জ্বলদর্চি

ভবতোষ শতপথী (লোককবি, ঝাড়গ্রাম/) ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৩
ভবতোষ শতপথী (লোককবি, ঝাড়গ্রাম

ভাস্করব্রত পতি

'ঢের দিন বাদে --- 
একদিন আচকা দেখা হয়্যেঁ গেল কুসমীর সঁঘে।
শ্বশুর ঘর লে বাপের ঘর আস্যেঁয়েঁছে! 
ক'লে একটা পদ্মফুল্যের লেখেন বেটা ছানা।
হামার দিগে আঙ্যুল বাঢ়ায়ঁ দেখায় দিছে ---
হায়্ দেখ্ ন রে --- বাবু, তর আর একটা মামা!
ভালবাসা ভেস্তায়ঁ গেলে ---
যার বাপ হবার কথা --- সে মামা হয়্যেঁ যায়'! 
            (শিরি চুনারাম মাঁহ্ত) 
সব ছেলেদেরই যেমন প্রেমে পড়লেই কবিত্ব শক্তির উদগীরণ হয়, ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটেছিল ভবতোষ শতপথীর জীবনেও। কিশোর বয়সেই প্রেমে পড়েছিলেন সহপাঠীর সঙ্গে। তাঁর এলোচুল আর নিটোল হাসিতে বিভোর হয়ে লিখে ফেলেছিলেন জীবনের প্রথম কবিতা -- 'আমায় দেখে আড়াল থেকে মুচকি হাসি হাসলে 
মনে হল এবার বুঝি সত্যি ভালোবাসলে 
তুমি তখন দাঁড়িয়ে ছিলে বকুল গাছের তলায় 
চিকন কালো ব্যাকুল বেণী বাতাস লেগে উড়ছিল  
রামধনু রঙ ভাবনাগুলো ছড়িয়ে ছিল হাওয়ায়'। 
গ্রামের পাঠশালায় ধীরেন্দ্রনাথ টুডুর কাছে পাঠগ্রহণের পর চিচিড়াতে আবাসিক হিসেবে ভর্তি হন। এরপর মাইনর স্কুলের পড়া শেষে হাইস্কুলের করিডোরে। সেখানেই তাঁর ঐ স্বপ্নসুন্দরীর দেখা। যাঁকে নিয়েই তাঁর কবিতার দৃপ্ত হস্তচারণা। ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ২৪ শে বৈশাখ (১৯৩৫ এর ৪ ঠা মে) ঝাড়গ্রামের জামবনি থানার টুলিবড় গ্রামে এক ব্রাম্ভণ জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন ভবতোষ শতপথী। বাবা শ্রীপতিচরণ শতপথী ছিলেন একজন জমিদার। আর মা বিনোদবালা শতপথী ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। শালপাতা, লালমাটি আর কালোপানা মানুষগুলোর সান্নিধ্যে বড় হয়ে তিনি লিখতে পেরেছিলেন -- 
'জীবনপুরের সেই মেয়েটা ভিক্ষুণী
    অন্ধকারে প্রায় সকলেই মুখ চেনা। 
সুড়সুড়ি দেয় অম্লমধুর টিপ্পনি
    নিঝুম রাতে ঝুমুর শোনায় তালকানা'। 

একসময় যাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল 'ভবতারণ', সেই পরবর্তীতে নিজেকে 'ছোট' করে হয়ে উঠেছিলেন 'ভবতোষ'। কিন্তু তিনি বাকি সকলের মতো ছোটখাটো 'হঠাৎ কবি' নন। তিনি ছিলেন 'স্বভাব কবি'। তাই তাঁর কবিতায় ছিল প্রাণ। প্রস্ফুটিত হত ছাপোষা মানুষের কথা। কবিতার জন্য নিজেকে শানিত করেছিলেন আত্মিকভাবে। তাঁর এই কাব্য প্রতিভা আখেরে তাঁর জীবনে ঝড় এনেছিল বলা যায়। যে ঝড় ধীরে ধীরে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতের সাক্ষী হয়ে আমৃত্যু এঁটুলির মতো গায়ে লেপটে ছিল। তাঁর বাবা কিন্তু ছেলের এহেন কবিতাপ্রীতি তথা কাব্যপ্রীতি মেনে নিতে পারেননি। তিনি বুঝেছিলেন, কবিতা লিখে পেটের ভাত জোগাড় হয়না। ছেলেরও হবে না। দরকার পড়াশোনা। দরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গ্রাম থেকে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন ঝাড়গ্রামে। ছেড়ে আসতে হল প্রেমিকাকে। ঝাড়গ্রাম কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর অবশ্য আর পড়াশোনা করেননি। অবশেষে সেই প্রেমিকারও বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। এতে কবির মন হয়ে ওঠে আরও উতলা। তখন তরুণ কবি ভবতোষ নিজেকে আরও পরিশীলিত করতে শুরু করেন কবিতার পরিসরে। শূন্য মনের তখন একমাত্র সঙ্গী কবিতার অক্ষরগুলো। শুরু করলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। পরবর্তীতে দেশ, কৃত্তিবাস, কবিপত্র, অমৃত ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন তিনি। 

তখন ১৩৫৮ সাল। সেসময় পাশে দাঁড়ালেন অতুল মাহাতো। 'গ্রামের ডাক' কবিতা দিয়ে শুরু হল তাঁর কাব্য জগতের উত্তরণ। জমিদার বংশের সন্তান হলেও জমিদারিত্ব দেখাননি কখনো। কবিতাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকতেন সবসময়। তাঁর বাবা জমিদার থাকলেও বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন একসময়। আর কিশোর ভবতোষও কখনো বৈষয়িক চিন্তা ভাবনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেননি। কবিতার নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে বেঁধে রাখতেন দিনভর। 
'রাইতে টুকু সুস্তি ঘুমাতে পারি নায়ঁ!
দেশে কি মশার উৎপাত হয়্যেঁছে হে!
শালা, মশায় কি আর মানুষ বাছে?
রগা ভগা যেমনেই হোক --- ফাঁক পালে রকত্ চুষ্যেঁয়ে
পেট ঢিল করেঁয়ে --- ভনভনায়ঁ উড়্যেঁয়ে পালায়!
মশা মাইরতে নিজের গালে
নিজেই চাপড়াঁয় হছি'।

এভাবে নিরন্তর কবিতাপ্রেম দেখে প্রমাদ গুনলেন বাবা। কবিতার নেশা কাটানোর দাওয়াই হিসেবে 'বিহাই' দিলেন ছেলের। গায়েত্রী দেবীর সাথে বিয়ে হল তাঁর। সংসারের চাপে কবিতার ভূত মাথা থেকে নামবে -- এই ভাবনা ছিল মাথায়। কিন্তু যাঁর আঙুলে কবিতার রসসিক্ত বাষ্প ঘনীভূত, সে কি পারে কাব্যের ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে? পারেননি জঙ্গলমহলের লোককবি ভবতোষ শতপথীও। জীবনের সব কিছু বেচে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন কবিতার পদতলে -- 
'বেশ করেছি, সব বেচেছি 
বাঁচার তাগিদে 
শেষ সম্বল ভালোবাসা 
বেচবো নগদে। 
টিপ দিয়েছি, সই করেছি 
দু'পিঠ দলিলে 
জানিয়ে সেলাম, সামিল হলাম 
মস্ত মিছিলে। 
সুখের মুখে ছাই দিয়েছি 
দুঃখের দায় ভাগ 
এই জীবনের প্রতি আমার 
অন্য অনুরাগ। 
চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে 
আমার তাতে কি? 
শূন্য ঘরে অন্ধকারে 
একলা বসেছি'। 

টিউবারকিউলোসিসের আগ্রাসী ছোবলে তিন সন্তানের জননী গায়েত্রীদেবীর মৃত্যু হয় ষাটের দশকে। আবারও হারিয়ে ফেললেন মনের প্রেয়সীকে। এরপর থেকে কবি হয়ে উঠলেন আরও ম্রিয়মান। হয়ে উঠলেন উদভ্রান্ত। জমিদারীর সূত্রে প্রাপ্ত ধনসম্পদ অকাতরে নষ্ট করে ফেললেন বন্ধু সংসর্গে গা ভাসিয়ে। কিন্তু লিখে যেতে থাকলেন কবিতার পর কবিতা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কবিতায় নিমজ্জিত রেখেছিলেন নিজেকে। যদিও অন্তিম সময়ে ঝাড়গ্রাম শহরের রাজ কলেজ সংলগ্ন খাসজঙ্গল এলাকায় একটা ছোট্ট কুঠুরিতে নিতান্ত অবহেলা এবং অনাদরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। যাঁর লেখা অসংখ্য কবিতা, ঝুমুর গান, নৃত্যনাট্য জঙ্গলমহলের লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির আকর রত্ন হিসেবে পরিগণিত হয়, সেই ব্যক্তিকে শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে নিদারুণ দারিদ্র্য এবং অসহায়তাকে সঙ্গী করে। ১৯৯২ থেকে বিগত রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের দেওয়া মাসিক দেড় হাজার টাকা আর্থিক অনুদানও ২০১২ তে বন্ধ করে দেয় বর্তমান রাজ্য সরকার। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই অনুদান আর কখনও চালু হয়নি। নুন আমানি চাওয়া অবক্ত যন্ত্রনা জঠরে নিয়ে কাটাতে হয়েছিল স্থবিরকাল। হলদিয়া থেকে প্রকাশিত 'আপনজন' পত্রিকা থেকে একবার কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বাড়িতে গিয়ে। ব্যাস, ঐটুকুই। অন্তরের দুঃখ পাথরচাপা দিয়ে তিনি কিন্তু লিখে গিয়েছেন আনন্দের গান ---
'ধামসা বনাঁয় দে 
একটা মাদল কিনে দে 
আর গাঁউলি এক দু কলি 
ঝুম্যইর শিখাঁয় দে হামি গাহইব বাজাব 
মইচ্ছা পড়া জীবনটাকে বেদম পাজাব'। 
যে ব্যক্তি লিখতে পারে 'শেষ বসন্তের সংলাপ' কাব্যগ্রন্থ কিংবা ব্যঙ্গাত্মক কবিতা সংকলন 'বদানন্দের পদাবলি' -- সেই ব্যক্তির জীবনের শেষ সংলাপ তাই হয়ে ওঠে --  'কাতর রাতের কানা গলিটার 
দুপিঠ অন্ধকারে 
অজ্ঞাতবাসে বন্দী রয়েছি 
কবিতার কারাগারে। 
লাঙলের ফলা, লেখনীর জ্বালা 
ফসলের অনুরাগ 
কিষানের সাথে সমান সমান 
দুঃখের দায় ভাগ'। 

বাংলা ও আঞ্চলিক কুড়মালি ভাষায় দু হাজার কবিতা এবং দেড় হাজার ঝুমুর গান লিখেছেন মেদিনীপুরের এই লোককবি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রথের রশি' ও 'চণ্ডালিকা'র অনুবাদ করেছেন কুড়মালি ভাষায়। বিদেশেও তা অভিনীত হয়েছিল। ১৯৯৫ এর মে মাসে কলকাতার রবীন্দ্র সদনে মঞ্চস্থ হয় তাঁর অনুদিত চণ্ডালিকা। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে পড়ানো হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ। মেদিনীপুর কলেজের ছাত্র ছাত্রীদেরও পড়ানো হয় তাঁর কবিতা। একসময় শুরু করেছিলেন 'গীতগোবিন্দম্' এর অনুবাদের কাজ। যদিও তা থমকে যায় উপযুক্ত কুড়মালি শব্দ ভাণ্ডারের অভাবে। 

যিনি নিজেকে 'ছোট জাতের কবি' তথা 'চুয়াড়দের কবি' বলে মান্যতা দিয়েছিলেন, তাঁর কলমের ডোগা থেকেই উন্মোচিত হয় অক্ষরের দ্যোতনা -- 
'আমি অসভ্যের সভাকবি মানিনা কালাকাল 
ব্রাম্ভণের পৈতা ছিঁড়ে 
হাহাকারে হয়েছি চণ্ডাল'। 
সেই চুয়াড়ের কবির শেষযাত্রায় অনুরণিত হয় -- 
'অনেক দুঃখে রাতারাতি হলাম দেশান্তর 
রইল পড়ে বাস্তুভিটে, করুন কুঁড়েঘর'। 
২০১৭ এর ১৫ ই জানুয়ারি অত্যন্ত অভাব এবং অবহেলায় যখন মৃত্যুবরণ করেন ঝাড়গ্রামের অরণ্যচারী মানুষের জীবন যন্ত্রনার প্রতিচ্ছবি আঁকা এই লোককবি, তখন আরেকবার অস্ফুটে উচ্চারিত হয় -- 
'ক্ষুধার্ত মাতার গর্ভে ক্ষুধাতুর পিতার ঔরসে 
আজন্ম বুভুক্ষু শিশুর জনান্তিকে জন্মায় স্বদেশে'। 

ভবতোষ শতপথীর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল --- অরণ্যের কাব্য, জল পড়ছে, আলকুশি, ঢেমনা মঙ্গল, জুমঢ়া এবং শিরি চুনারাম মাঁহ্ত। ১৯৮৬ তে 'পইন্যা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন তিনি। আসলে কুর্মি সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায় ছিল তাঁর। কবিতা চর্চা শুরু করার বহু বছর পর ১৯৮৮ তে প্রকাশিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অরণ্যের কাব্য'। যে কাব্যের পরতে পরতে ছিল জঙ্গলমহলের আপাত নিরীহ গরিবগুর্বো মানুষের 'দিন আনা দিন খাওয়া' দিনলিপির প্রতিচ্ছবি। এইসব ম্লান মুখের এবং মূক মুখের মানুষজনের মুখচ্ছবি হয়ে উঠেছিল কবির 'অরণ্যের কাব্য'। 

অধ্যাপক ফটিকচাঁদ ঘোষ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, "জঙ্গলমহলের সাংস্কৃতিক পালক এবং রক্ষাকর্তা কুড়মি সমাজ। তাঁদের সাহিত্যিক ভাষা নয়, যে ভাষায় এই অঞ্চলের মানুষেরা কথা বলেন সেই ভাষাকেই অবলম্বন করেছিলেন তিনি। বিশুদ্ধ বাংলায়ও লিখেছেন, মধ্যবিত্তের 'ঢ্যামনামো' প্রকাশ করেছেন। কিন্তু 'লোক'কে কখনও ছেড়ে যাননি লোককবি। তাঁদের ভাষা নিয়ে উঠে এসেছে মাধুরী মাহাতো, চাঁপা সরেণ, চুনারাম মাহাতোরা"। কবি ভবতোষ শতপথী সেই ঢ্যামনামোর টুকরো টাকরা নিদর্শন তাঁর 'ঢেমনা মঙ্গল' কাব্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জনজীবনের নিটোল কথোপকথনের মাধ্যমে তুলে এনেছেন এভাবে -- 
'ঢেমনা ডাঁঢ়া ডাঁঢা রে
             খরিসের লেখেন
 পেলকু ঢেমনা তর মাথায় যে
          লাঁথ্যায় দিছে বেঙ
(হায় রে) ঢেমনির সঁঘে রঁগে রঁগে
    টিলহায় বাঁধলিস ঘর
 খল্যস্ ছাঢ়া চিকন ঢেমনার
           খরখস্যা  গতর।
  গাঢ়া ঢঢ়ায় লুকায় বুলিস্ 
       ঢেমনা নেঁকা চদা
লাগ্যাল্ পালে চামড়া ছুল্যেঁ
 লিবেক চামটু লধা।
 ঢেমনা পালা, পালা রে
      চাঁড়ে চাঁড়ে পালা 
 গাঢ়া ঢঢ়া হাঁসথ্যায় বুইলছে
   কুথায় ঢেমনা শালা।
(হায় হায়) হাঁসা ঢেমনির ভালবাসা
      পরপুরুষের সঁঘে
  লিলজ ঢেমনা ফঁসফঁসাছিস্
   ডরে ন কি রাগে'?

মাহাতো লোধা থেকে সদগোপ চাষারা স্থান পেয়েছে কবির কবিতায়। ক্ষুধাতুর ভাতের হাঁড়ি থেকে লোনা ঘামের গন্ধ, কেঁদ মহুল কুরচি শিমূল পলাশ ভুঁড়রু থেকে ধামসা মাদল বাঁধনা আর টুসু ভাদু করম মুরগি লড়াইয়ের লৌকিক জীবন ফুটে উঠেছে কবির কবিতায়। ফটিকচন্দ্র ঘোষের কথায় "জঙ্গলমহলের লোকসংস্কৃতির প্রধান ধারক বাহক কুর্মি মাহাতোরা। আর এই কুড়মিদের সঙ্গে কবির নিবিড় সংযোগ ছিল। তাঁদের জীবনচর্চা, দারিদ্র্য, কঠিন জীবন সংগ্রাম, কষ্টকর জীবনযাত্রা, তবু ধামসা মাদল বাঁশি নিয়ে জীবনকে মাতিয়ে তোলার যে আশ্চর্য ক্ষমতা জঙ্গলমহলের লোকসমাজ পেয়েছিল, ভবতোষ ছিলেন তার আত্মার শরিক। 'লোক'দের যে আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত এই সমাজে, সেই ভাষাকে আয়ত্ব করেছিলেন কবি"। 
'নাগেই দিমু আলকুশি
  বকর বকর করনে ---
 ডাহান হাতটা ভাঁগি দিমু
       জাহান বাজি ধরনে।
 তুই ভালা ত মুই ভি ভালা
    উড়াওঁ ধবলা পাইরা
 নুয়া আঁগার নাল বন্ন
      কাচি দিতেই খইরা।
 বন পুড়েঠে মন পুড়েঠে
  শুকেই গেলা গাড়িয়া
 বাংলা কহিনে বাঁগালি মুঁই
 উড়িয়া কহিনে উড়িয়া।
মুঁই জানঁঅ মুঁই ভারতবাসী
  মানুষ জাতির বংশ
 বনবিহারী বাজাওঁ বাঁশি
   বিভেদ মানে ধ্বংস। 
 তিনকাল যাই চারে ঠেকলা
  কতদিন টানমু ঘানি 
মানুষ জাহান্ ঠসরা চারডাল
পদ্ম পতরে পানি'।
কবির লেখনিতে সাধারণ আলকুশি ফল হয়ে উঠেছে সমাজের ক্ষতচিহ্ণের পরিচয়। তাই মানতেই হয় কবির কলমের জোর। এই 'আলকুশি' কবিতায় সেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গির লেখনীই ফুটে উঠেছে সাবলীলভাবে। 

ভবতোষ শতপথীর কবিতায় গানে স্থান পেয়েছিল লোকসংগ্রাম। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে যখন মাহাতো আদিবাসী সহ সমগ্র অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিয়েছিলেন, তখন সেই গনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিটি জনসভায় গাওয়া হত ভবতোষ শতপথীর লেখা ঝুমুর গান। 
'ঝাড়খণ্ডী রে ঝাড়খণ্ডী
তর ঘর কত দূরে রে
বিহার বেঙ্গল ওড়িশার কিনারে কিনারে.. '। 
প্রবাদপ্রতিম ঝুমুর গায়ক বিজয় মাহাতো গাইতেন সেসব গ্রাম। কবির লেখা গান গেয়েছেন ঝুমুর সম্রাজ্ঞী ইন্দ্রাণী মাহাতোও। এ পর্যন্ত বিজয় মাহাতোর বিভিন্ন ক্যাসেটে যে ৩৪ টি ঝুমুর গান রেকর্ড হয়েছে, তার মধ্যে ১৯ টি ঝুমুর গানের লেখক এই 'শিরি চুনারাম মাঁহত' এর স্রষ্টা। 

'চুনারাম'রা বেঁচে আছে। 'চুনারাম'রা বেঁচে থাকে। দিন বদল হয়। শাসকের পরিচয় বদলায়। মুখোশ বদলায়। লাল থেকে নীল, গেরুয়া থেকে সবুজ। মুখগুলো একই থাকে। আর চুনারাম'রা পড়ে থাকে ডহর টিকর শোল ভূমিতে। হাজার শোষণ শাসন অশিক্ষা বঞ্চনা কুসংস্কার ও সহজ সরল জীবন যাপনের সুর ছন্দ নিয়ে পথচলা সেই 'চুনারাম'দের হয়ে মেদিনীপুরের অরণ্যের এই কবিই বলতে পারেন --
"রুজি পুঁজি স উব সিঁরায়, ছিলহি চুনারাম --
হঁয়্যা গেলহি চুনা। 
ই দুন্যায়টায় দেইখছি --
ম্যাঁয় মালিক মরদ আর মরদের মালিক টাকা।
টাকা পইসা, জাইগা জমিন নাঁয় থাইকলে --
বাঁচ্যে থাকাটা কি হয়রাণ হে বোহনই। 
শালা, গাঁয়ে ঘরের জ্যাত কুটুম গিলাঅ নাঁয় ভালে। 
কুকুর বিলায়ের লেখেন 'হাড়ি' 'হাড়ি' কর‍্যেঁয়ে খেদ্যেঁ দেই"।

🍂

Post a Comment

0 Comments