জ্বলদর্চি

রিকিসুমের পিশাচ(উপন্যাস) পর্ব-২/আবীর গুপ্ত

রিকিসুমের পিশাচ
পর্ব-২
আবীর গুপ্ত

(তিন)
ভালুকটা এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পিছনের লেপার্ড তিনটে ভালুকটির পাশে এসে দাঁড়ালো। এটা বেশ অস্বাভাবিক! রাজেশের ওয়াইল্ড লাইফ সম্বন্ধে যতটুকু জ্ঞান আছে তাতে লেপার্ড বা ভালুক নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে বা সামনে থাকা রাজেশকে এ্যাটাক না করে চুপ করে শৃঙ্খলাপরায়ন সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে! রাজেশের হঠাৎ কেন জানিনা মনে হল ওরা কারোর হুকুমের অপেক্ষায় আছে। প্রায় মিনিট দুয়েক সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে - রাজেশের মনে হচ্ছিল এক বিরাট সময়। সারা শরীর ভয়ে ঘেমে গেছে। কপাল আর গাল থেকে ঠান্ডার মধ্যেও টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে। রাজেশের মনে হলো কোন পাখির ডাক – টি-টি-টি করে একটা শব্দ। ভালুকটা শুধু নয়, লেপার্ড তিনটেও এক পা এগোলো, লেপার্ডদের লেজ নড়ে বেঁকে গেলো অর্থাৎ আক্রমণের পূর্ব মুহূর্ত। রাজেশ ভয়ে আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে গেল, পালিয়ে যাবার উপায় নেই - মায়ের মুখটা মনে পড়ল।  
  লেপার্ড তিনটে উবু হয় মাথাটা তুলে লেজ নেড়ে যে মুহুর্তে লাফ দিতে যাবে, রাজেশ ভয়ে চোখ বুজে ফেললো। একটা  শিসের শব্দ, কিছু তো হল না! রাজেশ চোখ খুলে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল! ভালুক আর লেপার্ডদের সামনে একটি মেয়ে আর ওদের দু'পাশে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, প্রত্যেকের হাতে একটা ছোট্ট সোনালী লাঠি বা রড। প্রত্যেকের পরনে একটা টাইট চকচকে সিলভার কালারের পোশাক, দেহের সঙ্গে আঁটোসাঁটো হয়ে ফিট করা, পোশাকে কোনও ঢিলেঢালা অংশ নেই। সামনের মেয়েটা ভালুকটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করছে। আর বাকি দুটো মেয়ে লেপার্ড তিনটির গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এমন ভাবে যেন পোষা বিড়াল! সামনের মেয়েটা পরিষ্কার বাংলায় রাজেশ কে জিজ্ঞাসা করলো –
   আপনি তো বাঙালি? এখানে কী করতে এসেছেন?
রাজেশ প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল, ধাতস্থ হয়ে বললো –
   হ্যাঁ, আমি বাঙালি। কী করে বুঝলেন! এখানে ট্রেকিংয়ের জন্য এসেছি। ইচ্ছা - পাহাড়ের চূড়ায় গুহাটাতে যাওয়া এবং দেখা। 
গুহায় যাওয়া যাবে না। হঠাৎ, গুহাটাকে দেখতে চাইছেন কেন?
  গ্রামবাসীরা বলল গুহাটায় নাকি পিশাচের বাস। তাই – 
   পিশাচের বাস! বুঝেছি। 
ঠিক আছে, আপনারা যখন না করছেন তখন যাব না। আমি গ্রামেই ফেরত যাচ্ছি। 
   সেটি হবে না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আর না যেতে চাইলে - এই পশুরা বড্ড বাধ্য, আমরা যা বলি শোনে। আমরা না আটকালে ওরা আপনাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। এখন, আপনার ইচ্ছা।
     মুহূর্তের মধ্যে রাজেশ বুঝে গেল, ওকে ওদের বন্দি হয়ে ওদের  সঙ্গে যেতে হবে। আর না যেতে চাইলে কী হতে পারে ভেবে শিঁউরে উঠলো। ভয়ে ভয়ে ভালুক আর লেপার্ডেদের দিকে তাকিয়ে বলল –
 ও-কে, আমি যাব। আমি তো না করিনি। 

(চার)
যে পথ দিয়ে রাজেশ এগোচ্ছিল ওরা কিন্তু সেই পথ ধরল না, একটু বাদিকে ঘুরে সম্পূর্ণ অন্য পথ দিয়ে যেতে শুরু করলো। রাজেশের মনে হলো ওরা ওকে ওদের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, বন্য প্রাণীগুলোকে এরকম পোষ মানালো কী করে! যেন পোষা বেড়াল! সামনে যে মেয়েটি লিড্ করছে সেই মেয়েটিই ওকে প্রশ্ন টশ্ন করছিল। মেয়েটির পিছনে লেপার্ড তিনটি আর তার পিছনে ভালুকটি। এরপর, একটা সেফ ডিসটেন্স রেখে রাজেশ আর রাজেশের পিছনে বাকি দুটো মেয়ে। রাজেশ ওদের সঙ্গে একবার কথা বলার চেষ্টা করে কোনো উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ে তিনটি রাজেশের মনে হল, মোটামুটি একই রকম দেখতে। শুধু চুলের ডিজাইন ছাড়া। এরকমও মনে হল, ওরা বোধ হয় জমজ বোন। 
   যে পথ দিয়ে যাচ্ছে সেই পথটায় যাতায়াত আছে বলে রাজেশের মনে হল কারন একটা আবছা হলেও ফুট্ ট্র্যাক রয়েছে। হঠাৎ, ওর সামনে জঙ্গল শেষ হয়ে গেল। ঠিক জঙ্গল শেষ নয়, একটা প্রায় তিরিশ ফুট বাই তিরিশ ফুট ফ্ল্যাট গ্রাউন্ড, যার চারপাশে উঁচু-উঁচু গাছপালার জঙ্গল থাকলেও, এই অংশে কিছুই নেই। এমনকী ঘাস অবধি নেই। জমিতে পা দিয়ে বুঝলো সেটা মাটি নয় শক্ত কিছু। টার্পোলিন বা ওই জাতীয় শক্ত কোন কিছু মাটির উপর বিছানো রয়েছে যাতে কোথাও কোন নেই জয়েন্ট নেই!
   সবাই ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ রাজেশের মনে হলো মেঝেটা যেন নড়ে উঠলো। দেখলো, ওই বর্গাকৃতি জায়গার চারধার কেমন যেন মুড়ে ছোটো হয়ে ধীরে ধীরে রেলিংয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে যেটা দাঁড়ালো সেটা হলো একটা দশ ফুট বাই দশ ফুট জায়গা যেটা বেশ উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা। হঠাৎ ওটা চলতে শুরু করলো। প্রথমে আস্তে, তারপর দ্রুত। রাজেশ হাত দিয়ে শক্ত করে রেলিংটা চেপে ধরলো। ধরেই আঁতকে উঠল - রেলিংটা কি ঠান্ডা! একেবারে হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে! হাত ছাড়াতে দিয়েও পারল না, রেলিঙে হাতের তালু, আঙুল সব আঠার মতো লেগে আছে। ওই মেয়েটি এতক্ষণ বাদে কথা বলল-
  হাত ছাড়াতে পারবেন না। বেশিক্ষণ কষ্ট সহ্য করতে হবে না। আমরা এখুনি পৌঁছে যাব। 
প্ল্যাটফর্মটা ফাঁকা মাটিতে চারপাশে পাক খেতে খেতে হঠাৎ শুন্যে উঠে পড়লো, তারপর গাছের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলল। থামলো গিয়ে রাজেশের বাইনোকুলারে দেখা গুহার সামনে। চাতালটা যেন জেটি। শুন্যে চাতালের গায়ে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো যেন নৌকা এসে জেটিতে ভিড়লো। হঠাৎ, রাজেশের হাত রেলিং থেকে ছেড়ে গেল, রেলিংটা খাড়া থেকে হরাইজন্টাল হয়ে গেল। পাথরের চাতালের উপর এমন ভাবে স্থির হল, একটা বাচ্চা ছেলেও ওর উপর দিয়ে কারোর সাহায্য ছাড়াই হেঁটে গুহার ভিতরে ঢুকতে পারে। গুহার মুখটা ডিম্বাকৃতি। মুখটা একটা ট্রান্সপারেন্ট কাঁচ জাতীয় কিছু দিয়ে বন্ধ ছিল। সেটা ধীরে ধীরে নিঃশব্দে খুলে গেল। ভিতর থেকে একটা মেটালিক ভয়েস ভেসে এল –
   মিস্টার রাজেশ, আমাদের ডেরায় আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। ওয়েলকাম টু আওয়ার হোম। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments