জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান -১৪/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

চতুর্দশ পর্ব- "সাহিত্য ৩"

রামায়ণ ও মহাভারতে ভারতবর্ষ এমন ভাবেই বর্ণিত করা আছে ভারতবর্ষের সমস্ত ইতিহাস ও তার খুঁটিনাটি শুধু নয়, প্রাচীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সমকোণ ও প্রতিকোণের সবটুকু জানার উদ্দেশ্যে এই দুই মহাকাব্য যেমন অত্যন্ত আবশ্যক ঠিক তেমনই একজন ভারতবাসীর নৈতিক উচিতের মধ্যে পড়ে ভারতবর্ষকে ঠিক করে জানা, বোঝা ও গভীর শ্রদ্ধার সাথে মহাভারত বা রামায়ণকে ধৈর্যের সাথে পাঠ ও বিশ্লেষণ করা। তবে এই দুই মহাকাব্যের রূপকার বাল্মীকি ও ব্যাস এই দুই মহাকাব্য আদৌ পূর্বকালে লিখেছিলেন কিনা, এবং এনাদের অস্তিত্ব আদৌ প্রমাণিত কিনা সেই বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ বা দ্বিমত আছে। মনে করা হয় ব্যাস নামটি কোনো ব্যক্তির কল্পনা প্রসূত বা উপাধি প্রাপ্ত। কারণ, ব্যাসদেবের চারি বেদ সংকলয়িতা-মহাভারত, গীতাশাস্ত্র, ব্রহ্মসূত্র, পুরাণ ও পতঞ্জলির ব্যাস-ভাষ্য প্রণেতা। এই সমস্ত গ্রন্থের আসল গ্রন্থকারের নাম হিসাবে ব্যাস শব্দটি  পাওয়া যাওয়ায় ধরা নেওয়া হয় ব্যাস বলে হয়ত সত্যি সত্যি কোনো এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি মহাপন্ডিত। তাই হয়ত ওনার নামের অনুকরণে অনেকের নাম যেমন রাখা হয়েছিল, ঠিক তেমনই মনে করা হয় ওনার পরবর্তীকালে অনেক লেখক বা গ্রন্থকার ওনার নাম ব্যবহার করে সমাজে সহজে নিজ নিজ গ্রন্থের প্রচারের উদ্দেশ্যে হয়ত'বা ব্যাসদেবের নামটি সংযোজন করে দিয়েছিলেন ওনাদের নিজ নিজ সংযোজনার সাথে। তাই, এই বহু প্রচলিত দ্বন্দ্বের মধ্যেই ব্যাস ও ব্যাস ব্যবহৃত রূপকারদের ইতিহাস সংশয় থেকেই গেছে আজ অব্দি।

  কিন্তু বাল্মীকি নামের এই অপ্রয়োগটা ততটা দেখা যায়নি। হয়ত কোশল দেশে সত্যি সত্যিই বাল্মীকি নামে একজন সুপন্ডিত ছিলেন, হয়ত তিনি মহাকাব্য লিখেছিলেন, এরপরও যদি উত্তরকান্ড ও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার অপসারণ ঘটালে মনে হয় সমস্ত রামায়ণটাই একজনের রচিত। কিন্তু মহাভারতের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যাবে মহাভারত ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত বা অনুবাদ হয়েছে, তাহলে বোঝা যায় এক একজন ব্যক্তি নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন বা নির্মাণ করেছেন। রামায়ণের থেকে মহাভারত অধিক বৃহত্তর এর সাথে মহাভারতে বহু প্ৰক্ষিপ্ত ঘটনা স্থানও পেয়েছে, এবং নিঃসন্দেহে সমগ্র বিশ্বের কাছে শ্রেষ্ঠতর স্থান পেয়েছে। মহাভারতের এই দীর্ঘ সূত্র পড়তে পড়তে বর্তমান দাঁড়িয়ে সময়ে এই ডিজিটাল ব্যস্ততার যুগে অধৈর্য্যতা এলেও মহাকাব্য শ্রবণে অধিক শান্তি অনুভূত হয় কর্ণে ও অন্তরে। যা এককথায় লোকশিক্ষা। যার ফলে ভারতবাসী এই একটা সভ্যতার উত্তরাধিকার হতে পেরেছে। এবং সেই কারণে হাভেলের মতো পন্ডিত ইংরেজের ভারত জনসাধারণ সম্বন্ধে উক্তি থেকে বোঝা যায়-

  "ভারতের নিরক্ষর জনসাধারণ এমন কি আধুনিক ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বর্বরদিগকে সভ্যতা শিক্ষা দিতে পারে।"

  তবে এই সমস্ত আখ্যায়িকার মধ্যে নলোপ্যাথানকে একটি পৃথক কাব্য বলা যেতে পারে। এবার এর প্রমাণ হিসেবে একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। পাশাখেলায় শকুনিদের কাছে যুধিষ্ঠিরের পরাজিত হয়ে বনবাসে যাওয়ার পর একদিন যুধিষ্ঠির বৃহদশ্ব ঋষির কাছে নিজেদের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বলেন তাঁর মতো হতভাগ্য এই ভূভারতে হয়ত আর কেউ নেই। প্রত্যুত্তরে ঋষি নল-দময়মন্তীর একটি উপাখ্যান শোনান। ভাবের মহত্ব, ভাষার সৌন্দর্য্য, প্রভৃতি সব দিক থেকেই নলোপাখ্যান জগতের সাহিত্যাকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। রামের অযোধ্যা থেকে বিদায়কালীন বর্ণনার মতো চমৎকার না হলেও নলোপাখ্যান করুণ ও মহৎ রসে পরিপূর্ণ। দময়ন্তীর পাতিব্রত্য রামায়ণের সীতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। অশেষ দুঃখের মধ্যেও দময়ন্তী কোনো বিরূপ ধারণা পোষণ করেন নি। তাই হয়ত শুধু ভারতবর্ষে নয় ইউরোপেও এই আখ্যান যে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছে তা জার্মান পণ্ডিত স্নেগেলের নলোপাখ্যান সম্বন্ধীয় মন্তব্যের দিকে লক্ষ্য রাখলে বোঝা যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন-

  "ইহা ভারতবর্ষে অসাধারণরূপে জনপ্রিয়, যেখানে সকল দেশের সকল যুগের সৃষ্ট গ্রন্থ একত্রিত হয় সেই ইউরোপেরও ইহা তদনুরূপে জনপ্রিয় হওয়ার যোগ্য।"

  তবে নলোপাখ্যান মহাভারতের বনপথের অন্তর্গত। এই পর্বে বহু আখ্যায়িকা আছে, তার মধ্যে আরো দুটো বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা- এক, পতিব্রতা- মাহাত্ম্য বা সাবিত্রী উপাখ্যান, এবং দুই, রামপাখ্যান। সাবিত্রীর পতিব্রত্য গুণে তাঁর স্বামী সত্যবাণের জীবনলাভ- যে ধারণা সমস্ত বাঙালীর ঘরে ঘরে প্রচলিত, সেহেতু এক্ষেত্রে সাবিত্রী আদর্শ মহিলা চরিত্র। আবার রামোপাখ্যানে সংক্ষেপে রামায়ণের গল্পটি বর্ণিত আছে। জয়দ্রথ কর্তৃক দ্রৌপদী অপহৃত হয়েছিলেন। তাঁকে উদ্ধারের পর যুধিষ্ঠির অপহরণে কথা উল্লেখ করে যখন মার্কেন্ডেয় মুনিকে তার মতো কেউ হতভাগ্য আছেন কিনা এ প্রশ্ন করেছিলেন, তখন মার্কণ্ডেয় মুনি রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ ও সুগ্রীব, হনুমান প্রভৃতি বানরদের সাহায্যে যেভাবে রাবণকে সবংশে নিধন করে রামলক্ষণ সীতার উদ্ধার সাধন করেন, সে কথাও বর্ণিত করেন। এই বর্ণনা মূল রামায়ণেরই সংক্ষিপ্ত বিবরণ মাত্র। মার্কণ্ডেয় মুনিও রামচন্দ্রের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর বর্ণনা পরিসমাপ্ত ঘটান। ভিন্ন ভিন্ন বই পাঠ করে এটুকু বুঝতে পেরেছি, ওনাদের মত অনুযায়ী এখানেও উত্তরখন্ডটি লিখিত হওয়ার পর, এবং রামচন্দ্রের অবতারত্ব ভারতবর্ষে সুপ্রচলিত হওয়ার পর, যথাযোগ্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। রাবণ কুন্তকর্ণ প্রভৃতির জন্মবৃত্তান্ত মহাভারতের রামোপাখ্যান রয়েছে। রাক্ষস বংশাবলী, বারণ প্রভৃতির জন্মবৃত্তান্ত ও রাবণের কর্তৃক দেবদানব ও গন্ধর্ব প্রভৃতির পরাজয় উত্তরকান্ডেই আছে-অন্য কোনো কান্ডে নেই। অতএব বলা যায় উত্তরকাণ্ডের সাথে মহাভারতের রামোপাখ্যানের পরিচয় সুস্পষ্ট।

(ক্রমশ...)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments