ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭৫
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ
জীবজন্তুদের নানা মজার কথা
সুমনা সাহা
পর্ব- ৭
পুকুরের জগত
ধানক্ষেত আর কড়াইশুঁটির ক্ষেত পেরিয়ে বিশাল এক ছায়াময় আমবাগানের পিছনে মস্ত এক পুকুর। দাদু বললেন, একে বলে সায়র বা দীঘি। সেখানেই জাল ফেলা হবে। ওরা পৌঁছে দেখল, আগে থেকেই পুকুরপাড়ে চার-পাঁচজন লোক উপস্থিত। গ্রামের জেলে ওরা। জাল নিয়ে এসেছে, দাদুর পুকুরের মাছ ধরবে, মজুরি নেবে। বর্ষাকাল আরম্ভ হলে অনেক রকমের মাছ ওঠে। তবে এখন গরমের সময়, মাছ তুলনায় কম পাওয়া যাবে, কিন্তু অতিথিদের তৃপ্তি সহকারে ভোজন করানোর জন্য পুকুর-মা তার বুক থেকে ধনরত্ন যতটুকু তুলে নিতে দেবে, তাই যথেষ্ট হবে। দাদুর মুখে তারা অনর্গল নানা গল্প শুনতে শুনতে এতটা পথ হেঁটে এসেছে। দাদু পুকুরকে যেমন ‘মা’ বললেন, তেমনই বড় বড় আমগাছগুলোকেও ‘মা’ বলছিলেন। বুকাইয়ের দাদুর কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগে। তিনি বলেন, “ফল হল গাছের সন্তান। মাছ পুকুরের সন্তান। সে তার বুকে জলের জীব ধরে রাখে, তাই তো আমরা সারা বছর খেতে পাই। তিনি যতটুকু দেবেন, ততটুকুই আমাদের প্রাপ্য।” বুকাই এই প্রথম মাছধরা জাল দেখল। মশারির মত সূক্ষ্ম নেট দিয়ে তৈরি জাল, একে বলে ঝাঁকি জাল। নেটের বুনটে টানা ও পোড়েনের মাঝে যে ফাঁক রয়েছে, তার নাকি নানা মাপ আছে, যার উপর নির্ভর করে কি ধরনের মাছ উঠবে। ইলিশ মাছ ধরার জাল ও রুই মাছ ধরার জাল এক রকম হয় না। চার-পাঁচজন মিলে দু’তিনটে জাল পুকুরের
মাঝখানে ও আরও দুই পাশে জলের উপর চাদরের মত ছুঁড়ে ছড়িয়ে দিল জালগুলো। এবার অপেক্ষার পালা। বেশ কিছু মাছ জালে আটকে পড়লে ধীরে ধীরে জাল গুটিয়ে পাড়ে টেনে আনা হবে। সঙ্গে আনা হয়েছে বড় বড় এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি, তাতে মাছ ভরে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। দাদু অনেক কথা বলছেন, আর বুকাই ও রাজি পুকুরপাড়ে দাদুর পাশে ছায়ায় বসে মন দিয়ে সেসব শুনছে। গিনির এসব গল্পে মন নেই। সে পা টিপে টিপে পুকুরের ধার ঘেঁষে হাঁটছে আর মাথা নিচু করে কি যেন কুড়িয়ে নিচ্ছে। রাজি গলা তুলে বলল, “এই গিনি, তুই কি করছিস? এদিকে আয় না!” দাদু রাজিকে ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলেন। ফিসফিস করে বললেন, “বেশি চেঁচামেচি করলে মাছ পালিয়ে যায়। ওকে ডেকো না। গিনি এখান থেকে কলমি শাক তুলে নিয়ে যায়, ওর মা বাজারে বিক্রি করে। ওদের খুব অভাব কি না!” তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে দাদু বললেন, “এই যে একটা পুকুর, এর বুকে কত জীবন ধরে রেখেছে। শুধু কি মাছ? এই জলের ভিতরে আছে ডাঙার পৃথিবীর মতোই আরেকটা জগত। সেটা পুকুরের জগত। এমনই সমুদ্রের জগত আছে, বনের জগত আছে, মরুভূমির জগত আছে। পুকুরের মধ্যে মাছ ছাড়াও আছে ব্যাঙ, কচ্ছপ, জলের পাখি, ফড়িং, সাপ, শামুক আরও কত প্রাণ। আবার ঝাঁঝি, পানা, টোকা, শ্যাওলা, পদ্ম, কলমি কত সব জলজ উদ্ভিদ। পুকুর পাড়ে কাদার মধ্যে ডিম রেখে যায় পানকৌটি ও নানা জলচর পাখিরা। শামুকখোল, বক এরা থাকে ধারে কাছে বড় গাছে। দিনের বেলা পুকুরের ধারে জলাজমিতে, ধানের ক্ষেতে ছোট মাছ খুঁজে বেড়ায়, আর রাত্রে গাছের ডালে বিশ্রাম করে। ব্যাঙও পাড়ের কাছাকাছি, জলের ঝাপটায় ভেসে না যায় এমন জলজ লতা-গুল্মের পাতার উপর ডিম ছাড়ে। পাড়ের গাছপালায় মাছের সন্ধানে বসে থাকে মাছরাঙা, ওপারে জলার ধারে দেখ বক হেঁটে বেড়াচ্ছে, ওরও মাছ চাই। শামুকখোলরাও আছে খাবারের খোঁজে।”
বুকাই দাদুর কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, “শামুকখোল কি দাদু?”
“ওটা বকের মতো একটা পাখি। ধানক্ষেতের আশেপাশে জলা জমিতে থাকে। ছোট মাছ, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, গেঁড়ি-গুগলি, ফড়িং এসব ওদের খাদ্য। এদের উপরের ঠোঁট আর নিচের ঠোঁটের মাঝে একটা বড়সড় ফাঁক থাকে, তাই এদের অনেকে হাই তোলা পাখি বলে। আসলে এরা সারস গোত্রের। ওই ফাঁক থাকার জন্য শামুকের খোল জাঁতির মত চাপ দিয়ে ভেঙে নিতে পারে সহজেই, আর ঠোঁটের সামনের দিকের ছুঁচালো অংশ ঢুকিয়ে শামুকের মাংসল শাঁস তুলে খায়, তাই নাম হয়েছে শামুকখোল। বক, পানকৌড়ি এদের সঙ্গেই জলাশয়ের ধারে বড় গাছে থাকে, কাঠিকুটো দিয়ে মাচার মত বাসা বানায়। এই পাখির সংখ্যা এখন ধীরে ধীরে অনেক কমে আসছে!”
দেখতে দেখতে জালে বেশ কিছু মাছ ধরা পড়ল। জেলেরা এখন জাল টেনে তুলছে। বুকাই আর রাজি দেখল বড় বড় দু’চারটে রুই, মৃগেলের সঙ্গে উঠে এসেছে বাটা, শোল আর পুঁটি মাছও। সব একেবারে জ্যান্ত, ছটফট করছে জালের ভিতরে। ওরা কখনও এত লাফানো মাছ দেখেনি। কলকাতার বাড়িতে বাজার থেকে মাছ কাটিয়ে আনা হয়। দাদু বিশে নামে বাড়ির একজন কাজের লোকের হাতে কিছু মাছ বাড়িতে রান্নার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে বাকি মাছ জেলেদের বিক্রি করে দিলেন, ওরা বাজারে নিয়ে যাবে। গিনিকে ডেকে ওকেও কিছু মাছ দিয়ে বললেন, “বাড়িতে নিয়ে যা, মাকে বলিস সর্ষে বাটা দিয়ে ঝাল করতে।” গিনি এক গোছা কলমি শাক তুলেছে। খুব খুশি হয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল ও। যাওয়ার আগে বলে গেল, “রাজি, আমি এগুলো মাকে দিয়ে এখনই আসছি, তারপর আমরা ঘুরতে যাব।”
ওরা তিনজন এদিক ওদিক খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করল, অনেক ফল পেড়েছে, এখন আমবাগানে এসে বসেছে। এখন গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া আর কুড়িয়ে পাওয়া আম, পেয়ারা আর জামরুলগুলোর সদ্গতি করার জন্য একটু বিটনুন পেলে ভালই হত। এমন সময় দূরে একটা রোগা ঢ্যাঙা মত ছেলেকে আসতে দেখে গিনি যেন হাতে চাঁদ পেল। বলল, “ওই দ্যাখো গেছো দাদা। ওকে ডাকি?” রাজি বুকাইকে বলল, “আমি এর কথাই বলেছিলাম তোকে। ও ব্যাঙ ধরতে পারে, জানিস?” গিনি চেঁচিয়ে ডাকে, “অ্যাই ভূতো, এদিকে আয়।” বুকাই অবাক হয়ে বলে, “এই যে বললে গেছো? আবার ভূতো ডাকলে যে!” গিনি এক গাল হেসে বলল, “ওর নাম ভূতো। আর গাছে উঠে পাখির বাসা নিয়ে আসে বলে গেছো দাদা বলে ডাকি!”
সেই ভূতো বা গেছো নামধারি দাদা ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ সরু করে ওদের দেখল। তারপর গিনিকে বলল, “এরা কারা রে?”
গিনি লিডারের ভূমিকায় এখন, বলল, “ও তো রাজি, চেনো না? আর এ হল রাজির বন্ধু বুকাই। গতকাল কলকেতা থেকে এইয়েচে। আমরা ফল কুইড়েচি। এখন এট্টু লবণ চাই, তোমার কাছে আছে নাকি দাদা?” গেছো দাদা বিজ্ঞের মত হাসল। তারপর তার ঢলঢলে ইজেরের পকেট থেকে জাদুর মত বের করল একটা অর্ধেক ব্লেড আর একটা ছোট্ট কাগজের পুরিয়ায় মুড়ে রাখা ঝালনুন। বুকাই মুগ্ধ চোখে গেছো দাদাকে দেখছিল, বিশেষ করে ওর কাঁধে ব্যাগের মত ঝোলানো একটি বস্তুকে। জিজ্ঞেস করল, “ওটা কি গো গেছো দাদা?” ছেলেটা ব্লেড দিয়ে নিপুণ হাতে ফলগুলো পিস করতে করতে বলল, “এটা? এ হল গুলতি। এটা দিয়ে ঢিল মেরে পাখিকে গাছ থেকে ফেলে দিই।” বুকাই শিউরে উঠল, “তারপর?” গেছো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “তারপর আবার কি? খাই। ছাল ছাড়িয়ে পুড়িয়ে খেয়ে নিই। আর আমার নাম হল বিশ্বনাথ। মা বলে ভূতো। আমি নাকি বিশ্বনাথের চ্যালা ভূত। এই গিনিরা আমায় গেছো বলে।”
“তুমি গাছে চড়ো সত্যি?”
“না তো কি? ফল খা। তারপর এই আমগাছের যে ডালে বলবি, চড়ে দেখাব।”
ওরা ঝালনুন মাখিয়ে ফল খেতে খেতে অনেক গল্প করল, সবই ভূতো ওরফে গেছোর রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী। পরিত্যক্ত পাখির বাসা ভেঙে আনা, আবার ঝড়ে বাসা ভেঙে পড়ে যাওয়া পাখির ছানা উদ্ধার করে শুশ্রূষা করে তাকে বাসায় ফেরত পাঠানো, পুরনো কাঠের বাক্সে প্রজাপতি পালন, লোকের বাগানের ফল চুরি করে মার খাওয়া, ব্যাঙ ধরে মাস্টারমশায়ের জুতোর মধ্যে রাখা এইসব নানা বীরত্বের গল্প শুনে বুকাই বিশ্বনাথের ফ্যান হয়ে গেল।
ভূতো বলল, “চল আমার ঘরে, তোদের আমার সংগ্রহে রাখা পাখির বাসা আর প্রজাপতি দেখাব। তোদের স্কুলের প্রোজেক্ট প্রজাপতির জীবনচক্র তো? ও আমি অনেক আগেই বানিয়েছি। তোদের দিয়ে দেব।”
চলতে চলতে বুকাই দেখল, কয়েকটা আমগাছের গোড়ায় সায়েন্স বইয়ের ছবির মত ব্যাঙের ছাতা হয়ে আছে। গিনির চোখ চকচক করে উঠল, ও ছুটে গিয়ে তুলে আনল, বলল, “এ তো ছাতু। খেতে দারুণ। ছাতু খেয়েছিস কখনও?” বুকাই বলল, “এগুলো কি খায়? আমি তো কখনও খাইনি!” রাজি বলল, “এগুলোই মাশরুম, জানিস না?”
বুকাই বিশ্বনাথকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি প্রজাপতির লাইফ সাইকেল কিভাবে বানালে?”
“আমি দেখেছি, ওরা বাগানে গাছের পাতার নিচে ডিম পাড়ে। পোস্তর মত দানা দানা ডিম, মাখনের মত রঙ। আমি ডিম সুদ্ধ পাতা তুলে এনেছি। গাছে ঐ ডিম ফুটে শুঁয়োপোকা বের হয়। আস্তে আস্তে পাতার উপর হেঁটে হেঁটে কচি মুকুল খায় দেখেছি। ওর গায়ের রোঁয়াগুলো হাতে লাগলে আল বিঁধে যায়। খুব জ্বলে তখন। পেঁয়াজ ঘষে দিলে জ্বালা কমে। খুব সাবধানে ওদের সংগ্রহ করতে হয়। একটা লম্বা কাঠির মাথায় তুলে নিয়ে ছোট্ট কৌটায় ভরে রাখি। পাতা খেতে দিই, কিন্তু বাঁচে না। মরে যায়। তখন শুকিয়ে রাখি। গাছে থাকলে ওই শুঁয়োপোকাই পাতা খেয়ে খেয়ে খুব মোটা হয়ে ফুলে ফেঁপে যায়। আর নিজেকে একটা গুটির মধ্যে বন্ধ করে রাখে। ঐ গুটি কেটে আবার প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়। আমি কাটা গুটি পেয়েছি অনেক। সব শুকিয়ে রাখা আছে। তোদের দেব।”
ভূতোর মাটির বাড়ি খুব সুন্দর ঠাণ্ডা। ভূতোর মা ওদের নারকোলের নাড়ু আর মাটির কুঁজোর ঠাণ্ডা জল দিলেন। উঠোনে মাদুর পেতে বসতে বললেন। বুকাই আর রাজির খুব ভাল লেগেছে। রাজি বলে, “আমি কখনও আগে ভূতোদাদার বাড়িতে আসিনি। তোর জন্যই আসা হল রে বুকাই।”
বুকাইয়ের মনে হয়, বিশ্বনাথ এক আস্ত বিস্ময়। ওর কাছে বাবুই পাখির বাসা আছে, বকের বাসা আছে, টুনটুনির আর দোয়েলের বাসাও আছে। জীবনে প্রথম বইয়ের ছবির বাইরে সত্যিকারের পাখির বাসা হাতে নিয়ে দেখার সৌভাগ্য হল বুকাই আর রাজির। কি সুন্দর সেসব। বিশেষ করে ছোট্ট কলসীর মত বাবুইয়ের বাসা আর ঠোঙার মত টুনটুনির বাসা। কত যত্নে কত ধৈর্য ধরে সেসব তৈরি করেছে ছোট্ট ছোট্ট পাখিরা! তাদের ছোট্ট ছোট্ট ঠোঁটে করে গাছের ডালপালা আর পাতার আঁশ সুতোর মত বের করে, ঠোঁটকে ছুঁচের মত ব্যবহার করে ঐ সুতো দিয়েই বুনেছে সেসব চমৎকার বাসা! বিশ্বনাথের কাছ থেকে ওরা দুজন পেয়ে গেল আস্ত দুটো প্রজাপতির জীবনচক্রের মডেল। সেগুলো জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার বলে মনে হল বুকাইয়ের। ওরা বিশ্বনাথকে আর তার মাকে মনসা পুজোয় নেমন্তন্ন করে ফিরে এল। বাড়িতে ততক্ষণে মাছ কুটে, ধুয়ে নানা রকমের ব্যঞ্জন রান্না হয়ে পরিবেশনের জন্য তৈরি।
আনিশা পারভীন।
নবম শ্রেণী। কেশপুর গার্লস হাই স্কুল
ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
শ্রীকান্ত অধিকারী
পর্ব ৪৪
অকুস্থলের ঠিক উত্তর পূর্ব দিকে আরো এক দল অদ্ভুত প্রাণী যাদের মাত্র একটা করে লাল চোখ জ্বলে উঠেছিল, তারাই এগিয়ে এসেছিল খুব কাছে। তারপরে সে কি হুসফুস হেট হাট চু চাঙ তাং বিভিন্ন হিংস্র শব্দে তার সঙ্গে বদ বদা বদ শব্দ পরিবেশকে অদ্ভুত ও পিলে চমকিয়ে আরও ভয়াল করে তুলে ছিল। শুনেই বোঝা যায় যে কারা যেন বিশাল বিশাল লাঠি নিয়ে কাদের যেন মারছে। এ সবই দীপকবাবুর মনে হচ্ছে। কারণ সামনের দৃশ্যমানতা যতখানি অনুমেয় তত খানি দর্শনীয় নয়। তবে দীর্ঘক্ষণ ধরে পাহাড়ি ঠাণ্ডায় যাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল বা পূর্ব থেকে যে ভয়ঙ্কর ঘটনার আঁচ করেছিল তার থেকেও যে অনেক গুণ বেশি এবং অবোধ্য তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তিনি ভয় কর ছিলেন এরই মাঝে আবার সেই রেড উল্ফদের কোনো গ্যাঙের পাল্লায় না পড়েন। তবে ঝাঁক ঝাঁক পাথর খণ্ডের নীচে নেমে আসাও বিস্তর ভাবিয়ে তোলে। কী করব,- এই কথাটুকুও পাসের জনকে বলার সাহস করতে পারেন না। কিংবা হাতে ধরা মেসিনটাও যে চালিয়ে দেবে সেটাও মনস্থির করতে পারছেন না। কারণ তিনি এখনো সেরগিল বা ছেত্রী ম্যাডামের কাছ থেকে বা কোনো ট্রেণ্ড পুলিশের কাছ থেকে কোনো আদেশ পান নি, আবার এটাও ঠিক কোন দিকে চালাবেন, কোনো লক্ষ্য ঠিক নেই।
এমন লোমহর্ষক প্রাণ সংশয় অভিযানের মাঝে হঠাৎ ঝাঁক ঝাঁক পাথর খন্ড গড়িয়ে পড়াতে এক সঙ্গে সবাই যেমন চমকে গিয়েছিল, তেমনি সেরগিল সাহেব, ছেত্রী ম্যাডাম সহ সকলেই হতচকিত হয়ে বিপদের আশঙ্কায় পিছু হটে ছিল। পিছু হটেনি শুধু লেপচা উপজাতির ভাড়া করা সেই শ্রমিকের দল। কেমন উত্তেজনায় তারা হাতে তির ধনুক বানপক, এবং খুকরি যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে ছুটে যায় সেই ভয়ঙ্কর জায়গাটার দিকে। সাঁ সাঁ শব্দে কি যেন সেই ভয়ঙ্কর জন্তুগুলোর ওপর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে গুঁ গুঁ গি গি করে বীভৎষ চিৎকার করে আশপাশ কাঁপিয়ে দেয়। ততক্ষণে শ্রমিকের দল তাদের হাতে ধরা মশাল ধরিয়ে দিয়েছে।
🍂
হঠাৎ ঘন অন্ধকার আর সেই অজস্র ভূতুড়ে অগ্নি গোলকের মাঝে হাজার বাতির আলোকের ঝলকে দীপকবাবু যা দেখলেন তা আর শব্দের বর্ণনায় ব্যাখ্যা করা যায় না। ভয়ানক উলট পালট কিছু এবং হাস্যকর অসামঞ্জস্য মুহুর্তে ভরপুর। এক সঙ্গে বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে ওঠে আর অন্য দিকে হাসির দম পেটের ভেতর থেকে দুরন্ত গতিতে বের হয়ে আসে।
সামনে এক বিরাট ইয়াক পাথরের গায়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। মুখে যন্ত্রনা কাতর গুঁঙানি। পা ও পেটের দিকটা থেকে কাঁচা চামড়া ছিঁড়ে কিছুটা ঝুলে পড়েছে। সেখান থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। দূরে বেশ কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে পাহাড়ি কুকুর। নেকড়েও হতে পারে। তবে সেটা জার্মানশেফার্ড এর মত অত স্থূলকায় নয় কিছুটা পেটের দিকটা সরু। তবে সব ক’টায় লোমশ। অনেকটা তিব্বতীয় লেপার্ডের মত। তাদের গায়ে তির গাঁথা। তার মানে এই দল থেকে কেউ তির ছুঁড়েছে। অথচ কোন প্রাণীকে এমন ভাবে আঘাত করার কথা সেরগিল সাহেব অর্ডার দেননি। কিন্তু দীপকবাবু লক্ষ করলেন সেরগিল সাহেব লেপচা শ্রমিকদের কিছু বললেন না। বরং দ্রুত ঐ জানোয়ারদের কাছে যেতে বারণ করলেন। ছেত্রী ম্যাডামকে দেখা গেল বেশ হৈ চৈ করছেন সামনে চুপ করে দাঁড়ানো কিছু সমতলের লোকদের সঙ্গে। সব ক’টার বয়স পঁয়ত্রিশের মধ্যে। ওদের সঙ্গে দীপকবাবুও খুব অবাক হয়, এই লোকগুলো এখানে এই সময় কী করে এলো।
সেরগিল সাহেব জোর জবরদস্তুর করতেই ছ’জনের দলের এক জন বলে, ওরা পাঁচ দিন আগে এসে ছিল পশ্চিমবঙ্গের বারাসত, কলাইকুন্ডা এবং বিহারের মজ্জফরপুর থেকে। মোট ছ’জন। সঙ্গে লোকাল কিছু শেরপাও ছিল।
শাক্যং পেন্টঙ্গ বা সাকিং পেন্তং থেকে প্রায় আট কিলো মিটার পাহাড়ি দূরত্বে থলুং পর্যন্ত ট্রেকিং রুট যে চালু আছে সেটা জানতেন না সেরগিল সাহেব। ওটা সিল্ড এরিয়া। এমনিতে নর্থ সিকিমের যে ট্রেকিং রুটে অভিযাত্রীর দল ট্রেক করে তখন লোকাল পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করে। মাঝে মাঝে ধ্বস নামা কিংবা বিভিন্ন সংকটের জন্য প্রশাসন থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ইদানিং বেশ কিছু ট্যুরিস্ট বেড়ানোর নাম করে লোকাল হোম স্টের মালিকের সহায়তায় ট্রেকিং রুটে যাচ্ছে এবং কিছু পথ ট্রেকিঙের শিহরণ উপভোগ করে। এই রকমই এক দল টুরিস্ট সেই রাতে থলুঙের পথে বেরিয়ে ছিল, অন্তত মঙ্গন পুলিশের কাছে যেটার কোন রিপোর্ট ছিল না। এই সুযোগটাই রেড উলফ নিচ্ছে। শবনম ছেত্রী ম্যাডাম উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন।
ট্রেকিঙের দলের লোকেরা তখন ফির ছিল। ওদের মনে হয়েছিল এই পথ দিয়ে রাতের মত একটা জায়গায় আশ্রয় নিলে অনেকটা পথ এগিয়ে থাকব। সেই রকমই প্ল্যান করেছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন ভয়াবহ পরিস্থিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই অবসরে শেরপাদের নির্দেশ মত ওপর থেকে পাথরের চাঁই ঠেলে ফেলতে শুরু করে। সঙ্গে যোগ দেয় আরও একটা দল-মেষপালকেরা। ওরা সন্ধ্যার আগে থেকেই গোটা কয়েক ইয়াককে ওদের দলের সঙ্গে মেলাতে পারছে না। খুঁজে চলেছে অনেক ক্ষণ ধরে। এরই মাঝে সেই বিকট চিৎকারে ওরাও ঘাবরে যায়। কারণ এই রকম বুনো উল্লাস ওদের চেনা। তবে সে গুলো সব হয় ঢোল অর্থাৎ বুনো কুকুরের কিংবা কখনো উদবেড়াল জাতীয় লেপার্ড গোষ্ঠীর কিছু জন্তুর। এ যে সাক্ষাৎ শমন! ওরা তেড়ে আসে ওদের অস্ত্র নিয়ে। তখনই বুঝতে পারে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ। এক সঙ্গে নেমে আসে সেই অকুস্থলে যেখান থেকে ভেসে আসে একদিকে সেই বুনো জন্তুদের শিকার ধরার চিৎকার আর একদিকে আর্তরব।
ক্রমশ
*বুড়হার নইতন ঘর*
ভানুপ্রিয়া মাহাত
একাদশ শ্রেণি
জওহর নবোদয় বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর
ছুটুরলে করলি বড়,
খাওয়াই পিঁয়াইঞ করলি দড়হ ,
ভুইলে যাইঞ সকইল কথা,
পাঠালি আইজ হামকে এথা ।
এথাইও হামি ভালই আছি ,
দিন দুবেলা থাকছি খাছি,
লাতি- লাতনির কথা ভাবছি,
সাধের ঘরটাকে মনে করছি ।
ঘরের পিঁড়াই গবচে বসে,
কত গল্পঅ হাঁসে মইজে ,
আইজ কত কথাই মনে পড়ে ,
হামার ঘর ভাঙ্গল আকাল ঝড়ে ।
পরের ঘরে খাঁটে-লুটে
নতুন জামা সুটে-বুটে
করলি যতন মনের মতন
তবুও তদের নাই পুড়ে মন ??
নাই পড়ে মনে তর বুড়া বাপটাকে ??
এখন তুইঞ বিদেশ ফেরত
খাঁচে বড় ফ্ল্যাটে বসত
তার জন্যই বাপকে বোধহয়
ছাইড়ে আলি বৃদ্ধাশ্রম ।।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী
কেশপুর গালর্স হাই স্কুল, মেদিনীপুর
গ্রহণ
মহুয়া মীল
রবিবারের সকাল আকাশ ঘনঘোর
ইন্দু তো ক্লাস ওয়ান, আদিত্য ফোর।
ইয়ারলি শেষ এখন স্কুল তাই ছুটি
কি করি কি করি ভাবে ভাইবোন জুটি।
খবরের কাগজ হাতে বাবা কন হেঁকে,
"সোমবার সূর্যগ্রহণ, সূর্য যাবে ঢেকে। "
"চন্দ্রগ্রহণ , সূর্যগ্রহণ রাহুর কেরামতি! "
বিজ্ঞান পড়ে নি, ইন্দু এখনও সরলমতি।
মা ডেকে কন, "আদি, তুমি বড় দাদা
বোনকে বোঝাও, দেখি তোমার ক্ষমতা। "
আদি বলে," পৃথিবী আর সূর্যের মাঝে
হঠাৎ কখনো যদি চাঁদ এসে বসে
সূর্য তখন ঢাকা পরে চাঁদের ছায়ায়
সূর্যগ্রহণ লুকোচুরি আলো আর ছায়ায়।
পৃথিবী যবে একইরেখায় চাঁদ রবির মাঝে
ছায়া-উপচ্ছায়া তখন জোছনা ঢেকে রাখে।
শোন ইন্দু, এ'অবস্থাকেই চন্দ্রগ্রহণ কয়
ভেবে দেখ বিজ্ঞানই সব, রাহু কেহ নয়।"
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments