জ্বলদর্চি

অসাম্যই শেষ কথা /মিলি ঘোষ

অসাম্যই শেষ কথা
মিলি ঘোষ

 ৫ই এপ্রিল ছিল সমতা দিবস আর ১২ই এপ্রিল বিশ্ব পথশিশু দিবস। 'সমতা' আর 'পথশিশু' দুই'ই একসূত্রে গাঁথা। সমতার ব্যাপ্তি অনেক দূর। পথশিশু তার একটা অঙ্গ। আসলে সমতা শব্দটাই হাস্যকর। একটা কাল্পনিক ব্যপার। যা বলতে লিখতে ভালো। শুনতেও ভালো। কিন্তু বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা শূন্য। 

সমতা বলতে আমরা বুঝি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আর্থিক পরিকাঠামো ইত্যাদি বিষয়ে সমান অধিকার। নারী পুরুষের সমান অধিকার। শিশু থেকে বৃদ্ধের সমান অধিকার। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী পাই? প্রতি ক্ষেত্রে অসম বণ্টন। পরিবার থেকে রাষ্ট্র, সর্বত্র একই চিত্র। খাদ্য, অর্থের অসমতা তো আছেই। এমনকী বাক-স্বাধীনতা পর্যন্ত সকলের সমান নয়। কথা বলবেন তিনি, যিনি প্রভাবশালী। একটু দাপুটে, গলার জোর বেশি, কথায় নাটকীয়তা বেশি তাঁদের কথাই মানুষ শোনে। হাঁ করে শোনে। জানে, এর একশোটা কথার মধ্যে নব্বইটাই মিথ্যে। তবু শোনে। সে জায়গায় নিচু স্বরে কথা বলা, মিথ্যে না বলা মানুষের কথা লোকে শুনবে কেন? অনেক সময়ই একজনের কথার মধ্যিখানে অন্য কেউ নিজের বক্তব্য পেশ করে থাকেন। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যান। চাপা পড়ে যায় সেই মানুষটির কথা। যার বক্তব্যে হয়তো যুক্তি ছিল। এই সমাজটা আমরা তৈরি করেছি। অন্যের কথার মধ্যিখানে কথা বলা যে তাঁকে অপমান করা এই বোধটা অনেকের নেই। অনেকে আবার জেনেশুনেই করেন। আমাদের শিক্ষা, আমাদের রুচি, আমাদের দম্ভই আমাদের পরিচয়। 

নারী-পুরুষ ভেদের আঁতুড়ঘর হলো পরিবারগুলো। ছেলে মেয়ের মধ্যে অসম বণ্টন শুরু করেন বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমারা। এই অসাম্য ত্রিশ, সত্তর কী একশো বছর বা তারও আগে যা ছিল, এখন তার অনেকটাই নেই। কিন্তু একেবারেই কি নেই? এখনও আছে। কিন্তু আগের মতো প্রকট নয়। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেকটাই কমেছে। তবে, রান্নাঘরের কারিকুরি নিঃশব্দে এখনও বহমান। তার সঙ্গে আছে ছেলের স্বাধীনতা। মেয়েরও আছে। তবু, কোথায় একটা পার্থক্য থেকে যায়। আবার যেখানে মা ছেলের বন্ডিং সাংঘাতিক, সেখানে বাড়ির বউ কোণঠাসা। যদিও সম্পর্কের এই চোরাস্রোত ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই। কারণ, তাঁরা পুত্রবধূকে কন্যাসম দেখেন। সে কন্যার খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাক কোনও কিছুতে ঘাটতি নেই। ঘাটতি শুধু সম্মানে। 
এ তো গেল ঘরের কথা। ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোলে অনেক সময়েই বিপরীত রূপ দেখা যায়। বাসে, মেট্রোতে মহিলাদের জন্য বসার জায়গার সংরক্ষণ সমর্থনযোগ্য নয়। তবে, বয়স্ক বা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট সিটের ব্যবস্থা কিন্তু কখনওই আলোচনার বিষয় হতে পারে না। লেডিজ স্পেশ্যাল ট্রেনে কোনও পুরুষ যদি উঠেও পড়েন, তাঁকে তিরস্কার বা ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া লিঙ্গ বৈষম্যের একটি ভয়ঙ্কর রূপ। তাঁকে সম্মানের সঙ্গে পরের স্টেশনে নেমে যেতে বলা যেতে পারে। তার বেশি নয়। তবে, ভিড় বাসে বা ট্রেনে মহিলারা কতখানি নিরাপদ, তা মহিলা মাত্রেই জানেন। তাই মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত কামরা বা ট্রেনের অবশ্যই দরকার আছে। এটা বৈষম্য নয়। এটা প্রয়োজন।


🍂

জাতি ধর্মের বিভেদ যত দিন যাচ্ছে, ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। ধর্ম কে মানবেন কে মানবেন না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু বিভেদ ছাড়াই যার যার ধর্মকে মানুষ বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, ইচ্ছা করলেই। কিন্তু তা হওয়ার নয়। অশিক্ষা, কু-সংস্কার মানুষকে দিনে দিনে হিংস্র করে তুলছে। নিজেকে রাজা ভাবার প্রবণতা মানুষের শিরায় শিরায়। শুধু আমিই ঠিক, আমারটাই ঠিক। অথচ প্রতিটি ধর্মের মূল কথা কিন্তু এক। ধর্ম না মানলে মিটে গেল। তাঁদের কাছে ধর্মই যখন নেই, তা নিয়ে গণ্ডগোলও নেই। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস রেখে তার গভীরে না গেলে যুদ্ধ হবেই। তবে, যাঁরা ধর্ম মানেন না, তাঁরা যে খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ তা নয়। তাঁরা আবার আস্তিক নাস্তিক নিয়ে লড়াই বাঁধাতে ভালোবাসেন। কাজেই বিভেদ আছেই। সর্বত্র, সর্বক্ষেত্রে। পাশাপাশি জাতপাতের উন্নাসিকতা দেখা যায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। এর থেকে বেরোনো মুশকিল আছে। কারণ, নাক উঁচু হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষিত মহলের। তাঁদের অহং জাতিভেদকে উস্কে দিচ্ছে। ওর হাতেরটা খাই না, তার হাতেরটা ছুঁই না, এসব এখন খুব কম লোক করে থাকেন। কিন্তু জাতিগত পার্থক্য ঠিক রেখে সম্পর্ক বজায় রাখতে জুড়ি নেই শিক্ষিত মানুষের। এমনিতে বোঝার উপায় নেই। গ্রামে গঞ্জে বা অন্য কোথাও কোনও শিশু বা যে কোনও মানুষকে জাতপাতের বলি হতে দেখলে মূল্যবান মতামতও রাখেন তাঁরা। কিন্তু কোনও পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানের সময় এদের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। তখন তাঁদের জাত্যাভিমান জাগ্রত হয় নির্লজ্জের মতো। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বর্ণ বৈষম্য। এর পরিধি অনেক দূর বিস্তৃত। শহর নগর ছাড়িয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করেও এ বহাল তবিয়তে বিরাজমান। আধুনিক সভ্যতা, উন্নত প্রযুক্তি এর কাছে নিতান্ত শিশু। এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন বললে ভুল হবে, বরং বলা যায় অসম্ভব।

সব রকম অসমতার মূলে বোধহয় রয়েছে অর্থনৈতিক অসাম্য। এই একটা বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা পৃথিবী। এতক্ষণ যে অসমতার কথা এলো, তার প্রায় সবগুলোই বন্ধ হয়ে যায়, যদি মানুষে মানুষে আর্থিক সমতা থাকে। গলার জোর, ছড়ি ঘোরানো, তুচ্ছজ্ঞান করা সমস্ত দাঁড়িয়ে আছে ওই একটি জিনিসের ওপর। এখানে শ্রেণি বৈষম্য, নারী পুরুষে ভেদাভেদ নগণ্য। মুখে যে যাই বলুক আর্থিক সমতা কেউ চাইবে না। সবাই যদি গাড়ি চালায়, গাড়ি ধোবে কে? আর্থিক পরিকাঠামো সমান না হলেও অন্তত কাছাকাছি হলেও সমগ্র পৃথিবীর চেহারাটাই পাল্টে যেত। যদিও তা হবার নয় এবং এক বিশাল সংখ্যক মানুষ তা চাইবেও না। লাঙ্গল যার, জমি তার নীতি সর্বৈব মিথ্যা। সত্য হলো, অর্থ যার, ছড়ি তার। তাহলে এই সমতা দিবসের কী মূল্য আছে?

পথশিশু দিবসের কথা একটু হলেও আসে। কারণ বিশ্বে সবথেকে অবহেলিত জীব হলো পথশিশু। আমাদের দেশে পথশিশুর সংখ্যা কত, এই সমস্ত পরিসংখ্যানে না গিয়ে আমার সামনে যে পড়ে, তার জন্য তো করা যায়। আমার বাড়ির নিকটতম জায়গায় যে পথশিশুরা থাকে, তাদের জন্য করা যায়। হয়তো অনেকেই করেন। বিভিন্ন সংস্থা থেকে বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কিন্তু কাজের ধারাবাহিকতা কোথায়? একদিন মন্ডা মিঠাই খাইয়ে বাকি ৩৬৪ দিন খোঁজও নিলাম না ওদের পেটে কিছু পড়ল কিনা, এভাবে কাজ করে বিশেষ কিছু উপকার হয় না। একটা সিঁড়িও বাড়তি ভাঙে না ওরা। পথশিশুই থেকে যায়। আর এর মূলে কিন্তু সেই অর্থনৈতিক বৈষম্য। যা কোনওদিন দূর হবার নয়।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments