জ্বলদর্চি

‌বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক আহমদ শরীফ/ নির্মল বর্মন

‌বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক আহমদ শরীফ 
              
নির্মল বর্মন 

ড. আহমদ শরীফ বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, বিবেকবান ব্যক্তি ও অধ্যাপক। ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিতা আব্দুল আজিজ ও মাতা মিরাজ খাতুনের কোল আলো করে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন।১৯৩৮ এ পটিয়া হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি.এ. সাফল্যের সঙ্গে পাশ করেন। ১৯৪৪ এ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ  ডিগ্রি লাভ করেন। ড.আহমদ শরীফ ১৯৬৭ তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকাকালীন 'সৈয়দ সুলতানের গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ' শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচ.ডি. অর্জন করেন। 
অধ্যাপক আহমদ আজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপনা করে গেছেন । তিনি শুধু আর পাঁচজন‌ অধ্যাপকের মতোই কুঁড়েমী জীবন যাপন করতেন না, সঙ্গে সাংবাদিকতা, গ্রন্থাগার বিভাগ ও নানাবিধ বিদ্যা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদসহ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে চেয়ারম্যানের পদ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপনার কাজে সরকারিভাবে অবসর নেন। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতিতে আহমদ সাহেব বাংলাদেশের "বিবেক" হিসেবে চিত্রিত ছিলেন। সামরিক প্রশাসন, গণতন্ত্রবিহীন স্বৈরাচারের রাজত্বে আপোষহীন সংগ্রামী ছিলেন।  সারাজীবন সক্রিয় মুজিব সরকারের বাকশাল প্রস্তাবকে অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেননি। প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ইসলামিকরণের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে গর্জন ও সজাগ করার চেষ্টা করেছেন।          বস্তুতঃ শরীফ সাহেব মুসলমান রাষ্ট্রে বসবাস করেও ইসলামি রাষ্ট্রের প্রবল সমালোচনা করতে কখনো  দ্বিধা বোধ করেননি। ফলতঃ যখনই বাংলাদেশে  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়েছে তখনই তৃণমূল স্তরে গণআন্দোলনের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। 

🍂

একসময় হিন্দু মন্দির ধ্বংসের শঙ্কায় হিন্দু জনগোষ্ঠী আক্রান্ত , বিপন্ন হতে পারে  ভেবে হিন্দু ছাত্রদলকে  সঙ্গে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি জগন্নাথ হলে অবাধে গিয়ে, বাংলাদেশে নির্ভয়ে ও সানন্দে থাকার জন্য হিন্দুজনগণকে   বিরাট সাহস ও পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এরশাদের ইসলামিকরণের বিরুদ্ধে যখনই 'হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ' গড়ে উঠেছিল তৎক্ষণাৎ শরীফ সাহেব তাকে সমর্থন করেছেন ও পাশে থেকে বিপুল উৎসাহ দান করেছিলেন।
অধ্যাপক সাহিত্যিক আহমদ শরীফ 'মার্শাল ল'-এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, বস্তুতঃ ১৯৬১ এবং ১৯৬৭ সালে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চর্চা বন্ধের 'আমলাতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা,'র প্রতি জোর জেহাদ ঘোষণা করে জনগণের সাক্ষর সংগ্রহের জন্য  পথে নেমেছিলেন। তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে  শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে শিল্পী কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও মহামারির বিরুদ্ধে 'মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইনের সাহায্যে'র জন্য কোর কমিটি গঠন করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পথ দেখিয়েছিলেন । আহমদ শরীফ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন প্রতিবাদ ও সংগ্ৰামের  জন্য' বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকার শরীফ বাবুকে কালো তালিকাভুক্ত করে রেখেছিলেন । প্রাবন্ধিক কে বঞ্চিত করে বহু প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা এবং সরকারি প্রচার মাধ্যম থেকে বিশ হাত দূরে থাকতেন।। ১৯৯২ সালে মৌলবাদীরা আহমদ কে ' মুরতাদ 'ও "দ্বিতীয় রুশদী' আখ্যা দিয়ে , ফাঁসির দাবিতে বার ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে। শরীফ সাহেবের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা চলেছিল । বিরাট মিছিল করে তাঁর বসত বাড়ি ঘেরাও করে ও টেলিফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। তথচ তিনি সদর্পে অবিচলিত থেকে জনগণের কাজ করে গেছেন। 
                        ১৯৯১ সালে   বাংলাদেশ সরকারের ' শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার 'একুশে পদক' সম্মান পেয়েছেন। আহমদ সাহেবকে ঐ সালেই  'ন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট এ্যাওয়ার্ড' দেওয়া হয় ।  পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শরীফ সাহেব কে বাংলাদেশের 'বিবেক' নামে চিহ্নিত করে ডি.লিট(সাম্মানিক )উপাধি প্রদান করে। ১৯৯৪ সালে 'পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বিদ্যা সম্মিলনী'নামক সংস্থা শরীফ সাহেব কে বাংলাদেশের 'শ্রেষ্ঠ শিক্ষক' হিসাবে অনাড়ম্বর সংবর্ধনা জানায়।
প্রাবন্ধিক গবেষক ও অধ্যাপক আহমদ শরীফ সাহেব রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা প্রায়  শতাধিক। নতুন দৃষ্টি ও ভাবনায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এখন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অজানা এক একটি দিককে আলোকিত করে নিবন্ধ ছোট প্রবন্ধ, ফিচার লিখেছেন অসংখ্য। মধ্যযুগের তাবৎ পুঁথি সাম্রাজ্য জরীপ করে তৎকালীন 'নিরন্ন মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনাভাবে'র দর্পণ চিত্রণ করেছেন।
 ‌‌             প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফ এর উল্লেখ্যযোগ্য বই: ''বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য'', ''বিচিত্র চিন্তা'', ''বাঙালির চিন্তা চেতনার বিবর্তন ধারা'', ''স্বদেশ চিন্তা'', ''স্বদেশ অন্বেষণ'', ''সময় সমাজ মানুষ'', ''বিশ শতকের বাঙালি'', ''জীবনে সমাজে সাহিত্য'', ''যুগ যন্ত্রণা'', ''বাংলা ভাষা সংস্কার আন্দোলন'', ''মানবতা ও গণমুক্তি'', ''স্বদেশের স্বকালের সমাজের চালচিত্র'', ''বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র'', ''কালের দর্পণে আমরা'', ''উজান স্রোতে কিছু আষাঢ়ে চিন্তা'','কালিক ভাবনা', ''নির্বাচিত প্রবন্ধ''প্রভৃতি।
        ড.আহমদ শরীফ সাহেব প্রতিষ্ঠিত "স্বদেশ চিন্তা সংঘ" থেকে ড.আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার ও বক্তৃতার আয়োজন হয়ে থাকে।
      প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক ড.আহমদ শরীফ উপমহাদেশের শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি , রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রথমসারির পান্ডিত্য, বিদ্রোহী ও অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল চিন্তাধারার বলিষ্ঠ চিন্তা নায়ক হওয়া সত্ত্বেও কালের অতলে তলিয়ে যাওয়ার অবস্থায় সাহিত্যিক।তাই প্রখরযুক্তিবোধ সুতীক্ষ্ণ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতির নিয়মে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো বিস্মৃত প্রায় সাহিত্যিক নিয়ে লেখাটি। অসংখ্য ধন্যবাদ ড. নির্মল বর্মনকে এত সুন্দর লেখা উপহার দেবার জন্য।

    ReplyDelete