জ্বলদর্চি

তিল /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১৯
তিল

ভাস্করব্রত পতি

তিল হল অতি ক্ষুদ্র একটি বীজ। সাধারণত ছোটখাটো জিনিস বোঝাতে তিলের তুলনা টানা হয়। তাই স্বভাবতই বাংলা প্রবাদে চলে এসেছে তিলের প্রসঙ্গ। কথায় বলে, "তাল প্রমাণ বাড়ে দুঃখ, তিল প্রমাণ কমে"! একদমই বাস্তবিক উপলব্ধি। 'তিলকে তাল করা'র ব্যাপারে আমাদের জুড়ি মেলা ভার! 'তিল কুড়িয়ে তাল' বলার লোকের অভাব নেই এখন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'চরিত্রহীন'তে রয়েছে, "মিথ্যে তিলকে তাল করে কষ্ট পাবেন না"। অনেকটা ঠিক এরকম -- "যদি হয় তিলটা, কয় তবে তালটা"। দাশু রায়ের লেখায় পাই, "তিলটি হলে তালটি কর তাকে"। প্রবাদে আছে, "বুনলাম ধান, তুললাম তিল, ফললো রুদ্রাক্ষ, খেলাম কিল"! অর্থাৎ খাজনার দায়ে চাষীর দফারফা! এছাড়াও রয়েছে, "হয় তিল নয় তিল, ধুকড়িতে ভরলে তিল"। 'লীলাবতী'তে পাই, "তিলটি পড়লে তালটি পড়ে, ঘাঁটালেই বলতে হয়"। তিল এবং কাঞ্চন দিয়ে সামান্য খরচে শ্রাদ্ধ করার সামর্থ্য যে ফতো বাবুর, তাঁকে প্রবাদের ভাষায় বলা হয়, 'তিলকাঞ্চুনে বাবু'। সাহিত্যের আঙিনায় এই প্রবাদের ব্যবহার রয়েছে। 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' তে পাই, " কোন পানসিখানিতে একজন তিলকাঞ্চুনে নবশাখ বাবু চলেছেন"। আবার দাশু রায়ের লেখায় পাই, "তিলকাঞ্চনে রাত্রি কাটান ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে"। যদি ঘটা করে ষোড়শপচারে শ্রাদ্ধের রীতি নীতি দেখা যায় আবার সামান্য ভাবে করা হয় তখন বলা হয় "তিলকাঞ্চনে দানসাগরের কিল"। এই বিষয়ে 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' তে রয়েছে, "প্রথমে তিলকাঞ্চনী রকম আরম্ভ করিয়া ক্রমে দানসাগরী গোচ হইত"। এখানেই আছে, "বড়লোকেরা দানসাগরে যাহা নির্ব্বাহ করবেন, সামান্য লোককে ভিক্ষা বা চুরি পর্যন্ত স্বীকার করেও কায়ক্লেশে তিলকাঞ্চনে সেটির নকল কত্তে হবে"। আবার দাশু রায়ের লেখায় পাই, "আদ্য শ্রাদ্ধ করে নরে, কেহ করে দানসাগরে, কেহ সারে তিলকাঞ্চনে"। 
তিলের চাষ হয়েছে

কারও কারও মতে তিলের আদি জন্মস্থান আফ্রিকা ও পূর্ব দ্বীপপুঞ্জে। তবে তিল ভারতে বহুদিন থেকেই প্রচলিত। অথর্ববেদ, শুক্র যজুর্বেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। একসময় উৎকৃষ্ট চালের ভাত রেঁধে তার সাথে তিল বাটা ও তিল সেদ্ধ দিয়ে ব্রাম্ভণদের খেতে নিমন্ত্রণ করা হত। এটি অথর্ববেদীয় শতপথ ব্রাম্ভণদের রীতি নীতি। পরবর্তীতে সেই রীতিটি পরিবর্তিত হয়েছে। সেদ্ধ করা অন্নে কিছু কিছু তিল মিশিয়ে পিণ্ড হিসেবে শ্রাদ্ধ কার্যাদিতে প্রদান করা হয় (মনুর ৩/২১৩ বিধান)। বেদ অনুসারে 'পিণ্ড' কথার অর্থ হল অন্নের গ্রাস। বলা হয়ে থাকে যে, ঘিয়ের পরেই তিল তেলের স্থান। আর তিল বেটে সেদ্ধ করে অন্নের (ভাতের) সঙ্গে খেতেন যাঁরা, তাঁরা আসলে জানতেন তিলের মধ্যে থাকা স্নেহপদার্থ সমগ্র দেহযন্ত্রকে পিচ্ছিল করে দেহের কর্ম উৎপাদন শক্তি দান করে। পূজার্চনার কাজে তিলের ব্যবহার সমধিক পরিচিত। 
তিল গাছ

তিলকে সংস্কৃতে হোমধান্য, বনোদ্ভব, তেলুগুতে তোবুলু, তামিলে বাল্লেনেয়, হিন্দিতে তিলী, অসমীয়াতে সিমসিম, কন্নড়ে এগু, গুজরাটিতে তল, ফারসীতে কুজন্দ এবং মারাঠীতে তিঠঠ বলে। এছাড়াও তিল পরিচিত পবিত্র, পিতৃতর্পণ, পাপঘ্ন, পুতধান্য, স্নেহফল, ফলপুর নামেও। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Sesamum indicum Lin। এটি Pedaliaceae পরিবারভুক্ত। এছাড়াও তিলের আরও যেকটি প্রজাতির সন্ধান মেলে সেগুলি হল --
Sesamum africanum Tod
Sesamum oleiferum Sm
Dysosmon amoenum Raf
Sesamum orientale L
Sesamum occidentalis Heer & Regel
Volkameria orientalis (L.) Kuntze

তিলের ফলগুলি ভল্লাকার। ফুলের রঙ সাদা, বেগুনি বা নীল রঙের হতে পারে। তিল সাধারণত চার ধরনের হয়। যেমন -- ১ শ্বেততিল, ২ কৃষ্ণ তিল, ৩ রক্ত তিল, ৪ বন্য তিল বা কাট তিল (কটা রংয়ের। লাল তিলকে বলে রাম তিল। কালো তিল বেশি প্রয়োজন হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে। শ্রাদ্ধাদির কাজেও এর ব্যবহার রয়েছে। এই তিল মাঘ ফাল্গুন মাসে চাষ করা হয়। আর জৈষ্ঠ্য নাগাদ কেটে তুলে নেওয়া হয়। সাদা তিল চাষ হয় জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে। কাটা হয় ভাদ্র আশ্বিন মাসে। সাদা তিল রান্নার কাজে বেশি প্রচলিত। খুব সুস্বাদু এবং গন্ধ কম। সাধারণত হেমন্তে তিল বীজ বপন করা হয়। যা কাটা হয় গ্রীষ্মের শুরুতেই। 

এটি মধ্য এশিয়ার একটি গাছ। আর্যরা ভারতে আসার সময় এটি নিয়ে এসেছে। ঋগ্বেদেও তিলের ব্যবহার দেখা গিয়েছে। তবে জাভা, সুমাত্রা এলাকার পাহাড়ী অঞ্চলে তিল আপনা আপনি হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে তিলের চাষ করে চাষীরা। মূলতঃ তিল থেকে তেল পাওয়ার জন্য এবং রান্নায় মশলা হিসেবে তিল বেটে পস্তুর বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রসুই ঘরে তিলের বড়া অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য সামগ্রী। ইদানীং গহনাবড়ি তৈরিতে থালার ওপরে পোস্তদানার বদলে ছাড়ানো সাদা তিল ব্যবহৃত হচ্ছে স্বাদে ভিন্নতা আনার জন্য। তিল বিভিন্ন স্থানে 'তিল্লি' নামেই পরিচিত। তিলের তেলকে বলে 'জিঞ্জিলি ওয়েল' ( Gingelly Oil)। ইউনানি চিকিৎসকদের কাছে এই তেলের পরিচিতি 'কুনজুদ' নামে। যদিও তিল তেল মিঠা তেল নামেও পরিচিত। অনেকেই সরিষার সঙ্গে তিল মিশিয়ে তেল উৎপাদন করে ঘানিতে। পৃথিবীর সেরা তিন তিল উৎপাদক দেশের মধ্যে রয়েছে বার্মা, ভারত এবং চীন। এঁরা বিশ্বের মোট তিল উৎপাদনের ৫০ শতাংশ উৎপাদন করে। 
তিলের ফুল ও ফল একসাথে

লোকায়তিক ব্যবহারে তিলের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। রক্ত আমাশায়, রক্তার্শে, মূত্র রোধে, অজীর্ণে, দন্তহর্ষে, পচা ঘায়ে, আমবাতে, ফোঁড়ায়, টাক পড়লে, শিরোরোগে, শূল রোগে, তৃষ্ণা রোগের উপশমকারী হল তিল। চরকসংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ের দশেমানি বর্গে তিলের অবস্থান। এখানে তিলকে বলা হয়েছে স্বেদোপগ। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তিলের সম্পর্কে লিখেছেন, "তিল স্নিগ্ধধর্মী, উষ্ণ ও তীক্ষ্ণধর্মী, রসে কষায়, মধুর, কটূ, আর ভেষজের ক্ষেত্রে ত্বকের বন্ধু, কেশের রজক, বলকর, বায়ুর উপশম করে। কিন্তু যাঁরা পিত্ত প্রধান ও শ্লেষ্মপ্রধান প্রকৃতির -- তাঁদের হিতকর নয়, তাও কৃষ্ণ তিলের ক্ষেত্রে। শ্বেত তিলে যদিও অল্প কিছু হিতকারিত্ব আছে, রুক্ষ পিঙ্গল বর্ণের তিলে তা কিছুই নেই, বরং ক্ষতিকর"।  চতুর্থ অধ্যায়ের দশেমানি বর্গে তিলের অবস্থান। এখানে তিলকে বলা হয়েছে 'স্বেদোপগ'। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তিলের সম্পর্কে লিখেছেন, "তিল স্নিগ্ধধর্মী, উষ্ণ ও তীক্ষ্ণধর্মী, রসে কষায়, মধুর, কটূ, আর ভেষজের ক্ষেত্রে ত্বকের বন্ধু, কেশের রজক, বলকর, বায়ুর উপশম করে। কিন্তু যাঁরা পিত্ত প্রধান ও শ্লেষ্মপ্রধান প্রকৃতির -- তাঁদের হিতকর নয়, তাও কৃষ্ণ তিলের ক্ষেত্রে। শ্বেত তিলে যদিও অল্প কিছু হিতকারিত্ব আছে, রুক্ষ পিঙ্গল বর্ণের তিলে তা কিছুই নেই, বরং ক্ষতিকর"।

🍂

Post a Comment

0 Comments