জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী -২/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩৩


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী -২

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


মা গো আমায় ছুটি দিতে বল 

বাড়িতে তখন এক মহারাজের সর্বক্ষণের বাস। যদিও তাঁর মুকুটে মহারাজ উপাধির পালক প্রাপ্তি অনেক পরে। ঘটনাক্রমে তিনি বাংলাদেশ থেকে আগত। 'ইস্কন' থেকে দীক্ষা প্রাপ্ত। ঘাঁটি আপাতত সাহু পরিবার। সকলে তাঁকে 'সখা মাস্টার' বলে ডাকে। ভালো নাম শ্রী সখানাথ ব্যাপারী। দীক্ষিত হওয়ার পর শ্রী সনৎ কুমার দাস ব্রহ্মচারী নামে পরিচিত হন। বিশ্বস্ত আর শিক্ষিত গ্রাজুয়েট। বাড়ির বড়দের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। বাড়ির কচি কচি ছেলে-মেয়েদের হোম টিউটর তিনি। কড়া ধাতের। তবে সুন্দর বুঝিয়ে দেন পড়া। সে-টিউটোরিয়ালে ননি আর নন্দের প্রথম 'অ আ ক খ' শেখা। তাঁর হাতেই দুজনের শিক্ষার হাতেখড়ি। অক্ষর পরিচয়। বর্ণপরিচয়, প্রথম ভাগ আর দ্বিতীয় ভাগের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। অতঃপর সখা মাস্টার ইস্কনে চলে গেলেন। সেখানেই তিনি পরে মহারাজ পদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর কচিকাঁচার পড়াশুনায় ছেদ পড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু নাহ, তেমন সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করলেন বিমলাদেবী। সে-খামতি পুষিয়ে দিতেন তিনি নিজে। কেননা লেখাপড়ায় খামতি একদম বরদাস্ত করতেন না তিনি।
       

তাঁর লেখাপড়ার দৌড় বেশি নয়। মাত্র চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার রাশ তিনি ধরেছিলেন শক্ত হাতে। হাল ছেড়ে দেবার পাত্রী তিনি নন। অসম্ভব মনের জোর এই মহিয়সী মহিলার। অসীম তাঁর ধৈর্য্য আর সহ্য শক্তি। সীমাহীন স্পৃহা। মাটির বাড়িতে যে দালান, সেখানে একটি দড়ির দোলনা টাঙানো থাকত। দোলনায় বসে তিনি মৃদু দোলা খেতেন। দোলা খেতে খেতে তীক্ষ্ম নজর রাখতেন ছেলে মেয়েদের উপর। দালানের দোতলায় চাটাই পাতা। সেটার উপর বই খাতা কলম নিয়ে বসে আছে তাঁর ছেলে মেয়ের দল। তিনি দৃঢ় হাতে তাদের পড়াশুনা সামলান। শর্ত একটাই―সজোরে পড়তে হবে পাঠ। যেন নিচে বসে তিনি স্পষ্ট শুনতে পান পড়া। বেশি বেগড়বাই করলে জুটত শাস্তি। কড়া শাস্তি। তাঁর চক্ষুর সামনে একদণ্ড ট্যাঁ ফোঁ করার দুঃসাহস করত না কেউ। এমনই কড়া ধাতের তাঁর অপত্য স্নেহ, ভালোবাসা আর টান।

এদিকে সংসারের আয় একেবারে তলানিতে। প্রকট আর্থিক সংকট। আট সন্তান নিয়ে ঘোর বিপাকে বিমলাদেবী। নিজে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছেন। অথচ সংসারে সুদিন অমিল। ভগবান বিমুখ। সে এক দিশেহারা অবস্থা। ভাগবাটোয়ারায় একশো চল্লিশ ডেসিমেল পারিবারিক জমি আর এগারো ডেসিমেল বাস্তু প্রাপ্তি। সর্বসাকুল্যে এই ছিল সম্পত্তি। আর ঘরে প্রাণী দশজন। দশজনের রোজ ন্যুনতম দুবেলা অন্ন সংস্থান করা দায় হয়ে দাঁড়াল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার বোঝা। না, বোঝা নয়; শিক্ষার অদম্য প্রয়াস। সবদিক সামাল দেওয়া কী করে সম্ভব? এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে। কুনারপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট তখন শ্যামাপদ বাবুর মামা শ্রী কেদার গুড়িয়া। প্রায় দশ - পনেরো বৎসর ধরে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন। তাঁর নিবাস সগুড়িয়া। বিমলাদেবীর বাপের বাড়ির গ্রাম। গ্রাম পঞ্চায়েতে এখনকার 'অঞ্চল প্রধান' পদের সমতুল্য এই প্রেসিডেন্ট পদ। একদিন তিনি ভাগ্নে শ্যামাপদ বাবুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন―
'শ্যাম, রেশনের এম আর ডিলারশিপ করবি?'
'কেন করবনি, মামা! অবশ্যই করব'―তৎক্ষণাৎ উত্তর ভাগ্নে শ্যাম-এর। ততদিনে বাপ-জেঠার যৌথ ফ্যামিলি আর নেই। গোড়ায় অবশ্যম্ভাবী ভাঙন ধরেছে। গড়ে উঠেছে টুকরো টুকরো নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। ফলে এতদিনকার শ্যামাপদ বাবুর শখ আর খামখেয়ালিপনায় রাশ টানার সময় আগত। নতুবা অকস্মাৎ পতন অনিবার্য। অবিন্যস্ত স্রোতে তলিয়ে যাবে সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারটা। তার আগে শক্ত হাতে ধরতে হবে সংসারের হাল। সেজন্য চাই চাষাবাদ ব্যতীত একটা বিকল্প ইনকাম-এর সুবন্দোবস্ত। না-হলে অতলে ভেসে যাবে সংসারটা। এমন সময় রেশনের ডিলারশিপ যেন তপ্ত গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে হঠাৎ বৃষ্টির মত শুধু একফোঁটা স্বস্তিই দিল না, বিকল্প ইনকামের সমান্তরাল পথ প্রসস্থ করল। তবে তা যথেষ্ট নয়। সংসারে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখল শুধুমাত্র।

এর সঙ্গে যুক্ত হল মুদিখানা দোকান। এক বিঘা জমি যৌতুকে পেয়েছিলেন শ্যামাপদ বাবু। সে-জমি বিক্রি করে মুদি দোকান খুললেন বিমলাদেবী। রেশনের হিসাব-খাতা আর মুদি দোকান― একা হাতে সামলান তিনি। এছাড়া তাঁর এক পিসিমণি রাজবালা নন্দী দেবী ও দিদিমা জানকী নন্দী দেবী তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দান করেন বিমলাদেবীকে। যদিও তাঁর সে-কষ্টের দিনগুলো পুরোপুরি অন্তর্হিত হয়নি। খুব ভোরে উঠে তিনি ধান সেদ্ধ করেন। সে-ধান ভাঙিয়ে চাল প্রস্তুত হয়। নিজের হাতে তৈরি চাল বিক্রি করতেন স্কুলে। প্রায়শই বাগানে ফলানো সব্জি, খাল-বিল-পুকুরে ধরা মাছ আর ঘরে ভাজা মুড়ি বিক্রি করে বিকল্প জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি।

(দুই)
আট ভাই-বোনের ভেতর রাম দুষ্টু ননি আর নন্দ। স্বভাবে দুজন দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। ননি খুব চঞ্চল আর দুষ্টুমিতে ওস্তাদ। নন্দ খুব চাপা স্বভাবের। কথা কম বলে। তীব্র জেদ। তবে অত্যন্ত মেধাবী। দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি। পাঠশালা হোক অথবা স্কুল, কোনও জিনিস একবার বুঝিয়ে দিলে দ্বিতীয় বার বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। কী বদমায়েশী, কী বিদ্যাবুদ্ধি―সকল দিকে প্রখর জ্ঞান। দুজনের দুষ্টুমিতে ঘরে টেকা দায়। অতিষ্ঠ সকলে। সারাদিন দু'ভাই টো টো ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যে ঘোরে, কে জানে? স্কুলে বন্ধুরা তাদের দুজনকে 'রাম-লক্ষণ' বলে ডাকে। দুজনে যেন মানিক জোড়। রাম লক্ষণের মতোই তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা। অনুজ নন্দ দাদা ননি'র খুব ন্যাওটা। ছোট ভাইকে মনপ্রাণ ঢেলে ভালোবাসে ননি। গ্রামে-পাড়ায় কড়ি-ডাং খেলা হোক কিংবা ফুটবল― সবেতেই দাদার সঙ্গী নন্দ। বিশেষত কড়ি-ডাং খেলায় সিদ্ধহস্ত দু'ভাই। আশি-নব্বইয়ের দশকে পল্লীগ্রামের এক জনপ্রিয় খেলা কড়ি-ডাং। প্রচলিত নাম 'কড়্যা-ডাং'। এ খেলার বিশেষত্ব দুটো মাত্র জিনিস― কড়ি আর ডাং। ডাং বলতে হাত দুয়েক লম্বা শক্ত একটি শুকনো ডাল বা ছড়ি। দেড় ইঞ্চি মত ব্যাস। কড়ি হল ছয় ইঞ্চি মাপের আর একটি সরু ডালের অংশবিশেষ; যার দুপ্রান্ত সূচালো আর মধ্যভাগ মোটা―এক ইঞ্চি ব্যাসের হয়। প্রান্তটি সূচালো করা হয় দা অথবা কাটারি দিয়ে ছিলে। এ খেলার নিয়ম― ডাং দিয়ে কড়ি'র প্রান্ত ভাগে সজোরে আঘাত করলে মাটি থেকে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে কড়ি। যতক্ষণ সেটি হাওয়ায় ভাসে, সে সময়ের মধ্যে ডাং দিয়ে পুনরায় দ্বিতীয়বার সজোরে আঘাত করতে হয়। আঘাত লেগে কড়ি তখন দূরে অনুভূমিক দিকে গিয়ে পড়ে। যার কড়ি যতদূর যায়, জয়ী হয় সে। অসম্ভব জনপ্রিয় এ খেলা। আবার বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। গতিশীল কড়ি কারও শরীরে লাগলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। চোখ কান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনই একটি অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছিল এলাকায়। কবে ঘটেছিল কারও জানা নেই; তবে ঘটেছিল। কড়্যা-ডাং খেলায় নষ্ট হয়েছিল চোখ। সেই ভয়ে শ্যামাপদ বাবু একবার হুইপ জারি করলেন― কড়ি-ডাং খেলা বন্ধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? লুকিয়ে চুরিয়ে গোপনে খেলা চালিয়ে যায় দুভাই ননি আর নন্দ। তারা একবার ধরা পড়ে গেলেন বাবার হাতে। সরকার পুকুরের পাড়ে কড়ি-ডাং খেলায় মত্ত দুভাই। জানতে পেরে উত্তম মধ্যম দিলেন পিতা। এই সরকার পুকুরে স্মৃতির ঘনঘটা। রঙিন স্মৃতিপটে অমলিন সে-সকল ঘটনা। পুকুরে স্নান করতে নামলে আর উঠবার নাম নেই নন্দের। পাড়ার সব দুষ্টু ছেলের দাপট তখন সরকার পুকুরে। ঘড়ির কাঁটা যেন আলোর বেগে দৌড়ায়। দেড়-দু ঘণ্টা সময় নিমেষে অতিক্রান্ত। এত কম সময় জলে দাপাদাপি করলে মন কি ভরে! না, ভরে না। আরও কিছুক্ষণ, আরও কিছু সময়! পুকুরের তলার কাদামাটি তুলে পরিষ্কার জল যতক্ষণ না ঘোলাটে হয়, ততক্ষণ আশ মেটে না সবের। শৈশব-কৈশোরের ষোলআনা মজা লুটেপুটে নেওয়া চাই। চাই প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদনের অভীক্ষা।

ইতিমধ্যে ননি'র একবছর পরে নন্দ'কে ভর্তি করা হল কুনারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাপকাঠিতে নন্দগোপালের জন্মতারিখ গেল পাল্টে। আসলে তখন বার্থ সার্টিফিকেটের এত প্রচলন ছিল না। প্রাথমিকে ভর্তির সময় আন্দাজে একটি জন্মতারিখ লিখে দিত সকলে। সরকারি মতে সেটাই বৈধ ডেট অফ বার্থ। সেহেতু ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের তিন তারিখ হল নন্দগোপালের জন্মতারিখ। এ হেন বিদ্যালয়টি বাড়ি থেকে পাঁচশ মিটারের হাঁটা মাটির পথ। প্রধান শিক্ষক তখন শ্রী কানাইলাল সিট। পশ্চিম মাধবচক গ্রামে বাড়ি। তিনি ছাড়া আরও দুজন মাস্টার মশাই। চকগনকা গ্রামের শ্রী রাধেশ্যাম সাহু আর নন্দকিশোরপুরের শ্রী জগন্নাথ জানা। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোর পর্যন্ত লেখাপড়া। ক্লাস থ্রি থেকে দুভাই একসঙ্গে সর্বত্র বিরাজমান। কী স্কুল অথবা বাড়ি! মাঠ-ঘাট-বনবাদাড় সর্বত্র। কেননা তৃতীয় শ্রেণী থেকে তারা একসঙ্গে একই শ্রেণীতে পড়ে। মেধাবী হবার সুবাদে ক্লাস জাম্প করে ওয়ান থেকে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয় নন্দগোপাল। ফলে রাম-লক্ষণের এই মজবুত জুটি ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন থাকে। শুধু স্কুলে না, ভর্তি হতে হল টিউটোরিয়ালে। গ্রাম্য পাঠশালায় সুর করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়াই অভ্যাস। জ্ঞাতিতুতো কাকা শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু'র পুত্র শ্রী সুকেশ দাদার কাছে সকাল-সন্ধ্যায় দুবেলা পাঠের বন্দোবস্ত হয়েছে। এছাড়াও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে শিক্ষক শ্রী রাধেশ্যাম সাহু'র কন্যা মাধুরী দেবীর নিকটও কিঞ্চিৎ বিদ্যালাভ সম্পন্ন হয়েছে। 
         
ছোটবেলা থেকে নন্দগোপালের বিজ্ঞানের ভিত বেশ পাকাপোক্ত। প্রিয় বিষয় গণিত। শুধু অংক কষেই রাত কাবার হয়ে যায়। পরে প্রিয় মেজদার সৌজন্যে প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কেমিস্ট্রি। অংক আর কেমিস্ট্রির টিউটর মেজদা নিজেই। এছাড়াও, পারুলদা'র শ্রী ভাগবৎ ঘোষ এবং ঠাকুরচক নিবাসী মেজো জামাইবাবু শ্রী জগদীশ চন্দ্র বারিক স্যারেরা বিভিন্ন সময় পাঠদান করে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছেন। নন্দের বিস্তর সমস্যা― একটানা বেশি ক্ষণ না-পড়া। খেলার দিকে ধ্যান। পাড়ায় গ্রামে তার বন্ধুবান্ধবের আধিক্য। তাদের সান্নিধ্যে কখন যে সময় হুশ করে বয়ে চলে যায় সে-খেয়াল থাকে না। সারা দিনে সর্বসাকুল্যে এক―দেড় ঘণ্টার বেশি পড়ায় মন বসে না তার। এভাবে চতুর্থ শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হতে হল সরিষা-কুনারপুর অঞ্চল হাইস্কুলে। কুনারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরিষা কুনারপুর অঞ্চল হাইস্কুল আর কুনারপুর গ্রাম পঞ্চায়েত―তিনটি প্রতিষ্ঠান একই কম্পাউন্ডের ভেতর অবস্থিত। বর্তমানে হাইস্কুলটি উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ। হাইস্কুলে এসেও স্বভাবে খুব একটা হেরফের হল না। যে-কে সেই, আগের মতোই ফাঁকিবাজি, পড়াশুনায় অমনোযোগ, খেলাধুলা―এভাবেই বয়ে যায় বহেমিয়ান সময়। স্বাভাবিক ভাবেই দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষার ফল যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ হল। সিরিয়াস পড়াশুনা না করলেও লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী নন্দগোপাল―এ বিষয়ে দ্বিমত ছিল না স্কুলের মাস্টার মশায়দের মনে। ফলে টেস্টের ফলাফল প্রত্যক্ষ করে তারা শিউরে উঠলেন। অথচ পরিত্রাণের উপায় তাদের অজানা। ইতিমধ্যে মেজদা শ্রী অসিত সাহু ভদ্রকালী হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। তিনি রসায়নের শিক্ষক। বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্কুল। প্রায় পনেরো কিলোমিটার। বাড়ি থেকে প্রতিদিন যাতায়াত কার্যত অসম্ভব। সেজন্য ভদ্রকালী স্কুলের হোস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত ও বন্দোবস্ত। সেই মেজদা'র সঙ্গে একদিন আচকাই দেখা হয়ে গেল কুনারপুর হাইস্কুলের শিক্ষক শ্রী গণপতি পাত্র স্যারের সঙ্গে। অসিতকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে গণপতি বাবু বললেন―
'আরে অসিত, তুমি তো হাইস্কুলে চাকুরি কর, অথচ তোমার ভাই নন্দ একেবারে বখাটে রয়ে গেল। এবার টেস্টে আশানুরূপ ফল করেনি। ভাইকে একটু গাইড কর। অন্যথায় অকালে ভেসে যাবে ও'র উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।'

এই ঘটনা নন্দের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আংশিক। বাড়ি ফিরে মেজদার স্থির সিদ্ধান্ত― আগামী মাস তিনেক ননি আর নন্দ তার তত্ত্বাবধানে মাধ্যমিকের পড়াশুনা করবে। প্রতিদিন যাতায়াত করতে খানিক অসুবিধা হবে ঠিকই; দুভাইকে মানুষের মতো মানুষ করার প্রয়াসে সেটুকু ঝামেলা পোহাতে রাজি অসিত বাবু। বাবা-মা দুজনেই তার এই সিদ্ধান্তে একমত। সে এক গুমোট আবহাওয়া। নিরন্তর পড়াশোনার চাপ। আর কথার অবাধ্য হলে রাম-ঠ্যাঙানি! টেস্টের পরে বাড়িতে এটাই রোজকার রুটিন। রুটিন মাফিক সবকিছু অভ্যাস করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে সে। অতিষ্ঠ খাঁচা-বন্দি নন্দের মুক্ত মন। নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ-ঘাট-প্রান্তর ঘুরে বেড়ানো কোমল মন সর্বক্ষণ খোঁজে অনাবিল মুক্তি। একমুঠো শুদ্ধ অক্সিজেন। কিন্তু বিধি বাম! তার এ অভীপ্সা পূরণ হবার নয়। এ যেন তার তিতিক্ষার কঠোর পরীক্ষা চলছে। খাঁচায় বন্দি নিরুপায় বাঘ যেমন জঙ্গলের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে ধীরে ধীরে ভুলে যায় নিজের অতীত, তারপর সেই খাঁচাটিই তার একমাত্র আস্তানা হয়ে ওঠে; সে রূপে নন্দগোপালও এটাই তার নিয়তি কল্পনা করে নিজেকে নিজে সান্ত্বনা জোগায়। আস্তে আস্তে সে মানিয়ে নেয় এমন পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে। এভাবে নিরন্তর নিজের সঙ্গে আর পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে এসে পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা। সেটা ১৯৮৯ সাল। পরীক্ষার সেন্টার নারায়ণগড় হাইস্কুল।

(তিন)
রাত্রি এক প্রহর কাল অতিক্রান্ত। নিশুতি শীতের রাত। জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। কনকনে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। লেপমুড়ি দিয়ে সুখ নিদ্রায় মগ্ন। বাড়ির পশ্চিমে খোলা ফাঁকা মাঠ। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। উত্তুরে হাওয়া। হিম মাখা সে-পবন ঢুকে পড়ছে চামড়া ভেদ করে মাংসপেশিতে। চরাচর নিস্তব্ধ। গা ছমছম অন্ধকার। পাতা খসার শব্দ শোনা যায়। বাইরে শেয়াল ডাকে 'হুক্কা হুয়া'। একটানা ঘেউ ঘেউ করছে নেড়ি একটা; কাছে পিঠে কোথাও। ঝিঁঝিঁ পোকার অবিচ্ছেদ্য কলরব। নিদ্রাহীন কেউ জেগে নেই। অথচ তার ঘুম নেই চোখে। দোতলার ছাদে তখন চরম ব্যস্ততা। প্রস্তুত বিছানা। কমপ্লিট মশারী টাঙানো। মশারীর ভেতর লেপ আর বালিশ গোছাতে ব্যস্ত নন্দ। বালিশের উপর লেপটাকে সুন্দর পাট করে সাজানো। পাছে সকলে ভাবে― মশারীর মধ্যে জম্পেশ নিদ্রায় মগ্ন সে। সম্পূর্ণ হয়েছে বিছানার সজ্জা। এইবার অতি সন্তর্পণে জানলা গলে টালির ছাউনিতে পা ফেলে সে। পা টিপে টিপে, যেন জোরে আওয়াজ না ওঠে এমন, নড়বড়ে টালির উপর দিয়ে হেঁটে কলতলার নিকটবর্তী পৌঁছয়। টালির চাল থেকে পা বাড়ায় টিউবওয়েলের মাথায়। খুব সাবধানে নেমে আসে মাটিতে, সরিসৃপের মতো। সে এখন মুক্ত, স্বাধীন। তড়িঘড়ি পা চালায় মেঠো রাস্তায়। ইতিমধ্যে বিস্তর লেট হয়েছে। অন্ধকার পথ জনমানবশূন্য। সঙ্গী কেবল দু'একটা পথ কুকুর আর নিশাচর প্রাণী। গন্তব্য দূরের এক মফস্বল পাড়া। ফ্রি-সেল ভিডিও প্রদর্শনী চলছে সেখানে। মিঠুন চক্রবর্তীর 'ওয়াতন কি রাখওয়ালে'। মিঠুনের দারুণ ভক্ত সে। ফ্রি-সেল হোক কিংবা ভিডিও হল, প্রিয় নায়কের ছবি মুক্তি পেলে তাকে ঘরে আটকে রাখা মুশকিল। সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে কখন যে অন্তর্ধান হয়ে যায়, দেবা ন জানন্তি! খাঁচা বন্দি পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় নীলিমায়। এভাবে রাতবিরেতে ভিডিও দেখার দারুণ নেশা। কুনারপুর ভিডিও হলে সে যে কতবার ঢুকেছে তার ইয়ত্তা নেই। আশা ভালোবাসা, আমার তুমি, অমরসঙ্গী, গুরুদক্ষিণা প্রভৃতি সিনেমা তার বেশ কয়েকবার দেখা। ভিডিও'র এই শখ তার মনোরঞ্জনের এক বড় উপায়। এতটাই তার ভিডিও-আসক্তি যে আঁধারে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পাড়ি জমানো তার কাছে যেন জলভাত। ফেরা সেই ভোর রাতে। এটা তার রোজকার রুটিন। সেজন্য পড়াশুনায় মন নেই। অমনোযোগী। কপালে ফাঁকিবাজ তকমা।

এক নিঝুম রাতের ঘটনা। ভিডিও শো দেখতে বের হয়েছে। এমন সময় মাঝ রাস্তায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি মাথায় দে ছুট, ঘরে। শরীর পুরো কাকভেজা। টিউবওয়েলের শীর্ষে পা দিয়ে টালিতে উঠতে যাবে, অমনি পা গেল ফস্কে। বৃষ্টির জল পড়ে পোড়া মাটির টালি ভিজে একসা, পিচ্ছিল। ভেজা টালিতে পা ফেলতেই স্লিপ খেয়ে পা পিছলে যাবার উপক্রম। নিচে পড়লে হাত-পা আর আস্ত থাকবে না। সে আর এক বিশাল ঝক্কি। বাড়ির লোক তখন আস্ত ছাড়বে না―একবার জানতে পারলে। অনেক কষ্টে সে-যাত্রায় উৎরে গেল সে। অশুভ দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি। তবে পায়ের চাপে টালির চালে কড়কড় মড়মড় শব্দ উঠে ঘুম ভেঙ্গে যায় বড়দার। এই যা বিপত্তি। সকাল সকাল মুচকি হেসে বড়দার গোয়েন্দাসুলভ সিরিয়াল-মার্কা কৌতূহলী প্রশ্ন―
'কী রে! কোথায় ছিলি কালকে? নিশ্চয় ভিডিও দেখতে গিয়েছিলি?'

প্রবাদ আছে―চোরের সাতদিন আর গেরস্থের একদিন। হ্যাঁ, এই প্রবাদ বাক্য সত্য প্রমাণ করে একদিন ঠিক ধরা পড়ে গেছিল হাতেনাতে। নন্দ গেছে ভিডিও দেখতে। নাক ডেকে সবাই ঘুমোচ্ছে। অঝোরে। পিতা শ্যামাপদ বাবুর চোখে ঘুম নেই। সাত-পাঁচ কী ভেবে মাটির বাড়ির ছাদে পৌঁছলেন টহল দিতে দিতে। 'দেখি, ছেলে ছোকরার দল ঘুমোচ্ছে কি-না'। মনে মনে ভাবলেন। দোতলায় এসে অব্দি তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! নন্দের শোবার ঘরে কেউ নেই! বিছানায় সুন্দর করে মশারী টাঙানো। এমনকি লেপ-বালিশগুলোকে বিছানায় এমন ভঙ্গিতে সাজানো দূর থেকে এক ঝলক দর্শণ করলে মনে হবে একজন লোক মশারীর ভেতর দিব্বি শুয়ে আছে। নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে! কিন্তু কোথায় কী? এ তো পুরোপুরি ঢপ। কারচুপি। এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে রাগে-ক্ষোভে গাত্র জ্বালা শুরু পিতার; চক্ষু লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। উত্তম-মধ্যম দিলেই মিটবে গায়ের জ্বালা। অপেক্ষা শুধু প্রতীক্ষার। শুভ সকাল আগমনের। কেমন করে কী জানি, ঘটনার কথা তৎক্ষণাৎ নন্দ'র কর্ণগোচর হয়ে গেল সে-রাত্রে। ঘটনার গুরুত্ব আর শাস্তি বিধানের আকাশ কুসুম চিন্তা আন্দাজ করে ফাঁকিবাজ নন্দ আগামী দুদিন ব্যাপী আর পিতার সম্মুখীন হবার দুঃসাহস দেখায়নি। ঘাপটি মেরে বসে থেকেছে; আড়ালে, আবডালে। দীর্ঘ প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টার এক রুদ্ধশ্বাস গোপন বন্দি জীবন। স্বেচ্ছায়। দু-তিন দিন পরের ঘটনা। পিতার রাগ প্রশমিত হলে পর মুখোমুখি সাক্ষাৎ করেছিল সে। অনেক কষ্টে সে-যাত্রায় উদ্ধার।

শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের গোড়া পর্যন্ত ভিডিও'র প্রতি তার এই মারাত্মক নেশা সমূহ ক্ষতি ডেকে আনে লেখাপড়ায়। দিনকে দিন বেড়েছে ভিডিও দেখার প্রবণতা। ড্রাগের মত প্রবল সে-নেশা। এতটুকু কমেনি ইলেভেন-টুয়েলভ ক্লাসে অধ্যয়ন কালেও। হোস্টেলের সুপার তখন জীবনবিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক শ্রী প্রদ্যোৎ স্যার। নন্দকে খুব ভালোবাসে। আদর করে 'ছোট্টু' নামে ডাকে। তা, সেই বাইলজি স্যার প্রিয় ছাত্রের দোষগুণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। জ্ঞাত হোস্টেলে নারানের ভিডিও দেখার কুকীর্তির সম্পর্কে। অজ্ঞাত নয় হামেশাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হোস্টেল থেকে তার ভিডিও দর্শনের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড। একবার তো রীতিমত বাজি ধরে বসলেন প্রিয় মাস্টার মশায়। ছুড়ে দিলেন একখানা পাটিগণিত-মার্কা আপাত কঠিন চ্যালেঞ্জ। ছোট্টুকে কাছে ডেকে শুধালেন―
'এরপর থেকে সিনেমা দেখতে গেলে হাতেনাতে ধরব, দেখে নিস।'
যদিও স্যারও জানেন এটা আপাত ভীষণ শক্ত কাজ। নাছোড়বান্দা ছাত্রও। স্যারের উদ্দেশ্যে সরাসরি টক্কর ছুঁড়ে দিয়ে সহাস্য বদনে ছাত্র বল্লে―
'ঠিক আছে, স্যার! আমাকে ধরে দেখান।'
নাহ, হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি ছাত্রকে। ছাত্রের অদম্য জেদের কাছে পরাজিত শিক্ষক। আসলে শিক্ষাগুরু চিরন্তন। নেই তাদের হারের গ্লানি কিংবা পরাজয়ের ভয়। আছে কেবল সাফল্যের বিজয়ডঙ্কা। ছাত্রকে নীল আকাশে উড়ানের শ্বেতপত্র।

(চার)
১৯৮৯ সাল। নারায়ণগড় হাইস্কুলের পাশে ঠিক হয়েছে ভাড়া ঘর। পরীক্ষার ক'টা দিন দু'ভাই কষ্টে-সৃষ্টে উতরে দেবে। মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পূর্ন করবে ভাড়ার ঘর থেকে। আনুমানিক মাস তিনেক পরে রেজাল্ট। প্রথম বিভাগে পাস করে মুখ রক্ষা করে ক্লাসের ফার্স্ট বয় নন্দ। দাদা ননিও ফার্স্ট ডিভিশন। এইবার আর ভুল নয়। উচ্চ মাধ্যমিকে তাঁর কাছে থেকে পড়বে ননি আর নন্দ―ডিসিশন মেজদার। অগত্যা বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে ভদ্রকালী গমন। সাধের কুনারপুর ছেড়ে, নিজের চেনা আকাশ-চেনা এলাকা, সরকার পুকুর, কড়্যা-ডাং, ফ্রি-সেল ভিডিও প্রদর্শনী, বন্ধুবান্ধব সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে আগমন অজানা অচেনা ভদ্রকালীতে। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হল দুভাই ননি আর নন্দ। মেট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার একটা সুবিধা হল― হোস্টেলে থাকা-খাওয়া ফ্রি। একই রুমের বাসিন্দা ননি আর নন্দ। তাদের দুজনের উপর তীক্ষ্ম নজর অসিত বাবুর। বখে যাওয়া ছোট দুভাই-এর পড়াশুনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের স্কন্ধে আরোপ করলেন। আসলে মেজদাকে যমের মতো ভয় পায় তারা। মেজদার মুখের উপর বাক্য প্রক্ষেপনের সাহস কারও নেই। মেজভাইয়ের সম্মুখে তাদের মাথা নিচে নামানো আর দৃষ্টি মাটিতে নিক্ষিপ্ত। যেন ভীষণ রকম শান্ত। ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না―ভাবখানা এমন। ঘাড় নেড়ে প্রত্যুত্তর দিয়েই খালাস। অন্যথায় হাজার প্রশ্নবাণে জর্জরিত তারা যথারীতি নিরুত্তর। একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স। অবশ্য বড় হয়ে দুভাই-এর অবিকল একই স্বীকারোক্তি― বিক্ষুব্ধ জীবন-নদীতে উত্তোরণের কালে এ হেন মেজদাই দুজনের মার্গ প্রদর্শক। তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা, ত্যাগ আর শাসন ননি এবং নন্দের সঠিক পথের দিশারী। পড়াশোনার যাবতীয় খরচ নিজের স্কন্ধে নিয়েছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। এমন দাদা তাদের জীবনে আশির্বাদ স্বরূপ। তাঁর কড়া তত্ত্বাবধানে দু'বছর কাল যাবৎ খাঁচা বন্দি তোতা'র ন্যায় হোস্টেলে পড়াশুনায় মগ্ন ছিল দুভাই।

তাল কাটল টেস্টের পর। উচ্চ মাধ্যমিক টেস্ট এক্সাম অতিক্রান্ত। তিন মাস পরে ফাইনাল পরীক্ষা। খুব ভাইটাল এ-সময়টা। নিবিড় মনোযোগ আর গভীর অধ্যবসায়― তুঙ্গে থাকে পরীক্ষার প্রিপারেশন। শুধু প্রয়োজন নিরিবিলি আর শান্ত এক জনবিরল স্থান। হোস্টেলে অনেক স্টুডেন্ট। দিনভর শুধু চিৎকার, চেঁচামেচি ও ঝগড়াঝাটি। বারবার বিঘ্নিত হয় লেখাপড়া। বন্ধুবান্ধব সব ডিসটার্ব করতে ওস্তাদ। সেজন্য ননি আর নন্দের অভিমত―বাড়িতে পরীক্ষার প্রিপারেশন সম্পূর্ণ করবে তারা। এই অভিনব আর্জি নিয়ে হাজির হল মেজদার দরবারে। সাত-পাঁচ ক্যালকুলেশন না করে দুভাইয়ের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়ে দেয় মেজদা। আনন্দে উচ্ছ্বসিত তারা। উল্লসিত ছুটি মঞ্জুর হয়েছে বলে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে এবার ঘর রওনা হওয়ার পালা। 
       
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে এক মহাপাপ বিদ্ধ করেছিল জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে। গুরু দ্রোণ'কে পরাজিত করতে ছলনার আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। 'অশ্বত্থামা ইতি গজ'― এই আপাত সত্য বাক্য উচ্চারিত হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের কণ্ঠ থেকে। সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের কণ্ঠ নিসৃত বাণী শ্রবণ করে সেদিন আড়ালে নিশ্চিত হেসে উঠেছিল নিয়তি। সেজন্য মহাপ্রস্থানের সময় নরক দর্শন হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের। সেরূপে দুই অনুজের ছলচাতুরি অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় অসিত বাবুর সন্নিকটে। অজান্তে তাঁর মুখ থেকে নিসৃত হয় 'হ্যাঁ, তবে যা বাড়ি'। ব্যাস, দীর্ঘ পরিশ্রমে স্বপ্নের যে সৌধ নির্মাণ করেছিলেন অসিত বাবু, যে-স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন দুভাইয়ের চোখে; এক ঝটকায় ভূপাতিত হল স্বপ্ন সাকার করার অলীক সে-প্রয়াস। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারপরনাই বাজে রেজাল্ট করে নন্দগোপাল। ঘটনা কী? 

টেস্টের পর বাড়ি ফিরে এল ননি ও নন্দ। এসে অব্দি গৌণ হয়ে পড়ে লেখাপড়া। মুখ্য হয় অকাজ সব। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি চরমে ওঠে। ঢিলে পড়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিক প্রিপারেশন। পাঠ্যপুস্তকের জায়গা দখল নেয় গল্পের বই। রাত জেগে চলে গল্পের বই পড়া। আর নিয়তি হাসে গোপনে।

১৯৯১ সাল। সময়টা উচ্চ মাধ্যমিক রেজাল্ট বেরোনোর দিন। রেজাল্ট দেখে মাথায় হাত অসিত বাবুর। আকাশ থেকে পড়বার জোগাড়। নিজের চোখকে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে তিল তিল গড়ে তোলা তাঁর স্বপ্নের ইমারত। স্বপ্ন ছিল উচ্চ মাধ্যমিকে ভাই নন্দের ভালো রেজাল্ট। চোখ ধাঁধানো ফলাফল। এমন ফল যাতে সকলের চোখে তাক লেগে যায়। দাদা হিসাবে গর্ববোধ হবে তাঁর। কিন্তু কোথায় কী? এ যে পঁচা শামুকে পা কাটার শামিল। সাদামাটা রেজাল্ট। এরপর কী হবে এমন রেজাল্ট নিয়ে? দৃষ্টির অন্তরালে এতদিন যে পর্দা ঢাকা ছিল, উন্মোচিত হল তা আজ। দিনের আলোর মত পরিস্কার হল সবকিছু। আসলে মতিভ্রম হয়েছিল তাঁর―এমন ভাবনা কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিনি পুরো মাত্রায় সচেতন ছিলেন মহা ধড়িবাজ দুভাই। তাদের দুজনের ফাঁকিবাজির সুদীর্ঘ ইতিহাস বিস্মৃত নয় কেউ। তবে কোন প্রকারে অসিত বাবুর মুখ থেকে নিসৃত হল এমন বাক্য― 'তবে যা বাড়ি'? এ অমার্জনীয় অপরাধ! হয়ত নিজের কাছে রাখলে রেজাল্ট বহু গুণ মধুর হত। তবে কি এই ফলাফলের জন্য পরোক্ষে সে নিজে দায়ী? আত্মগ্লানি কুরে কুরে খায় তাঁকে। নিজেকে নিজে ধিক্কার জানায়। এ আফশোস তাঁর চিরকালের। এ অপরাধ অমার্জনীয়। সেজন্য গভীর অনুতপ্ত।

(পাঁচ)
শুধু লেখাপড়ায় অবহেলা কিংবা বাদমাইশে তুখোড় ছিল না, কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতেও সমান দক্ষ ছিল নন্দগোপাল।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষজনের পবিত্র স্থান গির্জা। এ হেন গির্জায় সর্বনিয়ন্তা প্রভু যিশুখ্রিস্ট-এর সাকার মূর্তি। প্রভু যিশুর নিকট ভক্তি ভরে প্রার্থনা করলে মেলে মুক্তি। উপশম হয় দুঃখ কষ্ট। তা, প্রভু যিশু সেবার গির্জায় নয়, হাজির ভদ্রকালী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের খোলা মাঠে। একই রকম ক্রুশবিদ্ধ। পেরেক পোতা মাথা ঈষৎ হেলানো। কপাল, হাত, পা , শরীর থেকে লাল শোনিত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। এ হেন যিশুখ্রিস্টকে দেখতে জমজমাট ভীড়। শিক্ষক, বিদ্যার্থী, অভিভাবক–সকলের মুখচোখে অপার বিস্ময়। মুগ্ধতা বিচারকমণ্ডলীর হাবভাবে। ভদ্রকালী হাইস্কুলের বাৎসরিক ক্রিড়া ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। 'যেমন খুশি সাজো' প্রতিযোগিতা চলছে। এ হেন প্রতিযোগিতায় নন্দ সেজেছে খ্রিস্টান ধর্মগুরু। প্রথম স্থান পেল নন্দ। 

ভাঙা কাঁচ। তোবড়ানো ইঞ্জিন। রাস্তায় ছড়ানো ছেটানো টুকরো টুকরো কাঁচ। যত্রতত্র রক্তের দাগ। গুরুতর আহত এক বাসযাত্রী তখনও রাস্তার উপরে পড়ে। নিথর দেহ। সংঞ্জাহীন। নিঃশ্বাস টুকু প্রবহমান। তার জামাকাপড় ছেঁড়া, রক্তে ভেজা। উপস্থিত দর্শক আঁতকে উঠছে। শিউরে উঠছে ভয়াবহ দৃশ্য দেখে। ঘটনাটি একটি বাস অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্য। আর সে-দৃশ্যটি খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছে ক্লাস টুয়েলভের নন্দ। সে-বার 'গো অ্যাজ ইউ লাইক' প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সে। পরপর দুবার পুরস্কার। যারপরনাই খুশি সে। আনন্দিত ক্লাসমেট সৈকত মণ্ডল, শ্রীকান্ত আচার্য্য, সত্যেন মণ্ডল প্রমুখ। বন্ধু সংসর্গে দারুণ সময় কাটে নন্দ'র। ক্লাসের ভেতর জমিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠে সবাই। 

অংক, জীবনবিজ্ঞান, কেমিস্ট্রি খুব পছন্দের সাবজেক্ট। আর পছন্দের বিষয় বাংলা। বাংলা খুব ভালো লাগে নন্দ'র। দুর্বোধ্য ঠেকে ফিজিক্স। ইংরেজি বিষয়ে দুর্বলতা সর্বজন বিদিত। শুধু দুর্বলতা নয়, রীতিমত ভয় ছিল ইংরেজি ক্লাস। ভয়― পাছে ইংরেজি টিচার সর্বসমক্ষে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আর সে নিরুত্তর দণ্ডায়মান হয়। পুরো ক্লাসের সামনে প্রেস্টিজের পাম্পচার, দফারফা। 

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভয় ছিল ইতিহাস নতুবা ভূগোল। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত পালা করে অ্যানুয়েল পরীক্ষায় পর্যায়ক্রমে ইতিহাসে কিংবা ভূগোলে মার্কস এসেছে চৌত্রিশের কম। গোলকাকার পৃথিবী অথবা রাজারাজড়াদের সাম্রাজ্য বিস্তারে ডাহা ফেল সে। সেজন্য ক্লাসের মধ্যে সবচাইতে বেশি মার্কস পেলেও ইচ্ছে করে প্রথম করা হত না তাকে। নবম দশম শ্রেণীতে উঠে ইতিহাস-ভূগোলের চাকা খানিক পাল্টায়। প্রথম, একদম প্রথম, সবার প্রথম হয় সে। কুনারপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তখন শ্রী অজিত দাস মহাপাত্র। খুব জনপ্রিয় হেড মাস্টার। ছাত্র বৎসল। স্টুডেন্ট অন্ত প্রাণ। বিদ্যার্থীদের মঙ্গল চিন্তায় সদা নিয়োজিত। 

এত কিছুর পরে বাসনা সে-ই একই। পড়াশোনায় একদম মন নেই। সুযোগ পেলে ফাঁকি মারা বিদ্যা। সেই কোন ছোটবেলায় শুরু হয়েছিল মায়ের সম্মুখে লেখাপড়া। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে চিৎকার করে পড়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা―'মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল'। সে-ডাক পিছু ছাড়ে না আজ অব্দি; দ্বাদশ উত্তীর্ণ হয়েও।

অথচ দিনের শেষে দারুণ সফল নন্দগোপাল। বৈজ্ঞানিক ড. নন্দগোপাল সাহু। তার আগুনে-কৈশোরবেলা একটা ছোট্ট দেশলাই কাঠির মতো। ভেতরে বারুদ ঠাসা। যা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা'র মত একদিন ঠিক উদ্গীরণ করে তাঁর জ্ঞানের শিখা। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে প্রয়োজন ছিল শুধু সঠিক দিশা। প্রকৃত মার্গ দর্শণের পশ্চাতে এক বিশেষ ঘটনা। শুভ ক্ষণ। সেই ক্ষণের নিমিত্ত সময়োপযোগী তার গবেষণা আজ যুগান্তকারী। সমাজে বিশেষরূপে সমাদৃত। এই গগনচুম্বী সাফল্যের রহস্য কী? কার অনুপ্রেরণায় সম্ভব হল তাঁর এই আকাশের চাঁদ ধরা?  (চলবে)


তথ্যঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments