জ্বলদর্চি

সুকুমার সেন: ভারতীয় লোকতন্ত্রের অচর্চিত নায়ক/সোহম সেন

সুকুমার সেন: ভারতীয় লোকতন্ত্রের অচর্চিত নায়ক

সোহম সেন

স্বাধীনতা বা বলা ভাল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর আজ তিয়াত্তর বছর পার করে এসে বইয়ের পাতায় পাতায়, দেওয়ালে দেওয়ালে ভারতের যে কীটকর্তিত মানচিত্র দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তার হয়ে ওঠার নেপথ্যে জড়িয়ে আছে এক বেদনাদায়ক ইতিহাস। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেই ইতিহাসে বাঁচা মানুষগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট কয়েকটা শ্রেণী; শ্রেণী এই অর্থে যে, সমসাময়িক পরিস্থিতির তাড়নায় যারা কতকটা একই রকমের পরিণাম কিংবা অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সে শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে সব-হারানো, নিরবলম্বী, ছিন্নমূল মানুষ, রয়েছে নিয়তির করুণ পরিণতিতে আশাহত আদর্শবাদী রাষ্ট্রনেতার দল, রয়েছে বিচ্ছিন্নতাকামী স্বার্থসন্ধানী জননেতার ভিড়। আর আছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বৈদূর্যমণি, স্টিল ফ্রেম-- ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। এই শ্রেণীর কথা কোনো ইতিহাসবেত্তা হয়ত সেভাবে লিখে রেখে যাননি। সাহিত্যে, আলোচনায় তাঁদের কথা উঠে আসেনি ততটা, যতটা প্রয়োজন ছিল। এখন এমন একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, সাম্রাজ্যবাদের পায়ে দাসখৎ দেওয়া, ঔচিত্যবোধের কষ্টিপাথরে বিবেকের তাড়নাকে বিচার না করে, নিরাপত্তার ছত্রতলে আশ্রয় নেওয়ার এই যে একটা প্রবৃত্তি-- তাকে কেন পৃথকভাবে স্মরণ করবার কিংবা আলোচনার বৃত্তে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা আছে? খুব অল্পকথায় বলতে গেলে, এর যে উত্তর বা যুক্তি খাড়া করা যায়, তা হল, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সামাজিক অস্থিরতার দিনে এই একটিমাত্র কাঠামো ছিল ধ্রুবক এবং সেই অস্থিরতাকে নির্মূল করে স্থিরতা আনয়নের ক্ষেত্রে এই আমলাতন্ত্রের একটা সদর্থক ভূমিকা ছিল। ভারতের জাতীয় নেতারা যে ইস্পাত কাঠামোকে একদা নিন্দা করেছিলেন, পক্ষপাতদুষ্ট, উন্নাসিক প্রভৃতি আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিলেন, শাসনযন্ত্রের চাবিকাঠির উত্তরাধিকার পাওয়ার পর তাঁরা এটা বুঝেছিলেন, যে Machinery এযাবৎ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বিদেশি শাসকরা ব্যবহার করে এসেছে, তাকেই, চরিত্র পরিবর্তন করে ভারতের জনকল্যাণকর্মে ব্যবহার করাই সমীচীন হবে। আসলে পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল, জাতীয় নেতাদের কাছে এছাড়া আর উপায়ান্তর ছিল না। সাধারণতান্ত্রিক ভারতের ইতিহাস সাক্ষী-- এ অভিপ্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলই হয়েছে।

এ সফলতার কাণ্ডারী যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুকুমার সেন, এস কে দে, অশোক মিত্র প্রমুখ কর্মযোগী আধিকারিক। এ বছর ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের ১২২ তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালে ২ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে সুকুমার মেধাবী ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগের উজ্জ্বল ছাত্র সুকুমার পড়তে গিয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯২১ সালে মাত্রে ২২ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে। দীর্ঘ উনিশ বছর সুকুমার ডিসট্রিক্ট ও সেশন জজের কাজ করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুকুমার সেনকে চীফ সেক্রেটারির পদে উন্নীত করে দেয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো আত্মজীবনী বা কোনো বই তিনি লিখে রেখে যাননি। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও প্রশাসনিক কাগজপত্রে তাঁর কিছু লেখা নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তা অলভ্য। ইতিহাসকার রামচন্দ্র গুহ জানিয়েছেন, “It is a pity we know so little about Sukumar Sen. He left no memoirs and few papers either.” আন্তর্জালে সাধারণভাবে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তার অধিক কিছু সরবরাহ করবার মতো তথ্য আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কয়েকটি কথা বলবার আগে সে তথ্যটুকুর কিছু উল্লেখ প্রয়োজন। 
নির্বাচন কমিশন তৈরি হওয়ার পর ভারত সরকার সুকুমার সেনকে চীফ ইলেকশন কমিশনার করে নিয়ে যায়। ১৯৫০ সালের ২১ মার্চ থেকে ১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর অবধি এই পদে তিনি আসীন ছিলেন। সমস্যাজর্জর ভারতে সেদিন Universal Adult Franchise র ভিত্তিতে ভারতের কেন্দ্র ও প্রাদেশিক  স্তরে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সহজ কাজ ছিল না। যে-দেশে স্বাক্ষরতার হার নগণ্য, সেখানে  Universal Adult Franchise র মাধ্যমে জননেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া কতটা যুক্তিযুক্ত বা বাস্তবোচিত এমন একটা প্রশ্ন অনেকেই তোলেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকার চালনার ক্ষেত্রে এর থেকে সুষম, সুষ্ঠু কোনো বিকল্প উপায় আজ অবধি সেভাবে নির্ণয় করা যায়নি। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির সাথে স্বাক্ষরতা ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া যে উত্তরোত্তর উপযোগী হয়ে উঠবে, বোধ করি এমন একটা ধারণা সংবিধান-প্রণেতাদের মনমধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। সে যাই হোক, বিবিধ অসুবিধার মধ্যে থেকেও নবভারতের এই রাজসূয় যজ্ঞের প্রস্তুতি, সুকুমার সেন অপরিসীম নিষ্ঠা ও অসাধারণ প্রতিভার বলে সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯৫১-৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রায় ৪৫০০ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, ৫০০ টি কেন্দ্রে আর বাকি প্রাদেশিক কাউন্সিল ও এসেম্বলিতে। তৈরি করা হয় ২২৪০০০ টি পোলিং বুথ। বিভিন্ন থিয়েটারে ও বেতারে প্রচার করা হয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি। নির্বাচন পদ্ধতিতে ব্যালট বাক্সের ব্যবহার, রাজনৈতিক দলগুলিকে চিহ্নিত করতে প্রতীকের ব্যবহার এসবই ছিল সুকুমার সেনের মস্তিষ্কপ্রসূত। দূরদর্শী সুকুমার প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ব্যবহৃত প্রায় ২০ লক্ষ ব্যালট বাক্স সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। ফলত, দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে ভারত সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হয়। আন্তর্জাতিক নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে সুদানের সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়াটিও সুকুমার সেনের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়। দণ্ডকারণ্যতে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজেও তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার বিপুল পরিচয় মেলে। সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল দায়িত্বপ্রাপ্ত এঞ্জিনিয়ার হিসাবে তাঁর সাথে কাজ করবার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।

ভারতীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর সুদৃঢ়করণে সুকুমার সেনের সাগরতুল্য অবদানের কথা আমরা মনে রাখিনি। রামচন্দ্র গুহ তাঁকে বলেছেন, "Unsung hero of Indian Democracy" বা ভারতীয় লোকতন্ত্রের অচর্চিত নায়ক।প্রতিষ্ঠানের বৃত্তে, নিয়মতান্ত্রিকতার ছত্রতলে থেকে যারা সিস্টেমর আমূল সংস্কার সাধন করেন, তাঁদের প্রতি আমাদের বোধহয় উদাসীনতা আছে। ইতিহাস কখনো এহেন মানুষদের কথা বলেনি, বা বললেও এতটাই ক্ষীণভাবে বলেছে যে, তা আমদের কর্ণগোচর হয়নি। ইতিহাস-নির্মাতা মানুষের উপর তাই সে-বিস্মৃতির দায় বর্তায়। আইসিএস অশোক মিত্র তাঁর আত্মজীবনীতে বেশ কয়েকবার সুকুমার সেনের কথা লিখেছেন। কিন্তু তাতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ সেক্রেটারির কথোপকথন, দুই আধিকারিকের প্রশাসনিক বিষয় সংক্রান্ত আলোচনা ব্যতীত আর তেমন কোনো তথ্য নেই। নির্বাচন কমিশনের প্রথম দুটি নির্বাচন-রিপোর্টের ভূমিকায় সুকুমার বাবুর কিছু লেখা আছে। আরো দু'-একটি জায়গায় তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা ইতস্তত ভাবে পাওয়া যায়। প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট শঙ্কর পিল্লাই সম্পাদিত ‘Shankar’s Weekly’ তে ১৯৫৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এডিশনে সুকুমার সেনকে ‘The Man of the Week’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই পত্রিকা লিখেছে, “Sukumar Sen could easily have been a bit of the Steel Frame that rusted, for he was a District and Sessions Judge for 19 years,...[but as] the Chief Election Commissioner [he] became an unseen undogmatic influence patiently judicial in his attitude to parties insistent in regard to the machine he wielded.” 

সুকুমার সেন যেদিন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেদিন এদেশের বিবাহিতা নারীরা নিজেদের নাম ও পরিচয় দিতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত ছিলেন। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অদ্যাবধি বহু রূপান্তর ঘটেছে। মানুষের মানসিকতায় , তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। যুগের সাথে সাথে বদলে গিয়েছে তার চাহিদা, ভাবনা, জীবনযাপনের প্রকৃতি, মূল্যবোধ। তবু সবকিছু অতিক্রম করেও যে একটা বৃহৎ ব্যবস্থা বারবার নিজগুণেই নিজেকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলেছে, সেটা সম্ভব হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের স্থপতিদের কর্মগুণে। সুকুমার সেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর অনালোচিত, অনাবিষ্কৃত জীবন কোনো দক্ষ জীবনীকারের কলমে সার্থকরূপে বিধৃত হোক, এমত আশা করি। 

Reference:
1) GUHA, RAMACHANDRA; India After Gandhi
2) MUKHERJEE, Sh. PRANAB; First Sukumar Sen Memorial Lecture ( Jan 23, 2020) 
3) মিত্র, অশোক; তিন কুড়ি দশ (তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments