জ্বলদর্চি

আমার পুজোর দিনগুলো/(উৎসব ১৪২৮)/অনিন্দিতা শাসমল

আমার পুজোর দিনগুলো(১৯৮৫ থেকে ২০২০)

অনিন্দিতা শাসমল


রেলশহর খড়্গপুরের উজ্জ্বল আলোর রোশনাই থেকে মাত্র দু কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম,জফলা।বিদ্যুৎযোগাযোগহীন সেই গ্রামের অন্ধকারেই কেটেছে আমার শৈশব আর কৈশোরের  মধুর দিনগুলো। রাত জেগে হ‍্যারিকেনের আলোয় পড়েই মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছি। রাতের খাওয়া শেষ হলে , বাবা বকুনি দেবে বলে চুপ করে শুয়ে থাকতাম। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে , মশারির ভেতরে হ‍্যারিকেন নিয়ে , মশারির বাইরে চাদর দিয়ে দিতাম -- যাতে বাবা জেগে গেলেও ওদের চোখে আলো না পড়ে ; বুঝতে না পারে আমি জেগে আছি । কোনোদিন হয়তো ঘুমিয়েই পড়তাম বইয়ের ওপর । ভেতরে হ‍্যারিকেন জ্বলতে জ্বলতে, তেল ফুরিয়ে আলো ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে আসতো ,আমি জানতেও পারতাম না। মা ভোরে আমাকে দেখে , আঁতকে উঠে বলতো -- যদি হ‍্যারিকেন উল্টে আগুন লেগে যেতো মশারিতে ? কি হতো ? এভাবে কেউ ঘুমোয়  ? চোখ ঘষতে ঘষতে বলেছি-- সত্যি তো ! ভুল হয়ে গেছে মা । পরের দিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এই পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা আমার পুজো কেমন কাটতো ওই সময় , আর তার পরের পুজোর পরিবর্তনের ক্রমান্বয় ---- এবার আসি সেই প্রসঙ্গে।

                   ১৯৮৫  সাল । আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ,সেই প্রথম আমার শহরের আঙিনায় পা রাখা । একটি বাচ্চা মেয়ে তার থেকে উঁচু একটি সাইকেলে চড়ে, প্রতিদিন দু কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শহরের নামী স্কুলে যায়, আবার ফিরেও আসে। বন্ধুদের কাছে  গল্প শোনে -- টিভি, ফ্রিজ , মিক্সি , লাইট ট্রেস করে বিজ্ঞানের খাতায় পরিচ্ছন্ন ছবি আঁকা । তার তো এইসব কিছুই নেই। তাই মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। এইসব গল্প শুনতে শুনতে শরৎ আসে।সাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার দু'ধারে কাশ দেখে নেমে পড়ে । হাতে কাশের গুচ্ছ নিয়ে , আকাশে তাকিয়ে দেখে -- পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। লাইট ট্রেস করে ছবি আঁকতে না পারা , টিভি দেখাতে না পাওয়া , ঠান্ডা জল না খেতে পাওয়ার সব বেদনা ভুলে , সাইকেলের হ্যান্ডেলে কোনরকমে কাশফুলগুলো যত্ন করে দাঁড় করিয়ে , সাবধানে বাড়ি ফেরে ।

          পুজোর একমাস আগে থেকেই ,  ক্লাসের সবাই গল্প করছে --  কার ক'টা জামা হলো। লুকিয়ে শুনতাম। ক'টা জামা ? সে আবার কি ? পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর দিন সকালে বাবার হাতে বোনাস এলে , রেলকর্মী বাবার সাইকেলে চড়ে গোলবাজারে যেতাম। জ‍্যাঠাতুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে নিজের একটাই জামা কিনে বাড়ি ফিরতাম। বাবার টাকায় কোনোদিন খুব দামি জামা বা অনেকগুলো জামা কেনার কথা স্বপ্নেও ভাবি নি । বরং সেই টাকায় সবার জন্য জামা কিনে এনে , যখন ওদের গায়ে ফেলে দেখতাম -- কী আনন্দ ! কী আনন্দ !  মনে পড়তেই এক মুহূর্তে ভুলে গেলাম , একমাস আগে থেকে অনেকগুলো জামা কিনতে না পারার দুঃখ । 

                       পুজোর দিনগুলোতে সপ্তমী বা অষ্টমী, যে কোনো একটা দিন , সেই  নতুন জামা পরে , জ‍্যাঠামশাইয়ের  সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমরা সব ভাইবোনেরা  শহরে পাড়ি দিতাম । সারা রেলশহর ঘুরে, পায়ে হেঁটে হেঁটেই  ঠাকুর দেখতাম । দেখা শেষ হলে , একটা দোকানে বসে রসগোল্লা, জিলিপি , বড়জোর একটা নিমকি সঙ্গে -- এই ছিল আমাদের পরম তৃপ্তির আনন্দভোজন। আজ অবাক হয়ে ভাবি, সব মিলিয়ে প্রায় দশ বারো  কিলোমিটার হাঁটতাম আমি ? পারতাম এই আমিই ? বাড়ি ফিরে খোলা আকাশের নিচে গাছের তলায় দড়ির খাটিয়ায় বসে , মাকে ঠাকুর দেখার সব খুঁটিনাটি বর্ণনা দিতাম। মা উঠে গেলে ,  অবাক চোখে দেখতাম -- আমাদের অন্ধকার গ্রামের অনতিদূরে  রেলশহর থেকে আকাশে ছিটকে পড়া আলোর ছটা , কখনো কখনো সার্কাসের ঘূর্ণায়মান আলো।

              পুজো দেখতে অনেক সময় পিসি ,মাসি, মামী , মামা , মেসো ,তুতো ভাইবোনেরা আসতো  আমাদের বাড়িতে। তারা পুজো দেখতে যেতো শহরে-- সাইকেল ,  মোটর সাইকেল অথবা রিক্সা করে । আর আমরা ?  এতগুলো ভাইবোন মিলে জ‍্যাঠামশাই-এর সঙ্গে হেঁটে ঠাকুর দেখার আনন্দটাই ছিলো আলাদা ! অনেক বছর পর যখন ,বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রেখেছি , তখন গ্রামে প্রায় সকলের বাড়িতে বিদ্যুৎ এলো। রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলে উঠলো । তারপর ১৯৯৬ সালে, গ্রামেই শুরু হল দুর্গাপুজো। প্রথমে একটা , পরের বছর আরও একটা। কী আনন্দ তখন ! চারদিনই গ্রামের  পুজোমণ্ডপে পুজোর জোগাড় করা , সন্ধ্যা আরতি দেখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা-আনন্দ আর আনন্দ ! শহরের পুজো দেখার আকর্ষণ কমে গেলো । এখন গ্রামের প্রায় সকলের বাড়িতেই  মোটর সাইকেল । তাতে চড়ে বাবা , দাদাদের সাথে ঠাকুর দেখতে যেতাম হয়তো একটা দিন সন্ধেবেলায়। তবে আমার আকর্ষণ ছিল গ্রামের পুজো। গ্রামে একটি অলিখিত নিয়ম চালু ছিলো -- কেউ চাকরি পেলে সেই বছর সে প্রতিমার দাম দেবে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে চাকরি পাওয়ার পর, অক্টোবরের পুজোতে আমার প্রথম চাকরির টাকায় , প্রতিমা কেনা হলো । তার মাস পাঁচেক আগে থেকেই বিবাহসূত্রে আমি মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা । বাড়ির বাইরে পা দিলেই চোখ ধাঁধানো প‍্যান্ডেল, আলো , প্রতিমা , মঞ্চসজ্জা ,  নামী  শিল্পীদের গান-আবৃত্তি...

                তবুও মন পড়ে থাকে সেই গ্রামের পুজোতেই। বারবার ছুটে গেছি কী এক অমোঘ আকর্ষণে । সেই ঢাকের আওয়াজ ,  মন্ডপের বাঁধানো সিঁড়িতে বসে শাঁখ বাজানো , ছায়াঘেরা মেঠোপথ , বাড়িসংলগ্ন পুকুরে ঘট বিসর্জন ,  সিঁদুরখেলা , প্রতিমা নিরঞ্জন , আনন্দঘন পরিবেশ -- সব নস্টালজিয়ার কাছেই আমার জীবনের ঋণ।

        আজ আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা এই  শহরের সমস্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধে পাওয়া ,যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত এই আমি , অনেক কিছুই পারবো না আর।ভ‍্যাপসা গরমে হাত পাখার মৃদু বাতাস সহ‍্য হবে না । হ‍্যারিকেনের আলোয় হয়তো বইয়ের বা পরীক্ষার খাতার অক্ষরগুলো পড়তেই পারবো না । দশ বারো কিলোমিটার হাঁটার কথা কষ্টকল্পিত স্বপ্নই হয়তো বা ! তবু সেই স্মৃতিগুলো নিয়েই পুজোর চারটে দিন কাটাই । বেশ কয়েক বছর হলো , বাড়ি থেকে বেরোই না চারদিন , নতুন পুজোসংখ‍্যার পাতায় মুখ ডুবিয়ে দিই আর হারিয়ে যাই সেই ছোট্টবেলায় । শাশুড়ি বা কোনো আত্মীয়স্বজন এলে , অথবা মেয়ের জেদের  কাছে নতি স্বীকার করে , দিনের বেলায় পাড়ার মণ্ডপে গিয়ে একবার দেবী দুর্গার মুখদর্শন করে আসি , কখনও অঞ্জলি দিই।

 রাত হলে , জেলাশহর মেদিনীপুরের রাস্তায় ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা ভাবলেই, মনে পড়ে যায় -- নীল আকাশের নিচে দড়ির খাটিয়ায় বসে , অন্ধকার গ্রাম থেকে দূরে রেলশহরের উজ্জ্বল আলোর ছটায় আলোকময় দূরের আকাশ .....কী  অপরূপ তার শোভা!  মনের মনিকোঠায় আজও চির অম্লান সেই ছবি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments