জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী - ৩/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩৪


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী - ৩

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


হঠাৎ দেখা, 
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনোদিন 

বয়েসটা উড়বার। খোলা আকাশে মুক্ত হাওয়ায় বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানোর বয়স। দুহাত ছড়িয়ে। প্রাণ খুলে। জীবনের রূপ-রস-গন্ধ-রোমাঞ্চ আস্বাদনের বেপরোয়া সময়। হেলায় তুড়ি মেরে রঙিন স্বপ্নের ফানুস রামধনু আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার বয়স তখন। অশান্ত মন যা-চায়, তা প্রাপ্তির দুঃসাহসিক সময় তখন। দুর্নিবার ভঙ্গিতে আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার সংকল্প হৃদয়ে। ভাঙা-গড়ার কঠিন সময় সেটা। সে-কলেজ বয়সে প্রত্যেকেরই সিনেমার প্রতি থাকে এক অমোঘ টান। কলেজ ফাঁকি মেরে গোপনে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সিনেমা হলে মুভি দেখার মজাই আলাদা। আর তা যদি হয় প্রিয় নায়ক নায়িকার ছবি, তাহলে তো কথাই নেই। পোয়াবারো। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সামিল।

সময়টা অশান্ত নব্বই দশক। বলিউডে এক লাস্যময়ী অভিনেত্রীর উল্কা গতির উত্থান এবং পতন। দিব্যা ভারতী। আসমূদ্র-হিমাচলের অবিসংবাদিত বিউটি কুইন। লাখো লাখো তরুণের হার্টথ্রব। রাতঘুম ভঙ্গের উচ্ছ্বসিত জোয়ার। ১৯৯৩ সালে প্রিয় নায়িকার রোমান্টিক সিনেমা 'রং' (Rang) মুক্তি পেল জুলাই মাসে। অথচ ছবি মুক্তির চার মাস পূর্বে নায়িকার আকস্মিক মৃত্যু। বিস্মিত আট থেকে আশি। শোকে মুহ্যমান গোটা দেশ। এক বন্ধুর সবচাইতে প্রিয় অভিনেত্রী দিব্যা ভারতী। সে রাস্তায় পাকড়াও করল ভিডিও-পাগল নন্দকে―
'দিব্যা ভারতী'র 'রং' মুক্তি পেয়েছে। আজ সিনেমা হলে আসছে। চল দেখে আসি।'
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ফার্স্ট শো, ফার্স্ট টিকিট। কাঁথির সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টার তখন একেবারে ফাঁকা। জনমানবশূন্য। সবার প্রথম কাউন্টারের সামনে লাইনে দু'বন্ধু। তখনও কাউন্টার খোলার সময় হয়নি। দেখতে দেখতে বিশাল লম্বা লাইন তাদের পেছনে রাস্তায় গিয়ে পড়ল। আর দুই বন্ধু সবার প্রথম টিকিট কেটে তাদের পছন্দ মত চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল। শো হাউসফুল। শোয়ের শেষে প্রিয় নায়িকার অকাল মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠে বন্ধুর মুখ-চোখে সে এক দারুণ তৃপ্তি। হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ। এভাবে সময় কেটে যায় নন্দের।

১৯৯১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর পাশকুড়া বনমালী কলেজে ম্যাথ-অনার্সে সরাসরি ভর্তির সুযোগ এসেছিল নন্দের। তারও সুপ্ত ইচ্ছা গণিত অনার্স। বেঁকে বসলেন দাদা-বউদি। মেজদা শ্রী অসিত সাহু আর মেজো বউদি সুস্মিতা দেবী। দুজনেই হাইস্কুলে রসায়নের টিচার। থাকেন এগরা মিউনিসিপ্যাল এলাকায়। এ হেন দাদা-বউদির তীব্র আপত্তি নন্দের ম্যাথমেটিক্স অনার্স পঠন। তাঁদের যুক্তি রসায়নে সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। আর ফাঁকিবাজ নন্দকে তাঁরা একা ছাড়তে নিমরাজি। বরং কন্টাই প্রভাত কুমার কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্সে ভর্তি হোক নন্দ। তাহলে এগরায় দাদা-বউদির স্নেহচ্ছায়ায় থেকে পঠনপাঠন করতে পারবে― বাড়ির সকলের অভিমত। অগত্যা নিমরাজি নন্দকে রাজি হতেই হল। ম্যাথ অনার্স ছেড়ে ভর্তি হল কাঁথি কলেজে। গণিতের সফর ছেড়ে অণু-পরমাণুর বিক্রিয়ার সফরে সওয়ারী হল সে। স্নাতকে কেমিস্ট্রি অনার্স। কাঁথি কলেজে তখন চাঁদের হাট। একগুচ্ছ গুণী অধ্যাপক। জৈব রসায়নে প্রফেসর হৃষিকেশ বাবু, অজৈব রসায়নে প্রফেসর রঞ্জন বাবু আর সমীর জানা স্যার, ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির প্রাণপুরুষ অধ্যাপক রুদ্র বাবু। সকলেই দুর্দান্ত পড়ান ক্লাসে। বাড়িতে দাদা-বউদি কেমিস্ট্রির শিক্ষক হওয়ার সুবাদে তার বিস্তর সুবিধা। রসায়নের দূরহ যে তত্ত্বগুলি কলেজে অবোধ্য ঠেকে; বাড়িতে অতি সহজ পন্থায় বুঝিয়ে দেন মেজো দাদা শ্রী অসিত কুমার সাহু, তার হোম টিউটর।
        

এগরা থেকে কাঁথি পঁচিশ-ছাব্বিশ কিলোমিটার পথ। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম বাস গণপরিবহন ব্যবস্থা। বাসে এক ঘণ্টার পথ। মেদিনীপুর-কাঁথি অনেক লোকাল বাস। সাড়ে আটটা―পৌনে ন'টায় গাড়ি ধরা চাই। কেননা কলেজে সকাল দশটায় ক্লাস শুরু। বাসভাড়া মাত্র আড়াই টাকা। স্টুডেন্টের হাফ কনসেশন। অর্ধেক ভাড়া, সোয়া এক টাকা। সুপার ফাস্ট বাসের ভাড়া আকাশ ছোঁয়া। তায় নো কনসেশন। সেজন্য শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা লোকাল বাস ভরসা। প্রচুর ছেলেমেয়ে যাতায়াত করে বাসে, কলেজে যায়। নবগোপাল, হিস্ট্রি'র খোকন ও অশোক―তার খুব কাছের বন্ধু। তারা সব একে একে বিভিন্ন স্টপেজে ওঠে। একসঙ্গে হইহুল্লোড় করতে করতে কখন যে কলেজে পৌঁছয় সকলে, সে খেয়াল থাকে না। দীপক, সঞ্জয়, কাকলি, রঞ্জন, তনুশ্রী (মান্টি), দেবকুমার, দেবকৃষ্ণ, কানাই―ক্লাসে সবার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব। ক্লোজ ফ্রেন্ডস। সিনিয়র কল্যাণদা এসময় খুব সাহায্য করেছেন। নবগোপাল-এর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব নন্দের। কলেজে সারাক্ষণ দুজনে একসঙ্গে ঘোরে। তাদের দুটিকে সবাই 'নব-নন্দ' বলে ক্ষ্যাপায়। 
           
এগরা শহরে গড়ে উঠেছে একটি বিজ্ঞান ক্লাব। নাম 'অর্গানাইজেশন ফর দি কাল্টিভেসন অফ সায়েন্স' (Organization for the Cultivation of Science)। সংক্ষিপ্ত নাম 'ও সি এস' (O.C.S.)। এলাকায় বেশ নামডাক। স্নাতক অধ্যয়ন কালে দ্বিতীয় বর্ষে এ হেন বিজ্ঞান ক্লাবের সদস্য হয়েছিল নন্দ। প্রতি বছর আগস্ট মাসে একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করে ক্লাব। ওয়ার্কশপ চলে তিন থেকে চার দিন। মূলত স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রোজেক্ট, বিজ্ঞান-মডেল, চার্ট প্রভৃতি বিষয়ের ওয়ার্কশপ। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কখনও সখনও কম্পিটিশন আহ্বান করা হয়। কম্পিটিশনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী প্রতিযোগীকে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কার প্রদানের দিন অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময় অনেক বিশিষ্ঠ ব্যক্তি, বৈজ্ঞানিক উপস্থিত থাকেন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। ড. দেবীপ্রসাদ দুয়ারী, বৈজ্ঞানিক অমলেন্দু বন্দোপাধ্যায়, আই আই টি কানপুর থেকে প্রফেসর ভার্মা প্রভৃতি গুণীজনের সান্নিধ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিজ্ঞান ক্লাব। এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত মেজদা শ্রী অসিত কুমার সাহু এবং বউদি সুস্মিতা দেবী। সুস্মিতা দেবী দীর্ঘদিন ক্লাবের ভাইস-প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করেন। অনেক সমাজ সেবামূলক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত এই ক্লাব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, করোনা মহামারী কালে সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে এর বিশাল কর্মকান্ড।

(দুই)
দেবাশীষদা, দীপক, শান্তনু আর নন্দ―এই ছিল চারমূর্তি। ইউনিভার্সিটির ক্লাস রুম হোক কিংবা কাজু বাদামের বন―সর্বত্র একসাথে বিরাজিত চারমূর্তি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বেশ বড়। বিস্তীর্ণ সে-চত্বরে লেজার পিরিয়ডে ঘুরে ফিরে দেখার বিশাল ধুম। পশ্চিম দিকে সুদৃশ্য যে গেট, তার পাশটায় ক্যাম্পাসের বাইরে রাস্তার দুপাশে দুটি মাত্র চায়ের দোকান। সেখানে চায়ের আড্ডা খুব জমে ওঠে। গল্প-গুজব হয়। কদাচিৎ প্রফেসরদের পড়ানোর বিষয় উত্থাপিত হয় চায়ের ঠেক-এ। বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের খুব খ্যাতি জেলা জুড়ে। সেসময় ডিপার্টমেন্টে একঝাঁক উজ্জ্বল নক্ষত্র-অধ্যাপক। প্রফেসর ভূদেব রঞ্জন দে বাবু ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়ান। অরগানিক কেমিস্ট্রি'তে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যার, ইনঅরগানিক কেমিস্ট্রির প্রফেসর সুরজিৎ চ্যাটার্জি বাবু আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিমার কেমিস্ট্রি'তে অধ্যাপক সমীর বিশ্বাস স্যার খুব নামকরা। স্বনামধন্য এমন সব প্রফেসরের ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ফলো করে স্টুডেন্টরা। সেখানে ভাগ্যের জোরে এম এস সি'তে চান্স পেল নন্দ। সেটা ১৯৯৫ সাল।

বি এস সি'তে রেজাল্ট আহামরি কিছু নয়। মোটামুটি। ১৯৯৪-তে স্নাতকের পর সেজন্য নিজের লক্ষ্য আপাতত স্থির করে ফেলেছিল ছেলেটা। দশটা-চারটার স্কুল মাস্টারির নিরাপদ চাকুরী তার বাসনা। স্কুলে শিক্ষকতার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। শিক্ষক শিক্ষন প্রশিক্ষণ। চাই বি এড ডিগ্রি। সেজন্য কাল বিলম্ব না করে কাঁথি সরকারি শিক্ষক শিক্ষন মহাবিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন নেয় সে। ১৯৯৪ সালে। দিব্যি চলছিল তার বি এড-এর পঠনপাঠন। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। ১৯৯৫ সালে তার কপাল গেল খুলে। মাস্টার্স-এ ভর্তির হঠাৎ সুযোগ এসে হাজির। সেজন্য আপাতত মুলতবি রইল বি এড ডিগ্রি। তার গন্তব্য এখন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। ডিপার্টমেন্ট কেমিস্ট্রি। 
          
মেদিনীপুরে এসে খানিক নিশ্চিন্ত সে। এখন সে সম্পূর্ণ মুক্ত। পিছুটানহীন স্বাধীন এক যুবক। নিজের মর্জির একশো শতাংশের মালিক। সে এক সোনার সময়। টাউন কলোনিতে মেস। আগে থেকেই সঞ্জয়, রঞ্জন আর কানাই মেসে থাকে। পরের দিকে সেজদা ননিগোপালও সে-মেসের বর্ডার হন। আলাদা রুম শেয়ার করে থাকে। দিনের বেলা বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে টো টো ঘুরে বেড়ায় নন্দ। সন্ধ্যায় মেসে ফেরে। এসে অব্দি কোনও ক্রমে দেড়-দু ঘণ্টা বইয়ের পাতা উল্টায় সে, মেসে। ব্যাস, এটুকুই তার সারাদিনের পড়াশুনা। সেটাই যেন যথেষ্ট। রসায়নের পাঠ্যপুস্তকগুলোর বিস্তর অভিমান―মোটা ধুলোর স্তুপ;
কেন কেউ ছুঁয়ে দেখে না তাদের পৃষ্ঠাগুলো! ওদিকে, ন'টা বাজতে না বাজতেই ঘুমের দেশে ঢলে পড়ে নন্দ। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে পরের দিনের এনার্জি সঞ্চয়ের পালা। রোজকার একটাই রুটিন। একই নিয়ম।

বন্ধু বান্ধব, পিকনিক, হইহুল্লোড়―বছর ভর এ নিয়েই তার মাতামাতি। অসাধারণ সময় কাটছে। তখন ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ার-এর স্টুডেন্ট সে। সময়টা ১৯৯৭ সাল। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে একটি গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে। চারমূর্তি'র দেবাশীষদার খুব ন্যাওটা নন্দ। কোনও কাজ অথবা ডিসিশন একা একা নেয় না। দেবাশীষদা'র আজ্ঞাবহ সে। দেবাশীষদাও ভীষণ ভালোবাসে মিতবাক এই ভাইকে। সঠিক পথে গাইড করে। রি-ইউনিয়নে বিভিন্ন বিদ্যার্থীর ভিন্ন ভিন্ন রকম দায়িত্ব, কাজ। নন্দ দেবাশীষদাকে গিয়ে ধরে নাটক করবে। এক কথায় রাজি দেবাশীষদা। মোট পাঁচজনের নাটক। সে, দেবাশীষদা এবং আরও তিনজন বন্ধু। নাটকের নির্দেশনা-পরিচালনা-ড্রেসসজ্জা-পেইন্টিং সব নিজেদের ভাবনা। নন্দ সেজেছে চাকর। সে-ই নাটকের মূখ্য ভূমিকায়। নির্ধারিত দিনে মঞ্চস্থ হল তাদের নাটক। নাটকের শেষে অকল্পনীয় দৃশ্য! আরেক উপাড় অবাক হওয়ার পালা। হাততালির বন্যা বইছে। থামছে না করতালি। গমগম করছে ক্লাসরুম। প্রিয় স্যারদের প্রশংসা। ক্লাসমেটদের বাহবা। শিস ধ্বনি। নাটকের কুশীলবদের মুখ-চোখে পরম তৃপ্তির ছাপ। সময়ের প্রতি পদে জীবনকে উপভোগ করে চলার তীব্র আকুতি।

(তিন)
১৯৯৭ সাল। এম এস সি'র রেজাল্ট বেরল। স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণী। ফলাফল সন্তোষজনক। পরের লক্ষ্য প্রফেশন টিচিং। চিরটা কাল শিক্ষকতার পেশা তার ধ্যানজ্ঞান। এমন সময় একটি ঘটনা ঘটল।

মেদিনীপুরের আবাস-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এগ্রিকালচার‍্যাল অফিস। সে-অফিসে কর্মরত শ্রী হৃষিকেশ মণ্ডল। মেদিনীপুরে তাঁর সঙ্গে নন্দের পরিচিতি গড়ে ওঠে। তিনি ডেকে পাঠালেন নন্দকে। ব্যাপারখানা কী? কীসের এত তলব? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এগ্রিকালচার‍ ডিপার্টমেন্ট-এ একটি প্রোজেক্ট এসেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি স্নাতকোত্তর, স্পেসালাইজেশন রসায়ন। জরুরি তলবে এগ্রিকালচার‍্যাল অফিসে হাজির সে। হৃষিকেশ বাবুর জিজ্ঞাস্য―
'একটা নূতন প্রোজেক্ট আছে। প্রোজেক্টের কাজটা কি তুমি করবে?'
এক কথায় রাজি নন্দ। যতদিন না টিচারশিপ হচ্ছে, ততদিন এ বিকল্প ভাবনাই সই। কাজটা মূলত তদারকির। সুপারভাইজারের পোষ্ট। এ হেন প্রোজেক্টের কাজে প্রায়শই সবং, নারায়ণগড় ঘুরে বেড়ানো। প্রোজেক্টের কাজে চাপে চারপাশে চরকি ঘোরা ঘুরলে কী হবে; তার সুপ্ত ইচ্ছা স্কুল মাস্টারের ওই সরকারি চাকরি। তাছাড়া প্রোজেক্টের কাজটি প্রথমত অস্থায়ী আর দ্বিতীয়ত বেশি দিনের নয়। ফলে প্রোজেক্ট শেষে পুনরায় বি এড (B. Ed.)-এ ভর্তি মনস্থির করে সে।

পরের বছর ১৯৯৮ সালে বি এড পাঠক্রমের অ্যাপ্লিকেশন পূরণ করে সে। বি এড সেন্টার হিসাবে তার প্রথম পছন্দ পাশকুড়া বনমালী কলেজ। মেদিনীপুরে বি এড কলেজ থাকতে এত দূরে পাশকুড়ায় কেন? কারণ পাশকুড়া কলেজের অ্যাটেনডেন্স, মেদিনীপুরের মত, এত কড়াকড়ি নয়। শুধু সে একা নয়, তার প্রায় সকল বন্ধু বান্ধব বি এড-এ ভর্তি হল পাশকুড়ায়। মেদিনীপুর -হাওড়া লোকাল ট্রেনে একসঙ্গে তাদের নিত্য যাতায়াত। 

বি এড-এ পড়তে পড়তে তার জীবনে এল টার্নিং পয়েন্ট। যাকে বলে, জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা। সাধ আর সাধ্যের মাঝে খুব বড় একটা প্রশ্ন চিহ্ন! মিরাকল! ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তার এতদিনকার স্কুল মাস্টারির সাধনা, বাসনা।

(চার)
হঠাৎ দেখা। রেলগাড়ির কামরায় নয়। ইউনিভার্সিটির এক সিনিয়র দিদির মেসে; রাঙামাটিতে। বাইলজি ডিপার্টমেন্টের উষাদি। উষা রানা। উষাদির নিজের কোনও ভাই নেই। সেজন্য নন্দগোপালকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। সে-মেসে নিত্য অবাধ যাতায়াত নন্দগোপালের। সেখানেই প্রথম দেখা। প্রথম সাক্ষাৎ কলেজ পড়ুয়া কলি চৌধুরী'র সঙ্গে। 

প্রথম আলাপ। প্রথম পরিচয়। সময়টা ১৯৯৮ সাল। দুজন দুজনকে চেনা-জানার সবে শুরু। গোপালপুরের সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশ চৌধুরীদের বাড়ি। উচ্চ বংশ। সে-বাড়ির অতিশয় আদুরে কন্যা কলি চৌধুরী। বাংলা অনার্সের ছাত্রী। পড়াশুনার পাশাপাশি NIIT থেকে কম্পিউটার কোর্স সম্পূর্ণ। মা রাধারাণী দেবী স্কুল টিচার। বাবা শ্রী মৃনালকান্তি চৌধুরী ডাক্তার। কাকাও তথৈবচ। মাগুরিয়া নিবাসী শ্রী সজনীকান্ত গিরি সম্পর্কে মৃনাল বাবুর মামাদাদু। এ হেন মামাদাদুর নামে তেমাথানীতে 'সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়'। কলিদেবীর দাদু গোপালপুরে একটি বয়েজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৃনাল বাবুর দিদিমার নামে একটি গার্লস স্কুল 'সত্যময়ী বালিকা বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেছেন মৃনালবাবু নিজে। অনেক পরে, মৃনাল বাবুর মৃত্যুর পর একটি অডিটোরিয়াম স্থাপিত হয় সত্যময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে। স্বর্গীয় শ্বশুর মহাশয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে অডিটোরিয়ামটি নির্মাণের জন্য তাঁর জামাতা বৈজ্ঞানিক শ্রী নন্দগোপাল সাহু, তখন তিনি সফল এক মানুষ, আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কলিদেবীর মামারা সব বিদেশে সেটলড্। হাইলি কোয়ালিফায়েড― পি এইচ ডি হোল্ডার। ডক্টরেট। কেউ কেউ নামকরা সায়েন্টিস্ট। এভাবে একান্ত আলাপচারিতায় গাঢ় হল পরিচিতি। পরিচিতি থেকে অজ্ঞাতসারে কাছাকাছি আসা; উভয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক। কখন যে দুজন দুজনের প্রেমে হাবুডুবু, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ; কে জানে!

বি এড-এর হাজারো ঝক্কি। স্কুল সার্ভে, প্র্যাকটিস টিচিং, ফাইনাল টিচিং। তারপর লিখিত পরীক্ষা। পরীক্ষা তো নয়; পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে যেন ইতিহাস রচনা করে চলা, লেখা শেষ হতে চায় না। এর মাঝে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদ্য নব্য ঘোষণা। শিক্ষিত বেকারদের উদ্দেশ্যে নতুন আশ্বাস। পরের বছর ১৯৯৯ সালে আরম্ভ হবে স্কুলে নিয়োগের পরীক্ষা, বের হবে বিজ্ঞপ্তি। গঠিত হয়েছে রিজিওনাল স্কুল সার্ভিস কমিশন। তারাই কনডাক্ট করবে নিয়োগের যাবতীয় প্রক্রিয়া। একরাশ নতুন আশায় বুক বাঁধছে স্নাতক-স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ শিক্ষিত বেকার যুবকের দল। তার ব্যতিক্রম নয় নন্দগোপালও। বি এড-এর পাশাপাশি সেজন্য জোরকদমে চলছে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু বিধি বাম! বিধাতা বোধহয় অন্য রকম ভেবেছিলেন! তার জন্য লেখা অন্য ভবিষ্যৎ! বিকল্প পথ। অন্য জীবনচক্র রচনা করেছেন পরমেশ্বর। তা না হলে কীভাবে সম্ভব এমন অভূতপূর্ব মিরাকল! জীবনে যা সে কোনোদিন ভাবেইনি, তা সম্ভব হল কীভাবে? কী এমন ঘটনা, যার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না নন্দ?

একদিন কথায় কথায় প্রসঙ্গটা উত্থাপিত হল। তখন ১৯৯৯ সাল। এক বৎসর কালের অধিক দুজনের আলাপচারিতা। একজন আরেকজনের ভিতরকার 'আমি'টাকে এতদিনে ভালো মতন চেনে, জানে। কিন্তু নন্দের ভিতরে যে-আগুন লুক্কায়িত আছে, সে-সম্পর্কে সে নিজেও সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তারপর এল সে-দিন। নন্দের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। জীবনের মোড় ঘোরানো মিরাকল ঘটনা। ভালোবাসার জোরালো দাবি উচ্চারিত হল কলি দেবীর কণ্ঠে।

'আমার মামা-কাকা সবাই পি এইচ ডি হোল্ডার। ডক্টরেট। বড় বড় পোষ্টে কর্মরত। তোমাকেও গবেষণা করতে হবে। অন্যথায় আমাদের সম্পর্ক বাড়িতে মেনে নেবে না'–প্রেমিকার এমন আজব আবদারে যারপরনাই বিস্মিত সে। আকাশ থেকে পড়ার উপক্রম।
'আমি আর পি এইচ ডি! কদাচিৎ সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি কি পি এইচ ডি করতে পারব? আমি ফাঁকিবাজ। ইংলিশে কাঁচা। কী করব না করব কিছুই তো জানি না'―উদার আত্মসমর্পণ তার।

অল্পতেই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলা সাদামাটা নন্দ। সরকারি চাকুরীজীবির ইচ্ছা পোষণ করা মধ্যবিত্ত নন্দগোপাল। এতকাল মেজদা-মেজো বউদির কড়া অনুশাসনে পড়াশোনা করা নন্দ। প্রথমটায় হেসে উড়িয়ে দিলে সে। তার প্রণয়নী যথারীতি সিরিয়াস। নাছোড়বান্দা। এ যে ভালোবাসার দাবি! অনড় সে-দাবি। আজব সে-দাবি। নিজের ভেতরে তখন তীব্র দোলাচল। আমিত্বের সীমানায় নিজেকে নিজে ছাপিয়ে যাওয়ার তীব্র আকুতি। আপাত কঠিন সে-টার্গেট। এ কারণেই কঠিন―সর্বভারতীয় যে গুটিকয়েক কঠিন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা আছে, গবেষণার জন্য; তার কোনও টেষ্টে বসাই হয়নি নন্দের।

অথচ, প্রেমের আগুন বুকে জ্বাজল্যমান। ভালোবাসার দাবি সার্থক করার আপ্রাণ চেষ্টা। সহায় হল ভগবান। বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির একজন সিনিয়র দাদা ভানুদা তখন আই আই টি খড়গপুরে প্রফেসর চপল কুমার দাসের অধীনে গবেষণারত। মূলত সেই দাদা আর বন্ধু সঞ্জয়ের প্রচেষ্টায় খড়গপুর আই আই টি'র দরজা গেল খুলে। প্রফেসর সি কে দাসের নিকট নন্দগোপালের নাম গবেষণার জন্য সুপারিশ করে সঞ্জয় আর ভানুদা। নিমরাজি প্রফেসর দাস প্রথমে প্রোজেক্টের একটি ছোট্ট কাজ দিলেন ছাত্রকে। সেটা ১৯৯৯ সাল। পরের বছর তার পি এইচ ডি'র এনরোলমেন্ট হয়। অর্থাৎ ২০০০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নন্দগোপাল পুরোপুরি গবেষণার মূল স্রোতে। খড়গপুর আই আই টি'তে পলিমার কম্পোজিট বিষয়ে গবেষণায় তার হাতেখড়ি। দুই বা তার বেশি পলিমারের সংযোজন ঘটিয়ে মিশ্র প্লাস্টিকের মেকানিক্যাল প্রোপার্টি উন্নত করার গবেষণা। 
      
ইতিপূর্বে আই আই টি জয়েনের আগে সেরে ফেলেছেন বিয়ে। ১৯৯৯ সালে জুলাই মাসে সাতপাকে বাঁধা পড়লেন কলি দেবীর সঙ্গে। নন্দবাবুর জীবনের ঢেউ-খেলানো মেঠোপথ সোনায় মুড়ে দেওয়ার যে সংকল্প তার প্রেম, প্রণয়নী কলি দেবী তাকে দেখিয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থে আজ সেসব সত্যি। কঠিন বাস্তব। রূপকথার মত শোনালেও একথা সর্বৈব সত্য―চকগণকা'র মেঠোপথে ধুলো মাখা নন্দগোপাল থেকে বৈজ্ঞানিক নন্দগোপাল হওয়ার পশ্চাতে মস্ত বড় অনুপ্রেরণা কলি দেবী নিজে। এক বাক্যে তা স্বীকার করেন প্রিয় বৈজ্ঞানিক ড. নন্দগোপাল সাহু।

কলি দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎটা কাকতলীয়। হঠাৎ দেখার মত ঘটনা। আর সেই হঠাৎ-দেখাই আমূল বদলে ফেলল তাঁর ভেতরের 'আমি'টাকে। ফাঁকিবাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আস্ত মানুষটাকে। পি এইচ ডি, গবেষণা, 'গ্রাফিন'-এর জার্নি, ন্যাশনাল প্রাইজ― তাঁর মতে, সত্যিই 'ভাবিনি সম্ভব হবে কোনও দিন'। অথচ আজ তিনি রসায়নের কৃতী বৈজ্ঞানিক। বেশ সফল তাঁর জার্নি। সমাজকে প্লাস্টিক মুক্ত করার লড়াইয়ে তাঁর সংগ্রাম অবশ্যই কুর্ণিশ যোগ্য। প্রশংসার দাবি রাখে তাঁর কাজের পরিধি। কিন্তু আজকের উচ্চতায় পৌঁছতে যে অমানুষিক পরিশ্রম রয়েছে, সেসব অতীত ঘাঁটলে বড্ড কষ্ট হয়। অনেক হার না-মানা সংগ্রাম। না-জানা ঘটনার ঘনঘটা। কুসুমাস্তীর্ণ নয় তাঁর সে-জার্নি, সে-পথ ছিল কঙ্কটাকীর্ণ। কাঁটায় বিছানো।  (চলবে)

তথ্যঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বন্ধুস্থানীয় দাদা শিক্ষক শ্রী দেবাশীষ মান্না

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. মেদিনীপুরের মাটিতে বহু বৈজ্ঞানিক, দিকপাল প্রফেসর জন্মেছেন। আমি দুজনের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন প্রফেসর ডক্টর নন্দদুলাল পারিয়া এবং প্রফেসর ডক্টর অভয়া প্রসাদ দাস। প্রফেসর পারিয়া ছিলেন কলকাতা ইউনিভার্সিটির বোটানি ডিপার্টমেন্ট এ, এবং পরে বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর। প্রফেসর দাস ছিলেন নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি বোটানি ডিপার্টমেন্ট এ, এবং এখন আছেন রাজিব গান্ধী সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, ইটানগরে।

    ReplyDelete
  2. মেদিনীপুরের মাটিতে বহু বৈজ্ঞানিক, দিকপাল প্রফেসর জন্মেছেন। আমি দুজনের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন প্রফেসর ডক্টর নন্দদুলাল পারিয়া এবং প্রফেসর ডক্টর অভয়া প্রসাদ দাস। প্রফেসর পারিয়া ছিলেন কলকাতা ইউনিভার্সিটির বোটানি ডিপার্টমেন্ট এ, এবং পরে বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর। প্রফেসর দাস ছিলেন নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি বোটানি ডিপার্টমেন্ট এ, এবং এখন আছেন রাজিব গান্ধী সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, ইটানগরে।

    ReplyDelete