জ্বলদর্চি

কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ-র সাক্ষাৎকার/(উৎসব ১৪২৮)/ প্রতাপ সিংহ

কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ-র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতাপ সিংহ 


বুদ্ধদেব গুহ বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে লেখা একটি অতি প্রিয় নাম। সুদর্শন-সুগায়ক অরণ্যচারী এই প্রাণবন্ত মানুষটি একজন স্বনামধন্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে একদিকে যেমন ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন কাজের সম্পাদনা ও উপদেশকের ভূমিকা পালন করেছেন তেমনি জনপ্রিয় অন্যধারার লেখক রূপেও আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছেন বারেবারে। খেলার মাঠে, স্টিয়ারিং হাতে গাড়িতে বসে, সাদা ক্যানভাসে রঙের বিস্তারে -- সবখানেই তিনি একজন শিল্পীর আসনে বিরাজমান। মাত্র দশ বছর বয়সেই তাঁর শিকারজীবনের সূচনা। নানা রকমের রাইফেল হাতে তিনি হয়ে উঠতেন একজন নিপুণ শিকারি। ভ্রমণ করেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, কানাডাসহ পৃথিবীর বহু দেশের পাহাড় ও বনজঙ্গলে। মহানগরের ব্যস্ত-খ্যাতিমান মানুষ হয়েও তাই তিনি প্রকৃতির রূপসাগরে তাঁর চিরনবীন-চিরসবুজ মনটিকে বিছিয়ে রেখেছেন দিনের পর দিন। আমাদের প্রিয় লালাদা তাই তাঁর অনুরাগীদের চোখে 'পারোজিয়াস্ত' (জার্মান শব্দ) - স্পষ্টবাদী, 'ভার্সেটাইল' তথা বহুমুখী এক প্রতিভাধর শিল্পী। তাঁর 'হলুদ বসন্ত', 'খেলা যখন', 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'কোয়েলের কাছে', 'সবিনয় নিবেদন', 'চাপরাশ', 'চানঘরে গান', 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'বাবলি', 'সম', 'ওয়াইকিকি', 'নগ্ননির্জন', 'বাতিঘর', 'বাসনাকুসুম', 'চারুমতি', 'ছৌ', 'হাজারদুয়ারী', 'বাজা তোরা রাজা যায়', 'শালডুংরী' প্রভৃতি লেখাগুলো একদিকে যেমন অভিনব প্রেমের ধারা বহন করেছে পাশাপাশি অনেক উপন্যাসই দীর্ঘদিন ধরে বই-বাজারে বেস্টসেলার হয়েছে। এইসব উপন্যাসগুলোতে সৃষ্ট চরিত্রগুলোর নামেই আমাদের চারপাশের অনেক সন্তানসন্ততিদেরও নাম হয়ে যায় ঋজু, ঋভু, তিতলি, মৌলি, মঞ্জিমা, নয়না, সানাই, পৃথু, সুমন, সুকুমার, অনন্য, বুলবুলি, ঋতি, জয়ী। একসময় বহু বাঙালি পাঠকই শহর বা মফস্সলের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে তাঁর বই পড়বার জন্য আগেভাগে নাম লেখাতেন, দীর্ঘদিন বই নিজেদের কাছে রাখতেন আর হারিয়ে যেতেন পালামৌ, লাতেহার, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, টিগরিয়া, লামনি, পলাশতলি, কাঁকড়িকিরা,আলোকঝারি, মাহমুরগঞ্জের বিচিত্র ভুবনে। বড়দের সঙ্গে ছোটরাও লুকিয়ে পাল্লা দিয়ে পড়ে তাঁর বই, কী অমোঘ সেই আকর্ষণ। 
(করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বেশ কিছুদিন আগেই লালাদার সঙ্গে আমার দীর্ঘ কথাবার্তা হয়। এত অকপট স্বীকারোক্তি ও ভালোবাসায় আমার মতো যে কেউ মুগ্ধ হবেন সন্দেহ নেই। আরো কথা তিনি বলতে চেয়েছিলেন। করোনায় আমি অসুস্থ হলাম, চারদিকে এর প্রকোপ বাড়লে তিনিও অসুস্থ হয়ে গেলেন। সেরে উঠলেন কিন্তু দেখা হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সংযোজিত কথাগুলো শুধু টেলিফোনে হলো।)  
--প্রতাপ সিংহ 

প্রতাপ - লালাদা, আপনার অরণ্যপ্রেম, ভিন্নধারার প্রেমের উপন্যাস রচনা কিংবা লেখক হিসেবে দিনের পর দিন জনপ্রিয়তার শীর্ষে বিচরণ করা --
এসবই আজ বাঙালি পাঠকের কাছে অতি পরিচিত একটি ব্যাপার। 'হলুদ বসন্ত', 'খেলা যখন', 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'কোয়েলের কাছে', 'সবিনয় নিবেদন', 'হাজারদুয়ারী', 'বাসনাকুসুম' বা ঋজুদা-য় অভিভূত একজন সামান্য পাঠক হিসেবে প্রথমেই আমি জানতে চাইছি যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় লেখক কে?

বুদ্ধদেব - প্রিয় লেখক তো অনেকেই আছেন। 
বাঙালি, বিদেশি বা ভারতের অন্যান্য অনেক লেখকই আছেন যারা আমাকে আকৃষ্ট করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে বিভূতিভূষণের লেখা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। 



প্রতাপ - দাদা,আপনি তো কমার্সের ছাত্র ছিলেন। সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ ও লেখক হওয়ার প্রবণতা কীভাবে বেড়ে উঠল?

বুদ্ধদেব - ঠিকই বলেছ।স্কুল জীবনের পরে সাহিত্য নয়,কমার্সেরই ছাত্র ছিলাম। আমার বড়মামা ছিলেন সাহিত্যিক সুনির্মল বসু। আমি তাঁর অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলাম, এমনকি মামারই জন্য আসাম থেকে ঘুরে এসে আমার প্রথম লেখা একটি গল্প ( 'কাজিরাঙার গণ্ডার') প্রকাশিত হয় দেব সাহিত্য কুটির থেকে। সেই মানুষটিও ছিলেন ঈশ্বরতুল্য, সুবোধচন্দ্র মজুমদার মহাশয়। তাছাড়া সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তো সেই শৈশব থেকেই। প্রথমে আমি পাঠক, লেখক হওয়া তো পরের কথা। 

প্রতাপ - বাড়ির পরিমণ্ডল আপনার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এক মস্তবড় ভূমিকা পালন করেছে। 

বুদ্ধদেব - অবশ্যই। বই ছেলেবেলা থেকেই পড়ছি। সেন্ট জেভিয়ার্সে কমার্স নিয়ে পড়েছি ঠিকই কিন্তু সাহিত্যের প্রতিও আগ্রহ কিছু কম ছিল না। সাহিত্য বিশেষ করে কাব্যের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল বেশি। পড়ার কথা বলতে গেলে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথকে পড়া এখনও শেষ হয়নি। বিশেষ করে বলতে হয় তাঁর গানের কথা। এই গানগুলোর মধ্যে এমন কোনও অনুভূতি নেই যা আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়নি। পূজা পর্যায়, প্রেম পর্যায়, ঋতু বা প্রকৃতি পর্যায়– সমস্ত পর্বেই শিশুকাল থেকে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। 

 প্রতাপ - সাহিত্যের প্রতি এই ঝোঁক বা আগ্রহ লেখক হওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রেরণা জুগিয়েছে।দেশবিদেশের বহু বরেণ্য কবি লেখকই যখন আপনার এত প্রিয়। 

বুদ্ধদেব - প্রতাপ,এক্ষেত্রে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তোমাকে বলি। আমার এক বন্ধু ছিল, দীপক। গ্র্যাজুয়েশনের পরে ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে এম.এ. পড়ে। আমার তো রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে সাহিত্যের প্রতিও প্রবল অনুরাগ ছিল। সেজন্য কমার্সের ছাত্র হয়েও তুলনামূলক সাহিত্যের সিলেবাস ওর কাছ থেকে নিয়ে আসি। এরপর ওই সমস্ত পাঠ্য বইগুলো আমি কিনে এনে আমাদের বাড়ির ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রাখি । সেখানে বাঙালি লেখকদের বইয়ের পাশাপাশি টমাস মানের ‘ম্যাজিক মাউন্টেন’ ছিল। রিলকের ‘সনেটস্ টু অর্ফিয়ুস'ও ছিল, দস্তয়েভস্কির মতো লেখকের বই ছিল আবার শেক্‌সপিয়ার, এলিয়টও ছিলেন। রাশিয়ান, ইংরেজ কিংবা আমেরিকান লেখকদের নিয়ে পড়াশোনার পরিমণ্ডল বেশ বড়ই ছিল। 

প্রতাপ - লালাদা, বিভূতিভূষণ আপনার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। বাঙালি পাঠকেরাও তো 'হলুদ বসন্ত', 'জঙ্গলমহল', 'কোয়েলের কাছে', 'মাধুকরী', 'চাপরাশ', 'সম' প্রভৃতির স্রষ্টা বুদ্ধদেব গুহর লেখার সঙ্গে বিভূতিভূষণের তুলনা করে থাকেন, কোনো একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন - এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন। 

 বুদ্ধদেব - লেখকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ তো আমাকে ভীষণই আকৃষ্ট করেন। তাঁর সমস্ত লেখাতেই আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি। ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’ বহুবার পড়েছি। একথা অনেকেই বলেন যে, আমি বিভূতিভূষণের সার্থক উত্তরসূরি। তবে বিভূতিভূষণের সঙ্গে আমার লেখায় অমিলও আছে। তিনি প্রকৃতিকে দেখেছিলেন একজন রোমান্টিকের চোখ দিয়ে কিন্তু আমি প্রকৃতিকে সেভাবেই দেখেছি, যেভাবে একজন নারীর সঙ্গে সহবাস করলে নারীকে চেনা যায়। সেইভাবেই হাতে বন্দুক নিয়ে আমি এমন এমন জায়গায় পৌঁছেছি বা গেছি যেখানে বিভূতিভূষণের যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পাহাড় জঙ্গলের প্রকৃতির সঙ্গে আমার নিবিড় অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এজন্য বর্ষার সময়ে বর্ষার প্রকৃতি বা শীত-গরমের সময়ের প্রকৃতিকে চাক্ষুষ করে কিংবা উপভোগ করে যে দেখা তারই ফসল আমার 'কোয়েলের কাছে' বা অন্যান্য অনেক লেখা। কাজেই আমার দেখাটা একটু অন্যভাবে দেখা সেটা যাঁরা আমার লেখা পড়েছেন তাঁরা জানেন। বিভূতিবাবু তো কোনওদিন আফ্রিকায় যাননি, কিন্তু ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফির ম্যাগাজিনগুলো পড়েই তিনি জেনেছিলেন আর ‘চাঁদের পাহাড়'-এর মতো বিখ্যাত গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন। কী গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও একাত্মতা থাকলে এমন সৃষ্টি সম্ভব হয়। তিনি প্রকৃতই একজন সাধক ছিলেন। তাঁর লেখার সঙ্গে যাঁরা আমার তুলনা করেন তাঁদের আমি বলি তিনি ছিলেন আসলে শিব আর আমি সেখানে একজন বাঁদর। আমাদের কোনও মিলই নেই, উনি অনেক বড় মাপের লেখক।

  প্রতাপ - আপনার অগ্রজ বাঙালি লেখকদের মধ্যে আর কাকে খুব পছন্দ হয়?

বুদ্ধদেব - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখারও আমি এক মুগ্ধ পাঠক। শরৎচন্দ্রকে অনেকে কটাক্ষ করেন এই বলে যে তিনি মেয়েদের জন্য দুপুরে ঘুমানোর সময়ের লেখা লেখেন। আমি ভিন্নমত পোষণ করি। তিনিও অনেক বড় মাপের লেখক। অজস্র ভালো গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন শরৎবাবু। নারী চরিত্র অত্যন্ত ভালো বুঝতেন। তাঁর কত লেখায় প্রেম আছে অথচ তার উচ্চারণ পর্যন্ত নেই। অসামান্য সব ডায়ালগ তিনি লিখেছেন। এই ডায়ালগ বা সংলাপ কীভাবে লিখতে হয় তা শরৎবাবুর লেখা পড়ে অনেকখানি শেখা যায়। 

প্রতাপ - আর বঙ্কিমচন্দ্র? 

  বুদ্ধদেব - বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের বাঙালি সাহিত্যজীবনের পথিকৃৎ । ‘দুর্গেশনন্দিনী’ থেকে ‘আনন্দমঠ’ পড়েই আমাদের বড় হওয়া। সংস্কৃত ঘেঁষা লিখলেও তিনিই প্রথম সংস্কৃতকে ভেঙে বাংলায় লেখা আমাদের উপহার দিলেন। বাংলার প্রথম সার্থক উপন্যাসও তো তাঁরই হাত থেকে এসেছে। প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা আমরা তাঁর লেখাগুলোতে পাই। বঙ্কিমবাবু একটু মুসলমান বিদ্বেষী হওয়ার কারণে অনেক মুসলমানই তাঁর লেখা পছন্দ করতেন না কিন্তু সাহিত্য তিনি উৎকৃষ্ট রচনা করে গেছেন। 

প্রতাপ - বাংলা সাহিত্যের অজস্র মণিমুক্তোখচিত সিন্ধু থেকে আপনার প্রিয় লেখকদের কথা পাঠকদের জন্য যদি আরও কিছুটা বলেন তো আমরা ঋদ্ধ হই।

বুদ্ধদেব - বাংলার অন্যান্য লেখকদের মধ্যে সতীনাথ ভাদুড়ী খুব বেশি লেখেননি, তবে যা লিখেছেন তা অসাধারণ। ‘জাগরী’, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ সেরকমই দুটি লেখা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ কিংবা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাও খুব ভালো লাগে। বীরভূম নিয়ে বেশি লিখতেন বলে তারাশঙ্করবাবুকে লোকে মজা করে ট্যারাশঙ্কর বলত। তিনি খুব সুন্দর কাহিনি নির্মাণ করতে পারতেন। ‘গণদেবতা’, ‘কালিন্দী’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘রাইকমল’, ‘কবি’ তাঁর অসামান্য কয়েকটি সৃষ্টি। ‘কবি’ খুব ভালো ছবিও হয়েছে। আহা কী চমৎকার কথা :

“এই খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
কুলাল না এ জীবনে।
এ ভুবনে?”

প্রেমেন্দ্র মিত্র অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছেন। একাধারে কবি ও ঔপন্যাসিক, আমি তাঁকে প্রেমেন মামা বলে ডাকতাম। আমার নিজের লেখা খুব কাটাকুটি হতো, উনি আশ্বস্ত করতেন -- ' কাটে সকলেই। কেউ মনে কাটে আর কেউ পাতাতে কাটে।' সাম্প্রতিক অতীতে রমাপদ চৌধুরী চমৎকার গল্প লিখেছেন। 'চাবি', 'ফ্রিজ', 'ভারতবর্ষ' -- এগুলো কী অসাধারণ লেখা। ওঁর সমস্ত গল্পই পড়া উচিত। তিনি অসামান্য সম্পাদকও ছিলেন, আমার পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ। তাঁর লেখা 'খারিজ' বা 'বাড়ি বদলে যায়'-এর মতো মাস্টারপিস বাংলায় খুব বেশি লেখা হয়নি। আমার খুব ভালো লাগে সুবোধ ঘোষের লেখা। 'ভারত প্রেমকথা'র লেখকের 'জিয়াভরলি' পড়ে আমি একটা চিঠিও তাঁকে লিখেছিলাম, সন্তোষকুমার ঘোষও বড় লেখক ছিলেন,'শেষ নমস্কার : শ্রীচরণেষু মা-কে' একটি অনবদ্য সৃষ্টি কিন্তু সাংবাদিকতার কারণে তাঁর লেখার অনেক ক্ষতি হয়েছে।

প্রতাপ - আর বিমল কর? 

বুদ্ধদেব - বিমল কর আমার আর একজন প্রিয় লেখক। তাঁর বাড়ি ছিল হাজারিবাগের রোড স্টেশনে। এই হাজারিবাগ নিয়ে আমারও তো অনেক লেখা, তবে বিমলদা ওই অঞ্চলটাকে নিয়ে একেবারে আবিষ্ট ছিলেন।লাটাখাম্বার কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। 

প্রতাপ - লাটাখাম্বা কী? 

বুদ্ধদেব - অনেকেই এটা জিজ্ঞাসা করেন যে, লাটাখাম্বা কী ? বিহার-ঝাড়খণ্ডে কুয়োর সংলগ্ন
কাঠের যে খাম্বা মতন থাকে ইঁট বোঝাই করা— বালতি বাঁধা থাকত সেখানে সামনের কুয়ো থেকে জল তোলার জন্য। তাঁর চমৎকার লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখ করতেই হয় ‘পূর্ণ- অপূর্ণ’, 'যদুবংশ', 'বালিকা বধূ'র নাম। আরও আছে। অত্যন্ত বিষাদবিধুর তাঁর বিভিন্ন লেখাগুলো, তিনি অজস্র ভালো লেখা আমাদের জন্য লিখে গেছেন। সমরেশ বসুর চেয়ে কালকূটের লেখা আমার বেশি ভালো লাগে ৷ প্রবোধকুমার সান্যাল আর একজন বিখ্যাত লেখক। মূলত তিনি ভ্রমণ উপন্যাস লিখেছেন। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবি হল। হৈ-হৈ হল। তিনি একটু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় একটা চা-বাগানে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ডিগবয়, ডিব্ৰুগড় প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় তখন কোম্পানির ফ্লিটার প্লেনে চা সরবরাহের কাজ চলত চা-বাগানগুলোয়। সে রকমই একবার চা বাগানে নেমেছি, দূর থেকে দেখি দীর্ঘকায় প্রবোধবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তো ম্যানেজার। আমার বিদেশি বন্ধু ডোনাল্ড ম্যাকেঞ্জিও ছিলেন। দেখামাত্রই আমাদের আড্ডার পরিবেশ তৈরি হল। বাঙালি ম্যানেজাররা অনেকেই আমাদের দেখে বলতেন একই সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো আর লেখা দুই-ই চলছে। 

প্রতাপ - কী অবিস্মরণীয় এই স্মৃতি! কথাশিল্পের কথা সত্যিই ফুরোবার নয়।আচ্ছা রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতার প্রতিও তো আপনার দুর্নিবার আকর্ষণ আছে, আলাদা করে কারও কথা কি জানতে পারি?

বুদ্ধদেব - কবিতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পরে আরও অনেকের লেখা পড়েছি। তবে বিশেষ করে নাম করতে হয় জীবনানন্দের। তিনিও তো মস্তবড় একজন কবি। কী অসামান্য পংক্তি—
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর
সমুদ্রের 'পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা...
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী
ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

প্রতাপ - 'বনলতা সেন'-এর সঙ্গে 'রূপসী বাংলা'-র
কবিতার বিভাও তাহলে তীব্রভাবেই আপনার হৃদয় ছুঁয়ে আছে? 

বুদ্ধদেব - ‘রূপসী বাংলা’ একটি অসামান্য কবিতার বই। বাংলার প্রতি তাঁর যে গভীর প্রেম এই কাব্য না পড়লে তা জানা যায় না। এক্ষেত্রে আমি তো মনে করি বাংলা সাহিত্যের পাঠও সম্পূর্ণ হয় না।

জসীমউদ্দিনের কবিতা যেমন ভালো লাগে, সমকালীন লেখকদের লেখা বা সাম্প্রতিক গল্প - কবিতাও ভালো লাগে। বাংলার কত লেখক-কবি যে আমাকে প্রভাবিত করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না।   সুভাষদা(মুখোপাধ্যায়), শক্তি (চট্টোপাধ্যায়), শঙ্খদা(ঘোষ), সুনীল বসু, প্রণব(কুমার মুখোপাধ্যায়), জয়( গোস্বামী), সুনীল(গঙ্গোপাধ্যায়), নীরেনদা( নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) ও আরো অনেকেরই কবিতা ভালোবাসি।পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা, লেখা দুটোই সুন্দর। শংকর,বিমল মিত্র, শীর্ষেন্দু(মুখোপাধ্যায়),অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ রায়,শিবরাম চক্রবর্তী, বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়), মহাশ্বেতাদি, নবনীতা (দেবসেন),সমরেশ(মজুমদার) এবং আরও অনেকেরই লেখা আমি পড়েছি। বয়স হচ্ছে তো, সবার সবকথা একসঙ্গে মনেও পড়ে না। 

প্রতাপ - উর্দু কবিতা বা শায়েরির সঙ্গে মুসলমানি সাহিত্যের প্রতিও আপনার আগ্রহের কথা শুনেছি। 

বুদ্ধদেব - মুসলমানি সাহিত্যের প্রতিও আমি খুব আকৃষ্ট ছিলাম। আব্দুল হালিম শাহের ‘পুরাতন লখ্‌নৌ’ বলে একটি বই আছে, সেটিতে পুরোনো দিনের লখনৌ-র কথা জানা যায়। আমার ‘সারস্বত’ বইতে আমি একথা লিখেছি। সঙ্গে সিড়ে হায়দরি-র কথাও (সিড়ে মানে ছিটেল) লিখেছি। আরও অনেকের কথা লিখেছি।


প্রতাপ - বিশ্বসাহিত্যের প্রতিও তো আপনার দুর্নিবার আকর্ষণ। এখানেও আপনার প্রভূত পড়াশোনা। বিশেষ করে হুইটম্যান ও হেমিংওয়ে -- এই দু'টি নাম সবার আগে মনে পড়ছে। দুজনেই তো আমেরিকার সর্বকালের অন্যতম সেরা কবি ও কথাশিল্পীদের সারিতে সমাদৃত হন।

বুদ্ধদেব - হ্যাঁ, দুজনেই আমার খুব প্রিয় সাহিত্যিক। আমেরিকার ফাদার পোয়েট রূপে গণ্য ওয়াল্ট হুইটম্যানের লেখা আমি আদ্যপ্রান্ত পড়েছি। ‘লিভস্ অব গ্রাস’-এর এই কবিও জঙ্গলে যেতেন। শিকার করতেন। প্রিয় কুকুরটিকে পায়ের কাছে নিয়ে ক্যাম্প ফায়ারে যেতেন, ম্যুস (এক শ্রেণির হরিণ) শিকার করতেন। এক্ষেত্রে তিনি তো আমারই মতন মনে হয়। 

  আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আমার আর একজন প্রিয় লেখক। তিনিও শিকারী এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ ছিলেন। যে আফ্রিকায় তিনি প্রতি বছর যেতেন সেখানে আমিও গিয়েছি। তিনি স্কি করতেন সুইজারল্যান্ডে, ডিপ সী ফিশিং অর্থাৎ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার নেশা ছিল। কিউবাতে তাঁর বাড়ি ছিল ফিংকাভিজিয়া নামে। আইডোহোতে বাড়ির নাম ছিল কিচাম আর তাঁর মিয়ামি দ্বীপের কি ওয়েস্ট বাড়ি তো এখন অসংখ্য পর্যটকের প্রিয় এক জাদুঘর। কিচামে তিনি আত্মহত্যা করেন, তাঁর বাবাও আত্মহত্যা করেছিলেন। তাদের পরিবারে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। হেমিংওয়ের বিখ্যাত বইগুলো অনেকেই তো পড়েছেন। যদিও তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন 'দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ উপন্যাসের জন্য। এটি ছোট লেখা হলেও খুব ভালো লাগে। একজন বৃদ্ধ ও একজন বাচ্চা ছেলে দুজনে মিলে নৌকোয় করে যাচ্ছেন। একটা মাছ শিকার করে নিয়ে আসার পরে দেখা গেল অন্য একটা বড় মাছ সেই মাছটাকে খেয়ে চলে গেছে, শুধু পড়ে আছে তার কঙ্কালটুকু। এ এক অসামান্য দর্শন – ফিলোজফিক্যাল লেখা।

  হেমিংওয়ের আর একটি বইয়ের কথাও বলতে হয় ‘দি স্নোস অব কিলিমাঞ্জারো’, এটি পড়েই আফ্রিকার মাউন্ট মেরু, কিলিমাঞ্জারো ও আরো পাহাড় সেরিটেটিভ রেঞ্জ-এ আমি গেছি। ‘মাউন্টেন অব দ্য মুন' নামের আস্ত একটা রেঞ্জ বা পাহাড় তো আছেই। আর এখানে না এসেও বিভূতিবাবুর আশ্চর্য ‘চাঁদের পাহাড়’-এর কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। হেমিংওয়ের 'মেন উইদাউট উইমেন’ এবং অন্যান্য লেখাগুলোও খুব আকর্ষণ করে। তাঁর অনেক লেখা নিয়েই আমেরিকাতে রিসার্চ হয়েছে, কিন্তু বলবার মধ্যে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল তাঁর অনবদ্য ন্যারেটিভ প্যাটার্ন।

প্রতাপ - সত্যি লালাদা, কী অনায়াসে এক আশ্চর্য জগতে আমাদের আপনি নিয়ে যেতে পারেন! 

বুদ্ধদেব - আসলে কী জানো,এইভাবে যা পেতাম তাই গ্রোগ্রাসে গিলতাম। ঘরে বাবার অনুশাসনে একদিকে ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গেলাম, পড়া, গান,কবিতা এসব নিয়েই তো কেটে যেত। আর একজন বিদেশি ও নোবেল বিজয়ী কবি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতাও আমর খুব ভালো লাগে। তিনি নেহেরুরও খুব প্রিয় ছিলেন। দু'টি অসাধারণ লেখা 'দি রোড নট টেকেন' এবং 'স্টপিং বাই উডস অন এ স্নোয়ি ইভনিং' - এ আমিও বেশ আসক্ত হয়েছি। এই কবিতার (স্টপিং বাই...) শেষ চারটি লাইন তো নেহেরুরও খুব প্রিয় ছিল। আহা কী অসাধারণ সেই শেষ পংক্তি! বারবার পড়ি :
"The woods are lovely dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep, 
And miles to go before I sleep.

প্রতাপ - লালাদা, ইউরোপীয়, রুশ বা অন্যান্য লেখকদের কথাও যদি একটু বলেন তো আমরা আরো কিছুটা পরিশীলিত হতে পারি। 

বুদ্ধদেব- নুত হাম সুন, একজন সুইডিশ লেখক। তিনি ‘হাঙ্গার’ গ্রন্থের জন্য নোবেলও পেয়েছেন। আমাকে অবশ্য তাঁর ‘গ্রোথ অব দি সয়েল' বইটি বেশি ইন্সপায়ার করেছে। অসাধারণ ভালো এই আরেকটি বই, বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছে। বরিস পাস্তেরনাকের লেখাও খুব ভালো লাগে। তাঁর ‘ড. জিভাগো’ (বইটি পরে ছবিও হয়) একটি চমৎকার সৃষ্টি। তিনি ছাড়া রাশিয়ান লেখকদের মধ্যে আন্তন চেকভ, দস্তয়েভস্কি এবং তুর্গেনিভের লেখাও আমার খুব প্রিয়। পাস্তেরনাকের কথা তো বললাম। এমনকি তাঁর কবিতাও আমাকে দারুণ টানে। “ড. জিভাগো” বইটির শেষের দিকে বেশ কিছু অসাধারণ কবিতা আছে, আর তিনি যে ভালো কবিতাও লিখতেন তা আমরা অনেকেই হয়তো খেয়াল রাখি না।বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রে আরো অনেকেরই লেখা ভালো লাগে, খুব আনন্দ দেয়।

প্রতাপ - আনন্দের কথা যখন উঠল তখন বরিশাল বা রংপুরের সোনালি অধ্যায় আর পুরনো বন্ধুদের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ে। কোনো বিশেষ স্মৃতির কথা যদি বলেন তো আমাদেরও ভালো লাগে। 

বুদ্ধদেব - সেই দিনগুলো সত্যিই বড় আনন্দদায়ক ছিল।হরিসভার পুজো, সামনের পুকুর তার পাশে কদম গাছ থেকে ঝরে যাওয়া ফুল, যাত্রা দেখতে যাওয়া আর পুজোর অঞ্জলির সময়ে ছিল অনাবিল হাসিমাখা সুন্দরী মেয়েদের মুখ। তখন তো মেলামেশা এত সহজ ছিল না, তাই দূূর থেকে দেখার কৌতূহল ছিল।

পূর্ব বাংলায় ছিপ নৌকোয় করে ছেলেরা বাইচ খেলত। অত্যন্ত দ্রুতগামী এই ছিপ নৌকোগুলোয় সারি দিয়ে বসত ছেলের দল, তারপর সেগুলো তিরবেগে ছুটত। ছিপনৌকোয় ডাকাতরা ডাকাতি করত। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল। এসব কিছুর মধ্যে একটা সাহিত্যের চালচিত্র যেন বাঁধা আছে। 

প্রতাপ - এবারে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি দাদা।দক্ষিণীতে আপনার গান শিখতে যাওয়া, দীর্ঘ চিঠিতে প্রেম নিবেদন, উত্তর না-পেয়ে রাগ-ক্ষোভ -বিরক্তি এবং আকাশবাণীতে গান শোনার আমন্ত্রণ তারপর গানের মানুষ, ঋতু গুহের সঙ্গে 'আজি হৃদয় আমার... ' জীবনের পথচলা, এসবই আজ আমাদের চেনা জগৎ। কিন্তু আপনার অন্তরের গান হলেও আপনি রবীন্দ্রসংগীত নয়, মঞ্চে অনুষ্ঠানে টপ্পা গানই মূলত পরিবেশন করেন, এমনটা কেন হয়? তাহলে কি রবীন্দ্রনাথের গান শুধুই ঘরের আর টপ্পা বাইরের?
বুদ্ধদেব - আমি তো বারবারই বলি যে, রবীন্দ্রনাথের গান আমার প্রাণের গান। কোথাও গাইতে গেলে ঋতুর আপত্তি তো ছিল। আমি জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে গান শিখেছি, সবকিছু স্বরলিপি অনুসারী গাইও না। এমনকি বাথরুমে গাইলে মেয়েরাও ভুল ধরত। শ্বশুরবাড়ির অনেকেই গায় রবীন্দ্রসংগীত।তাই আমি টপ্পাতেই চলে এলাম। অনেক অনুষ্ঠানে গেয়েছি। 
প্রতাপ - পুরাতনী গানেরও তালিমও তো নিয়েছেন? 
বুদ্ধদেব - হ্যাঁ। অনেকের কাছেই তো শিখলাম। চণ্ডীদাস মাল,রামকুমারদা(রামকুমার মুখোপাধ্যায়), দিলীপ মুখোপাধ্যায় - এঁরা নানাভাবে সহায়তা করেছেন। নিধুবাবু অত্যন্ত পণ্ডিত, গুণী মানুষ ছিলেন এবং রসবোধও ছিল চমৎকার। বৈঠকী গানের আসরে এখনো গাইতে ইচ্ছে করে। 

প্রতাপ - আর কোন ধরনের গান বা বিশেষ কারও গান আপনাকে আপ্লুত করেছে? 

বুদ্ধদেব - ভাওয়াইয়া - ভাটিয়ালি গান। মুগ্ধ হয়েছি আব্বাসউদ্দিনের অপূর্ব গানের মাধুর্যে।
আমার মোহরদি,মোহন সিং বা আরও অনেকেরই গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ভালো লাগে। তবে ঋতুর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতই আমার বেশি ভালো লাগে, খুব দরদ দিয়েই সব ধরনের রবীন্দ্রনাথের গান ও গেয়েছে। 

প্রতাপ - আপনার ছবি আঁকা আর রঙের প্রতি আকর্ষণের কথা অনেকেই জানেন। রংতুলিতেও আপনি একজন শিল্পী। 

বুদ্ধদেব - দুঃখ-যন্ত্রণার নিরসনে ছবি আঁকার সত্যি কোনো তুলনা হয় না। আমি প্রকৃতির সুন্দর কোনো দৃশ্য দেখলে যেমন আঁকি,কল্পনায় যেসব জন্তু- জানোয়ার আসে তা-ও আঁকি আবার বিচিত্র ব্যাপারগুলো যখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়,সেগুলোও আমার আঁকার বিষয় হয়ে যায়। এরকম রিলিজ আর কোথাও নেই। 

প্রতাপ - আপনার কলমের ছোঁয়াতে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ হয়ে ওঠে বাঙালির টুরিস্ট স্পট - ভ্রমণ সঙ্গী। কোল, মুণ্ডা গরিব আদিবাসীরা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ, ঠুঠা বইগার মতো সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠে সাহিত্যে অমর। কী রকম লাগে এই অনুভূতি?

বুদ্ধদেব - সে তো ভালোই লাগে, অনেক বড় পাওয়া। এটাই হচ্ছে আমাদের আসল ভারতবর্ষ। ভীল, মুন্ডাদের মধ্যে আমি প্রকৃতির মতোই দেখেছি সহজ-সরল-স্বতঃস্ফূর্ত জীবন। ভারতবর্ষের বনজঙ্গলই আমার আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু। শীতের দিনে এখানে দেখেছি মানুষ কীভাবে কখনো বুক পেতে কখনো পিঠ পেতে আগুনে সেঁকে কত কঠিন ভাবে বাঁচে। আবার বসন্ত-বর্ষায় অপরূপ আর ভয়ংকর যে বিচিত্র প্রকৃতি তা-ও দেখেছি। এই আদিম জনজীবনের কোলে শহরের তথাকথিত শিক্ষিতদের ভন্ডামি, তঞ্চকতা নেই। তাই বন-পাহাড় আমার এত প্রিয়, হয়ে উঠেছে প্রকৃতই বন্ধু।
প্রতাপ - কত বিচিত্র অভিঘাতে বেড়ে ওঠা মানুষের
জীবনকে আপনি দেখেছেন দিনের পর দিন, এ আমাদের অনেকখানি পাওয়া। বাংলা সাহিত্য - সংস্কৃতির পরিধিও তাই প্রসারিত হতে পেরেছে। 
জীবনী গ্রন্থের প্রতিও যে আপনি অনুরক্ত হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ প্রসঙ্গে অল্প করে হলেও যদি কিছু বলেন তো আমরা আরও কিছু জানতে পারি। 
বুদ্ধদেব - জীবনীগ্রন্থ পড়ার দিকেও আমার খুব ঝোঁক ছিল। ভ্যান গখের জীবনী ও আরভিং স্টোনের লেখাগুলো আমার বিশেষ প্রিয়। হেমিংওয়ের জীবনী ভালো লাগে। কালোর্স বেকারের লেখা। অরবিন্দ গুহ-র 'করুণাসাগর বিদ্যাসাগর' বইটিও খুব সুন্দর, যেটি ছদ্মনামে ( ইন্দ্র মিত্র) লেখা। সবচেয়ে ভালো লাগে একজনের জীবনী পড়তে তিনি হলেন লা ম্যুর পিয়েরের 'বিয়ন্ড ডিজায়ার বইয়ের নায়ক ফেলিক্স মেন্ডেলসনকে। যে বই খুব কম বাঙালিই হয়তো পড়েছেন। মেন্ডেলসন একজন বড়মাপের কম্পোজার, সুরকার তথা সঙ্গীত স্রষ্টা ছিলেন। বাখ্, বিঠোফনের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হয়। ইউনাইটেড জার্মানির অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তির উত্তরসূরি হয়েও তিনি ব্যবসায় কোনো আগ্রহ দেখাননি। তাঁর বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। মা খুব সংবেদনশীল মহিলা ছিলেন ও তাঁকে গান-বাজনায় উৎসাহ দিতেন। এই ধনী বাবাকে কেউ চেনে না কিন্তু ফেলিক্স মেন্ডেলসনের নাম সারা দুনিয়া মনে রাখবে আগামীতেও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অকালেই আনহিটেড রুমে টিউবারকুলোসিসে তাঁর মৃত্যু হয়। অসম্ভব ভালো বই এই 'বিয়ন্ড ডিজায়ার' যেখানে প্রেমিক মেন্ডেলসন ও প্রেমিকা ইউরোপের একজন অসামান্যা সুন্দরীর কথা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে থাকে। আমেরিকার যুদ্ধের ওপর নোবেলজী এরিখ মারিয়া রিমার্কের 'অল কোয়াইট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' আর একটি বিখ্যাত বই। রিমার্কের লেখা 
‘থ্রি কমরেডস' বইটিও বেশ ভালো যার অনুবাদ করেছেন হীরেন দত্ত 'তিন বন্ধু' শিরোনামে এবং এই অনুবাদটিও ভারী চমৎকার হয়েছে।

প্রতাপ - লেখক সত্তার পাশাপাশি পাঠক হিসেবেও আপনি অনন্য তাই আপনার লেখায় এবং নিবিড় পাঠেও গদ্যের সঙ্গে কবিতার এক আশ্চর্য সহাবস্থান আমরা দেখতে পাই। 

 বুদ্ধদেব - এত লেখা পড়েছি, গল্প পড়েছি, কবিতা উপন্যাস পড়েছি তার অনেক কিছুই বলা হল না। আমি পাঠক হিসেবেই বড়, লেখক হিসেবে আমি কী তা আমার পাঠকেরা বিচার করবেন। পাঠক হিসেবে আমি অবশ্যই গর্বিত। এক্ষেত্রে একটা কথা বলতে পারি যে, গদ্যের চেয়ে আমার কবিতা বেশি প্রিয়। গদ্য হচ্ছে পারফিউম যা বড় বোতলে বা শিশিতে থাকে আর কবিতা হল আতর এবং খুব ছোট্ট শিশিতে ধরা থাকে— এক ফোঁটাতেই চারদিক গন্ধে ভরে ওঠে। 

প্রতাপ - আপনার পাঠ অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে মন ভরে গেল দাদা। চোখের সমস্যায় এখন তো পড়া বা আঁকা খুব কঠিন হয়ে গেল। তা হলে এখন কীভাবে সময় কাটে? 

 বুদ্ধদেব - এখন তো আমার চোখটাই চলে গেছে, পড়তে আর পারি না, পড়া বন্ধই হয়ে গেল। যা আগে পড়েছি, তারই স্মৃতি রোমন্থন করি, আর তাতেই বুক ভরে ওঠে। এছাড়া গদ্য ও কবিতার কিছু কিছু লাইন আমার মনের চোখে ঝিলিক মেরে যায়, গান তো অবশ্যই শুনি, প্রেরণা জোগায়। 

প্রতাপ - এত খ্যাতি-জনপ্রিয়তা আপনার, তা-ও না- পাওয়ার যন্ত্রণা বা আক্ষেপ কিছু তো রয়েই গেল। কী বলবেন? 

বুদ্ধদেব - শহুরে ভদ্রলোকদের কপটতা নিয়মিত দেখেছি, খারাপ লেগেছে। মেরুদণ্ড সোজা রেখে প্রকৃতির কাছের মানুষেরা বেঁচে থাকে,তাই তারা আমার অন্তরে বাস করে। আনন্দবাজারে নিয়মিত লিখলেও বা আনন্দ পেলেও (আনন্দ পুরস্কার) দেশ পত্রিকায় আমি অপাংক্তেয় থেকেছি কিন্তু কোনোদিন কোথাও নিচু হতে পারিনি। অনেকে তো আমাকে লেখক বলে মনেই করেন না, শর্টলিস্টেড হয়েও বড় পুরস্কার পাইনি। কোনোকিছুর জন্যই আক্ষেপ করিনি। এত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, বহু পাঠক নিবিষ্ট মনে আমার বইগুলো পড়ে -- এগুলোই আমার পাওয়া।পাঠকের অকৃত্রিম ভালোবাসাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। 

প্রতাপ - সত্যি আপ্লুত হলাম দাদা। আরও কিছু কথা আর একদিন এসে আপনার মুখ থেকে শুনব, আজ তাহলে উঠি।

 বুদ্ধদেব - এসো আবার। আমার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক কথা বলার থাকে, সব তো বলা হয়ে ওঠে না। ফোন কোরো। 

সংযোজন (করোনাকে জয় করে নিজের বাড়িতে আসার পর টেলিফোনে কথা) 

প্রতাপ - লালাদা,অসুখে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এই অতিমারির সময়ে অনেক স্বজন-বন্ধুদেরও হারালাম। আপনি ঘরে ফিরেছেন বলে আজ খুব আনন্দ হচ্ছে। এখন কেমন আছেন? ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং আরও দীর্ঘদিন আমাদের জন্য সৃজনের আনন্দে থাকুন -- শুভকামনা জানাই। 

বুদ্ধদেব - শরীরটা এখনো বেশ দুর্বল আছে। খুব খারাপ সময় চলছে। কতজন একে একে চলে গেলেন, বড় বিষণ্ণ লাগে আজকাল। তোমরাও খুব ভালো থেকো। 'জ্বলদর্চি'র পাঠকদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিও। এখন ডাক্তারবাবু বেশি কথা বলতে বারণ করেছেন। আজ আর বেশি কথা বলতে পারছি না। 
প্রতাপ - ঠিক আছে দাদা, আপনার অনেক কথা শুনেছি, দ্রুত সেরে উঠুন। আবার দেখা হবে, প্রণাম জানবেন। 

বুদ্ধদেব - বেশ ভালো থেকো। তোমাদের সাফল্য কামনা করি।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. দুর্লভ প্রাপ্তি। ভবিষ্যতের এক অমূল্য দলিল।

    ReplyDelete