জ্বলদর্চি

'এইবার শোন, মোদের কেমনে হয়েছে এই হাল'/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

'এইবার শোন, মোদের কেমনে  হয়েছে এই হাল'

 সন্দীপ কাঞ্জিলাল

যুদ্ধ চলছে। দিনের-পর-দিন যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। এদিকে রসদ শেষ। এবার কি হবে সবাই যখন ভেবে অস্থির, ঠিক সে সময় আকাশ থেকে ঝরে পড়লো, মিহিদানা, পিঠে পুলি, আর রসগোল্লার হাঁড়ি। সৈন্যরা যুদ্ধ ভুলে সেই পিঠেপুলি আর রসগোল্লা খেতে ছুটছে। তখন তাদের মাথায় যুদ্ধ নেই, দেশ নেই, আচ্ছে শুধু ক্ষুধা। ক্ষুধা কোন জাত মানে না, ধর্ম মানে না, ন্যায়-অন্যায় জয় পরাজয় মানে না। ক্ষুধার্ত, শুধু খেতে চায়। 
  এইদৃশ্য আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য। যার পরিচালক একাই এক'শ, বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায়। এই গল্পে হল্লা রাজা ভালো। কিন্তু তার মন্ত্রী তাকে জাদু করে বশ করে রেখেছে। এই রাজ্যে সবাই প্রায় অনাহারে, শুধু চব্য চোষ্য খেয়ে যান মন্ত্রী মশাই। তাইতো কারাগারে বসে প্রহরীকে খাবারের লোভ দেখিয়ে বশ করেছিল গুপী-বাঘা। আর প্রহরীর সেই অমানুষিক খাওয়া, এখনও বাংলা সিনেমায় সেরা দৃশ্যগুলির অন্যতম। 

  এই দৃশ্য যেন অনেক আগেই দেখতে পেয়েছিলেন, বিশ্ববন্দিত দার্শনিক 'কার্ল মার্কস'। মানবসমাজে মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর শোষণ নিপীড়ন চালানোর কৌশল এবং তা নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর আগে পর্যন্ত দার্শনিকরা জগৎকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিন্তু আসল কাজ হল তাকে পরিবর্তন করা,সেই কথা সর্বপ্রথম মার্কস বলেন। মার্কস তার জীবদ্দশায় যে আর্থসামাজিক অবস্থা লক্ষ্য করেন,তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল শোষণ। তাই দেখে তিনি বিহ্বল হয়ে ওঠেন। সেই ছবি যেন বিশ্ববন্দিত পরিচালক তাঁর 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' সিনেমায় ফুটিয়ে তুললেন। 

  এই অসাম্যের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রনামক শোষনযন্ত্রের বিরুদ্ধে একজনের অন্তত রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাই তিনি 'হীরক রাজার দেশে' সৃষ্টি করলেন 'উদয়ন পণ্ডিত' চরিত্র। 'উদয়ন  পণ্ডিত'-কে তাঁর বাবা এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল। কারণ যে দেশে রাজার কথাই একমাত্র কথা। তাঁর উপরে কারোর কথা বলতে নেই, ভিন্নমত দিতে নেই। যে অন্য কথা বলবে তাঁর গর্দান যাবে। সে রাজ্যে সবাই রাজার কথায় শুধু 'ঠিক ঠিক' বলে চলে। সবাইকে শেখানো হয় 'বিদ্যালাভে লোকসান/ নাই অর্থ, নাই মান।' কিন্তু এই যে কথায় আছে 'If you do not like it, Change it.' এই কথাকে 'উদয়ন পণ্ডিত' বেদবাক্য মনে করে সে দেশ ছেড়ে যায় নি। রাজা ভেবেছিল রাষ্ট্র যখন তার করায়ত্ত, দাস, তখন যে কোন বিদ্রোহ সে দমন করতে পারবে। কিন্তু রাজার ভাবনা ছিল না শোষিত মানুষের উত্থান, যে কোনো শোষণকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। যখন মানুষ শোষণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়বে তখন শোষক এর আসন টলমল করবে। তাই তো সত্যজিৎ রায়, যিনি সিনেমার মাধ্যমে বলেন- "রাজা রাখল তাদের চেপে/ যারা উঠল পরে ক্ষেপে/ রাজার আসন খানা করবে টলমল।" এই চিন্তা ভাবনা যেন দেখতে পাই দার্শনিক মার্কসের মধ্যে। তিনি মনে করেন, ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শোষণের পরিমাণ সর্বোচ্চ রূপ ধারণ করবে এবং বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি দ্বন্দ্বের তীব্রতা এত ব্যাপক আকার লাভ করবে যে, তা রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে। তিনি আরো মনে করেন, শোষিত মানুষ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে, তারা যে সামাজিক বিপ্লবে শামিল হবে তাতে তাদের বিজয় অনিবার্য। তাইতো সত্যজিৎ রায় লেখেন, "দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান"। দড়িতে হাত লাগায় শ্রমিক কৃষক শোষিত মানুষের দল। কারণ সমাজ পরিবর্তন হতে পারেনা শোষিত বঞ্চিত মানুষের জোটবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া। তাই দার্শনিক মার্কস মনে করেন, শোষিত মানুষের বিপ্লবের ফলে যে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গঠিত হবে, সেই সমাজে সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে, সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত হবে এবং তাই এই উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে যে উদ্বৃত্ত মূল্য বা 'সারপ্লাস ভ্যালু' সৃষ্টি হবে তা সমাজের উন্নতির স্বার্থে পুনরায় বিনিয়োগ হবে। সেই লাভ কোন ব্যক্তির পকেটে- এ যাবে না। তার ফলে সমাজের অভূতপূর্ব অগ্রগতি সম্ভব হবে।
  কবিতা বা চিত্রকলা অতি প্রাচীন এবং প্রমাণিত শিল্প। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে তার উল্টো। সিনেমার কাছ আজ থেকে আমরা প্রত্যাশা করি দায়বদ্ধতা। কারণ সিনেমা উত্তর শিল্পবিপ্লব শ্রমজীবী অংশের জায়গা থেকে জন্ম। তাই আদিতে সিনেমার জন্ম শিল্প হিসেবে ছিল না। চলচ্চিত্রে প্রথম শিক্ষায়তন রুশ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করেন, যা 'ভিজিআইকে' নামে পরিচিত। 

  রাজনীতিবিদেরা সিনেমাকে আবার প্রচার মাধ্যম হিসেবেও কাজে লাগাল। যে কারণে ফ্যাসিস্ট, বেনিটো মুসোলিনি পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব 'ভেনিস চলচ্চিত্র' উৎসব ১৯৩২ সালে ভেনিসে উদ্বোধন করেছিলেন। এবং ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ মুরারি ভাদুড়ীকে বলেছিলেন যে, "এত সহজে সিনেমা শিল্প বা আর্ট হয়ে উঠবে না। কারণ তাতে বিনিয়োগের প্রশ্ন রয়েছে।"

  তা সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায় সিনেমাকে যেমন শিল্পে পরিণত করেছেন, তেমনি তা থেকে বিনিয়োগকৃত টাকাও তুলে এনেছেন। যে কারণে, ১৯৬৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মারি স্টেনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, "গুপী এক জব্বর ছবি হয়েছে। ভূতদের সাড়ে ছয় মিনিটের এই নৃত্যের দৃশ্য সিনেমার কোরিওগ্রাফির ইতিহাসে আজ অবধি ঘটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।"

  এবার আসি 'শংকর' এর 'সীমাবদ্ধ' উপন্যাস নিয়ে। এই একই নামে ছবি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। সীমাবদ্ধ হচ্ছে মধ্যবিত্তদের ক্রম-অধঃপতনের বিবরণ। শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জী, যে কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সে কলকাতায় এসে একটা কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে বড় হতে হতে, বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে প্রয়োজনে মানুষ খুন করতে দ্বিধা করবে না। যে কোনো ধরনের অবৈধ কাজ করতেও পিছপা হয় না। এটাই হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। 

  সমাজে শ্রমিকের সংখ্যা যখন কমে আসে, যখন তাদের হাতে অর্থের যোগান ভালো থাকে, তখন শ্রমিক শ্রেণিভুক্ত মানুষ নিজেদের মধ্যবিত্ত বলে ভাবতে থাকে। তাদের নতুন নতুন ক্রমপরিবর্তনশীল চাহিদা বোধ থেকে তাদের প্রত্যাশা আরো বেড়ে যায়। তখন মধ্যবিত্তরা সকলেই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ব্যস্ত থাকে। তাদের সকলেই চিন্তা করে কিভাবে আরো ভালো থাকা যায়।আরো অর্থ, আরো সম্মান। এখানে মার্কসবাদের যে মৌলিক প্রত্যাশা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। মার্কস যেমন বলেন, এদের সকলের মধ্যেই রয়েছে নিজেকে বুর্জোয়া শ্রেণি বা ধনী হিসেবে রূপান্তরিত করার অদম্য বাসনা। সত্যজিৎ রায় 'সীমাবদ্ধ' চলচ্চিত্রে তা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন। আর মধ্যবিত্তদের এই স্পৃহাই মার্কসবাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এই স্পৃহাই মার্কস এর চিন্তা ও মতবাদকে বর্তমানকালে অসার ও অর্থহীন হিসেবে প্রতিপন্ন করতে প্রতিনিয়ত উদগ্রীব। 

  এই সীমাবদ্ধ ছবি যখন মুক্তি পায়, তখন পশ্চিমবঙ্গে চলছে নকশাল আন্দোলন। বহু তরুণ মারা পড়ছে। এখানে-সেখানে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়ছে। এই বোমা পড়া সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় ক্রিশ্চিয়ান থমসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বললেন- "তারা সত্যিকারের লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমন করত না। যেমন বৃহৎ শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে তারা বোমা ছোঁড়ে না। কেননা তাতে তাদের কিছু হারাবার ভয় ছিল। বরং তারা নিজেদের মধ্যেই লড়ত।" যেমন এখন আমরা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি সেই ঘটনা। মধ্যবিত্ত গরিব শ্রেণি নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত। ছবির শেষ অংশে মধ্যবিত্ত শ্যামলেন্দু যখন অনৈতিক উপায়ে অনেক উঁচুতে উঠলো, তখন সে দেখল সে ভীষণ একা। তার চারপাশে কেউ কোথাও নেই। সব পেয়েও সে পরাজিত। মার্কস তাই বললেন, "সমাজের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ বিত্তবান ও সর্বহারা। এর বাইরে মধ্যবর্তীস্তরে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী রয়েছে, তা বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার মধ্য দিয়ে, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য।" সীমাবদ্ধ ছবি শেষ হয়েছে এই সত্য সামনে রেখে।
১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া সত্যজিতের সিনেমা 'টু' (two)। 'টু' কে কি বলবো?শ্রেণী দ্বন্দ্ব? না সমাজবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই? নাকি শুধু দুই শিশুর খেলাচ্ছলে লড়াই? 
  এক উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলে যার মা-বাবা দুজনেই চাকরি করে। ছেলেটি একা বাড়িতে থাকে, এবং তার সময় কাটানোর উপকরণ হিসেবে খেলনা, তরেয়াল, ড্রাম, ভায়োলিন, খেলনা মুখোশ ইত্যাদি। আর তার বাড়ির নিচেই একটা বস্তিতে থাকে তার সমবয়সী এক বস্তির ছেলে। উচ্চবিত্ত ছেলেটি যখন এইসব খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত, তখনই সে একটি বাঁশের বাঁশির সুর শুনতে পায়। এগিয়ে যায় জানালার দিকে। সেখান থেকে দেখতে পায় তার বাসার নিচে একটা ঝুপড়ি ঘরের পাশে তার বয়সী আরেক শিশু আপনমনে বাঁশি বাজাচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে তার ক্ল্যারিওনেট নিয়ে আসে। সেও বাজায়। ঝুপড়ি ঘরে দরিদ্র ছেলেটিও সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। সেও আরো জোরে বাজায়। কিন্তু এক সময় বাঁশের বাঁশির সুর চাপা পড়ে যায় আধুনিক প্রযুক্তির ক্ল্যারিওনেট এর কাছে। এবার ঝুপড়ি ঘরের ছেলেটি তার খেলনার ঢোল নিয়ে আসে এবং নেচে নেচে বাজায়।ধনি ছেলেটি নিয়ে আসে মাঙ্কি ড্রাম। এবারও ঢোল পরাজিত হয় আধুনিক প্রযুক্তির মাঙ্কি ড্রামের কাছে। দরিদ্র ছেলেটি এবার মুখোশ পড়ে খেলনার তীর-ধনুক হাতে এসে নাচতে থাকে। এর জবাবে ধনী ছেলেটি মুখোশ পরে তার উন্নত প্রযুক্তির তৈরি তলোয়ার, বন্দুক নিয়ে আসে। বন্দুকের গর্জনে দরিদ্র ছেলেটির নাচের ছন্দ থেমে যায়। ধনী ছেলেটির মুখে বিজয়ের হাসি। সে এবার মুখের চুইংগাম বের করে খেলনা রোবটের কপালে লাগিয়ে দেয় জয়টিকা। 

  দরিদ্র ছেলেটিকে হারিয়ে বিত্তবানের বিজয়ী ছেলেটি যখন ফ্রিজ খুলে আপেলে কামড় বসিয়েছে তখন সে জানালা দিয়ে একটি ঘুড়ি দেখতে পায়। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখল দরিদ্র ছেলেটি আপনমনে আকাশে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। এবার ধনী ছেলেটি গুলতি নিয়ে আসে। দু'বার গুলতি দিয়ে ঘুড়ি ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতায় হাসি উপহার দেয় দরিদ্র ছেলেটি। এবার ক্ষেপে যায় ধনী ছেলেটি। সে হাতে নেয় সেই মোক্ষম অস্ত্র। এয়ারগানের গুলি ভরে এক শটেই সে ছিঁড়ে ফেলে ঘুড়ি। আমরা দেখতে পাই দরিদ্র ছেলেটির মুখ। কান্না আসার আগে শিশুদের মুখে যে অভিব্যক্তি আসে সেই অভিব্যক্তি। সেই মুখাবয়ব ছিল রাগ অভিমানের এক মিশ্রণ যা দেখলে মনের ভেতর একটা মোচড় দেয়। সেই শিশু মুখ যেন ধিক্কার দিচ্ছে গায়ে পড়ে যুদ্ধের দামামা বাজানো বিশ্ব মোড়লদের প্রতি। দরিদ্র ছেলেটি ছেঁড়া ঘুড়ি নিয়ে ফিরে যায় তার ঝুপড়ি ঘরে, বিজয়ী ধনী ছেলেটি ফিরে আসে তার খেলনার কাছে। সব খেলনা সে আবার চালু করে। খেলনা রোবট চালু করে। আবার শুরু হয় যান্ত্রিক খেলনার গর্জন। এইসব গর্জন ছাপিয়ে আবার ভেসে আসে সেই বাঁশির সুর। এইবার হতাশ হয় ধনী ছেলেটি। খেলনা রোবট চলতে চলতে ভেঙ্গে ফেলে তার মনুমেন্ট। বাঁশির সুরের সাথে এক দমকা হাওয়া এসে ফেলে দেয় তার খেলনা। গল্প এখানেই শেষ। 

  এই যে দরিদ্র ছেলেটির আপনমনে বাঁশি বাজানো দেখে ধনী ছেলেটি ক্ষেপে যায় সে কি কেবলই শিশুমনের জেদ? স্বাধীন মুক্ত আকাশের নিচে দরিদ্র ছেলেটিকে দেখে, ঘরবন্দী ধনী ছেলেটির মানবিক বিপর্যয়? আসলে ছেলেটির ভুবন তৈরি হয়েছে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার ছায়াতলে, যে সমাজ তাকে সবকিছুতেই তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে শিখিয়েছে এবং সেটা বল প্রয়োগ করে হলেও, ভোগ করতে শিখিয়েছে। তাই দরিদ্র ছেলেটির মুক্ত আকাশের নিচে বাঁশি বাজানো তার সহ্য হয় না। সে থামিয়ে দিতে চায় তার ঢোল, তার খেলনা তীর ধনুক। তার কাছে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির খেলনা বন্দুক। এখানে সাম্রাজ্যবাদ কিংবা সামন্তবাদের একটা রূপ দেখতে পাই। 

  আমরা কি এখানে ভাবতে পারি না, মার্কস এঙ্গেলস- এর ১৮৪৮ সালে "দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো" রচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন যে, "পৃথিবীর এ-যাবৎ কালের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস"।  এই শ্রেণিসংগ্রাম বিত্তবান ও সর্বহারা কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, সমাজের এই দুই স্তর হল প্রধান দুই প্রতিপক্ষ।
আবার সত্যজিৎ রায়ের 'অপূর্ব' কলকাতায় আসে। এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। এর মাধ্যমে মার্কসে- এর  কমিউনিস্ট ইস্তেহারের ছায়া দেখতে পাই। তবে আমি একথা বলতে চাই না সত্যজিৎ রায় ইস্তেহার অনুযায়ী ছবি করেছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামনে এক উন্নত জীবন ও জীবিকার যে হাতছানি, তা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবনে তাদের অর্জিত জ্ঞান বহুবিধ ক্ষমতাই প্রধান অবলম্বন। এসব বিচার করলে এই শ্রেণি অনেকটাই আত্মনির্ভর এবং অপরের দাসত্ব জ্ঞাপনের বন্ধন থেকে মুক্ত। তাই ঐ শ্রেণির পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি অথবা সর্বহারা মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রকাশের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে মার্কস এ-ও দেখিয়েছেন বিত্তবান ও সর্বহারার শ্রেনির মধ্যে যখন 'ক্লাস পোলারাইজেশন' ঘটবে, তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিলুপ্ত ঘটবে। তাই অপূর্ব কিছুতেই আর শহুরে জীবন যাপন ছেড়ে গ্রামে ফিরতে চায়না।

  'হীরকরাজার দেশে' ছবির শুরুতে গুপী বাঘা গান ধরছে- "এইবারে শোন/ মোদের কেমনে হয়েছে এই হাল"। আমাদের কি মনে করায় না, আগে আমরা ভালো ছিলাম। মানব ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ যা পেতো সবাই ভাগ করে খেতো। মানুষ কর্তৃক মানুষের ওপর শোষণ নিপীড়ন চালানোর মানসিকতা ছিল না। সকলে মিলে যৌথভাবে জীবনযাপন করত। মানুষে মানুষে আর্থসামাজিক ব্যবধান ছিল না। এবং সেই কারণে সামাজিক শ্রেণিও আত্মপ্রকাশ করেনি। তারপর মানুষের সমাজে পণ্য বলে বিষয়বস্তুর আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকেই মানুষে মানুষে উঁচু-নিচুর স্তর নির্ধারিত হতে শুরু করে। তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সামাজিক শ্রেণি এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি শ্রেণীদ্বন্দ্ব। এই পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে যে উদ্বৃত্ত মূল্য বা 'সারপ্লাস ভ্যালু' কার দখলে থাকবে, তাই নিয়ে চলল দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর নির্ভর করে তিনি ব্যাখ্যা করলেন 'ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।' তারপরে বুঝি অনিবার্য সত্য- " আয়েশ করে আলসেমিতে দশটা বছর পার।" হল্লা আর হীরক রাজা নিজেদের ক্ষমতা দখলের জন্য মেতে ওঠে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক কৃষক সর্বহারা ভেঙে ফেলে অত্যাচারী রাজার মূর্তি। অত্যাচারী নৃশংস শাসক ও মেহনতী মানুষের কাছে পরাজিত হয়ে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে, তিনি দড়িতে টান মারেন, নিজের মূর্তি ভাঙ্গার জন্য। আর তাই চিরন্তন সত্য বলে, আগেও কবিতা লেখা হতো, এখনও হয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments