জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫১




সম্পাদকীয়,
উৎসব, পুজো, পরব, এসব নিয়ে মেতে উঠলেও পড়াটা কিন্তু অবশ্যই করে নিও পড়ার সময়। আরে রকি দাদার মতো অঙ্ককে ভয় পাও নাকি? তাহলে প্রিয়াঞ্জলি আন্টির গল্পে জেনে নাও অঙ্ক দাদা কিভাবে তোমাদের সে সমস্যা মিটিয়ে দেয়। বাকি গুলোতো জলের মতো সহজ। হ্যাঁ, সহজ নাহলে রবীন্দ্রনাথ কেমন করে বইএর নাম দিলেন সহজপাঠ! সহজপাঠের সেই ইতিহাস জেনে নাও অনিমেষ আঙ্কেলের লেখায়। তাতেও সহজ না হলে শ্রীপর্ণা আণ্টির ছড়া পড়ে নাও, সহজ আরো সহজতর হয়ে যাবে। এখনকার দিনে ইচ্ছে থাকলে পড়াশুনা করা সত্যিই খুব সহজ ব্যাপার। কিন্তু তোমরা কি জানো, একসময় পড়াশুনা করতে চাইলেও মেয়েরা তা করতে পারতো না? সে কষ্টের কথা আমি বলব না। মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া কী কষ্ট করে নিজে পড়ে আবার মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, সে ইতিহাস তোমরা পড়ে নাও স্নেহা দিদির লেখা থেকে। কি চোখ জলে ভরে গেছে দেখছি? তাহলে মালা আন্টির ছড়া পড়ে নাও,  পুজোর মজা আবার ফিরে পাবে। আর কল্যাণ আঙ্কেলের তোলা ছবিতে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভরা আকাশে ঘুড়ি উড়িয়েও নিতে পারো। মজা আর দেখে কে! শুধু মনে রেখো, পড়াশুনা ছবি আঁকা খেলাধুলা যাই করোনা কেন, সবার আগে আমাদের মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে হবে, কেমন করে? সে কথা সূর্যকান্ত আঙ্কেলের গল্প পড়লেই জানতে পারবে। পীযূষ আঙ্কেলের কলমে বিভূতিভূষণ, স্নেহা দিদির কলমে বেগম রোকেয়া পড়ে তোমরা যেমন জেনে গেছো বরণীয় মানুষ কাদের বলে। তেমন আরো আরো অনেক কিছু জানতে উৎসবের দিনগুলি বইমুখী না হলেও ওয়েবে ছোটোবেলা মুখী হতে ভুলো না। আমি তোমাদের জন্য রাশি রাশি ডালি সাজাচ্ছি। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাদেই ছোটোবেলার জন্মদিন।  মনে আছে তো?    - মৌসুমী ঘোষ।


সহজ পাঠের গল্প
অনিমেষ দত্ত


সহজপাঠ সহজ করে বলার আরেক নাম।ছোটদের মনের একটা ভাষা বলা যেতে পারে।তোমরা জান শিশুপাঠ্য গ্রন্থ ‘বর্ণপরিচয়’ লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিন্তু তোমরা কি এটা জান তার ৭৫ বছর পরে ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ।'

অনেকগুলো সহজ কথাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহজেই বলেছেন। নন্দলাল বসু অসাধারণ অলংকরণে যেন চোখকে আরো শান্তি দিয়েছে।
 শুরুটা হয় 'ছোট খোকা বলে অ আ/ শেখে নি সে কথা কওয়া।

অ আ শেখানো এভাবেও  যায় তা তোমরা পড়েই জেনেছো।তোমরা এ ঐ পড়তে গিয়ে দেখেছো/বাটি হাতে এ ঐ….গ্রাম বাংলা চিত্র পরিবেশিত সহজ পাঠ সহজ পাঠের প্রথম ভাগের আমরা দেখি একদম কিভাবে মানুষের জীবনের চিত্র ছবির মতো সামনে তুলে ধরা হয়।
তবে,
 বনে থাকে বাঘ,গাছে থাকে পাখি, সেই জলে থাকে মাছ।
সবথেকে বড় সবাই মজা নেই সহজ পাঠের সহজ কথা গুলো শুনে।
আমাদের ছোটবেলায় সহজ পাঠে দেখেছি এখনো আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে, পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
এর থেকে সহজ কথা আর কি হতে পারে।
 আবার মনে আছে সেই ছন্দ সেই দুই -মাত্রা, তিন মাত্রার পড়া ছন্দ
কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে।

 ছন্দের এরকম সুন্দর তাল আর কিসেও নেই! বাংলা ভাষা শেখার বইয়ের দুটি সংস্করণে এই বইটি বাংলার ভাষা ও সাহিত্যের মৌলিক বিষয়গুলি বর্ণনা করে। প্রথম সংস্করণ (প্রথম ভাগ) বাংলা বর্ণমালার প্রাথমিক ধারণা, তাদের কাঠামো, উচ্চারণ শেখায় আর দ্বিতীয় সংস্করণ (দ্বিতীয় অংশ) একটি বাক্য, অনুচ্ছেদের মধ্যে শব্দ ব্যবহার এবং ছড়ার গঠন শেখায়।

সহজ পাঠ’ ১ম ও ২য় ভাগ প্রথম প্রকাশিত হয় শান্তিনিকেতনে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে।রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 

“ সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে'। আমার জীবনে এইটেই  আদিকবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না—তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনও তাহার ঝংকারটা ফুরায় না, মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িত ও পাতা নড়িতে লাগিল।” [ শিক্ষারম্ভ / জীবনস্মৃতি]

সহজপাঠ’ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথম ভাগের আরম্ভেই মুদ্রিত হল স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয় ছোট ছোট ছন্দোবদ্ধ বাক্যের সাহায্যে। প্রথম ভাগে আছে মোট দশটি পাঠ। 
তোমরা কি জান প্রতিটি পাঠ শুরু হয়েছে গদ্য রচনা দিয়ে, সমাপ্ত হয়েছে কবিতায়। দ্বিতীয় ভাগে আছে মোট ১৩ টি পাঠ।সত্যি কি অবাক করা বিষয় তাই না।
ছোট্টবন্ধুরা তোমরা সবাই সহজ পাঠ পড়।দেখবে কত মজা পাবে।নতুন নতুন কথাও জানবে।


ছড়ায় পড়া পড়ায় ছড়া
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
 
অ-য় অজগর ছুটতে ছুটতে
আমকে বুঝি গিলে খায়?
ইঁদুর ছানার ভয়ে মরার
কারণ তবু বোঝা যায়।
 
উটের চলন আকাশমুখে
মরূভূমির জাহাজ সে
দীর্ঘ-ঊ-টি গাছে ঝোলে
কোন সে গাঁয়ে কোন দেশে?
 
হোক না এমন একটু আধটু
কথায় কাজে গণ্ডগোল
বর্ণমালা সাজছে ছড়ায়
হাসিখুশির তুলছে রোল।
 
ছোট্ট বেলায় মায়ের কোলে
এসব নিয়েই ভূবন গড়া
যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন বলে
পড়তে পড়তে ছড়ায় চড়া।
 
শুনছ কোথাও ইংরিজীতে
চলছে এমন ছড়ার কল?
A for Apple B for Ball
C for Cattle D for Doll?


অঙ্কদাদা
প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ 


অঙ্কটা কিছুতেই ঢোকে না গবেট গোবর্ধনের মাথায়। যদিও মাথা তার নেই একথা কিন্তু কোনো ভাবেই বলা চলে না। কেননা অঙ্ক বাদ দিয়ে যতরকম দুষ্টুমি বিদ্যে আছে সবই তার নখদর্পণে। টিউটর  প্রদীপ মাস্টারের পিটুনির পাল্লায় পড়ে সেসব বিদ্যে একটু ক্ষীণ হলেও অঙ্কের হিজিবিজি নিয়মগুলো কিছুতেই মগজস্ত হয় না তার। অঙ্কে টেনেটুনে দুই। একথা জানলে না জানি আরো কত বেত্রাঘাত পড়বে তার পিঠে, তা ভেবেই শিউরে উঠছে গোবর। এমন ভয়ংকর মাস্টার দেওয়ায় মা-বাবার প্রতি চরম অভিমানে, মনের দুঃখে এবং অঙ্ক বিষয়টার প্রতি প্রচণ্ড রাগে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়েই এখানটায় এসে দাঁড়ায় গোবর। 

চারিদিকে শুনশান পরিবেশ। গাছে গাছে ঘেরা নির্জন দুপুর। মাথার ওপর ঝুলছে লাল পেয়ারা গাছের নিচু ডালটা। ওপর দিকে তাকাতেই গোবরের মাথার অঙ্কের ভূতটা কিছুটা রেহাই পেয়ে মস্তিষ্ক তখন মনোনিবেশ করে টুসটুসে লাল পেয়ারাগুলোর দিকে। পরপর চারটে ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা ঝুলছে গাছের ডালে। যেন গোবরের জন্যই তারা অপেক্ষা করছিল। খুশি মনে ওপরের দিকে হাত বাড়াতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় গোবর। গাছের ডালে এখন চারটের জায়গায় দুটো পেয়ারা। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! এই যে গোবর দেখল চারটে! তবে কী এখানেও অঙ্কে ভুল করেছে সে! মনের দুঃখে এবার ভেউ ভেউ  করে কেঁদেই ফেলে গোবর।
--"করছিস কী? করছিস কী? কাঁদছিস কেন?"
হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত গলার শব্দে চমকে ওঠে সে। গলাটা অনেকটা প্রদীপ স্যারের মতোই। কিন্তু ঠিক যেন অতটা ভারীও নয়। এই ঘোর দুপুরে শুনশান জঙ্গলে পদীপ স্যার এখানেই বা কী করে আসবেন! তবে কী স্যার জানতে পেরে গেছেন তার অঙ্কে দুই পাওয়ার খবরটা! কাঁদো কাঁদো মুখে চারিদিক দেখতে লাগল গোবর।
--"আরে আমি এখানে। এই যে এখানে। ওপরের দিকে তাকা।"
সেই একই কণ্ঠস্বর শুনে ওপরে গাছের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে মুখ শুকিয়ে আসে গোবরের। এ কী! ঠিক যেন গোবর্ধনের মতোই দেখতে একটা ছেলে পেয়ারার ডালে বসে পা দোলাচ্ছে আর ডাঁসা লাল পেয়ারায় কামড় দিচ্ছে। গোবর তার প্রায়-প্রতিবিম্বকে দেখে গোলগোল চোখে একদৃষ্টে সেদিকেই চেয়ে রইল। তবে ছেলেটি অনেকটা গোবরের মতো দেখতে হলেও তার কানগুলো কিন্তু অস্বাভাবিক বড় আর পা'দুটো ঠিক রিকেট রুগীর মতো সরু সরু। তবে গলাটা তেমন বাজখাই না হলেও, প্রদীপ স্যারের মতই বলা চলে। ছেলেটা একমনে পেয়ারায় কামড় দিতে দিতেই একটু গলা ঝেড়ে বলল গোবরকে,
--"কী রে, কী ভাবছিস?" 
গোবর আমতা আমতা স্বরে বলে,
--"না মানে আমি গোবর। গোবরধন।"
--"জানি জানি। অঙ্ক পারিস না তো? অঙ্কে দুই পেয়ে মনে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিস বুঝি?"
এবার প্রায় চমকে ওঠে গোবর। ছেলেটি কী করে জানল তার সব কথা!? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে গোবর,
--"তুমি কে গো? তুমি কী করে জানলে..."
গোবরের কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেটি আবার বলে ওঠে,
--"আমি সব জানি। তোদের ওই প্রদীপ মাস্টার, খুব ভয় পাস বুঝি?"
--"পাই তো, বড্ড মারে যে...।"
কাঁদোকাঁদো মুখে বলে গোবর। 
--"ভয় পাস না। আর মারবে না। কাল থেকে দেখবি তুইও সব অঙ্ক পাড়ছিস।" 
--"মানে...! সেটা কী করে?"
বলেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে গোবর।
--"হু হু..."
একটা তৃপ্তিসূচক শব্দ করে মৃদু হেসে ছেলেটি পা দোলাতে থাকে।
--"নে পেয়ারা খা।"
বলে একটা ডাঁসা লাল পেয়ারাও সে এগিয়ে দেয় গোবরের দিকে।

প্রদীপ স্যার সেদিন খুব দুঃখী দুঃখী মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে বসে ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। ঠিক যেদিকে লাল পেয়ারা গাছটার ডালে থোকা থোকা পেয়ারা ঝুলে থাকে সেদিকের জঙ্গলটাতেই। কে বলতে পারে তাঁর এই দুঃখের কারণটা আসলে কী! ব্ল্যাকবোর্ডে খসখস করে এঁকে ফেলা তাঁর পরমাণু বিস্ফোরক সব জটিল অঙ্কগুলো সেদিন নিমেষের মধ্যে গবেট গোবর্ধনেরের কষে ফেলার কারণ, নাকি সেইসব কুটিল অঙ্কের প্যাঁচ গোবর্ধন ছাড়া অন্য কেউই ধরতে পারেনি সেই কারণে! নাকি অন্য কিছু...! কে জানে...! তা অবশ্যি কারোরি জানা ছিল না। তবে সেই দিনের পর থেকে প্রদীপ মাস্টার আর কখনোই গোবর্ধনকে বেধড়ক ধোলাই দিতে পারেননি। গোবরেরো অঙ্কে দুই পাওয়ার দুঃখ আজীবনের মতো ঘুচেছিল। সে এক বিস্ময় বটে। অদ্ভুত রহস্য। তবে এ রহস্য ভেদ করতে করতে কেটে গেছে বহু বছর। 

প্রদীপ মাস্টার এখন আর নেই। স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে সাদা রেখার আঁকিবুকি কাটা অঙ্কগুলো ডাস্টার দিয়ে মুছে ফেলে দাপুটে অঙ্কের মাস্টার গোবর্ধন বসু। আজ তার শিক্ষক জীবনের শেষ দিন। তাই ফেয়ারওয়েলের সমস্ত অনুষ্ঠান পর্ব শেষে প্রিয় ছাত্রদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে গোবর্ধন নেমে আসে ক্লাসরুম থেকে বাড়ির পথে। তারপর হাঁটতে থাকে গাছে ঘেরা সেই নির্জন দুপুরের ভেতর দিয়ে। সেই জঙ্গলের পথ। সেই যে লাল পেয়ারা গাছটা, সেটা এখন আর নেই। সেখানে গজিয়ে উঠেছে বহু ছোট-বড় গাছ। এখানে এসে দাঁড়ায় গোবর্ধন মাস্টার। তরপর অস্ফুট স্বরে কয়েকবার ডাকে,
--"অঙ্কদাদা, অঙ্কদাদা, ও অঙ্কদাদা, কোথায় গো তুমি?"
অমনি নিমেষের মধ্যে সেই যে ছেলেটি, গোবর্ধনের প্রতিবিম্ব, তার লম্বা লম্বা কান আর সরু সরু পা নিয়ে এসে হাজির। অবিকল সেই ছেলেটিই। একচুলও বয়স বাড়েনি তার। একচুলও পরিবর্তন হয়নি চেহারার। অথচ গোবর্ধনের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথার চুলও প্রায় সাদা। সে আজ পা বাড়িয়েছে বার্ধক্যের দিকে। 
--"কী হে গোবর্ধন, কী খবর তোর?" 
ছেলেটির গলার স্বরও ঠিক যেন একই রকম রয়ে গেছে। অথচ গোবর্ধনের আজ প্রদীপ মাস্টারের মতোই গম্ভীর গলা।

গোবর্ধন একগাল হেসে বলল,
--"তুমি এসেছ অঙ্কদাদা। আজ যে আমার অঙ্ক জীবনের শেষ দিন..."
কথাটা শেষ না হতেই মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে চোখ মোছে গোবর্ধন। তারপর আবার বলে,
--"তোমার কাছে তোমার বিদ্যা জমা দিতে এলাম আজ।"
 গোবর্ধনের অঙ্কদাদা আর কোনো কথাই বলল না। শুধু গোবর্ধনের দিকে এগিয়ে দেয় একটা লাল ডাঁসা পেয়ারা। তারপর হাসিমুখে খুব মৃদু স্বরে বলে,
--"নে পেয়ারা খা।"



টুকাই ও দাদুভাই
সূর্যকান্ত মাহাতো

টুকাই পড়ার ফাঁকেই জানালা দিয়ে দেখল, ওর বাবা বাইক নিয়ে সাত সকালেই কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। আজ রবিবার। রবিবারে সকালে টুকাইয়ের  কোনও টিউশন থাকে না। সে বাবা কিংবা দাদুভাইয়ের কাছেই পড়ে। আজও তাই দাদুভাইয়ের কাছেই সে পড়ছিল। হঠাৎ মা এসে দাদুভাইকে বলল, "বাবা, বাজার থেকে একটু মাংস আনলে হত না?"

দাদুভাই বললেন, "হ্যাঁ, মা। তুমি বাজারের ব্যাগটা আমাকে এনে দাও।" টুকাইয়ের মতো দাদুভাইও মাকে 'মা' বলেই ডাকেন। দাদুভাই টুকাইকে সহাস্যে বললেন, " তুমি পড়তে থাকো। আমি বাজারটা করে আসি। তারপর দুপুরে জমিয়ে দুজনে মাংস ভাত খাবো। কেমন!"

টুকাই কী ভেবে হঠাই জেদ ধরল সেও দাদুভাইয়ের সঙ্গে আজ বাজারে যাবে। মা প্রথমটায় বারণ করল, কিন্তু টুকাইয়ের জেদের কাছে মাকে হার মানতেই হল। তাছাড়া দাদুভাইও একটু সায় দিলেন। টুকাই তো দারুণ খুশি। দাদুভাইয়ের হাত ধরে সে বাজারে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে বাজারটা একটু দূরেই। একটা রিক্সা নিতে হয় বলে টুকাই দাদুভাইয়ের সঙ্গে রিক্সার অপেক্ষা করছে।

একটু পরেই এক রিক্সাওয়ালা এসে দাদুভাইকে বলল," স্যার, কোথায় যাবেন?"

দাদুভাই বললেন, "হ্যাঁ, স্যার। আমাদেরকে একটু বাজারে নিয়ে চলুন তো!"

টুকাই আর রিক্সাওয়ালা দুজনেই দাদুর মুখে 'স্যার' শুনে খুব অবাক হল। টুকাই দেখল, রিক্সাওয়ালা বেশ লজ্জা পেয়েছে। মাথা নিচু করে তাই বলল, "আমাকে ওভাবে বলবেন না স্যার।"

টুকাইকে বসানোর পর দাদুভাই নিজেও রিক্সায় ভালো ভাবে বসে রিক্সাওয়ালাকে বলতে লাগলেন, "আসলে কী জানেন তো স্যার, প্রতিটি মানুষেরই একটা আত্মসম্মান বোধ থাকে। সকলেই সমান সম্মানের যোগ্য। সে যে কাজই করুক না কেন। কাজের থেকেও মানুষ সব সময় বড়। তাই সবাইকে সম্মান দিয়েই কথা বলা উচিত।"

টুকাই শক্ত করে দাদুভাইয়ের হাত ধরে কথাগুলো শুনছিল। আর ভাবছিল, এর আগে বাবা মায়ের সঙ্গেও সে কয়েকবার রিক্সায় চড়েছে। কিন্তু তারা কখনও রিক্সাওয়ালাকে 'স্যার' বলে ডেকেছে বলে তো তার মনে পড়ছে না। বরং বাবা তো একবার ভাড়া নিয়ে তর্ক করার সময় তুই তোকারি করেই বলছিল। অথচ দাদুভাই কত আলাদা। সবাইকে কত্ত সম্মান দেন। আজ বাজারে না এলে সে দাদুভাইয়ের এমন ব্যবহার জানতেই পারত না।

বাজারের মুখটায় এসময় খুব ভিড় হয়। রিক্সা এই মুখটা পর্যন্তই আসে। ঘন্টি বাজিয়ে রিক্সাটা থামতেই টুকাইয়ের ভাবনাটা যেন কেটে গেল। দেখল, রিক্সাওয়ালা দাদুভাইকে হাতে ধরে নামিয়ে দিল। তারপর কী ভেবে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। টুকাই কেবল অবাক হয়েই চলেছে।

টুকাই এই প্রথম বাজারে এসেছে। কত লোক। কত ভিড়। কত চিৎকার চেঁচামেচি। সে বেশ অবাক হচ্ছে। দুপাশে সার সার আলু পটলের দোকান। সবাই দাদুভাইকে, "স্যার, আসুন, কী নেবেন বলুন, আজ সবকিছুই টাটকা আছে" বলে ডাকছিল।

টুকাই কেবল দেখছে, কখনও দাদুভাই কাউকে স্যার, কাউকে দিদিমণি বলে ডাকছেন। সবাইকে আপনি করে সম্বোধন করছেন। কেউ কেউ টুকাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। টুকাই দেখল, দাদুকেও সবাই কত শ্রদ্ধা করে। সবাই কত ভালো ব্যবহার করছে দাদুভাইয়ের সঙ্গে।

বাজার সেরে ফেরার সময় আবারও একটি রিক্সায় চড়ে টুকাই দাদুভাইয়ের সঙ্গে ফিরে এল। দাদুভাই ভাড়াটা পকেট থেকে বের করতেই টুকাই দ্রুত কেড়ে নিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বলল, "স্যার, এই নিন আপনার ভাড়াটা।"

রিক্সাওয়ালা চোখ দুটো একটু কুঁচকালো, কিন্তু দাদুর বুকটা তখন গর্বে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।


আকাশ নীলাম্বরী 
 মালা ঘোষ (মিত্র) 

শরৎ আসে বারে বারে 
নীল আকাশে ঘাসে ঘাসে। 
মিঠে রোদে ধানের ক্ষেতে
মন যে ওঠে গানে মেতে। 
ঢাকের তালে আকাশ জুড়ে
পুজোর সুবাস থাকছে সুরে। 
শিউলি ফুলের গন্ধে মাতি
আগমনী সুর আসছে ভাসি। 
স্বর্ণালী রোদের ঝর্ণাধারায়
কাশফুল হাসে মিটমিটিয়ে। 
খুশির দোলায় ভাসতে ভাসতে
মা যে আসছে হাসতে হাসতে। 
বিভেদ ভুলে সবাই চলো
পুজোর আনন্দে উঠি মাতি। 
বন্ধু সবাই হাত মিলিয়ে 
খুশির আনন্দ দেয় বিলিয়ে।


মুসলিম বাংলার অগ্নিকন্যা: বেগম রোকেয়া
স্নেহা মণ্ডল 
(প্রথম বর্ষ, শ্রীচৈতন‍্য কলেজ, উত্তর চব্বিশ পরগনা)

চতুর্দিকে তখন বর্ষার অমানিশার মত নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।এ অন্ধকার মুসলিম নারী জাতির।পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মত সে নিশ্চল,পঙ্গু,নিরানন্দ।সংখ্যায় তাঁরা সমাজের অর্ধেক।জীবনকে কল্যাণময় ও সুন্দর করে তুলবার দায়িত্ব যাদের হাতে,সেই পুরুষরা তাঁদের পোষা জন্তুতে পরিণত করেছে-আকাশের মুক্ত বিহংগীকে শুধু খাঁচায় বন্দী করা হল না,সেই সঙ্গে তার ডানা দুটোও কেটে দেয়া হল।বিশ্বনবী বলেছেন, "আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি কেননা এ বিশ্বে সুগন্ধি ও নারী রয়েছে।" তবে চিরকাল তো আর সমাজ অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতে পারে না-সেই নিকষ কালো সমাজের যবনিকা টেনে যিনি প্রথম জ্ঞানরূপী আলোর সমুদ্রে পা বাড়িয়েছিলেন তাঁর নাম 'বেগম রোকেয়া।'

         রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম।তাই সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে গভীর রাত্রে মোমবাতির আলোয় তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট বিদ্যাভ্যাস করতেন।জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও জ্যেষ্ঠ ভগ্নির সহায়তায় তিনি সেই অবোধপুরীতেও বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ পান।ক্রমে রোকেয়া যৌবনের সীমায় পদার্পণ করলে বিহারের অন্তর্গত ভাগলপুর নিবাসী সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, ন্যায়বান,আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পুরুষ।বিবাহের পর রোকেয়ার ভিতরে যে বিপুল সম্ভাবনা লুক্কায়িত ছিল বিদ্যোৎসাহী স্বামীর সন্নিধানে তা প্রকাশ পেতে থাকে।সাখাওয়াৎ সাহেব ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে প্রতিভাময়ী স্ত্রীর জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করেন।

      বিহারে অবস্থানকালে সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে রোকেয়া লিখেছেন, "বিহার অঞ্চলে বিবাহের পূর্বে ছয়-সাত মাস পর্যন্ত নির্জন কারাগারে রাখিয়া মেয়েকে আধমরা করা হয়।ঐ সময় মেয়ে মাটিতে পা রাখে না।প্রয়োজনমত তাহাকে কোলে করিয়া স্নানাগারে লইয়া যাওয়া হয়।সমস্ত দিন মাথা গুজিয়া একটি খাটিয়ার উপর বসিয়া থাকিতে হয়,রাত্রিকালে সেখানেই শুইতে হয়।অপরে মুখে তুলিয়া ভাতের গ্রাস খাওয়ায়।"
              
   স্বামীর সঙ্গে তিনি নানা পরামর্শ করতেন।বিচক্ষণ স্বামী গভীর মনোনিবেশ সহকারে রোকেয়ার গতিপথ নির্দেশ করতেন।রোকেয়ার পরপর দুটি সন্তান জন্মলাভ করে মারা যায়।এরই মধ্যে সাখাওয়াৎ হোসেন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন।সেবাযত্নে তিনি আহার-নিদ্রার কথা ভুলে গিয়েছিলেন।নানা দুর্ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে রোকেয়া লিখেছিলেন: "আমার মত দুর্ভাগিনী অপদার্থ বোধহয় এ দুনিয়ায় আর একটা জন্মায়নি।শৈশবে বাপের আদর পাইনি।বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি-প্রত্যহ urine পরীক্ষা করেছি,পথ্য রেঁধেছি,ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি।দুবার মা হয়েছিলুম- তাদেরও প্রানভরে কোলে নিতে পারিনি।একজন পাঁচ মাসে, একজন চার মাস বয়সে চলে গেছে।" ক্রমে রোকেয়ার স্বামীর অবস্থার অবনতি হতে থাকায় তিনি তার জীবনের সঞ্চিত সত্তর হাজার টাকা হতে দশ হাজার টাকা তাঁদের পরিকল্পিত 'মুসলিম মহিলা বিদ্যালয়'এর জন্য পৃথক করে দিয়ে যান।অবশেষে ১৯০১খ্রিস্টাব্দের ৩রা মে সাখাওয়াৎ হোসেন কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

               স্বামী,পুত্র-কন্যা বিবর্জিত সংসারে আজ রোকেয়া একা।সামনে বৃহৎ কর্মক্ষেত্র।অন্তরে বিরাট আশা নিয়ে ১৯০৯ সালের ১লা অক্টোবর মোট পাঁচটি মেয়ে নিয়ে ভাগলপুরে "সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়" আরম্ভ করেন।এক বছর পর ১৯১০সালে তিনি ভাগলপুর হতে কলকাতায় স্কুল স্থানান্তর করেন।মাত্র আটটি ছাত্রী ও দুটি বেঞ্চ নিয়ে কলকাতার একটি গলিতে এই স্কুল স্থানান্তর করেন।

         কিন্তু রোকেয়ার এ ঐকান্তিক সাধনা সমাজে প্রশংসা লাভ করা দূরে থাকুক,বরং চতুর্দিক থেকে তাঁর উপর নিন্দার ঝড় বয়ে আনলো! কেউ কেউ বলে বেড়াতে লাগলো,রূপসী বিধবা রূপ-যৌবনের বিজ্ঞাপন প্রচার করে বেড়াচ্ছে।সংবাদপত্রের বিরোধিতা, মোল্লাদের ফতোয়া শিলাবৃষ্টির মত আপতিত হতে থাকে।পেচক যেমন সূর্যালোককে ভয় পায়, অন্ধকারকেই সে ভালোবাসে,তেমনিভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজ যেন স্ত্রীশিক্ষার আলোক সহ্য করতে পারছিল না।রোকেয়া বলেছেন, "আমি কারসিয়াং ও মধুপুরে বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়া,উড়িষ্যা ও মাদ্রাজের সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের,বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি।আর জীবনের পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কেবল কাঠ-মোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইযাছি।" এতদসত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্য স্বীয় কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত হননি।তাঁর কঠোর পরিশ্রমের ফলেই ধীরে ধীরে শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তাঁর স্কুল হাইস্কুলের পথে উন্নীত হয়।

            রোকেয়া বাল্যকালেই জ্যেষ্ঠ ভগ্নি করিমুন্নেছার প্রভাবে সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন।উৎসাহ ও প্রতিভার সম্মিলনে পরবর্তীকালে তাঁর লেখনীতে উৎকৃষ্ট সাহিত্যের সৃষ্টি হয়।রোকেয়া 'মতিচুর' ১ম ও ২য় খন্ড,' পদ্মরাগ', 'অবরোধবাসিনি', 'সুলতানার স্বপ্ন' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।এছাড়া তিনি 'মুক্তিফল' নামে সুবিখ্যাত প্রবন্ধ রচনা করেন।

        তাঁর 'অবরোধবাসিনি' গ্রন্থে মুসলিম নারীসমাজের অবরোধ প্রথা ও লাঞ্ছনার কথা জীবন্ত ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে।অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত নারীমুক্তি আসতে পারে না-- এ সত্যই তিনি তুলে ধরেছেন 'পদ্মরাগ' গ্রন্থে।'মুক্তিফল'প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, নারীর সহায়তা ব্যতীত পুরুষজাতির পক্ষে দেশের স্বাধীনতা আনয়ন করা সম্ভবপর নহে।

                    রোকেয়ার সাহিত্যের বিশেষত্ব তাঁহার সহজ-সরল তীক্ষ্ণ ও জোরালো ভাষা:                    নিষ্ঠুর নিদয় শশি সুদূর গগনে বসি
   কি দেখিছ? জগতের হিংসা পাপরাশি?
"প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য বিদ্যাশিক্ষা ফরয"--পবিত্র কুরআনের এ বাণীকে তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ এবং তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

            সমাজ তাঁকে ধর্মদ্রোহিনী আখ্যা দিতে কুন্ঠিত না হলেও ইসলামকে তিনি কিন্তু পরিপূর্ণভাবে বুঝতেন।তিনি একবার ধর্মপ্রসঙ্গে বলেছিলেন: "নারিকেলের চমৎকার স্বাদ তাহার দুর্ভেদ্য আবরণের ভিতর আবদ্ধ।অন্ধমানুষ সেই কঠিন আবরণ ভেদ করিবার চেষ্টা না করিয়া সারাজীবন শুধু ত্বকের উপরিভাগটাই লেহন করে।" 

                 অবশেষে হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে রোকেয়ার স্বাস্থ্য ক্রমে ভেঙে পড়ে।১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।কলকাতার উপকণ্ঠে যাদবপুরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।


প্রয়াস
রকি হালদার
নবম শ্রেণী, আচনা হাইস্কুল, দক্ষিণ ২৪ পরগণা

অঙ্ক করতে লাগে বড় ভয়। গুলিয়ে যায় সব,
 দুয়ে- দুয়ে চার, নাকি তিনে- তিনে ছয় ।
 অঙ্ক করতে না পারলে, স্যার-ম্যাডাম কয়।
 পারবিনে জীবনে করতে কোনদিন,
 ভয় কে জয়।
 দুঃখ লাগি মনের দরে আজ। অংক করতে না পারলে,
 বৃথা সুন্দর সাজ ।
নিজেকে করেছিলাম বড় অসহায়।
 নিজেকেই নিজে অদক্ষ করতে ,
মনকে দিই শুধু দায়।। 
এই কষ্টে হৃদয়টা জ্বলে-পুড়ে হায় !হায় !
জানিনা কোন দিন ,
জীবনের মোড় ঘুরে যায় ।।হঠাৎ পেলাম ,
এক দীর্ঘ শিক্ষা।
 যা মনকে দিয়েছে ,
চরম সত্যি দীক্ষা ।
প্রকৃত সত্যি যে থাকে না, কখনও লুকিয়ে ।
সত্য একদিনে ছুঁয়ে যায়, হৃদয়ের হদ শুকিয়ে।
 কেউ নই আমরা সেরা।
 সবাই করেছে প্রয়াস,
 জিরো থেকে পারা।
 প্রয়াস করেছে যে তাকে হারাইবার,
 ক্ষমতা কারে ।
প্রয়াস করেছে যে সেও ,
পাথর ভেঙে জলকে বের করতে পারে ।
শুধু মনে রাখতে হবে,
 একটু জেঠ।
যদিও আমরা না হতে পারি প্রাচীন যুগের,
 জগৎশেঠ।
 এবার অঙ্ক করতে লাগে না আমার ভয়।
 যায়না গলিয়ে আর দুয়ে দুয়ে চার,
 নাকি তিনে তিনে ছয় ।
আমার এই ছোট্ট জ্ঞান ,
দিলাম তোমাদের সাথে ভাগ করে।
 আমার মত তোমরা যেন ভয় পেয়ে সরে যেও না,
 অঙ্ক থেকে দূরে।




ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ২৪
রতনতনু ঘাটী

ফুলকুসুমপুর গ্রামের একেবারে পুব দিকে তেমোহানি নদী। স্বাধীনতার সময় এখনকার মতো চওড়া ছিল না নদীটা। তার পাড়ে একটা জঙ্গল গড়ে উঠেছিল অনেক দিন আগে থেকেই। কেউ বলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ইচ্ছেকুমার ত্রিপাঠীর বাবা অভয়কুমার ত্রিপাঠী নদীর ধারের সেই জঙ্গলে হাজার পাঁচেক সাল-সেগুনের গাছ লাগিয়েছিলেন। তিনি নিজে স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়াইও করেছিলেন।
    পুলিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই জঙ্গল থেকে কিছুতেই ধরতে পারত না। কেউ বলত, জঙ্গলের ভিতরে নাকি একটা খুব লম্বা সরু সুড়ঙ্গ ছিল। পুলিশ তাড়া করলে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সেই সুড়ঙ্গ-পথ ধরে নদীর তীরে গিয়ে জলপথে পালিয়ে যেতেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাই জঙ্গলের পাশে একটা ব্যারাক তৈরি করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরার জন্যে। 
   তারপর স্বাধীনতার আগে-আগে সে জঙ্গল আরও ঘন হয়ে উঠেছিল। তখন অভয়কুমারের খুব বয়স হয়েছে। তিনি মনে-মনে ঠিক করলেন, ব্রিটিশদের ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে পালিয়ে যাওয়ার আর খুব বেশি দেরি নেই। ব্রিটিশ পুলিশও ওই ব্যারাক ছেড়ে কলকাতার ফোর্টউইলিয়ামের সাউথ ব্যারাকে চলে গেল। তখন ওই পরিত্যক্ত ব্যারাকে একটা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে আশ্রম করবেন ঠিক করলেন। দূত মারফত গান্ধীজির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ‘গান্ধীআশ্রম’ নামে একটা পিতৃমাতৃহীন ছেলেদের আবাসিক আশ্রম গড়ে তুললেন ওই বাড়িটায় অভয়কুমার। 

   তারপর অভয়কুমার মারা গেলেন। ইচ্ছেকুমার ত্রিপাঠী সেই আশ্রমে টাকাপয়সা দেন এখনও নিয়মিত। তিরিশটা ছেলে থাকে সে আশ্রমে। তারা ফুলসুমুমপুর হাই স্কুলে পড়ে।
   ইচ্ছেদাদু আগের দিন সন্ধেবেলা ডিনারের টেবিলে ঘোষণা করলেন, ‘কাল ছাব্বিশে জানুয়ারি। তিন্নিদের স্কুলের ছাব্বিশে জানুয়ারির অনুষ্ঠান হয়ে গেলে আমরা বাড়ির সকলে মিলে দুপুরে যাব ফুলকুসুমপুর গান্ধীআশ্রমে।’
   ইচ্ছেঠাকুরমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুপুরবেলা যাবে। ছেলেদের জন্যে খালিহাতে যাবে নাকি? তা ছাড়া আমরাই বা খাব কোথায়?’
   ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘সে নিয়ে ভেবো না অনিচ্ছে। আমি আশ্রমের ম্যানেজার অনন্তকে টাকা পাঠিয়ে খবর পাঠিয়েছি বিলম্বের হাতে। ফোনও করেছি। আমাদের সকলের ওখানেই মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন। ছেলেদের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে বসে খাব। কেমন মজা হবে না?’
   বল দাদু বুম্বার দিকে তাকালেন। বুম্বা এ কথা শুনে ভীষণ খুশি। বলল, ‘দারুণ হবে দাদু! কতদিন আমরা পিকনিকে যাইনি।’
   মাধুরীজেম্মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘বাবা, খুব আনন্দ হবে। আমরা বাড়ি থেকে কিছু রান্না করে নিয়ে গেলে ভাল হয় না বাবা?’
   ইচ্ছেঠাকুরমা বললেন, ‘খুব ভাল কথা বলেছ বড়বউমা! তা হলে এক কাজ করো। সকালে বসে যাও নারকোল নাড়ু বানাতে। ওদের জন্যে নারকোল নাড়ু নিয়ে যাওয়া হবে।’ বিলম্বদাদুকে বললেন, ‘তুই গোটা পনেরো নারকোল কেটে দিস সকাল-সকাল?’
   তিন্নির বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার পোষ্যদের নিয়ে গেলে মন্দ হত না। দেখি, ওরা বাইরে গিয়ে কেমন শৃঙ্খলা মেনে থাকে?’
   ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘তা হলে পরিপালনকেও সঙ্গে নিস। ও থাকলে পোষ্যদের সামলাতে পারবে।’ ইচ্ছেঠাকুরমার দিকে তাকালেন দাদু, ‘হ্যাঁ গো! কুয়াশামাসি আর বাদ পড়ে কেন? ওকেও নিও। মেয়েটা সারা বছর কাজ করে আমাদের বাড়িতে। একদিন আনন্দ করতে যায় যদি যাক না!’

   পরদিন ছোটরা স্কুল থেকে ফিরে আসতে, সকলে তৈরি হয়েই ছিলেন। নারকোল নাড়ুর মস্ত বড় হাঁড়িটা মাথায় নিল চলল বিলম্বদাদু। সে সকলের সামনে-সামনে চলল। হাঁটাপথে আধঘণ্টাও লাগবে না। 
    যাওয়ার কথা শুনে কুয়াশামাসিও একপায়ে খাড়া! আনন্দে ডগবগ। কাদের-কাদের বাগান থেকে অনেকটা ফুল তুলে কলাপাতায় মুড়ে সঙ্গে চলেছে। 
   বিন্নি তা দেখে বলল, ‘তুমি এত ফুল গাছ থেকে তুলে আনলে কুয়াশামাসি? জানো না, মিস বলেছেন ফুল তুললে গাছেদের কষ্ট হয়?’
   ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘তা হলে তোদের ঠাকুরমা যে রোজ ফুল তোলে পুজোর জন্যে? তাতে গাছের কষ্ট হয় না?’
   বিন্নি বলল, ‘ঠাকুরমা এখন মাত্র একটা ফুল তোলে রাধাকৃষ্ণের পায়ে দেওয়ার জন্যে। আর ক’দিন পরে ঠাকুরমা হয়তো পুজোর জন্যে ফুলই তুলবে না, দেখে নিও!’
   পরিচালনকাকা চলেছে রাধাগোবিন্দকে কাঁধে বসিয়ে নিয়ে। রাধাগোবিন্দর পায়ে আলতো হয়ে ঝুলছে সোনার শিকলটা।


স্মরণীয়
(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার


'চাঁদের পাহাড়' এর শঙ্করকে মনে আছে তোমাদের? অ্যালভারেজ? মনে আছে 'পথের পাঁচালী' র অপু এবং দুর্গাকে? যদি মনে আছে তাহলে নিশ্চয় জানো এগুলো কার সৃষ্টি। তিনি হলেন আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৯৪ সালের ১২ ই সেপ্টেম্বর উত্তর ২৪পরগনার কাঁচরাপাড়ার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। মা ছিলেন মৃণালিনী দেবী। পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষার পর গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের পাঠশালায় পড়ে ভর্তি হন বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পাশ করে তিনি ভর্তি হন রিপন(বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ) কলেজে। সেখান থেকে আই. এ. পাশ করেন ১৯১৬ সালে। ১৯১৮ তে ঐ কলেজ থেকেই বি. এ. পাশ করেন ডিশ্টিংশন নিয়ে। এরপর এম. এ. এবং আইন পড়া শুরু করেও ছেড়ে দেন। এরপর শিক্ষকতা সহ নানা ধরনের কাজ করেছেন বাংলা ও বিহারের নানা জায়গায়। পরবর্তী কালে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন এবং আমৃত্যু বনগাঁর গোপালপুর হরিপদ ইনষ্টিটিউশনে শিক্ষকতা করেন। ১৯২১ সালে 'প্রবাসী' পত্রিকায় তার প্রথম গল্প 'উপেক্ষিতা' প্রকাশিত হলেও ১৯২৯ এ 'বিচিত্রা' পত্রিকায় তার প্রথম উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' প্রকাশিত হলে সাহিত্যিক হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর রচিত অন্যান্য কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল 'অপরাজিত'(১ম ও ২য় খন্ড,১৯৩২), 'আরণ্যক'(১৯৩৯), 'চাঁদের পাহাড়'(১৯৩৮), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'(১৯৪০), 'ইছামতী'(১৯৫০), 'দেবযান'(১৯৪৪) এবং 'অশনি সংকেত'। তাঁর রচিত ২০টি গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'মেঘমল্লার'(১৯৩১), 'মৌরিফুল'(১৯৩২), 'যাত্রাবাদল'(১৯৩৪), 'তালনবমী'(১৯৪৪) এবং 'অসাধারণ'(১৯৪৬)। কিশোরদের জন্য তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হল 'আইভ্যানহো'(সারানুবাদ, ১৯৩৮), 'মরণের ডঙ্কা বাজে'(১৯৪০), 'মিসমিদের কবচ'(১৯৪২), 'হীরা মাণিক জ্বলে'(১৯৪৬) ইত্যাদি। ১৯৫১ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর 'ইছামতী' উপন্যাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান মরনোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করে।
 ১৯৫০ সালের ১নভেম্বর বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান কথাসাহিত্যিক মৃত্যু বরণ করেন।



পাঠ প্রতিক্রিয়া

( কবি ও গল্পকার মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস জ্বলদর্চির ৫০ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে যা লিখলেন) 

একটা ছোট্ট পদক্ষেপের সূচনা অসীম সম্ভাবনার সাথে অস্হির আশঙ্কাও সৃষ্টি করে৷ কি জানি কতটা পথ...
কিন্তু ছোটবেলা নির্ভুল পদক্ষেপে পঞ্চাশের রেখা স্পর্শ করে ফেলল আর কি মায়াময় নিষ্পাপ শিউলি চিহ্ন এঁকে শিশু কিশোরদের মনে স্হায়ী আসনের দাবিদার হয়ে গেল৷ 
আমাদের ছোটবেলা আর ওদের ছোটবেলা আলাদা হয়েও আলাদা নয়৷ আমরা কাগজের গন্ধে বুকে অদ্ভুত বুড়বুড়ি পেতাম৷ ওরা টাচ স্ক্রিনে জড়িয়ে গেছে৷ যাক না, ভাল কিছু থাক সে স্পর্শতেও৷ 
একটা অপূর্ব সম্পাদকীয়র পর বৈচিত্রে ঠাসা লেখনীর প্রকাশ৷ বড়দের সাথে ছোটরা এখানে হাত ধরে থাকে৷ আলাদা করে কোনো ছোটদের পাতা না থাকায় ছোট অবয়বের বড় মনগুলো নিশ্চয়ই খুব আনন্দ পায়৷ তাই গৌর বৈরাগীর আশ্চর্য গল্পের পরই সপ্তমের শিঞ্চনীর মা সন্তানের চিরন্তন ছবি চোখ টানে৷ বিমলেন্দ্র চক্রবর্তীর সহজ চালে ফুলের ছড়ার সুবাস মনে থাকতে থাকতেই দেবার্পণের দেশপ্রেমের ছবি চমক লাগায়৷

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যর লেখা পড়তে পড়তে আমি নির্জন গোপালপুরে চলেই গেছিলাম আবার৷ চমকপ্রদ কইএর গল্প উপরি পাওয়া৷ এখনকার ছোটরা মাছ নিয়ে খুঁতখুঁতে হলেও এই গল্পে যে অসম্ভব মজা পাবে, কোনো সন্দেহ নেই৷ তেমনি মুগ্ধ হবে ঋতা বসুর জঙ্গলের গল্পে৷ শতভীষা, রিয়ান, প্রবাহনীল, সখী, অনুভব সবার মধ্যের সম্ভাবনাকে কুর্নিশ জানাই৷ যখন সবাই বলে ছোটদের আর সাহিত্য সংস্কৃতি টানে না, তখন এই নামগুলো আমাদের মনে আশা জাগায়৷ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অসাধারণ লেখা ওদের পাথেয় হবে সন্দেহ নেই৷
আর 'ফুলকুসুমপুর' তো আমি সব সংখ্যাতেই পড়ি৷ আশেপাশে এমন একটা জায়গা যদি থাকত! 
স্মরণীয় বিভাগটিও মনকাড়া৷ ছোটদের জন্য প্রয়োজনীয়৷

কুইজ চলুক৷ ছোটদের হয়ে এই দাবিটা আমিও জানালাম৷

বন্ধু মৌসুমী এত্ত এত্ত শুভেচ্ছা জানাই এমন সুন্দর একটা পত্রিকাকে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য৷


আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. মৌসুমী মাসি! আজকের সংখ্যা পড়তে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি বৈভবী সেনগুপ্ত বলছি। গল্প, কবিতা সব ভালো আছে। আমি এখন বাসে করে আমাদের বাড়ি কলকাতা যাচ্ছি। আর বাসে খুব এনজয় করছি।

    ReplyDelete
  2. মৌসুমী তোমার সম্পাদকীয় কলম টি বেশ সুন্দর , আলাদা করে সূচিপত্রের প্রয়োজন পরে না । খুব ‌‌বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই কাজটা করো । প্রতিবারই পড়ে খুব আনন্দ পাই । সমস্ত গল্প , পদ্য , প্রবন্ধ একনিশ্বাসে পড়ে ফেললাম , খুব সুন্দর লেখার বুনন । ছোটদের অনেক আদর , ছবি তোমাদের মতই নিস্পাপ সুন্দর ।

    ReplyDelete