জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা- ৩০


বিশেষ ছোটোবেলা সংখ্যা ৩০

 সম্পাদকীয়
লক্ষ্মীসোনা ছোট্টোবন্ধুরা, ঘর থেকে একদম বের হয়োনা কিন্তু মনের জানলা খুলে রাখো। নাহলে হীরামন তোমার সাথে গল্প করতে আসবে কেমন করে! মজার ব্যাপার হল, এবারের সংখ্যায় শুধু ফুলকুসুমপুরের অনিচ্ছে ঠাকুমার হীরামন নয়, তাতাই এরও একটা হীরামন আছে। সেও আসবে। কবে? তা জানতে হলে পারতে হবে সুকুমার রুজ মহাশয়ের গল্প। কোন তাতাই? আরে বাবা, হীরামন যখন দুটো তখন দুজন তাতাই হতে মানা কোথায়? এক তাতাই হীরামনের খোঁজ করছে আর এক তাতাই রাস্তার খোঁজ করছে। কোন রাস্তা? তা জানতে হলে পড়তে হবে লেখক মুক্তি দাশ মহাশয়ের গল্প। এবারের সংখ্যায় হীরামন দু'টো, তাতাই দুটো, কবি জগদীশ শর্মার ছড়া দুটো, প্রচ্ছদের ছবিতে দেওয়ালে আঁকা পাখিও দুটো কিন্তু অসীম হালদার মহাশয়ের ছোটোবেলার মজার মজার গল্প অনেকগুলো, ছোটোদের আঁকা রঙিন রঙিন ছবি অনেকগুলো, সায়নীর আঁকায় খাঁচা অনেকগুলো, পাঠ প্রতিক্রিয়াও অনেকগুলো। প্রচ্ছদের মনকেমনকরা বাস্তব চিত্রটি ক্যামেরায় ভরে এনে আমাদের উপহার দেবার জন্য পুরুলিয়ার শিক্ষক জাতীয় পুরস্কাররাপ্ত চিত্রগ্রাহক সুদীপ পাত্রকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শ্রদ্ধা জানাই ঔপন্যাসিক রতনতনু ঘাটী মহাশয়কে, গল্পকার সুকুমার রুজ মহাশয়কে, গল্পকার মুক্তি দাশ মহাশয়কে, কবি জগদীশ শর্মা মহাশয়কে, ও লেখক অসীম হালদার মহাশয়কেও। খুদে কবি রেনেসাঁ গঙ্গোপাধ্যায় ও খুদে লেখিকা সাত্ত্বিকি নস্করকে অনেক ভালোবাসা। যে কথা না বললেই নয়, এই ভাবেই এত্ত এত্ত পাঠ প্রতিক্রিয়া পাঠিয়ে তোমরা আমাদের আরো আরো বেঁধে রেখো তোমাদের ভালোবাসায়।   -মৌসুমী ঘোষ।


ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ৩ 
রতনতনু ঘাটী
ইচ্ছেদাদুর কথার উত্তরে কেউ কিছু বললেন না। ওদিকে টিভিরুমেও নীরবতা নেমে এল। এমন কাণ্ড হলে অন্য সময় ইচ্ছেদাদু ভীষণ রেগে যেতেন। আজ কিন্তু একটুও রাগলেনই না। বরং সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। তা হলে একটা খাঁচা আমাদের বাড়ির মধ্যে রাখার অনুমতি দিলাম। সেটা এক্সক্লুসিভলি রাধাগোবিন্দর জন্যে। কেউ ভুলে যেও না যেন!’
   মিটিংয়ের সকলেই একসঙ্গে সম্মতির ঘাড় নাড়লেন। ইচ্ছেদাদু এবার বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আন্য খাঁচাগুলোর আগমনের কারণ জানতে পারি কি?’
   তিন্নির বাবা আমতা-আমতা করে বললেন, ‘তুমি কি আর বাড়ির সব খবর রাখো? দিন তিনেক হল, আমাদের বাড়িতে একটা বিড়ালছানা এসে হাজির হয়েছে। এখনও ওর চোখ ফোটেনি! ওর নাম রেখেছি ‘মিঁউ’। ভেবেছিলাম, তোপান্তর হাট থেকে যখন খাঁচা কেনা হয়ে বাড়িতে আসছেই, তখন মিঁউয়ের জন্যেও একটা খাঁচা এলে মন্দ কী?’
   দাদুর মুখে একটা হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বললেন, ‘ও, তার মানে তোমারও একটা খাঁচা চাই? আর সে খাঁচায় থাকবে তোমার মিঁউ? তার মানে আমাদের বাড়ির জনসংখ্যা এগারো। তার সঙ্গে যুক্ত হল দুটো প্রাণীও?’
   তিন্নির বাবা বললেন, ‘বাবা, বিড়াল খুব মায়াময় প্রাণী। মিঁউ যদি এ বাড়িতে থাকে, তখন ঠিক কে কাকে লালনপালন করছে, তুমি বিড়ালকে নাকি বিড়াল তোমাকে, চট করে বোঝা যাবে না!’
   অনিচ্ছেঠাকুরমা কথার মাঝখানে দাদুকে বললেন, ‘বাড়িতে যখন আমার রাধাগোবিন্দর ঠাঁই করে দিলে, তখন মিঁউও না হয় থাকুক! দুটিতে মিলে নিজের মনে খেলবে। একজন থাকবে বারান্দার ঝোলানো খাঁচায়, আর-একজন মেঝেতে বসানো খাঁচায়।’
   দাদু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, অনিচ্ছেঠাকুরমা বললেন, আমার রাধাগোবিন্দকে ‘মিঁউ’ ডাকটা শিখিয়ে দেব। ও খাঁচার ভিতর থেকে যখন মন চাইবে মিঁউকে দেখতে, তখন ডাকবে!’
   ইচ্ছেদাদু সকলের উদ্দেশে রাগত গলায় বললেন, ‘তোমরা দয়া করে আর উটকো প্রাণীর লিস্ট বাড়িও না। বাকি খাঁচাগুলো ফেরত নিয়ে যেতে খবর দাও ইউসুফকে। ও এসে ওর দুটো খাঁচার দাম নিয়ে যাক আর বাকি খাঁচাগুলো সুবিধে মতো নিয়ে যাক! বলে দাও, অতগুলো খাঁচা লাগবে না।’
   এমন সময় শুধুকাকা মুখ ভার করে ইচ্ছেদাদুকে বললেন, ‘বাবা, দুটো খাঁচার যদি জায়গা হয় এই বাড়িতে, তা হলে বাকি দুটোকে নিয়ে তোমার অত রাগ দেখিয়ে লাভ কী? বাকি দুটোও থাক না। চারটে খাঁচা মিলেমিশেই এ বাড়িতে থাকুক!’
   ইচ্ছেদাদু কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর মধ্যে আর দুটো খাঁচায় কারা থাকবেন, শুনি?’
   শুধুকাকা লাজুক মুক করে বললেন, ‘আমি একটা খরগোশ কিনব বায়না করে দিয়ে এসেছি পাখিবাজারে গিয়ে। দেখে পছন্দ করেও এসেছি। ভারী মিষ্টি খরগোশটা। একটা নামও ভেবে ফেলেছি, ‘কুমি’। ধবধবে সাদা, তুলতুলে চেহারা। বাবা, খরগোশটা দেখলে, তোমারও আদর করতে ইচ্ছে করবে, দেখে নিও!’
   দাদু চোখের পাতা বার কয়েক পটাপট করে খুললেন, তারপর বন্ধ করে বললেন, ‘ও, শুধু, তোমার বুদ্ধিতেও একটা খাঁচা আনা হয়েছে তা হলে?’ ইচ্ছেদাদু শুধুকাকাকে ‘শুধু’ বলে ডাকেন।
   দাদু মনে একটু ক্ষোভ ঝরিয়ে বললেন, ‘আর তো একটা খাঁচাই মাত্র পড়ে রইল! এটা নিশ্চয়ই ‘গল্প’ তোর ভাগের? দাদু গল্পকাকাকে ‘গল্প’ বলে ডাকেন।’
   বিন্নির বাবা গল্পকাকা বললেন, ‘একটা কুকুর চারটে বাচ্চা দিয়েছে নিধিকাকুদের গোয়ালঘরের উঠোনে। মা-কুকুরটা নিধিকাকুদের পোষা। তাই বাচ্চাগুলোকে ট্রাস্ট করা যায়। স্ট্রিট ডগ নয়। কালো-সাদায় মিশে বেশ দেখতে কিন্তু!’
   ইচ্ছেদাদুর বুকের ভিতর থেকে একটা অচেনা দুঃখ বেরিয়ে এল। টিভিরুমে বসে তিন্নি, বিন্নি আর বুম্বা আজকের মিটিংয়ের শোনা কথাগুলোর সারাংশ করে নিল। 
   বিন্নি দু’ হাত নেড়ে বলল, ‘শোন তিন্নিদি, আমাদের বাড়িতে চারটে খাঁচাই তা হলে থাকছে। ভালই হল, ইচ্ছেঠাকুরমার একটা হীরামন পাখি, বড়বাবুর একটা বিড়াল মিঁউ, আমার বাবার একটা কুকুর বিংগো, আর শুধুকাকার একটা খরগোশ কুমি---কী মজাই না হবে!’
   বুম্বা জিজ্ঞেস করল, ‘বিন্নিদি, খাঁচাগুলো কোথায় রাখা হবে রে? একতলায় না দোতলার বারান্দায়?’
   বিন্নি বলল, ‘তার আমি কী জানি? এখন তো সব খাঁচাই দোতলার বারান্দায় রাখা আছে দেখছি। দেখি কী হয়!’
   এমন সময় ইচ্ছেদাদুর সঙ্গে সকলেই মিটিং শেষ করে বেরিয়ে আসছেন, তার মানে আজকের মতো মিটিং শেষ!
(এর পর আগামী রোববার)

হীরামন
সুকুমার রুজ

 তাতাই! তুই তো খুব মিথ্যুক!  কোথায় তোর সেই বন্ধু?  
   বন্ধুর কথাগুলো শুনে তাতাই কোন কথা বলে না। ওর ডাগর চোখজোড়া জানলার বাইরের স্থির, মনের মাঝে মেঘ, চোখের কোনে বৃষ্টিফোঁটা। ও মিথ্যে বলেনি। অথচ বন্ধুরা...!          
  আজ ওর জন্মদিনের আনন্দটা আস্তে আস্তে কষ্টে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ও ভেবেছিল, ওর এই এগারোতম  জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা সবচেয়ে আনন্দের হবে।  
  তাতাই বন্ধুদের কাছে আর বসে থাকতে পারে না। ওর কান্না পায়। তাই ও রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে আসে। মা তখন বাটিতে বাটিতে পায়েস তুলতে ব্যস্ত। ও মায়ের আঁচল ধরে অভিমানী গলায় বলে ওঠে — মা, আমার নতুন বন্ধু তো এলো না!       
  ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলে ওঠেন — আসবে রে বাবা! আসবে। মানুষেরা কথা না রাখলেও ওরা কথা রাখে। যা, তুই এখন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প কর। একটু পরেই খেতে দেব।          
  তাতাই বন্ধুদের কাছে যায় না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঠোনে লেবুগাছ দেখে। কাঁঠালগাছের ডালে চোখ ছোঁড়ে। কিন্তু কোথাও নেই ওর নতুন বন্ধু। অথচ রোজ খাওয়ার সময় মা গলা উঁচিয়ে 'আয় আয় হীরামন' ব'লে ডাকতেই, কোত্থেকে উড়ে এসে বসে গ্রিলের ফাঁকে। ডাইনে-বাঁয়ে ঘার ঘোরায়। ও খেতে খেতে কয়েকদানা ভাত ছড়িয়ে দেয় বারান্দার মেঝেতে। বন্ধু গ্রিল থেকে উড়ে এসে মেঝেয় বসে। তুরুক তুরুক লাফায় আর খুঁটে খুঁটে ভাত খায়। তা দেখতে দেখতে কখন যে মা ওর পেটে সমস্ত ভাত চালান করে দেন, তা ও জানতেই পারে না। খাওয়া শেষ হতে না হতেই, বন্ধুটা ফুরুৎ করে উড়ে আবার গ্রিলের ফাঁকে বসে। বাদামি পালক ফুলিয়ে, মাথার কালো ঝুঁটি উঁচিয়ে, আকাশপানে মুখ তুলে মিষ্টি সুরে শিস দিয়ে ওঠে। তখন মা বলেন, 'দেখলি, তুই সব ভাত খেয়ে নিয়েছিস ব'লে খুশি হয়ে তোর বন্ধু তোকে গান শুনিয়ে দিল।' তখন ওর মনটা খুশিতে ভরে যায়।  
  অথচ আজ ওর মনে কষ্ট। ওর মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন — রেডি হয়ে গেছে, এসো, এবার সবাইকে খেতে দেবো। 
  একটু পরেই সবাই বারান্দায় খেতে বসেছে। মা হাসি হাসি মুখে ওদেরকে খাবার দিচ্ছেন। তাতাইয়ের খাওয়ায় তেমন মন নেই। মা আড়চোখে ওর দিকে তাকান। মুচকি হেসে লেবুগাছের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সুর করে ডেকে  ওঠেন — আয় আয় হীরামন...!  
  তাতাইয়ের মনে দোলাচল, বন্ধু আসবে তো? না এলে স্কুলের বন্ধুদের কাছে খেলো হতে হবে। ওরা মিথ্যুক বলবে। ও হঠাৎ দেখে, হাওয়ায় গা ভাসিয়ে কাঁঠালগাছ থেকে উড়ে এলো ওর বন্ধু। গ্রিলের ফাঁকে বসল সঙ্গে সঙ্গে তাতাইয়ের ঠোঁটের ফাঁকে মুক্তোঝিলিক। ও খুশিভরা চোখে বন্ধুকে দেখে।  
  আরে! ওর মুখে কী যেন একটা! ও মা! টকটকে হলুদ রঙের একটা নাম না জানা ফুল! তাতাই হইহই করে  ওঠে — ওই তো আমার নতুন বন্ধু এসে গেছে। দ্যাখ, তোরা বিশ্বাসই করছিলিস না।  
  পাখিটা গ্রিল থেকে উড়ান দিয়ে তাতাইয়ের কাঁধে এসে বসে। তাতাই খুশি হয়ে ওকে আদর করার জন্য আলতো    করে হাত উঁচু করতেই, হাতের তালুতে টুপুস করে ফুলটা ফেলে দেয় পাখিটা। তারপর আবার উড়ে গিয়ে গ্রিলের ফাঁকে বসে। মা ততক্ষণে একটা বাটিতে হীরামন এর জন্য পায়েস তুলেছেন। হীরামনের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আকাশের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তুমুল সুরে শিস দিতে থাকে। তাতাই সে শিসের মধ্যে শুনতে পায় — জন্মদিন... বন্ধুর জন্মদিন...! 

নোনাজল
জগদীশ শর্মা 

টাক্ ডুম টাক্ ডুম
রাতে জাগি দিনে ঘুম

খটাখট্   খটা খট্ খট্
এ সময়   কট্ মট্ কট্

ছলছল    ছলাৎ ছল
আঁখি দিঘি  নোনা জল।

জলছুরি
জগদীশ শর্মা 

ফুলেরা ফুটছে ফুটুক 
রোদে জলে
ঝলসে  উঠুক

জলছুরি রঙে আঁকা 
আমার এই ভূবনডাঙা।


রাস্তা
মুক্তি দাশ

তাতাইদের বাড়ির পেছনদিকের যে মেঠোপথটা বিশ্বাসকাকুর বাড়ির কাছে বাঁক নিয়ে সটান গিয়ে বড়রাস্তায় পড়েছে, সেই রাস্তায় এখন মেরামতির কাজ চলছে। এবড়ো-খেবড়ো মাটির রাস্তাকে সমান করে ইঁট বিছানো হয়ে গেছে। এরপর নাকি আবার ঢালাই হবে। 
তাতাই তার বাড়ির জানলার গ্রীলে গাল ঠেকিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে রোজ রাস্তা সারানো দেখে। বিভোর হয়ে দেখে। মাথায় গামছা বাঁধা কালো কালো ঘেমো শরীরের চারজন মিস্তিরি অনবরত কাজ করে চলেছে। একদিন বেজায় কৌতূহলী হয়ে একজন মিস্তিরি জানলার কাছে এসে বলল, ‘ক’দিন ধরে দেখছি খুব মন দিয়ে তুমি আমাদের কাজ দেখছ…তোমার নাম কী? 
‘আমার নাম তাতাই…তোমরা রাস্তা বানাও বুঝি?
মিস্তিরি বলল, ‘বানাই তো! দেখছ না, তোমাদের এই মাটির রাস্তায় কত সুন্দর করে ইঁট বসিয়ে দিয়েছি। এরপর সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে দেব। তখন আরাম করে এই রাস্তায় তোমরা দিব্যি হাঁটাচলা পারবে…বেশ মজা হবে তাইনা?’
কথাগুলো যেন তাতাইয়ের কানেই ঢুকলো না। সে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আমার জন্যে একটা রাস্তা বানিয়ে দেবে গো?’
মিস্তির অবাক। এ আবার কেমনধারা কথা! মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে না পেরে সে বলল, ‘তুমি কোন রাস্তার কথা বলছ বল তো?’
ব্যথিত গলায় তাতাই বলল, ‘আমার মায়ের কাছে যাবার রাস্তা। আমার মা-তো এখানে থাকে না…’
‘তাহলে কোথায় থাকেন তোমার মা?’
অ-নে-ক দূরে থাকে! যখন খুব ছোটো ছিলাম কোথায় যে হারিয়ে গেল আমার মা! বাপি বলেছে মা নাকি আকাশের তারা হয়ে গেছে…’ 
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে তাতাই ফের বলল, ‘এখন দিনেরবেলা তো দেখাতে পারবো না…একদিন রাত হয়ে গেলে এসো, দেখিয়ে দেব! কত্তোবার বাপিকে বলেছি, আমাকে মায়ের কাছে একবার নিয়ে চলো, নিয়ে চলো, নিয়ে চলো…আমি ঠিক মা-কে ফেরত নিয়ে আসব! বাপি শোনেই না! কী বলে জানো?’
মিস্তিরি প্রায় বাকরুদ্ধ। তবু কোনোরকমে বলল, ‘কী বলে?’
তাতাই বলল, ‘বলে, মায়ের কাছে যাবার কোনো রাস্তাই নাকি নেই! ও কাকু, একদিন রাত্তিরে এসো না গো! আমি তোমাকে সেই তারাটা দেখিয়ে দেব, তাহলে তুমি ভালো করে দেখে নিয়ে সেই পর্যন্ত একটা রাস্তা বানিয়ে দেবে…দেবে তো?’ 
আমার স্কুল-জীবন ও মাস্টারমশাইরা
অসীম হালদার

ছোট বন্ধুরা, তোমরা ঘরে বসে অন লাইন ক্লাস করতে করতে অবশ্যই হাঁপিয়ে উঠেছো, নিশ্চয়ই। হবারই কথা; চলো একটু না ওসব ছেড়ে একটু গল্প করি, মাঠে তো জড়ো হতে পারছি না, তাই তো তোমাদের সোনালী আন্টি বলেই দিয়েছেন এসময়ে কি কি করলে তোমরা ভালো থাকবে, তাই না! চলো, এখন একটু গল্প করা যাক আমার ছোটবেলা নিয়ে তোমাদের সাথে...

আমি ছোটবেলায় অনেক স্কুলে পড়েছি, কারণ বাবার চাকরিতে বদলি হয়ে যেত। তাই বিভিন্ন স্কুলের মাস্টারমশাইদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি।
যখন আমি ক্লাস সিক্সে, তখন পড়তাম নূরপুরের কাছে মাথুর জে. এম. হাই স্কুলে। তখন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে প্রায় তিন মাস। আমি জানতাম, ওখানে অ্যাডমিশান টেস্ট দিতে হবে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার পৃথ্বীশ পুরকাইতবাবু বললেন মজা করে, "পরীক্ষা দেবে? আচ্ছা, ঠিক আছে, সামনে ফার্স্ট টারমিনাল পরীক্ষা, তুমি পড়তে থাকো।" বাবা বললো আগের বছরের প্রশ্নগুলো যোগাড় করতে। পড়াও চলতে লাগলো, আর স্কুল থেকে গুচ্ছের প্রশ্নপত্র পেয়ে কি আনন্দ, অনেক উত্তর বলতে পারছি, উঃ! কি মজা! ঐ স্কুলে ত্রিপাঠী স্যারের নামে তখন পিলে চমকে যেতো সবার! উনি জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন। পড়াতে আসার সময় হাতে ছড়ি আনতে ভুলতেন না কোনদিন! ঐ ভয়ের চোটে একদিনও পড়া কামাই করি নি আমি। ললিতকুমার খাঁ নিতেন ইংরাজীর ক্লাস...বাবার কাছে গ্রামার বা ইংরাজীর গল্পগুলো পড়ে নিতাম। তাই ক্লাসে অসুবিধা হোত না বুঝতে। এইজন্য স্যারেরা ভালবাসতেন আমাকে, আশীর্বাদ করতেন। পরের বছর ক্লাস এইটে ভর্তি হলাম সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে। ঐ একবছরই পড়েছিলাম সেখানে। এখানেও একজন ভয়ানক রাগী স্যার ছিলেন, যাঁকে সবাই শাসমলবাবু বলে ডাকতেন। একদিন হয়েছে কি, ভাবলাম ওনাকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে, যদি কোন দোষই না করি! ভেবে ওনার কাছাকাছি একটু ঘুরঘুর করতেই কাছে ডাকলেন, 'অ্যাই, এদিকে আয় তো' ... কাছে যেতেই দিলেন কানটা মুলে! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বুঝতেই পারলাম না কি দোষটা করলাম! বোঝ তোমরা! একজন স্যার ক্লাসে ঢুকেই কারো নাম ধরে ডাকতেন না...এসেই বলতেন, "ইঁদুর বিড়াল টিকটিকি ছুঁচো বাঁদড়...বের কর বই, পড়া না পারলে..." তারপর হস্টেলের খাবার দাবার নিয়ে খোঁজ নিতেন যারা হস্টেলে থাকত, তাদের কাছ থেকে...
মাধ্যমিক পর্যন্ত হস্টেলে থেকে ঐ স্কুলে পড়লে খুব ভাল হোত, কিন্তু মা বাবা চোখের আড়াল করতে দেয় নি। তবে ঐ স্কুলে আমার একটা বাজে রেকর্ডও হয়ে গিয়েছিল। আসলে জানো তো, তোমরা যতই পড়ো না কেন, তা যদি প্রতিদিন চর্চা না রাখো, সব ভুলতে থাকবে একটা সময় পর। এমনই একটা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার জীবনে ঐ স্কুলে পড়তে গিয়ে। ফার্স্ট টারমিনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো, তিনটে পেপার, ইংরাজী, অঙ্ক আর ভৌতবিজ্ঞানে ২৭ নম্বর করে পেয়েছিলাম ১০০র মধ্যে! কি মনে হচ্ছে শুনে? জঘন্য, তাই না! সত্যি, আমি খাতা পেয়ে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না এত ভুল কি করে হোল! অগত্যা উত্তম মধ্যম ধোলাই পড়লো, তখন থেকে বাবার কাছে প্রতি শনি ও রবিবার করে ইংরাজী ও অঙ্কের পরীক্ষা দিতাম। দুর্গাপুজোর সময়েও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি, জানো! জেদ নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে তবেই ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলাম। এর ফলে পরের পরীক্ষাগুলোতে তিনগুণ নম্বর পেয়ে ক্লাস এইটে উঠলাম। এতে কিন্তু ঠকি নি, শিখেছি, এই লড়াইটা খুবই দরকার। 
আবার ট্রান্সফার, গন্তব্যস্থল হোল মল্লিকপুরের কাছে গোবিন্দপুর রত্নেশ্বর হাই স্কুল, ক্লাস এইটে ভর্তি হলাম টেস্ট দিয়ে। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় রত্নেশ্বর চট্টোপাধ্যায় একজন বিপ্লবী ছিলেন। এই স্কুলের অভিজ্ঞতাই সবচাইতে বেশী। এখানে পেয়েছি নরেশবাবুকে, জ্যোতি বাবুকে, চিত্তবাবু, অরুণবাবু, পূর্ণেন্দুবাবু, ইন্দুবাবু, অনিন্দিতা দিদিমণিকে...এঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা না লিখলে বোধহয় সবকিছু বলা বাকি থেকেই যাবে! 
প্রথমেই আসি, ইন্দুবাবুর কথায়, উনি বাংলা পড়াতেন। না, এইটুকু বললে হবে না...ওনার কলেবরটি না জানালে রসিকবোধটা আমার জেগে উঠবে না। তবে তোমাদের বলে দি, এই দুষ্টুমিগুলো তোমাদের মতো ভাল ছেলেমেয়েদের জন্য একদম নয় কিন্তু। আমরা শান্তস্বভাবের মধ্যে ছিলাম কয়েকজন ভয়ানক ডেঁপো! উনি লম্বায় অন্ততঃ ৫ ফুট ১০ ইন্চি, প্রমাণমাপের উদর বিশিষ্ট অনেকটা ব্যারেল আকৃতির, মাথাটাও বেশ কাতলা মাছের মতো! ধবধবে ধুতি পান্জাবীপরিহিত আর মাথার পিছনে একটি শিখা! তাতে কোনদিন একটি করে জবাফুল লাগানো থাকতো! সংস্কৃতির পণ্ডিত মানুষ যখন বাংলা পড়াতেন, খুব বিভোর হয়ে যেতেন। ক্লাসের সবাই জানতো সেটা। পড়া না পাড়লে রক্ষে থাকতো না। বেছে বেছে মুখ দেখে দাঁড় করিয়ে পড়া জিগ্যেস করতেন। না পারলে কাছে ডাকতেন, তারপর সেই ছাত্রের জামার কাপড় দিয়ে কান ধরে রগড়ে দিয়ে মোটা হাত দিয়ে কষিয়ে এক থাপ্পড়! বুঝতে পারছো না তো, কান ধরার টেকনিকটা অমন কেন...বলছি, তখন তো অনেকেই সরষের তেল মেখে স্নান করতো, কান ধরতে গিয়ে সেই তেল স্যারের হাতে পাছে লেগে যায়, তার জন্য তিনি এই টেকনিক নিতেন। নীল ডাউনও করাতেন ক্লাসের বাইরে! কি লজ্জার ব্যাপার বলো তো! আমার জীবনে এরকম দু দিন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাতে একটি হাল্কা চড় এবং বেন্চে দাঁড়ানোর শাস্তি জুটেছিল! কি বুঝতে পারছো তো! দুষ্টুমিতে খুব কম ছিলাম না! একদিন 'পূর্বরাগ' কবিতাটি পড়ে সুন্দর করে বোঝাচ্ছেন...সবেমাত্র একটি লাইন পড়ে শেষ করেছেন, "রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা..." আবেগে চোখ বন্ধ করেই ছিলেন, হঠাৎ শুনতে পেলেন, দু তিনজন পর পর বলে গেল...'ব্যথা, ব্যথা, ব্যথা...' সঙ্গে সঙ্গে পড়া থামিয়ে বলে উঠলেন, 'যদি কোন ভদ্রলোকের সন্তান হয়, উঠে দাঁড়াও, আবারও বলছি..." তাড়স্বরে কোনদিনই কিছু বলতেন না, কিন্তু বেশ আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করেই যা বলতেন, তাতে চোখমুখ লাল হয়ে উঠতো। কিন্তু ভাবতে পারবে না তোমরা আমি এনার কাছেই বাংলা ক্লাস করেছি, সাহিত্য রসের সন্ধান পেয়েছি আজ ওনার জন্যই। পরীক্ষার খাতা দেখার সময় স্যার চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডাকতেন। এবার আসি নরেশবাবুর কথায়, উনি ইংরাজী নিতেন আমাদের। হাতঘড়িটা কব্জি ছেড়ে কনুইএর কাছে চলে আসতো। প্যান্ট উঠে আসতো গোড়ালির ওপরে। প্রচুর জ্ঞান ইংরাজীতে। উচ্চতায় বড়জোর পৌঁনে পাঁচ ফুট, রোগাটে গরণ। হাই পাওয়ারের চশমায় মাথাটা লম্বালম্বী দাড় করানো ঘাড়ের ওপর। কিন্তু ওনার উচ্চারণ বুঝতে কষ্ট হোত, বড় জিহ্বার জন্য! ফলে লালা ছড়িয়ে পড়তো সামনের ছাত্রদের হাতে, গায়ের জামায়! ওনার ভালবাসার টেকনিক আবার অদ্ভূত রকমের! হঠাৎ কারো হাত টেনে ধরে পড়াশুনোর খবর নিয়েই হাতে দিতেন একটা মোক্ষম চিমটি! তা না হয় সহ্য হোত, কিন্তু যে হাত দিয়ে চিমটি কাটলেন, তা হামেশাই রাখতেন মুখের ভেতর, সুতরাং কি কাণ্ড হোত বোঝ! এইজন্য নাগালের বাইরে থাকতেই চাইতাম সবাই। এরপর আসি অরুণবাবুর কথায়...একগাল পানখাওয়া মুখ নিয়ে পড়াতে এসে যখন সবাইকে জিগ্যেস করতেন আমরা সবাই বুঝেছি কি না, উনি বলতেন, " ঘাড় তো ঢক ঢক করে নড়ছে..." তবে পড়াতেন বেশ! আরও টুকরো টুকরো কত ঘটনা চোখে ভাসে স্মৃতির পাতায়...তোমাদের জীবনেও স্কুলের বন্ধুদের সাহচর্য এবং দিদিমণি, স্যারেদের সংস্পর্শে অভিজ্ঞতার কথা যখন মনে পড়বে বড়ো হয়ে, তখন কখনো যেমন খুব ভালো লাগবে, তেমনি ঐ সময়টা পেরিয়ে এলে তখন অনেককেই খুব মিস্ করবে গো! এটাই তো একাত্মতা স্কুলের সাথে ছাত্রছাত্রীদের! জীবনে বড়ো হতে তাঁদের আশীর্বাদ এবং স্নেহ সবসময়ই যে চাই। তাই এঁদের গুরুত্ব অনেক ছাত্রজীবনে। এখন একটা খুব অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি ঠিকই, দরকার লড়াই, একসাথে বাবা মায়েদের সাথে। তোমরা সাথে থাকলে বাবা মায়েরাও মনে জোর পাবে, তোমরাই তো তাঁদের শক্তি, তাই না!

গরমের ছড়া 
রেনেসাঁ গঙ্গোপাধ্যায় 
সপ্তম শ্রেণী, স্যাক্রেড হার্ট স্কুল, আদ্রা,পুরুলিয়া

রোদ বাড়ে পায়ে পায়ে
পুড়ে যায় গাছও 
এমন গরম দিনে
কীরকম আছো ?

ভালো নেই ডালপালা 
ছানাপোনা ফুল 
এক ফুঁয়ে সব যদি
হয়ে যেত cool.


বেরঙা সময়
সাত্ত্বিকী নস্কর, 
পঞ্চম শ্রেণী, মাকড়দহ গার্লস হাইস্কুল, ডোমজুড়, হাওড়া

আমার কাছে প্রত্যেকটা দিন আমার রঙের বাক্সটার মতো। এক একটা খুশির জমাট মোম। অন্তত একটা বছর আগে তাই ছিল। সব বন্ধুরা মিলে খেলা, টিফিন খাওয়া, হৈ চৈ-এ বেশ কাটছিল। বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে বলতাম, ‘যা! কোনোদিন কথা বলবনা তোর সঙ্গে’। এখন সেই বন্ধুকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে। মোবাইল আছে। ভিডিও কলে কথাও হয়। কিন্তু সে যেন কথা নয়। ছুঁতে পারি না তো। খেলতে পারি না তো একসঙ্গে।
 তখন মার্চ মাস। ২০২০। Annual Exam শেষ হলো 7th এ। 9th এ আমাদের যাওয়ার কথা সিকিম। পরীক্ষার দিনগুলোতে সেই গল্প করতাম বন্ধুদের কাছে। শেষ পরীক্ষার দিন সকলকে টা টা করে সেই যে বাড়ি ফিরলাম এখনও পর্যন্ত আর স্কুলে যাওয়া হল না। দেখা হয় না, খেলা হয় না আর কারও সঙ্গে।
প্রথম ধাক্কাটা এল 8th মার্চ। পাপা-মাম্‌মা কয়েকদিন ধরেই বেড়াতে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিল। সেদিন জানতে পারলাম যাওয়া হচ্ছে না। খুউউব মন খারাপ হল। না যাওয়ার কারণ ছিল করোনা। নতুন নামের অজানা এক ভাইরাস। খুব রাগ হল করোনার ওপর। তারপর আস্তে আস্তে খেলার জায়গা দখল নিল করোনা। আঁকার স্কুলও বন্ধ হয়ে গেল। দুটো ঘর আর ছোট্ট বারান্দার ফ্ল্যাটে বন্দী হয়ে গেলাম।

লকডাউনের প্রথম দিকে অবশ্য বেশ মজা হয়েছিল। আমাকে স্কুল যেতে হচ্ছে না। পাপার অফিস নেই। মাম্‌-মা-র কলেজ বন্ধ। বাড়িতে একসঙ্গে দুজনকে পেয়ে খুব আনন্দে দিন কাটছিল। কিন্তু তিন-চার মাস কাটার পর সব একঘেঁয়ে লাগতে লাগল। সেই অবস্থা থেকে বাঁচতে  আমাদের ছোট্ট বারান্দাটি  সাজিয়ে তুললাম  ফুলের গাছে। রঙিন ফুল দেখে আনন্দ হয়। কিন্তু ওরাও যেন আমার মতো বন্দী।

 লকডাউনের  মধ্যেই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেল। কিন্তু পুরোনো দিন ফিরে এলো না। স্কুলের বেঞ্চে বসে ক্লাস করা ----বড্ড মিস্‌ করি। অনলাইন ক্লাস একটুও ভালো নয়। কেউ  বুঝতে চায় না যে ভালো লাগে না। কিচ্ছু ভালো লাগে না। সব বেরঙা লাগে। কিছুদিন আগেও মনে হচ্ছিল নতুন বছরে আবার হয়ত স্কুলে যাব। মাঠে খেলব বন্ধুদের হাত ধরে। ম্যামের হাতের লেখায় লাল কালিতে Very good -- খাতায় দেখতে পাব। এই ইচ্ছেগুলো যে আবার বাক্স বন্দী হয়ে গেল। কবে আবার বাইরে বের হব ? স্কুলে সবার সঙ্গে বেঞ্চে বসব? খেলব? কবে? কবে?
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১
(দশম শ্রেণীর সুখময় বিশ্বাস ২৯ তম সংখ্যা পড়ে যা লিখল) 

সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন বছরে নতুন সাজে জ্বলদর্চি। উপন্যাস মানেই তো একটা নেশা তাই না! একবার ধরলে হয়, শেষ না করে ওঠার কোনো প্রসঙ্গ আসেই না। কিন্তু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হয় ফএকটা সপ্তাহের।
  নতুন বছরে নতুন উপন্যাস, "ফুলকুসুম পুর খুব কাছেই"। ইচ্ছেদাদুর হাসি খুশি পরিবার,যেটা আমরা সকলেই চাই। এই অংশে ইচ্ছেদাদু ও অনিচ্ছঠাকুমার ঝগড়ার আড়ালে আছে ভালোবাসার সূক্ষ্ম সুতোর বাঁধন। আর ইচ্ছেদাদুর বাড়ির মালিকানা। আমরা ছোটরা বড়দের কথার অর্থ বুঝি বা না বুঝি ওর মাঝেই খুঁজে নিই নিজেদের আনন্দের বিষয়।এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বুম্বা রাধাগোবিন্দকে রাইম শেখানোর আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছে। 
    সত্যি কি একটা ভয়ানক অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা চলছি। সারা বিশ্বকে ঘায়েল করেছে "করোনার" থাবা। করোনার দ্বিতীয় থাবা এবার আঘাত করছে ছোটোদের। এই সময় করোনা ডিজিস এড়ানোর গাইড লাইন দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ডঃ সোনালি মুখোপাধ্যায় ভট্টাচার্যকে। 
      আমাদের সমাজটা আজ‌ও কত স্বার্থপর মানুষে ভরতি। সমস্ত জীবের অপত্য জীব সেই প্রজাতি ভুক্ত‌ই হয়, একমাত্র মানুষ ছাড়া।জন্মালেই মানুষ হ‌ওয়া যায় না, দুপায়া জীব হ‌ওয়া যায় বটে। মানুষ হতে গেলে অবশ্যই চরম অধ্যাবসা ও জেদ, পরিশ্রম দরকার। 
   রূপকথার ভন্টাই গল্পে ভন্টাই তার পরিশ্রমের দ্বারা হতে চেয়েছে একজন ভালো মানুষ। যাকে সবাই মনে রাখবে। আমাদের দুপায়া জীব না হয়ে মানুষ হ‌ওয়া উচিত, সবার। 
    "পেটুক বেড়াল" মানে বাঙালি বটে। ভোজন রসিক বাঙালি। আর বাঙালি বাড়িতে বর্ষাতে কি ইলিশ না হলে চলে! কিন্তু হুলোর কীর্তি কবিতায় আঁকুপাঁকু প্রাণের সীতানাথের আনা ইলিশ শেষপর্যন্ত গেল হুলোর পেটে। বেশ রসিক কবিতাটা। 
      কিছু পেতে গেলে কিছু খোয়াতেও হয়। বিদায় পার্বতীপুর ছোটো গল্পে এমনটাই হয়েছে।
   শ্রীপর্ণা ঘোষের "গোয়েন্দা রিমিল গল্পে,গল্পের কথকের শার্লক হোমস চরিত্রটা দেখে বাস্তবে তার প্রয়োগ করা বেশ উল্লেখ যোগ্য। আমরা যা শিখি তা অবশ্যই বাস্তবে প্রয়োগ করা উচিত। 
  চতুর্থ শ্রেণীর সুহেনার প্রচেষ্টা যেন অব্যাহত থাকে। তাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। 
   অনেক অনেক ধন্যবাদ চিত্র শিল্পী দের জ্বলদর্চিকে রঙীন করার জন্য
 একটা কিছু বাদ রাখছি কি? হ্যাঁ..মনোজিৎদা-র জানো কি। ক্যুইজ ব‌ইয়ের মতো মনোজিৎদা প্রতি সপ্তাহে দিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কিছু।তাকেও নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইল।। অপেক্ষায় রইলাম পরের সংখ্যার।

পাঠ প্রতিক্রিয়া ২
(দ্বিতীয় শ্রেণীর সাঁঝবাতি কুন্ডু ২৯ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে যা লিখল)

দেওয়ালে আঁকা দুটো রাগি রাগি ছবির সামনে ভাই-বোনের আদেরর ছবিটা ভীষন মিষ্টি লেগেছে আমার।
রতনতনু ঘাঁটির
'ফুলকুসুমপুর খুব কাছে"
ইচ্ছে দাদু আর অনিচ্ছে ঠাকুরমা ঝগড়াটা খুব মিষ্টি ছিল। হীরামন রাধাগোবিন্দ খাঁচা পাওয়াতে তিন্নিদিদি,বিন্নি আর বুম্বাদের মত আমিও খুব খুশি।
এরপর কি হয় জানতে আমার খুব আগ্রহ।গল্পের সাথে মিলিয়ে আঁকা ভীষণ সুন্দর।
ডাঃ সোনালী মুখোপাধ্যায় ভট্টাচার্য 
'কোভিড ঠেকানোর উপায়' 
এই দুঃসময় আমাদের সবাই কে সচেতন হতে হবে।উনি যেই বিধি-নিষেধ গুলো আমাদের মানতে বলেছেন সেগুলো যদি মেনে চলি তাহলে আমাদেরই উপকার হবে।এই লড়াই আমাদের কে জিততেই হবে।আর যে ঘরবন্দি থাকা যাচ্ছে না।যারা সবথেকে বেশি লড়ছে-ডাক্তারদের কে এসো সবাই মিলে চিয়ার্স করি।
সৌমী আচার্য 
'রূপকথার ভন্টাই
ভন্টাইয়ের কত কষ্ট করে লড়াই করে।
আমাদের আশেপাশে এইরকম অনেক ভন্টাই আছে আমি বড় হয়ে তাদের জন্যে কিছু করতে চাই
আমিও ভন্টাইয়ের মতো রোল মডেল হতে চাই।
ছন্দিতা মল্লিক 
হুলোর কীর্তি 
ইলিশ মাছের গন্ধ পেলে আমিও 
সীতানাথবাবুর মত হুলো হয়ে যাই।
কড়া করে ইলিশ মাছটা উপরে একটু নুন ছড়িয়ে-ইয়াম্ম ইয়াম্মি।আর ভাপা-আহা।
শতদ্রু মজুমদার 
বিদায় পার্বতীপুর
এই গল্পটা ভীষণ মজার লেগেছে।চোরেরও যে পোকেট মার হয় আমি জানতামই না।
শ্রীপর্ণা ঘোষ
গোয়েন্দা রিমিল
এই গল্পটা আমি 'এন.জে.'এর আড্ডায় শুনেছিলাম।এই গল্প পড়ে এখন আমি মাঝে মাঝে বাড়িতে গোয়েন্দাগিরি করছি।
সুহেনা মন্ডল
জাদুর দেশ
দারুণ লেগেছে এই ছড়াটা।
ঐশিকের আঁকা বিড়ালটা ভারি মিষ্টি।আচ্ছা এই ঐশিক কি 'ক্যাপ্টেন নিমো?' ও তো আমার বন্ধু।
সাত্ত্বিকী নস্কর,তুলি দাস,সংজ্ঞা রায়,ঈশিতা ব্যানার্জি সবার আঁকাই খুব ভালো লেগেছে আমার।
জানো কি? বিভাগে ভারতরত্ন কেন পায় সেটা আমাকে মা বুঝিয়ে দিল।
শেষে বলি আমি জ্বলদর্চির প্রত্যেক সংখ্যা পড়ি। গল্প শুরুর আগে মৌসুমী মাসির লেখা আমার সব থেকে ভালো লাগে।মা আমাকে বলেছে সেটা কে সম্পাদকীয় বলে।আমি মৌসুমী মাসির কাছে জ্বলদর্চির মানে জানতে চাই আর জ্বলদর্চি যদি বই হত তাহলে আমার পড়তে আরো ভালো লাগত কারন ফোনটা আমি সব সময় মার কাছ থেকে পাই না।

পাঠ প্রতিক্রিয়া ৩
(জ্বলদর্চির ২৯ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে সুদীপ্তা আদিত্য যা লিখলেন)

আদর ও আবদার -পরিপূরক শব্দযুগল। এমনি একজন মানুষ যার মুখের আদলে মাতৃত্ব ধরা পড়ে। আবদারে আদরে যার বুকে মাথা রেখে সহস্র ভয় কাটিয়ে ওঠা যায় -সেই মানুষটি বোধ হয় 'দিদি' হয়ে থাকেন। টিনের চাল আর সুসজ্জিত গোবরলেপা দেওয়াল জুড়ে কত সুন্দর ভাবে গোমাতা এমন দিদি বোনের খুনসুটি দেখে তৃপ্তির হাসি হাসছেন তাই না! চিত্রগ্রাহক নীলাব্জ ঘোষ মহাশয়ের ক্যামেরা বন্দী ছবি খানা সেই কথা বলে। 

এবার আসা যাক রতনতনু ঘাটী মহাশয়ের 'ফুলকুসুমপুর খুব কাছে' ধারাবাহিক উপন্যাস এর দ্বিতীয় পর্ব এ। পর্ব জুড়ে শুধুই ইচ্ছে দাদুর আর অনিচ্ছে ঠাম্মির মধ্যে একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে টানাপোড়ন। রাধাগোবিন্দ যা কি না ঠাম্মির সাধের হীরামন পাখি তাকে বাঁশের খাঁচাতে পোষার বড় সাধ। হীরামন কে নাকি খাসা কথা শেখাবে, আদো আদো করে রাইমস শেখাবে এমনি ইচ্ছে দাদুর নাতি নাতনিদের। দাদুও বেশ একরোখা। পশুপাখি কে এমন করে কে বাঁধে! দেখা যাক সংসারে কার সিদ্ধান্ত অটল থাকে -'রাধাগোবিন্দর জন্য কি একটা খাঁচা  বরাদ্দ হল? '

এ আলোচনা তে 'করোনা' থাকবে না তা কেমন করে হয়! ডাক্তার  সোনালী মুখোপাধ্যায় ভট্টাচার্য মহাশয়া করোনা ঠেকানোর দশটি টিপস দিয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় স্রোতে মানুষ এখন প্রায় বিপদসীমায়। এই পরামর্শ যথাযথ ভাবে না মানলে পস্তাতে হবে বইকি!  আগাম সতর্কবার্তা প্রেরণ করে পাশে থাকার জন্য লেখিকাকে ধন্যবাদ ।

আজো সমাজে অনির্বাণ স্যারের মতন শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষ আছেন বলেই কত 'ভন্টাই ' হারিয়ে যায় না। 'জগদীশ দেব' হয়ে জনসমক্ষে উঠে আসে। ভন্টাইয়ের প্রতিকূল জীবনে স্বপ্ন ছোঁয়ার সদিচ্ছাকে কুর্ণিশ জানাই। লেখিকা সৌমী আচার্য  মহাশয়ার 'রূপকথার ভন্টাই' এভাবেই বাস্তবের মাটিতে পরিচিতি পাক,শুভকামনা রইল।

খাদ্যরসিক সীতানাথবাবু কত না সাধ করে বাড়িতে মাছ আনেন, গিন্নীও তা রাঁধেন বেশ জমিয়ে। কিন্ত কার খাবার কার পেটে যায় তা বোঝা দায়! 'একমুখ ভাজা মাছে হুলো পড়ে ধরা। ' এমন করে সাবলীল, সহজ, সরল শব্দ চয়ন করে 'হুলোর কির্তী ' নিয়ে হাজির লেখিকা ছন্দিতা মল্লিক। 

লেখক শতদ্রু মজুমদার এর 'বিদায় পার্বতীপুর' ছোটগল্প এ কাঁদন পরামাণিক এর চুরিবিদ্যা আদতে যে বড়োবিদ্যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তা বোঝা আর বাকি থাকে না। ওস্তাদে ওস্তাদে কোলাকুলি তে কাঁদন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায় -'তিন পয়সার নাকছাবিটা চুরি গেল! পাওয়া গেল আট আনা সোনার আংটি' বলতেই হবে যে কাঁদনের পার্বতীপুর অভিযান তাহলে সার্থক হল বটে। 

খুদে লেখিকা শ্রীপর্না ঘোষ এর 'গোয়েন্দা রিমিল' বেশ অন্যরকম। 

আমাদের পুচকে লেখিকা সুহেনা মন্ডল কম যায় না। তার 'জাদুর দেশ'কবিতা পড়ে রূপকথার দেশে তলিয়ে গেছি আমরা সবাই। রাজকুমার, জাদুকুমারের বশে বশীভূত হয়ে বলে চলেছি-
'জাদুর দেশ থাকে চিরন্তন, 
অমর হয়ে, হয় না পরিবর্তন। '

রয়ে গেল রঙচঙে ছবি আর মনোজিৎ বেরার 'জানো কি' নামক উপাদেয় অধ্যায়। 

ঐশিক ভাই এর আঁকা  বিড়ালছানাটি কেমন যেন মুখ ভেঙচিয়ে দুখী দুখী মন নিয়ে কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে আছে -মা কত না বকেছে ছানাটাকে! 

ঈশিতা বুনুর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ছবিটা বেশ। 

সংজ্ঞা বুনুর কাঁচা  হাতে রঙ তুলির জাদু আছে বলতে হবে। ওই লোকশূন্য দোলনাটায় চড়ে আমিও একদিন বিকেল উপভোগ করব। কেমন!! 

তুলি দাসের 'lays'এর প্যাকেট  এবার খুলতেই হবে। কেউ চাইলেই বলে দেব -'এ স্বাদের ভাগ হবে না '

সাত্ত্বিকী বুনুর ওই গ্রামচড়ানো কিশোর চরিত্রে বেশ লালিত্য রয়েছে অনেকখানি । 

এভাবেই 'জ্বলদর্চি' লক্ষাধিক পাঠকের মনে জায়গা করে নিচ্ছে। একাধিক প্রাণবন্ত পাঠপ্রতিক্রিয়াতে ভরপুর আমাদের 'জ্বলদর্চি'।  এতে অবশ্য সম্পাদিকা মৌসুমী ঘোষ মহাশয়াকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। এভাবেই শতদল হয়ে ফুটুক 'জ্বলদর্চি', চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক সুগন্ধ।

সুদীপ্তা আদিত্য
Apollo Gleneagles Nursing College 
প্রথম বর্ষ।
আজকের বিষয়: সুন্দরবন।

১. সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড লাইফ সেঞ্চুয়ারি হিসেবে কত সালে ঘোষিত হয়?
২. বাঘ সংরক্ষণ কত সালে শুরু হয় সুন্দরবনে?
৩. জাতীয় উদ্যান রূপে সুন্দরবন ঘোষিত হয় কত সালে?
৪. UNISCO কত সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেড সাইড হিসেবে ঘোষিত করে সুন্দরবনকে?
৫. কী বিশেষ কারণে জন্য ওয়াল্ড হেরিটেড সাইড স্বীকৃতি পায়?
৬. সুন্দরবনে কোন বিশেষ পশু সংরক্ষিত হয়?
৭.সুন্দরবন কোন জেলায় অবস্থিত?
৮.সুন্দরবনে আরেক বিশেষ ধরনের সরীসৃপ পাওয়া যায় সেটি কি বলতে হবে।
৯. বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসেবে কত সালে সুন্দরবন স্বীকৃতি পায়?
১০. রামসর সাইড হিসেবে কত সালে ঘোষিত হয় সুন্দরবন?

গত সপ্তাহের উত্তর: 
১.ক্রিকেট ২. বৈজ্ঞানিক ৩. উচাঙ্গ সংগীত ৪. উচাঙ্গ সানাই বাদন ৫. ২০০১ ৬. স্বাধীনতা সংগ্রামী ৭. বিখ্যাত সেতারবাদক ৮. ১৯৯২ ৯. ১৯৯৭ ১০. স্বাধীনতা সংগ্রামী ও স্বাধীন ভারতের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments

  1. গল্প, কবিতা সব পড়লাম, বেশ ভাল লাগল। পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো পড়া হয়নি অবশ্য

    ReplyDelete