জ্বলদর্চি

সত্যজিতের সংগীত ভাবনা/তুলসীদাস মাইতি

সত্যজিতের সংগীত ভাবনা

তুলসীদাস মাইতি

সত্যজিৎ রায়ের সংগীত সৃষ্টি তার ব্যাবহার - মৌলিক সৃজনের অনন্যতায় এ পর্যায়টি বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন গভীর মৌলিক সাঙ্গীতিক আবহ আর সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না । প্রকৃতপ্রস্তাবে, সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ সিনেমায় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ ও সংগীত স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়কে আলাদা করে দেখা মুসকিল। 
 বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আগে একটু পূর্বকথাও বলা জরুরি। 

  চলচ্চিত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে সঙ্গীতের কথা না সুরের আবহ তৈরির জন্য সত্যজিৎ রায় যে প্রকৃতিগত সরল অথচ গভীর যে পরিকল্পনা নির্মাণ করেছিলেন তার জন্য তাঁর প্রতিভা ও ধ্যান দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বসুরী প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ ও পাশ্চাত্যের বিটোফেন ও মোজাটের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের সম্পর্কে তিনি লিখেও ছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথের সংগীত ও তাঁর রূপক সাংকেতিক নাটকে গানের ব্যাবহার তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা ভাবে প্রভাবিত করেছিল মনে করা হয়। সমসাময়িক কালে পণ্ডিত রবিশংকর, বিলায়েত খা, আলি আকবর খান সহ বহু দেশ বিদেশের সংগীত সঙ্গীত সৃষ্টির নানান বিষয়কে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

  দেশী -বিদেশী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি নিবিড় আকর্ষণ সত্যজিৎ সংগীত জগৎকে নিয়ন্ত্রন করলেও তিনি সিনেমার প্রয়োজনে সঙ্গীতকে এক সংকেত ময় অনুভবে বেঁধে ফেলে ছিলেন। চলচ্চিত্রে সঙ্গীতভাবনার মূলত দুটি দিক। 
এক, আবহধ্বনি বা নেপথ্য সংগীত।
দুই., কথাসমন্বিত সংগীত। 

মনের ভাবকে সহজভাবে অর্থবহ অনুভূতি মগ্ন করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি প্রায় নেই। সমাজবিন্যাসের নানা দিক নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর সিনেমায় প্রতীকায়িত করেছেন অভিনব শৈলীতে। সঙ্গীতের ব্যবহারও তিনি এই আঙ্গিকেই প্রতিস্থাপিত করেছেন।
কথারচনা, সুরসৃষ্টি ও ধ্বনিনির্মাণ -এই তিনটি বিষয়কেই  তিনি সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে দৃশ্য ও ঘটনার সাথে সংগীতের এই তিনটি দিককে এমনভাবে সম্পৃক্ত করেছেন যাকে আলাদা করাই মুশকিল। তার নিজের পরিচালিত সিনেমা ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যের সিনেমা বা তথ্যচিত্রে তিনি সুর সৃষ্টি করেছেন। প্রথম দিকের কয়েকটি সিনেমায় তিনি নিজে সংগীত পরিচালনা করেন নি। তবে কয়েকটি সিনেমার পরিচালনার পর তিনি নিজে সংগীত পরিচালনাও করতে শুরু করেন এবং তারপর প্রায় সমস্ত সিনেমাতেই তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। 
পথের পাঁচালী ,অপুর সংসার, অপরাজিত, ও পরশপাথর (১৯৬০)  ছবিতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জলসাঘর (১৯৫৮) ছবিতে বিলায়েত খান ও দেবী (১৯৬০) ছবিতে আলি আকবর খান কে দিয়ে সত্যজিৎ রায় সংগীত পরিচালনা করিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত তিন কন্যা চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। তারপর প্রায় সব ছবিতেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই সংগীত পরিচালনাও করেছেন। তিনি পেশাদার সংগীত পরিচালক ছেড়ে কেনো নিজেই সংগীত পরিচালনা করেছিলেন তা  তিনি নিজেই বলেছেন।

"The reason why I do not work with professional composers any more is that I get too many musical ideas of my own, and composers, understandably enough, resent being guided too much.”

  পিয়ানোয় সুর তুলতে ভালোবাসতেন সত্যজিত রায়। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি বসে মিউজিক কম্বোজ করতেন। চলচ্চিত্রে ব্যাবহার করতেন দৃশ্যের ভাব অনুযায়ী। তিনি মনে করতেন চলচ্চিত্রে সংগীত হবে সহজবোধ্য কিন্তু গভীর অনুভবের দ্যোতক। যা তাঁর মনের মধ্যে ভাব তৈরি করত তখনি তা কম্পোজ করতেন। সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার পর তিনি সংগীত রচনা করতেন এমন নয়। তিনি স্ক্রিপ্ট যখন লিখছেন কাহিনি ও নির্মাণের ভাব, অর্থ ও সংকেত যখন যেভাবে মানসিক অবস্থান তৈরি করছে সেভাবেই তিনি কথা ও সুর সৃষ্টি করেছেন। 
 
  তার হীরক রাজার দেশে, গুপি গাইন বাঘা বাইন,  প্রভৃতি সিনেমাতে দৃশ্য অনুযায়ী তিনি সংগীত সাজিয়েছেন। এক গভীর সামাজিক সংকেতকে সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তিনি এনেছেন। তার লেখা  ও সুর করা  কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়,  মহারাজা তোমারে সেলাম, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, মোরা দুজনাই রাজার জামাই, নহি যন্ত্র নহি যন্ত্র , পায়ে পড়ি বাঘ মামা , কেমন বাজায় বাঁশি শোনো, ভালোবাসার তুমি কি জানো, সুধীজনে যত আছো, একদিনে দুজনে, এসে হীরক দেশে, প্রভৃতি গানগুলির ক্ষেত্রে মিউজিক কম্পোজের শৈলী এক অনন্য সৌন্দর্যে নির্মিত। 
গভীর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়  তাকে যত যা কষ্ট দিত তার চেয়ে বেশি তিনি আনন্দ পেতেন। এই আনন্দ প্রাপ্তির কথা  তিনি লিখেছিলেন তার লেখায়। 

".. the pleasure of finding out that the music sounds as you had imagined it would, more than compensates for the hard work that goes into it. The final pleasure, of course, is in finding out that it not only sounds right but is also right for the scene for which it was meant"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments