূর্য নন্দীর লেখা অন্যান্য বইগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকুল্যে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত 'এবং সংহতি' (কবিতা), ঘাটালের 'সৃজন' থেকে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত 'জন্ম শিকড়' (কবিতা), চন্দননগরের 'প্রিয়ংবদা' থেকে ২০০৪ সালে প্রকাশিত 'শিকড় থেকে শিখরে' (কবিতা), পাঠক, কলকাতা থেকে 'আউল বাউল পথে' (কবিতা), 'গল্প সঞ্চয়নের শিল্পকথা' (প্রবন্ধ / যুগ্মভাবে), পারুল প্রকাশনী' কলকাতা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত 'মোঘলমারির বৌদ্ধ মহাবিহার বিবিধ প্রসঙ্গ' (প্রবন্ধ / সম্পাদনা) এবং কবিতিকা মেদিনীপুর থেকে 'স্বাধীনতা সংগ্রামে দাঁতন মোহনপুর'। কিন্তু সূর্য নন্দীর বড় পরিচয় প্রোথিতযশা কবি হিসেবে। জেলা এবং রাজ্যের বহু সাহিত্য পত্রিকাতে নিয়মিত লেখেন কবিতা। আঞ্চলিক ইতিহাস কে প্রাধান্য দিলেও তাঁর কলম ছুঁয়ে সিক্ত হয় সাদা কাগজের পাতা। সেখানে তিনি আঁচড় কাটেন --
'আমার পাশেই ধ্বনি, দূরের থেকে ভেসে আসা গান বহুকাল আগে কে যেন গেয়েছিল, মন দিয়ে শুনেছিলাম
আজও সে স্বপ্ন দেখা ফুরোয় না, আর হারায় না 
সে রকমই আছি, বন্ধু পেলে আবার পথে নামা।
কারা যেন পথে নেমেছে, পা রেখেছে সর্বনাশের মাথায় পশ্চিম দুয়ার থেকে যেতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে তো ডানা মেলায়।
দূরের থেকে ভেসে আসা গান, আমার পাশেই ধ্বনি বহুকাল পরে পাথরে পা রেখে বেঁচে থাকার গান শুনি'। 

এ পর্যন্ত কবি সম্পাদক সূর্য নন্দী যেসব সম্মান, সংবর্ধনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংস্থার পক্ষ থেকে পেয়েছেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘাটালের 'সৃজন' পত্রিকা থেকে কবি হিসেবে 'সৃজন সম্মান' (১৯৯৬) প্রাপ্তি। এছাড়াও পেয়েছেন বালিচক সাহিত্য সংসদ থেকে সম্মাননা (১৯৯৮), পটাশপুরের নৈপুরের ভগৎ সিং মেলা কমিটির সম্মাননা (২০০৭), কুলটিকরির লিপিকা সাহিত্য পুরস্কার, (২০০৯), মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন আকাদেমির পুরস্কার (২০১০), মহিষাদলের লোককৃতি সংস্কৃতি সংসদের 'লোককৃতি সম্মান' (২০১১), কাঁথির 'কবিতার কাগজ' পত্রিকার 'নিত্যানন্দ পুরস্কার' (২০১৩), নারায়ণগড়ের' 'লাল নীল সবুজ' পত্রিকার সম্মাননা (২০১৪), হলদিয়ার 'আপনজন' পত্রিকার দেওয়া 'আপনজন স্মারক সম্মাননা (২০১৬) কলকাতার পারুল প্রকাশনী থেকে শিক্ষকতার জন্য 'পারুল শিক্ষক সম্মান' (২০১৩) ইত্যাদি। এছাড়াও বাংলাদেশের রাজশাহীর চিহ্ণমেলা চিরায়ত বাংলা থেকে সম্পাদক রূপে সম্মানিত হয়েছেন ২০১৯ এ। ওড়িশার রাইবনিয়া দুর্গ সুরক্ষা ও আঞ্চলিক উন্নয়ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্পাদক ও লেখক সম্মাননা ২০১৯, বামনবিরুয়া সমবায় সমিতি থেকে সাহিত্যিক ও সম্পাদকরূপে পুরস্কার (২০২০) পেয়েছেন। 'কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্রে'র পক্ষ থেকেও সম্মানিত হয়েছেন। এগরার শামিয়ানা পত্রিকা, অন্বেষা গোষ্ঠী' ও 'এষনা' পত্রিকা, বেলদার বসন্ত উৎসব কমিটিও দিয়েছেন নানাবিধ সম্মাননা। 
দোলগ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্রের সাথে সূর্য নন্দী

তিনি এরাজ্যের বাংলা ভাষার একজন শক্তিশালী কবি। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কবি সম্পাদক সূর্য নন্দী টানা ৫০ বছর ধরে একটানা পত্রিকা প্রকাশ করে সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য কৃতিত্ব। শুধু অন্যের লেখায় সম্পৃক্ত করে নয়, নিজেও নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গিয়েছেন কাব্য জগতের সাথে সখ্যতা। তাঁর কবিতায় মেলে সমাজের কথা। অবক্ষয়ের কথা। অবনমনের কথা। অনায়াসে তিনি উচ্চারিত করতে পারেন তাঁর মনের অভিঘাত --
'টিভি চ্যানেলগুলো ছুটছে জঙ্গল কভার করবে বলে প্লাটফর্ম ছেড়ে এই মাত্র বেরিয়ে গেল 'রবীন্দ্রনাথ' সংস্কৃতি এক্সপ্রেস।
সংস্কৃতি কভার করতে গিয়ে 
জঙ্গল যাওয়া হয়নি অনেকদিন, তাই উন্নতি হয়নি অমসৃণ থেকে গেছে সেখানকার মোরাম রাস্তা 
আর রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন আরণ্যক মানুষ।
বারুদের গন্ধেও মুখ পুড়ছে প্রাণের 'সে অরণ্যের'।
টিভি ক্যামেরাগুলো নাগাল পাচ্ছে না 
বম্ব ব্লাস্টের ভয়ে ওবি ভ্যানও যাচ্ছে না 
তবু চ্যানেলে চ্যানেলে উঠে আসছে জঙ্গল
প্রতিদিন জঙ্গলকে উলঙ্গ, তারপর ধর্ষণ, তারপর পোস্টমর্টেম 
পরিশেষে পক্ষে বিপক্ষের টেবিলে – সংস্কৃতির জাতীয় সঙ্গীত'। (আরণ্যক)

🍂

Post a Comment

0 Comments