জ্বলদর্চি

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একশো পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে/‘ওবিন ঠাকুর, ছবি লেখে’/মুক্তি দাশ

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  একশো পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে

‘ওবিন ঠাকুর, ছবি লেখে’

মুক্তি দাশ

“আমার জীবনের প্রান্তভাগে যখন মনে করি সমস্ত দেশের হয়ে কাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া যেতে পারে তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের নাম।…আজ সমস্ত ভারতের যুগান্তরের অবতারণা হয়েছে চিত্রকলায় আত্ম উপলদ্ধিতে। সমস্ত ভারতবর্ষ আজ তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাদান গ্রহণ করেছে। এঁকে যদি দেশলক্ষ্মী বরণ করে না নেয়, আজও যদি সে উদাসীন থাকে, বিদেশী জয় ঘোষণায় আত্মাবসান স্বীকার করে নেয়, তবে এই যুগের চরম কর্তব্য থেকে বাঙালী ভ্রষ্ট হবে।” 

অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমন ঋজু অকপট স্বীকৃতি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। মৃত্যুর মাত্র মাসখানেক আগে কবিগুরু তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের আলোচনা প্রসংগে এমন উক্তি করেছিলেন। এবং এর কোনও অংশকেই অত্যুক্তি বা অতিরঞ্জিত বলে ভাবার কোনও অবকাশই নেই।

অবনীন্দ্রনাথ যথার্থই একজন মহৎ ও মুক্তমনের চিত্রশিল্পী। ভাবের পথে জীবনকে উপলব্ধি অবনীন্দ্র-শিল্পাদর্শের প্রধান ও অন্যতম লক্ষণ। তিনিই সর্বপ্রথম শিল্পকলার জগতে প্রাচ্যরীতির উদ্বোধন করে ভারতীয় চিত্রশিল্পের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের বিভিন্ন শিল্প-আঙ্গিকে যত্নের সংগে শিক্ষাগ্রহণ করে তিনি তাঁর স্বকীয় ভাবসম্পদে তাকে সমৃদ্ধ করে চিত্রাবলীতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। অর্থাৎ আরও সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে, ভারতীয় চিত্রশিল্পে পাশ্চাত্ত্য ভাবধারা আনয়নের প্রথম ভগীরথ অবনীন্দ্রনাথ। চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথের চেয়ে ভারতীয় চারুশিল্পের পুনরুদ্ধারকারী ও নবযুগের প্রবর্তক হিসেবে অবনীন্দ্রনাথের খ্যাতি ও প্রতিভার ঐতিহাসিক মূল্য অবিসংবাদিত।

অবনীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৭১ সালের ৭ই আগস্ট। জন্মাষ্টমীর দিন। আর তাঁর ছবি আঁকা শুরু হয় ১৮৯২ সালে, একুশ বছর বয়সে। বাল্যকালে নর্মাল স্কুলে কিছুকাল অধ্যয়নের পর অবনীন্দ্রনাথ ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজে। ঊনিশবছর বয়সে, প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক আগেই, তিনি কলেজ পরিত্যাগ করেন। কারণ? কারণটা তাঁর নিজের ভাষাতেই শোনা যাক :

“কলেজের গায়ে অমন যে গোলদীঘির সবুজ ঘাস, ফুলগাছ দেওয়া বাগান, সেটার দিকের প্রবেশপথের জানলাগুলো, গরাদ-আঁটা ফাটকের তালা কাউকে খুলতে দেখিনি, কাজেই কাঁচা বয়সেই কলম সরস্বতীর একটা চমৎকার বন্দনা লিখে বিদ্যামন্দিরের এন্ট্রাস থেকেই সরে পড়তে আমি একটুকুও লজ্জাবোধ করিনি। বরং উৎসাহই দেখিয়েছিলেম। বন্দনাটা সব মনে নেই; কিন্তু মনে আছে, হেডমাস্টারের কাছে খুব তারিফ পেয়েছিলেম -
এসো মা, হৃদয়ে বসো,
হৃদি আঁধার নাশো। 
দয়া কর আমারে মা, আমি ক্ষুদ্রপ্রাণী।
এটা আমার ঊনিশ বছরের original composition. ঊনিশবছরে নিজেকে ক্ষুদ্রপ্রাণী বোলে জ্ঞান করছি জেনে তোমরা মনে মনে নিশ্চয়ই হাসছ। কিন্তু ভেবে দেখ, ক্ষুদ্রপ্রাণী না হলে বিদ্যার জাঁতিকলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়া আমার পক্ষে কতটা শক্ত হতো।”

বিদ্যার জাঁতিকল থেকে বেরিয়ে অবনীন্দ্রনাথ বেশ ক’টা বছর কাটিয়ে দিলেন যন্ত্রসংগীতের আরাধনায়। যদিও তা তাঁর পরবর্তী জীবনে তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।

চিত্রকলার প্রতি শৈশবকাল থেকেই অবনীন্দ্রনাথের দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল একেবারে সহজাত। তাঁর পিতা, অর্থাৎ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র গুণেন্দ্রনাথও একসময় আর্টস্কুলের কৃতী ছাত্র ছিলেন। খুব শৌখিন মানুষ তিনি। শৌখিন পরিবেশ ও শিল্পচর্চার যে পারিবারিক পরিমন্ডলে অবনীন্দ্রনাথের জন্ম, তা তাঁর শিল্প-প্রতিভার বিকাশ ও বিকিরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। তার ওপর চিত্রচর্চার সূচনাপর্বে তিনি পেয়েছিলেন গিলার্ডির মতন প্রতিভাবান ধ্রুপদী শিল্পীকে শিক্ষাগুরু হিসেবে। গিলার্ডি তৎকালীন আর্টস্কুলের প্রথিতযশা বিদেশি শিক্ষক। এটা যেমন অবনীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে পরম সৌভাগ্যের পরিচায়ক, তেমনি বোধহয় গিলার্ডির ক্ষেত্রেও। চিত্রাঙ্কনে প্যাস্টেল ড্রইং-রীতির অনিবার্য ভূমিকা সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ সচেতন হন গিলার্ডির শিল্প-সান্নিধ্যেই।

এরপর ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনে শিল্পগুরুর ভূমিকা পালন করেন ইংরেজ শিল্পী সি. এল. পামার – যাঁর তত্ত্বাবধানে তিনি অচিরেই আয়ত্ব করে নেন অয়েল-পেন্টিং, লাইফস্টাডি প্রভৃতি অঙ্কনরীতি ও কৌশল।

এইসময় অবনীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটে গেল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রিন্স দ্বারকানাথের একদা বান্ধবী এক মেমসাহেবের কাছ থেকে তিনি অযাচিতভাবে পেয়ে গেলেন একটি অনবদ্য অ্যালবাম, উপহার হিসেবে। পরমাবতার যিশুর ক্রমানুসারিক জীবনচিত্রে ভরা সেই অ্যালবাম। এতে স্বভাতবতই রীতিমতো উদ্বুদ্ধ হলেন। লেগে পড়লেন দেশীয় পদ্ধতিতে একেবারে নিজস্ব কায়দায় রাধাকৃষ্ণের জীবনচিত্র আঁকার কাজে – যা পরবর্তীকালে ‘কৃষ্ণলীলা’ সিরিজ হিসেবে সমধিক খ্যাত। রাতদিন সে কী অমানুষিক পরিশ্রম! সেই সময়কার অনুভূতির কথা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন এইভাবে : “রো্‌জই আরম্ভ করতুম ছবি; রাত্রে স্বপনের মতো দেখে রাখতুম। আর সকালে এঁকে শেষ করতুম।” 

তাঁর নিজস্ব কল্পনার রঙে ও স্টাইলে ছবিগুলি হয়ে উঠেছিল প্রাণময়তায় ভরপুর। কল্পনাপ্রবণ মানুষ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। কল্পনার রঙিন জগতই তাঁর ঘরবাড়ি। এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘A man without imagination is like a bird without wings’ 

এই ‘কৃষ্ণলীলা’ সিরিজের ছবি দেখতে একদা জোড়াসাঁকোয় এসেছিলেন ইউরোপের মনস্বী শিল্পী এবং কলকাতার তদানীন্তন আর্টস্কুলের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ স্বয়ং ই. বি. হ্যাভেল। তাঁর নিকট-সংস্পর্শে এসে অবনীন্দ্রনাথ যেন খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর শিল্পীজীবনের পরমাস্পদ অভীষ্ট শিক্ষাগুরুকে। হ্যাভেলও তাঁকে সস্নেহ রসিকতায় ‘চ্যালা’ বলে সম্বোধন করতেন।

পরবর্তীকালে তাঁর শিল্পচর্চার জগতে জীবন্ত প্রেরণা হয়ে হাজির হয়েছেন একে একে টাইকান, হিসিডি, খাৎসুতা, কন্দুকারাই প্রমুখ জাপানী শিল্পী-প্রতিভা। একে একে তাঁর করায়ত্ব হয়েছিল জাপানী স্টাইল, তিব্বতী স্টাইল, পার্শিয়ান স্টাইল। এবং সর্বোপরি তাঁর নিজস্ব স্টাইলের যাদু তো আছেই! সমস্তকিছুর নিখুঁত সংমিশ্রণে তাঁর তুলিতে জন্ম নিল এক অনবদ্য নান্দনিক শৈলী। জাপানী পদ্ধতি এবং তাঁর পূর্বানুসৃত পদ্ধতির মিশ্রণে অবনীন্দ্রনাথের হাতে চিত্রিত হয়েছিল ‘ভারতমাতা’ ছবিটি – ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের পরিমন্ডলে যা গভীর ও তীব্র আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর ওমর খৈয়ামের চিত্রাবলীতেও ওই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে।

১৯০২ সালে জাপানের প্রতিভাবান যশস্বী শিল্পী ‘কাকুজো ওকাকুরা’-র সংগে পরিচয়কে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পীজীবনের মাইলস্টোন হিসেবে ধরা যেতে পারে। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সান্নিধ্যে এসেই আয়ত্ব করেছিলেন জলরঙের কাজ ও ‘ওয়াশ টেকনিক’।
কেবল চারুশিল্পে নয়, সাহিত্যশিল্পেও অবনীন্দ্রনাথ, সেই রবীন্দ্রযুগেও, তাঁর নিজস্ব স্টাইলে প্রায় কিংবদন্তী। চারুকলায় যখন অসামান্য সাফল্য তাঁর করতলগত, সেইসময় চিত্রাঙ্কন ব্যাপারে তিনি হঠাৎই উদাসীন। এবং ‘পুরা যাত্রাপালাগান সোয়ান ফাউন্টেনে’। একের পর এক তাঁর সেই ফাউন্টেন-তুলি থেকে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে বেরিয়ে এসেছে ‘বুড়ো আংলা’, ‘মারুতির পুঁথি’, ‘চাঁইবুড়োর পুঁথি’, ‘শকুন্তলা’, ‘ক্ষীরের পুতুল’। কী স্বচ্ছলতায় ভরা ভাষার বুনোট! ভাষা তো না, যেন খরস্রোতা কলস্বিনী! তাতে আনন্দোচ্ছ্বাস আছে, নেই প্রগলভতা। উচ্ছলতা আছে, নেই উদ্দামতা।

তাঁর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যসাধনায় আমরা পেয়েছি সাকুল্যে তিনশো চৌষট্টিটি রচনা। তার মধ্যে অন্তত চুরানব্বইটি গল্প। প্রায় তিরিশের কাছাকাছি নাটক ও পালাগান। প্রায় পঞ্চাশটি পদ্য-গদ্য কবিতা। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ভাষাতত্ববিদ সুকুমার সেনের বক্তব্য : “রবীন্দ্রনাথ যেমন অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে লেখ্যকর্ম হইতে চিত্রকর্মে পৌঁছিয়াছিলেন অবনীন্দ্রনাথও অনেকটা তেমনিভাবেই চিত্রকর্ম হইতে লেখ্যকর্মে পৌঁছান।” 

সে নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু কেন? স্বয়ং রবীন্দ্রাথের মনেও এই জিজ্ঞাসা দেখা গিয়েছিল। যার উত্তরে অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন : “কী জান রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করে তা-ই এঁকে ফেলতে পারি, সেইজন্য চিত্রকর্মে আর মন বসে না। নতুন খেলার জন্য মন ব্যস্ত।” 

অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যরচনা ও চিত্ররচনা – এই দ্বৈত প্রতিভাতেই সমুজ্জ্বল। অন্যভাবে বলা যায়, এই দুই সত্ত্বার এক অপূর্ব ও অনাস্বাদিত সংমিশ্রণই অবনীন্দ্রনাথ। এ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব উক্তি : “শব্দের সঙ্গে রূপকে জড়িয়ে নিয়ে বাক্য যদি হোলো উচ্চারিত ছবি, তার ছবি হোলো রূপের রেখায় রঙের সঙ্গে কথাকে জড়িয়ে নিয়ে রূপকথা।” 

আসলে অবনীন্দ্রনাথ ছবি লেখেন, গল্প আঁকেন। অথচ কোনোক্ষেত্রেই তিনি তেমন পরিতৃপ্ত নন। এইসময় সাময়িকভাবে চিত্ররচনা সম্পর্কে নিস্পৃহ হলেও অন্তত ১৯৪১ সাল পর্যন্ত পুরোপুরি ছবি আঁকা তিনি ছাড়েননি। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি পাকাপাকিভাবে চারুশিল্পের জগৎ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নেন। রবীন্দ্রনাথের অন্তিমযাত্রার ছবিই অবনীন্দ্রনাথের জীবনের শেষতম ছবির বিষয়বস্তু। ছবিটির ক্যাপশন ছিল : “সম্মুখে শান্তির পারাবার”।

ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যমন্ডিত। অবনীন্দ্রনাথের শিল্পপ্রতিভা রবীন্দ্রনাথের মতন যুগন্ধর কবিকেও বারে বারে চমকিত ও বিস্মিত করেছে। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন : “অবন কী আশ্চর্য মানুষ, সত্যিই আর্টিস্ট। ওর তুলিতেও ছবি, কলমেও ছবি। একেবারে নিজস্ব স্টাইল।” 

এবং ‘রবিকা’-র এই স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতির প্রায় প্রতিধ্বনি করেই নিজের নামে রসিকতা করে অবনীন্দ্রনাথ ছড়া কেটেছেন : “কোন ঠাকুর? / ওবিন ঠাকুর, ছবি লেখে!” 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments