সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক
পর্ব – ৩
তৃতীয় অধ্যায়
৭
নার্সিংহোমেই রূপাঞ্জনার সঙ্গে বিহানের প্রথম আলাপ৷ মা-কে ভর্তি করতে হয়েছিল৷ এস এস সি দিয়ে বিহানের তখন সবে চাকরিটা হয়েছে হাইস্কুলে৷ বিহানের স্কুলের সময়টুকু বাবা থাকতো নার্সিংহোমে৷ আর বাকি সময় বিহান থাকতো৷ দুপুরে বাবার সঙ্গে হোটেলে খেয়ে বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতো বিহান৷ ও ফিরতো রাতে৷
একদিন রিসেপশনে বসেছিল রূপাঞ্জনা৷ বিহান জিজ্ঞেস করলো, “এক্সকিউজমি, ড. সরকার কি চলে গেছেন?”
“হ্যাঁ৷ আবার রাতে আসবেন৷” কম্পিউটারে চোখ রূপাঞ্জনার৷
“ওহ্! দরকার ছিল ওনার সঙ্গে৷ মা-কে কবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো সেই ব্যাপারে একটু কথা বলতাম৷”
“উনি রাতে আসবেন৷ বললাম তো আপনাকে৷ তখন কথা বলে নেবেন৷” রূপাঞ্জনার মুখে বিরক্তি, চোখ তখনও কম্পিউটারেই৷
“আসলে মা পাঁচ দিন হলো ভর্তি আছেন৷ অনেক টাকা বিল হয়ে গেছে৷ তাই একটু...”
এবার বিহানের দিকে তাকালো রূপাঞ্জনা৷ নীল-কমলা চুড়িদার৷ চোখে কাজল৷ কপালে ছোট্ট টিপ৷ চুলে ক্লিপ, সুন্দর করে বাঁধা৷ ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক৷ একটু নরম স্বরেই বলল, “আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি৷ কিন্তু ডাক্তারবাবু না আসা অবধি তো কিছু বলা যাচ্ছে না৷ আপনার মা কেমন আছেন এখন?”
“আগের থেকে অনেকটা ভালো৷ যদি ছুটি দিতেন ডাক্তারবাবু, খুব ভালো হতো৷ বাকিটা বাড়িতে আমরা দেখে নিতাম৷”
“ভালো যখন আছেন অনেকটা, দেখুন, হয়তো আজই ছুটি হয়ে যেতে পারে কিংবা আগামীকাল৷” রূপাঞ্জনার মুখে সান্ত্বনা মেশানো মৃদু হাসি৷
“দেখা যাক৷ রাতে ক’টার দিকে আসেন ড. সরকার?”
“সাতটা-আটটার দিকে৷ কোন কোনদিন একটু দেরি হয়ে যায় আসতে৷ তবে সাতটার আগে কখনও আসেননা৷”
“আচ্ছা৷ অনেক ধন্যবাদ৷” ঠোঁটে হাল্কা হাসি রেখে বলে বিহান৷ তারপর মা-কে দেখার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়৷
পরের দিন সকাল সকাল বিহানের মায়ের ছুটি হয়ে যায়৷ বিহান আগে থেকেই একটা গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল৷ ড. সরকার গতকাল রাতেই ছুটির কথা বলে দিয়েছিলেন৷ বেরোবার সময় রূপাঞ্জনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ কথা হলো না আজ কোন, শুধু মৃদু হাসি বিনিময়৷ একটু হাসিও যে কখন দুটো মানুষের মাঝে সাঁকো গড়ে দেয় – কেউ তা বুঝতে পারেনা, মানুষ দুটোও না৷
৮
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে বিহান৷ বৃষ্টির সঙ্গে ঝোরো হাওয়া৷ চারপাশ অন্ধকার হয়ে আছে৷ সকালবেলা ভালোই রোদ উঠেছিল৷ কে জানতো এমনটা হবে৷ রেইনকোটটাও নিয়ে বেরোয়নি বিহান৷ ভিজতে ভিজতেই বাইক চালাচ্ছে৷ রাস্তাঘাট শুনশান৷
হঠাৎ রাস্তার ধারে চোখ চলে গেল বিহানের৷ গাছের নীচে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে রূপাঞ্জনা৷ অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে সম্ভবত৷ বিহান বাইক দাঁড় করালো রূপাঞ্জনার সামনে৷
“আপনি বাড়ি যাবেন তো?”
“আরে আপনি! হ্যাঁ৷ এই বেরোলাম নার্সিংহোম থেকে৷ কী বৃষ্টি দেখুন! আপনি তো পুরো ভিজে গেছেন! স্কুল থেকে ফিরছেন?” ঝোরো হাওয়া রূপাঞ্জনার ছাতা উড়িয়ে নিতে চাইছে৷ চুল এলোমেলো হয়ে চোখের সামনে চলে আসছে৷ আঙুল দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে রূপাঞ্জনা৷
“আসুন৷ উঠে বসুন৷ আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি৷ অনেকটাই ভিজে গেছেন আপনি৷ এই বৃষ্টিতে অটো কখন পাবেন কোন ঠিক নেই৷”
“আরে না না৷ আমি চলে যেতে পারবো৷ আপনি ভিজে গেছেন৷ সোজা বাড়ি চলে যান এখুনি৷”
“বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস আছে আমার৷ আপনি উঠে পরুন৷ আকাশের যা অবস্থা – আরও জোর বৃষ্টি নামবে৷ বসুন বসুন৷”
“হ্যাঁ, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে...” বলতে বলতে বিহানের বাইকের পেছনে বসে পড়লো রূপাঞ্জনা৷ বিহানকে আর না করতে পারলো না৷ মা দিদির শ্বশুরবাড়িতে গেছে৷ বাবা বাড়িতে একা৷ বয়স হয়েছে৷ সুগারের রুগি৷ কাজেই তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটে ফিরতে হবে৷
বৃষ্টির ভেতর দিয়ে বাইক ছুটে চলে৷ বিহানের মা-কে নিয়ে কথা হলো কিছুটা৷ বহুদিন হলো কারও বাইকের পেছনে বসেনি রূপাঞ্জনা৷ তাই কিছুটা আড়ষ্ট হয়েই বসেছিল৷ বিহান বললো, “ভালো করে বসুন৷ পড়ে গেলে আপনাকে নিয়ে আবার আপনার নার্সিংহোমেই ছুটতে হবে৷”
“না না পড়বো না৷ আসলে অনেকদিন হলো বাইকে বসিনি৷” একটু হেসে এবার বিহানের কাঁধে হাত রেখে ভালো করে বসলো রূপাঞ্জনা৷
“আপনার ওই নার্সিংহোমে কতদিন হলো? আচ্ছা, আমাকে রাস্তাটা একটু বলে দেবেন প্লিজ৷”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷ দু’বছর হয়নি এখনও৷ আপনার চাকরি?”
“এই সবে একবছর হলো৷”
“পড়াশুনোয় নিশ্চয়ই ভালো ছিলেন? কী সাবজেক্ট পড়ান আপনি?’
“ইংরাজি৷ পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিলাম বলা যায় না, ওই মধ্যমেধা আর কী৷ তবে এস এস সি-র জন্য খেটেছিলাম৷ প্রথমবার হয়নি৷ দ্বিতীয়বার পেয়ে গেছি৷ আপনার পড়াশুনো? অন্য কোন চাকরির চেষ্টা করেনি?”
“আমার ফ্ল্যাট এসে গেছে৷”
বাইক থেকে নেমে বিহানকে ধন্যবাদ জানায় রূপাঞ্জনা৷ ভেতরেও আসতে বলে৷ কিন্তু বিহান ওরকম ভেজা কাকের মতো অবস্থায় রাজি হয় না ভেতরে যেতে৷ রুপাঞ্জনা বলে, “সময় পেলে চলে আসবেন৷ আমি দুপুরের পর পর ফিরে আসি৷”
“বেশ৷ চলে আসবো কোনদিন দুম করে৷ বাড়ির লোক কিছু মনে করবে না তো?”
“না না৷ আমার মা-বাবা ভীষণ ফ্রি অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্ক৷”
“আসবো তাহলে একদিন৷ আজ চলি৷ ভালো থাকবেন৷”
“আপনিও ভালো থাকবেন৷”
৯
“যে তোমাকে দেখে, সে-ই তোমাকে সুন্দর করে
দ্রষ্টা যে, ঈশ্বরও সে৷
তোমার নিঃসঙ্গ রূপ মেশে বাতাসের হাহাকারে৷”
বুকশেল্ফ থেকে ‘সুনীলের নীরা’ বইটি নিয়ে পড়ছে বিহান৷ বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে দুপুর থেকে৷ রূপাঞ্জনা টেবিলে সাজাচ্ছে সন্ধ্যার টিফিন৷ মা-বাবা দু’জনই দিদির শ্বশুরবাড়িতে৷ একটি বৃষ্টিদিন থেকে আবার একটি বৃষ্টিদিন৷ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রূপাঞ্জনা বললো, “সুনীলের কবিতা কেমন লাগে তোমার?” আপনি থেকে দু’জনই এখন তুমিতে এসেছে৷
“বেশ ভালো লাগে৷ তবে জয়ের কবিতাই আমার বেশি প্রিয়৷ বিশেষ করে ওঁর প্রেমের কবিতাগুলি৷ আলাদাই একটা ঘোর তৈরি করে৷”
“জয়ের কবিতা আমারও ভালো লাগে ভীষণ৷ কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কারও কবিতাই পড়া হয়ে ওঠে না৷ মাঝে মধ্যে পড়ি৷”
“কবিতা ছাড়া আর কী কী পড়ো? পড়তে ভালো লাগে? গল্প-উপন্যাস?”
“হ্যাঁ উপন্যাস, ইংরাজি নভেল পড়ি সবারই কম বেশি৷ আমার এক ছোটবেলার বন্ধু একেবারে বইপোকা৷ ওর কাছ থেকে এনে পড়ি৷ কিছু কিছু কিনিও৷”
“আমার কাছে আছে বেশ কিছু বই৷ তোমাকে দেবো যেগুলো পড়া হয়নি তোমার৷ কবিতার বইও দিতে পারি৷”
“বেশ৷ দিয়ো তাহলে৷”
“তোমার কী ধরণের বই পড়তে ভালো লাগে?”
“মূলত কবিতার বই৷ অন্যান্য বইপত্রও পড়ি, তবে কবিতার বই-ই বেশি পড়া হয়৷”
“তুমি কি কবিতা লেখো?” রূপাঞ্জনার মুখে মৃদু হাসি৷
“ওই একটু আধটু আরকি৷” বিহানের মুখেও যেন সেই হাসির ঢেউ এসে লাগলো৷ “সিরিয়াস কিছু নয়৷ টুকটাক লিখি৷”
“আমাকে শোনাও কয়েকটা৷ প্লিজ৷”
“এখন? না থাক৷ গল্প করছি, এই তো বেশ ভালো৷ তোমার মা-বাবা কবে ফিরছেন?”
“ডোন্ট চেঞ্জ দ্য টপিক৷ কবিতা শোনাও তোমার৷ নাহলে ছাড়ছি না আজ তোমাকে৷”
“বেশ৷ একটা পুরোনো শোনাচ্ছি৷” ইতস্ততবোধটা কিছুটা কাটিয়ে বললো বিহান৷
“বৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলে ভেসে আসে তোলপাড়
মুঠো থেকে উড়াল দেয় দিওয়ানা দোয়েল
নিষিদ্ধ যাকিছু আদিম, শ্বাসে গুলে দেয়
নবকাঙ্খা – আঘাতে বকুল ঝরে অবিরাম”
“কী ভালো! ‘আঘাতে বকুল ঝরে অবিরাম৷’ তুমি তো দারুণ লেখো৷ আরেকটা শোনাও প্লিজ৷” এবার একেবারে বাচ্চাদের মতো বায়না করতে থাকে রূপাঞ্জনা৷
“আজ আর নয়৷ অন্যদিন শোনাবো৷ সব তো এভাবে বলা যায় না মনে করে করে৷ আমি পারি না৷”
“আচ্ছা বেশ৷ এরপর যেদিন আসবে তোমার কবিতা নিয়ে আসবে৷ আমি শুনতে চাই৷”
হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল৷ বৃষ্টি বেগ নিয়ে নিয়েছে৷ গল্পে গল্পে কখন ন’টা বেজে গেছে, কেউ টের পায়নি৷ রূপাঞ্জনা একটা মোমবাতি ধরিয়ে টেবিলে রাখলো৷ মোমবাতির আলোয় রূপাঞ্জনার মুখটাকে কোন চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা রাতপরির মুখ মনে হচ্ছিলো বিহানের৷ সেই পরির অমোঘ সম্মোহনেই বোধহয় বিহান নিজের অজান্তেই অনেকটা কাছে চলে এসেছিল রূপাঞ্জনার৷ এতোটাই কাছে যে ওদের নিঃশ্বাস একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিলো৷ ক্রমশ চোখ বুজে এলো রূপাঞ্জনার৷ বিহানের ঠোঁট একটা মেঘের মতো ভেসে চলেছে রূপাঞ্জনার দিকে৷ ছুঁয়ে দিলেই বৃষ্টি৷ কিন্তু রুপাঞ্জনা হঠাৎ পিছিয়ে এলো বিহানকে অবাক করে৷ তারপর একমুহূর্তে ছুটে চলে গেল বাথরুমে৷ বিহান একটা লজ্জা ও অপরাধবোধ নিয়ে বসে আছে মোমবাতির আলোয়৷ ক্যানভাস থেকে ততক্ষণে উড়ে গেছে রাতপরি৷ আর বিহান অবাক শিল্পীর মতো স্থবির বসে আছে সেই ক্যানভাসের সামনে৷ বাথরুম থেকে ভেসে আসছে জলঝরনার শব্দ৷ আরেক অদৃশ্য নিঃশব্দ জলঝরনার নীচে বসে আছে বিহান৷ এতো জল, এতো জল... সব কি তবে ধুয়ে যাবে আজই? ধুয়ে ভেসে যাবে? ভেসে ভেসে হারিয়ে যাবে?
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন।
0 Comments