জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-১৭/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---- পর্ব--- (১৭)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মের মাহাত্ম্য

তৈত্তিরীয় উপনিষদ একটি সুন্দর আখ্যান আছে, যা প্রমাণ করে, এই লোক আয়তো ধর্মকে কিভাবে দমন করা হয়েছিল এবং তা করেছিলেন হিন্দুত্ববাদীগন। আখ্যানটি হলো, "কোন সময়ে বৃহস্পতি গায়ত্রীদেবীর মাথায়  প্রচন্ড ভাবে আঘাত করেছিলেন। এর ফলে গায়ত্রী দেবীর মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি অমর ছিলেন বলে তাঁকে মারা সম্ভব হয়নি। চূর্ণিত মস্তকের অংশগুলি ও জীবন্ত ছিল।" বিশেষজ্ঞদের মত হল, এই রূপকের অন্তরালে রয়েছে বৃহস্পতির প্রচলিত হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী শক্তির প্রয়োগ। হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল চাপে লোকায়ত দর্শন শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিবাদের অংশ হয়ে পড়ল এবং সব দর্শনের মূল হিসেবে প্রসিদ্ধ পেল। লোকায়ত দর্শন অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল না। এই দর্শনের ভিত্তিতে মৃত্তিকা বায়ু অগ্নি এবং জল যাদের অস্তিত্বকে কেন্দ্র করেই সবকিছু গড়ে উঠেছে এবং প্রকাশ পাচ্ছে। এই বস্তুগুলির অনুময় অংশও অবস্থান এবং পরিমাণগত সংমিশ্রণের তারতম্য থেকেই জীবের উৎপত্তি। এর বাইরে আর কিছু নেই -- না ঈশ্বর, না আত্মা, না পরকাল। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের অর্জিত জ্ঞানেরও মৃত্যু ঘটে। তাই অনুমান ও অনুমানকে কেন্দ্র করে যাবতীয় ধর্মীয় ব্যাখ্যা শুধুমাত্র কল্পকথা, যা ধর্মতত্ত্ববিদদের কল্পনার জগতের বিষয়। লোকায়ত দর্শনে শরীরই সব। শরীরের বাইরে আত্মার অবস্থান অকল্পনীয়। লোকায়তিগণ অদৃষ্টবাদী অথবা দৈবে বিশ্বাসী নন। বৃহস্পতির অনুগামী গণ স্বভাবের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দান করেছেন। 

লোকায়ত দার্শনিকদের ভাষায় ধর্ম হল আফিমের মতোই ক্ষতিকর, যারা আশাহত দুর্বল আত্মশক্তিতে আস্থাশীল নয় এবং কর্মবিমুখ তারাই প্রার্থনায় নত হয়ে, ঈশ্বরের অনুকম্পা ও আশ্রয় চায়। পাপ ও নরক থেকে মুক্তি পেতে তারা অবিবেচকের মতো পূজা-অর্চনায় রত হয়। তাদের মতে ঈশ্বরের মতো মিথ্যাবাদী বিশ্বের দ্বিতীয় আর নেই। বেদের বিশিষ্টতা কিসে? কিছু মন্ত্র কিছু আখ্যান কিছু ভাবনা, যা সবই ভুলে ভরা,  অস্পষ্ট দুর্বোধ্য এবং পরস্পর বিরোধী মতের সমাহার।

 লোকালয়তিগন স্পষ্ট ভাবে স্বমত প্রকাশ করে বলেন- এই ধর্ম শুধুমাত্র মানুষকে প্রতারিত করে একশ্রেণীর মানুষের উদরপূর্তির ব্যবস্থা করে, এবং জীবিকা নির্বাহের উপায় হয়ে, এবং অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের প্রতারিত করে। তাদের যুক্তি হলো প্রকৃতিই সব, প্রকৃতির নিয়মেই সব কিছু ঘটে চলেছে। আর্যদের মধ্যে যারা ব্রাত্য শ্রেণীর মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ছিলেন, তাঁরাও এই লোকায়ত ধর্মের শরিক হয়েছিলেন। বর্ণভেদ বলিদান প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপট থেকেই উঠে এসেছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতি। লোকায়তিদের মতই  বুদ্ধ বৈদিক ধর্মের প্রথাগুলি - যেমন বলিদান বর্ণভেদ মূর্তি পূজা প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি কে বর্জন করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি মুক্তচিন্তা প্রবাহ মানব সমাজের মূল স্রোতে মিশে দিতে পেরেছিলেন শুধু নয়, মানুষের ধর্ম পালনের উপায় ও অনুষঙ্গগুলি, যা তাঁর দীর্ঘ সাধনার ধন, তা জনসমাজে বিতরণ করেছিলেন। এই সময়ে জনজীবনে কুসংস্কারমুক্ত হওয়ার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।

মানুষ বুঝতে শিখল, 'মানুষের জীবন' চারটি উপাদানের গঠিত। মৃত্যুর সময় মৃত্তিকা উপাদান মৃত্তিকায় মিশে যায়; জলীয় উপাদান জলে, উষ্ণতা অংশ আগুনে এবং বায়ু উপাদান বায়ুতে মিশে যায়। মৃত্যুতেই সব শেষ। এর বাইরে আর কিছু নেই। এই অসাধারণ লোকায়ত ধর্মের পতন শুরু হল, যখন মানুষের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দৈনন্দিন জীবনকে নানা দিক দিয়ে কলুষিত করতে শুরু করল। যৌনতা, আত্মসুখ, দুর্নীতি প্রভৃতি অনাচারগুলি সমাজ জীবন কে অস্থির করে তুলল। 

চার্বাক শব্দের অর্থ চারু বাক- ঋণ করে ঘি খাও, যতক্ষণ বাঁচবে সুখে বাঁচো; মৃত্যুর পর এই আনন্দ সুখ কোথায় পাবে- এই সব আবেগময় কথাগুলির বিস্তার থেকেই যখন শুরু হল লোকায়তিদের অধঃপতন, তখনই বৌদ্ধধর্মী ও জৈনধর্মীদের প্রকাশ ঘটল বৈদিক প্রথার বিরুদ্ধে। লোকায়তিরা এই সুযোগে বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জৈন ও বৌদ্ধধর্মীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। স্বভাববাদী ও দেহাত্মবাদী বিরুদ্ধে ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য যোগ, পতঞ্জলি, কপিল একে একে আবির্ভূত হয়ে লোকায়িতদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নিলেন। জৈমিনি সোজাসুজি নতুন করে বেদের অভ্রান্ততা প্রমাণ করলেন। ব্যাস ভাববাদী দর্শনে জনজীবনকে উদ্বুদ্ধ করলেন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত লোকায়ত দর্শনও ভাববাদীদের প্রভাব ও অনুষঙ্গে পড়ে রূপান্তর লাভ করল। জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঘটার ফলে লোকায়তি বা চার্বাক পন্থীগণ নাস্তিক আখ্যায় ভূষিত হলেন। বৈদিক ধর্মের মধ্যেও আর প্রাচীন পন্থাগুলি একইভাবে বহাল থাকতে পারল না। সেখানেও সময়োচিত সংস্কার ঘটতে থাকলো। বৌদ্ধধর্মের পতনের পর শঙ্করাচার্য হিন্দু ধর্মের ধ্বজা তুলে ধরলেন। তার সময়েই বৃহষ্পতি বা লোকায়তিগণের যতটুকু প্রভাব ছিল, তা প্রায় লোপ পেল। ধর্মক্ষেত্রে মানুষের জীবন এক দোলাচলের শিকার হয়ে পড়ল। 

ধর্মক্ষেত্রে আধিপত্য কায়েম করার পিছনে কি কি কারণ সাধারণভাবে বর্তমান থাকে তার কিছু নিদর্শন বিশেষভাবে সব ধর্মেই চোখে পড়ে। প্রাচ্য ধর্ম গুলির উত্থান ও পতনের ইতিহাস বিচার করলে এই সত্যে উপনীত হতে হয় যে ধর্মের উত্থান, আধিপত্য ও অবক্ষয় যুগ যুগ ধরে ঘটে চলছে। জীবনচর্চার ক্ষেত্রে মানুষের ধর্মচর্চার ক্ষেত্রগুলি সামগ্রিকভাবে মানব সভ্যতার অগ্রগতি বা অবনতির ক্ষেত্রেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রাচ্যের ধর্মজগতে যেমন উত্থান পতন ঘটেছে, এবং এই উত্থান পতনে এক ধর্মের উপর অন্য ধর্মের আধিপত্যের ঘটনা ঘটেছে, পাশ্চাত্য ধর্মেও এই ঘটনা অপ্রতুল নয়। মানুষের ধর্মজীবনের বহিপ্রকাশের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির বিরোধ অনিবার্যভাবে দেখা দিয়েছে এবং সভ্য মানুষের অবস্থান সমাজজীবনে কখন ও নিরাপদ হয়নি।

 রাজনৈতিক আধিপত্য ও ধর্মীয় আধিপত্যকে সম্প্রসারিত করেছে যুগে যুগে। এর জন্য বহু ধর্মপ্রাণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। বহু সাধারণ মানুষকে নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে বিজিতের অনুকম্পাময় জীবন যাপন করতে হয়েছে। তখনও মানুষ নিজেকে খুঁজতে চেয়েছে। রাষ্ট্রজীবন, ধর্মজীবন তাকে খোঁজার কাজে কখনও সাহায্য করেনি, বরং তাকে উত্ত্যক্ত করেছে, নানাভাবে বশ্য করে তুলেছে। মানবসভ্যতার ইতিহাস তাই ধর্মের মানুষ ও মানুষের ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments