জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ৪০ ( চল্লিশ)/ গৌতম বাড়ই

চিত্র- মণিদীপা দাস 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৪০ ( চল্লিশ) 
গৌতম বাড়ই


সোনাঝুরি:বাউলপ্রাঙ্গণে মন বাউলমনা

বাউলতত্বের আলোচনায় মেতে উঠলো সবাই এবারে। বীরভূমে আসবে আর বাউল সংগীত নিয়ে কোনও কথাই হবে না তা কি হয়? বাংলার বাউল আর তার সংগীত, বাউলের জীবন দর্শন এ তো ইওরোপ- আমেরিকার মতন আধুনিক সভ্যতার চরম শিখরে থাকা দেশগুলিরও  গভীর আলোচনার বিষয়বস্তু। 

"বাউল কী? ধর্ম? সম্প্রদায়? নাকি বাউল মানে শুধুই সংগীত ? " - সুশোভন এই প্রশ্ন তুলে ধরে আজ রাতের আড্ডায় সবার সামনে গল্পের ছলে। 

অদ্ভুত এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে শান্তিনিকেতনে আসা ইস্তক। বাউল বলতে তো বীরভূম বুঝি আমরা । আর এখানে এসে, এই বাউল প্রাঙ্গণে এসে মন তাই হয়ে ওঠে বাউলমনা। সুশোভনের প্রশ্নে , এই রকম পরিবেশে সবাই তাই গভীরভাবে মনোনিবেশ করে শুনলো তার কথা। ভালোমামার আবার মুখে আটকায় না কিছু, বসন্তসেনাও জানে। আসলে মানুষটির ভেতর একটি সহজ সরল রাখাল বালক লুকিয়ে আছে। তার এই কথার জন্য , কণিকা অর্থাৎ ভালোমামিকেও সজাগ থাকতে হয়, ভালোমামা বকাও খায় মামির কাছে এইজন্য, বসন্তসেনা ভালোমতন জানে সে কথা। আর এই মুহূর্তে ভালো মামা তাই করে বসল,

"সুশোভনদা তোমরা বাউল নিয়ে এত তো জানো! তোমরা কী জান এই বীরভূমের এক বাউল -সাধু ন্যাংটা বাবার কথা?" 

ভালোমামি চোখ পাকিয়ে বলল-" তোমার কী মাথামুন্ডুর পুরোটাই গেল এবার এখানে এসে? বয়স বাড়ছে আর কথা বলার ছিরিছাঁদ কেমন হচ্ছে দেখো? আমাদের বাচ্চা মেয়েটিও এখানে বসে আছে আমাদের সঙ্গে, সে খেয়ালটি আছে?  " 

ভালোমামা বলল- " শোনো আমাদের হাসনু এখন এডাল্ট, আর এডাল্ট হয়ে গেলে ছেলে- মেয়ে ইয়ারবক্সি।বুঝলে!" এই কথা শুনে কণিকা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দেখল সুশোভন ঠোঁটের কোণে এখন চিলতে হাসি মেখে বলছে-" সত্যি তো তাই, হাসনুমা এখন বাচ্চা নয়, আমাদের সবার অভিভাবক এখন, কোন ন্যাংটা বাবা? তারাপীঠের সেই তান্ত্রিক? এক ইতালিয়ান মহিলা ভারতের তান্ত্রিক সাধুদের ওপর গবেষণা করতে এসেছিলেন। পরে ন্যাংটাবাবার সন্তান গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সেই ন্যাংটাবাবা আজ কোথায় কেউ জানে না। সেই মহিলা ফিরে গেছেন তার দেশে, সেখানেই বড় হচ্ছে ন্যাংটাবাবার সন্তান। কিন্তু এর সাথে বাউল যোগ খুব একটা নেই, আছে তন্ত্রসাধনা। তবে তোমার কথার পিঠে বলি, এও সত্যি বিখ্যাত আর খ্যাতিমান বাউলেরা এখন বিদেশিনিদের সঙ্গ করছেন, লিভ টুগেদার করছেন। এর রহস্য তুমি খুঁজে বের করো!" সুশোভন ভালোমামার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। ভালোমামি বললে-"  থাক দাদা ওর কাঁধে আর এইসব চাপিয়ে দেবেন না, আমার মনে হচ্ছে শুধু বাউল -ই নয় এ ব্যাটা তলে তলে নাগাসাধু হওয়ার মতলব খুঁজছে। " ভালোমামির কথা শুনে আলোমাসিও পর্যন্ত হা হা করে হেসে উঠলো। বসন্তসেনার অভিকাকু বললেন- " হাসনুমা তোর ভালোমামি যাই বলুক, এই ভালোমামাটি এখানে না এলে আমাদের অর্দ্ধেক মজাই  মাটি হত। আমাদের এই টিম জিন্দাবাদ।" বলেই অভিজিতের মনে হল , জিন্দাবাদ শব্দটি কেমন রাজনীতির স্লোগানের মতন শোনালো না। শব্দরাও ব্যবহারে ব্যবহারে কেমন রাজনৈতিক হয়ে ওঠে! 
ভালোমামি বললে- " হাসনু তোর এই ভালোমামাটি কিন্তু মোটেই ভালো নয়! জেনে রাখ, যৌবনে চুটিয়ে তিনটি নারীর সাথে অল্প কয়েক বছরের ব্যাবধানে প্রেম-প্যায়ার- মোহব্বত করেছেন, আর দুটি কোথায় আছে? বললেই বলে, জানি না, তবে তৃতীয়টি যে আমি,  এইটুকু আজ বলেই দিলাম। " 

সুশোভন বলে - " এই প্রেমের মধ্যে খারাপ কী দেখলি? ও'তো সহজাত একটি মানবিক ধর্ম! এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে, কণিকা তোকে আর টোটোনকে দিশেরগড়ের সেই ভাড়া বাড়িতে কলিয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের রাতে এই লোকটি তো কালিবাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে এনে তুলেছিল, মনে আছে? " নিজেকে হাত দিয়ে দেখাল। 

-- " নিজের অমন বিয়ের রাতের কথা কেউ ভুলতে পারে? সুশোভনদা সেদিন থেকে তুমি আমার নিজের সবচেয়ে প্রিয়  দাদা। এই দাদাকে এই জীবনে কী ভুলে থাকতে পারি! তুমি ডাকলেই তো ছুটে আসি তাই। "
ভালোমামা বলে- " দেখো আলোদি, সেই মহিলা যে বুড়ি হলে  পরে এত ম্যাড়ম্যেড়ে রোমান্সবিহীন হয়ে যাবে ভাবা যায়? "

ভালোমামি বলে - " ওরে আমার বুড়োরে! তোমায় আমি রোমান্স করা দেখাচ্ছি। আজকাল ওই সেলেব বুড়োদের মতন কচিকাঁচা ছুড়ির পাল্লায় পড়লে, দুটোরই মাথায় খুন্তির বাড়ি পড়বে, বলে দিলাম! " ভালোমামি একদম হাত নেড়েচেড়ে দেখালো ভালোমামাকে। 

সুশোভন এবারে অন্যকথায় ফেরে, বলে- " রুক্ষ বাবরি চুল ধম্মিল্ল করে বাঁধা, হাতে একতারা, বগলে গাবগুবি। পরনে আলখাল্লা, শত তাপ্পি, গেরুয়া বসন, এই জগত নিয়ে উদাসীন, বুকে তাদের আনন্দলহরী, ঠোঁটে গান, দেখামাত্রই 'জয়গুরু' 'জয়গুরু' বলে রব , গুরুর দু-পা ছুঁয়ে প্রণাম। এই গুরুবাদী সম্প্রদায়টি হল বাউল। জয়দেব কেঁদুলির মেলা, ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ গ্রামীণ মেলা। তবে বাউলশ্রেষ্ঠ লালন শাহী তো বাঙলাদেশের কুষ্ঠিয়া তে ছেঁউড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন। আর এই ছেঁউরিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কালীগঙ্গা নদী। কথিত আছে এই নদীর পারেই বসন্ত রোগে আক্রান্ত লালনকে ফেলে যান তার আত্মীয়স্বজনরা। এক মুসলমান জোলা বা তাঁতী সেবার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন তাঁকে । আর তোমরা তো সবাই ' মনের মানুষ ' চলচ্চিত্রে এসব নিশ্চয় জেনেছো? "

ভালোমামি কণিকা বলে ওঠে-- " না দাদা, তোমার টোটন আমায় নিয়ে শেষবার সিনেমা দেখেছিল টাইটানিক, তারপর আর নিয়ে গিয়েছে? শোনো ওর কাছে। " 
সুশোভন বলে - " টাইটানিক তো হলিউডের প্রেমকাব্য। প্রেম দিয়েই তো এখনও শেষ চলচ্চিত্র। আর এখন আর কী করে নিয়ে যাবে! তুমি তো ওকে বাউল সংস্পর্শ করতে দেবে না, সাধু হতে সাবধান করবে। বেচারা কী করবে? তোমায় আর ওই লালন ফকিরের সিনেমা দেখতে নিয়ে যাবে বলে বলবে, পাগল!"

আলোমাসি বলে-" না রে কণিকা একদম ঠিক করেছিস। কে বলতো দেখতে চায় , নিজের বর সংসার ছেড়ে, তান্ত্রিকবাবা হয়ে, ধুনি জ্বালিয়ে বাঘছাল পেতে পঞ্চমুন্ডির আসনে চোখ লাল করে গাঁজার কল্কে নিয়ে বসে আছে?" 

ভালোমামা এই না শুনে মজা করে বিকট গলায় বলে উঠল-" জয় কালী! জয় তারা! ব্যোম! ব্যোম ! " 
সবাই হা হা করে হেসে উঠলো। অভিজিৎ বলল-" বীরভূম শাক্তপীঠও বটে আর বৈষ্ণবপীঠ ও বটে। তবে এর পরেরবার আবার এখানে এলে শোভন তারাপীঠটা কিন্তু এড করে রাখবি। "

আজ রাতে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বার জন্য প্রস্তুত হলো। আগামীকাল সকালেই তারা আবার যে তার বাড়িতে ফিরবে। আর আলোলিকা খুব সকালেই ট্রেন ধরে শিলিগুড়িতে নিজের  বাড়িতে ফিরবে। তারপর হাসনুর ভালোমামা আর মামি দুর্গাপুর ফিরে যাবে, আর গাড়ি করে কলকাতা ফিরবে বসন্তসেনারা। সঙ্গে শুধু অভিকাকু থাকবে তার। অভিজিতকে এবার কিছুদিনের জন্য ওরা ওদের কাছে আটকেই রাখবে বলে দিয়েছে। বসন্তসেনা তার মা দীপশিখার মৃত্যুর পর এই অভিকাকু, ভালোমামা আর মামি এবং আলোমাসির কাছে আরও আদরের হয়ে উঠেছে, এই শুধু তার মনে হয়। এরা সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। আর এদের সাথে আরও একজন তো রয়েছে, সে হল অঙ্কুশ। বসন্তসেনা ভাবে, যদি অঙ্কুশ ও তাদের সাথে এখানে আসত তাহলে কী মজাটাই না হতো! 
মানুষ তো তার মনের মানুষকে চায়, তার আনন্দ উদযাপনে, শোকে, দুঃখে, বিরহে তার কাছে, তার পাশে থাকে যেন সবসময়। বাউল তো সেই মনের মানুষকেই খুঁজে বেড়ায়। 

🍂

সকালের এই দুরন্তগতির সুপার ফাস্ট ট্রেনটি কিছুদিন আগেই চালু হয়েছে। সুশোভন গাড়ি নিয়ে আলোলিকাকে বোলপুর স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিতে চলে যায়। তখনও ট্রেন আসতে মিনিট পনের দেরী, সুশোভন ঘাড় কাত করে আলোলিকাকে বলল, " বললে না তো সবটা মিলিয়ে শান্তিনিকেতন কেমন লাগলো? "
-" মুখ দেখেও বুঝতে পারোনি! ভীষণ ভীষণ ভালো। বন্ধু বিনে জীবন, জল ছাড়া মীনের মতন। জীবনের বেঁচে থাকবার নিজস্ব কিছু ভালো থাকবার উপাদান নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। তুমি কী বলো সুশোভন?"

--" আমার কখনও মনে হয়েছিল এই ফোনের মাধ্যমে দীর্ঘক্ষণ কথা বলাটা এর একটা পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যদিও জানি দেবরাজ অতটা ঠুনকো চরিত্রের মানুষ নয়। আমি জানি , আমার নীরব দুঃসহ একাকী যন্ত্রণা তুমি নিজের করে নিয়ে আমাকে হাল্কা করে তুলছিলে তখনকার প্রতিটি রাতে। আমি হাসনুমার জন্যই বেঁচে থাকবার একটি আলোকবিন্দু খুঁজে নিচ্ছিলাম। তবে এসবের পরেও নিজস্ব একটা একাকী জীবন আরও আরও কিছু পেতে চায়, যেখানে আমি বুঝে উঠতে পারছিলামও না কী করব? বা সেই অতৃপ্তিটা কী? সে কী ফ্রয়েডের ব্যাখা অনুযায়ী  অবচেতনের অবদমিত যৌনচেতনা? না তা তো নয়! তবে? দেখলাম এই কথাগুলো ধীরে ধীরে তোমায় শেয়ার করতে পারছি। আর এই সময়ে নিজেকে জুড়লাম সামাজিক মাধ্যমে। আর এই সামাজিক মাধ্যম, অনেক না বলা কথা, আমায় দিয়ে তোমার কাছে বলিয়ে নিল। নিজে যেন ফের বেঁচে উঠলাম। বসন্তসেনা জানেও তা, তার আলোমাসি এখন তার বাবার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। এই নিয়ে আমাকে অনেক প্রশ্ন করেছিল, আমি এক এক করে তার উত্তরও দিয়েছি।সরল জিজ্ঞাসা, অকপট উত্তর । " 

আলোলিকা কথা বলে, মুখের ওপর  তার সেই উজ্জ্বল হাসির রেশের আভা--" দেবরাজও জানে, সুশোভন এখন তাঁর স্ত্রী আলোলিকার সাথে জীবনের প্রতি মুহূর্তের অমূল্য ভাবনাগুলো লেনদেন করে। তবে ও তো চিরকাল উদার আর যুক্তিবাদী, মানুষটার সাথে এই এতগুলো বছরের  দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে তাই তো জানি। শুধু এটুকু বলে,' দেখো কখনও আমার কাউকে তোমার থেকেও শুধুমাত্র বন্ধু হিসেবে খুব ভালো লাগলে তখন আমার মতনই এইরকম ভাবে ভাববে। অন্য কিছু ভেবে বসো না তখন। "

পনেরমিনিট  যেন দ্রুত শেষ হয়ে গেল।  দূর থেকে ছুটে আসছে বন্দেভারত এক্সপ্রেস। সুশোভন আগে থেকে জেনে নিয়েছে সি-৪ কামরাটা কোথায় পড়তে পারে।একটা ছোট্ট লাগেজই ছিল। আলোলিকাকে বলল,"তুমি এগিয়ে যাবে আমি তুলে দেব হাতে। বন্দেভারতের আবার সমস্ত দরজা ট্রেন ছাড়বার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে চিন্তার কিছু নেই উঠে পড়তে পারবে ওই সময়ে।" আলোলিকা একটা হাত বাড়িয়ে সুশোভনের ডান হাতটি ধরলো। বলল, "শোভন নিজের প্রতি আর হাসনুমায়ের প্রতি সবসময় নজর রাখবে। ভীষণ ভালো থাকবে। তোমাদের ভালো থাকাই আমাদের এখন সবসময়ের কাম্য।"  

সুশোভন আলোলিকাকে বন্দেভারতে তুলে দিয়ে সোনাঝুরির রিসোর্টে ফিরল। এবার তাদেরও ঘরে ফেরার পালা। মনে হল, শুধু আলোলিকার পথের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতেই বন্দেভারত শূন্যতায় মিলিয়ে গিয়েছিল। আর সেই আশ্চর্য দৃশ্যটি বারবার ভাবতে লেগেছে সে, আলোলিকা একমুহূর্তের জন্য হাসিমুখে পিছন ফিরে লাগেজটি নেওয়ার সময়, সুশোভনের মনে হল দীপশিখা যেন হাত নাড়তে নাড়তে ডিসট্যান্স সিগন্যালের লালআলোর সাথে মিলিয়ে গেল। তাহলে শুধু বসন্তসেনা নয়, সুশোভনের কাছেও এই আজকের সদ্য চোখেভাসা ঘটনাটিও হ্যালুসিনেশন! 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments