জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প— ওয়েলস, আয়ারল্যাণ্ড (পশ্চিম ইউরোপ)মুরগির গায়ে ছোপ ছোপ দাগ /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 
দূরদেশের লোকগল্প— ওয়েলস, আয়ারল্যাণ্ড (পশ্চিম ইউরোপ)
মুরগির গায়ে ছোপ ছোপ দাগ
চিন্ময় দাশ

অনেক কাল আগের কথা। কত কাল আগের, সেটা কেউ জানে না। কেউই না।
একটা মুরগি ছিল। আকারে বেশ ছোটই। তবে, ধবধবে সাদা গায়ের রঙ তার। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। পছন্দও হয়ে যায় মুরগিটাকে।
একদিনের ঘটনা। সকালে বেরিয়েই মাটি আঁচড়ানো মুরগিদের অভ্যাস। দু’পায়ে মাটি আঁচড়ায়। তাতে পোকাটা উঠে আসে। মাকড়টা উঠে আসে। দু’টো একটা গম বা যবের দানাও উঠে আসে তাতে। অমনি কপ করে তুলে নেয়  ঠোঁটের ডগায়। 
একদিন তেমনই মাটি আঁচড়াচ্ছে মুরগি।  মুখে অভ্যাস মতো কিচ-কিচ কিচ-কিচ আওয়াজ। 
হঠাতই এক টুকরো কাগজ উঠে এল নখের আঁচড়ে। অমনি সেই কিচ-কিচ কিচ-কিচ।  এখানে কাগজ এলো কোথা থেকে? ভাবতে ভাবতে,  একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
দেশের রাজা একবার দরবার বসিয়েছিল এখানে। প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শুনবে বলে। যার যা বলবার প্রজারা সবাই লিখে নিয়ে এসেছিল। আর, রাজামশাইর পায়ে নামিয়ে রেখেছিল।
এটা নিশ্চয়ই সেদিনের তেমনি একটা কাগজ। মুরগির তো আনন্দ ধরে না। আহা, আজ আমারও একটা চিঠি হোল রাজাকে দেওয়ার! হলামই বা ছোট্ট একটা মুরগি! আমারও কিছু বলবার আছে দেশের রাজাকে। আমিও গিয়ে রাজার পায়ে নামিয়ে দেব এই চিঠি।
পরদিনই বেরিয়ে পড়েছে মুরগি। রাজার বাড়ি বলে কথা। সে তো সেই রাজধানিতে। কত দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে। চিঠিখানা যদি হারিয়ে যায়। যদি নষ্ট হয়ে যায়!
অনেক দিনের একটা পুরাণো বাক্স ছিল মুরগির।  কাঠের ছোট্ট একটা বাক্স। চিঠিটা ভরে, বাক্স পিঠে বসিয়ে নিয়েছে।
অত দূরের পথ কোনদিন পাড়ি দেয়নি মুরগি। তবুও, মনে সাহস নিয়ে বের হয়েছে। কত দূর গিয়েছে, একটা শেয়ালের সাথে দেখা। 
শেয়াল আর মুরগির কখনও সম্পর্ক ভালো হয় না। তবে, এই শেয়ালের সংগে তার সম্পর্ক বেশ ভালোই। একবার ফাঁদে আটকা পড়েছিল শেয়াল। মুরগিই তাকে বাঁচিয়েছিল। সে উপকার শেয়াল ভোলেনি। সেদিন থেকে ভারি ভাবসাব দুজনের মধ্যে। 
মুরগিকে দেখে, শেয়াল বলল—কী, বন্ধু! কোথায় চললে? 
--কিচ-কিচ, কিচ-কিচ। মুরগি বলল—রাজার বাড়ি যাচ্ছি। রাজাকে দেওয়ার একটা চিঠি আছে আমার।
--আরে, তাই নাকি? তা ভাই, আমার ভারি ইচ্ছা করছে, তোমার সাথে যাই। আপত্তি কোর না তুমি।
--না, না। আপত্তি করব কেন? এতটা পথ। বেশ একসাথে যাওয়া যাবে দুজনে। কিন্তু তোমাকে কি ঢুকতে দেবে দরবারে? 
শেয়াল বলল—সে তো আমি বলতে পারব না। 
--ঠিক আছে, এক কাজ করো। তুমি বরং আমার এই বাক্সটার ভিতরে ঢুকে পড়ো। 
 এক লাফে বাক্সের ভিতরে সেঁধিয়ে গেল শেয়াল। 
চলছে, চলছে। এবার পথ এসে পড়েছে নদীর পাড়ে। নদী বলল—কী বন্ধু? কোথায় চলেছ? 
হয়েছে কী,  একবার কয়েকটা পোকা জলে কিলবিল করছিল। কেউ এসে তার জল নোংরা করুক, মোটেই পছন্দ নয় নদীর। তাই পোকাগুলোকে তুলে ডাঙ্গায় ফেলে দিচ্ছিল নদী। কিন্তু ঝামেলা হোল, যতবার ফেলে দিয়ে আসে, পোকাগুলো ঠিক বেয়ে বেয়ে আবার নদীতে নেমে আসে। সে সময় মুরগিটা এসে হয়রানি থেকে বাঁচিয়েছিল নদীকে। খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফেলেছিল পোকাগুলোকে। সেদিন থেকে নদীর সাথেও তার বন্ধুত্ব। 
মুরগি বলল—রাজার বাড়ি যাচ্ছি গো। একটা চিঠি দেওয়ার আছে রাজাকে। 
নদী বলল—তাহলে আর কী? আমিও যাই তোমার সাথে। আমার তো আর কোনদিন রাজবাড়ি দেখবার উপায় নাই।
মুরগি বলল—তা, চলো না কেন? অসুবিধার কিছু নাই। তবে বন্ধু, অনেক দূরের পথ। তুমি বরং আমার এই বাক্সটায় ঢুকে পড়ো।
নদীও বাক্সে ঢুকে পড়ল। দুই বন্ধুকে নিয়ে মুরগি চলেছে। আরও খানিক দূর গিয়ে আগুনের সাথে দেখা। এই আগুনও মুরগির বন্ধু। 
একবার কী হয়েছিল, সে কথা বলি। আগুনের ভারি বিপদ। আর কোনও ইন্ধন নাই, যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। তখন এই মুরগিই শুকনো ঘাস-পাতা,  ছোট ডাল-পালা কুড়িয়ে এনে, আগুনকে জুগিয়েছিল। তাতেই সেবার প্রাণ বেঁচেছিল আগুনের। 
মুরগিকে দেখে আগুন বলল—কী বন্ধু, কোথায় চললে?
--রাজার বাড়ি যাচ্ছি। একটা চিঠি দেওয়ার আছে রাজাকে।
আগুন বলল—আরেব্বাস। রাজার বাড়ি? কোনদিন দেখা হয়নি আমার। আমাকে সাথে নিয়ে চলো।
মুরগি বলল— অসুবিধা কীসের? কিন্তু বন্ধু, তোমাকে কি আর ঢুকতে দেবে দেউড়িতে? এক কাজ করো বরং। তুমি আমার বাক্সটায় ঢুকে পড়। আমি নিয়ে যাব তোমাকে।
সমস্যা হোল জায়গার। ছোট্ট একটা বাক্স। তার ভিতরে আবার শেয়াল আর নদী ঢুকে বসে আছে আগে থেকে। আগুনের জায়গা হচ্ছে না কোন মতেই। আগুন তখন করল কী, ছাই হয়ে গেল। তাতে কোন মতে এক কোণে ঠাঁই হোল তার।
চলতে চলতে কত পথ পার হোল। তারপর এক সময় রাজবাড়িতে এসে পৌঁছল মুরগি। দেউড়ির সেপাই একটা মুরগিকে ভেতরে যেতে দেবে কেন? সে তেড়ে এল—কে তুমি? তোমার বাক্সেই বা কী আছে? 
একটুও ভড়কালো না মুরগি। বলল— দেখতেই পাচ্ছ, আমি ছোট্ট একটা বনের মুরগি। আমার বাক্সে একটা চিঠি আছে। রাজামশাইকে দিতে হবে। বলল বটে, কিন্তু  বাক্সের ভিতরে যে তার তিন বন্ধু ঘাপটি মেরে আছে, সে কথা মুখে আনল না মুরগি।
রাজার চিঠি আছে শুনে,  সেপাই তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভরা দরবার। মুরগি একেবারে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সেলাম জানাল রাজাকে। 
দরবারে হঠাৎ করে একটা মুরগি দেখে রাজা ভারি বিরক্ত। হেঁকে উঠল— কে রে, তুই? দরবারে তোর কী দরকার? 
হেঁড়ে গলা রাজার। কথা বলল, না কি আকাশ ভেঙে বাজ পড়ল দরবারে বোঝা দায়। থরথর করে কেঁপে উঠল মুরগি। কোন রকমে কিচ-কিচ করে বলল—বনের একটা ছোট্ট মুরগি আমি। আমার একটা চিঠি আছে রাজার জন্য।
--বনের মুরগির চিঠি? রাজার জন্য? হাসবে না কি কাঁদবে, বুঝতে পারছে না। রাজা বলল— কই দেখি, কী তোর চিঠি?
বাক্স থেকে কাগজটা বের করে দিল মুরগি। হয়েছে কী, কাগজটা পাতা ছিল বাক্সের ভিতরে, একেবারে নীচে। সেটার এক দিকে শেয়ালের নোংরা পায়ের ছাপ। একদিক নদীর জলে ভিজে স্যাঁৎসেঁতে। একদিকে আবার একটা কালো ফুটো। ফুটোটা হয়েছে গরম ছাইয়ের তাত লেগে। 
বিচ্ছিরি নোংরা একটা কাগজ দেখে, রাজার মেজাজ গেছে বিগড়ে। হেঁকে উঠল—হতচ্ছাড়া, এই নোংরা কাগজটা নিয়ে দরবারে ঢুকেছিস তুই। এই পুঁচকে মুরগিগুলো যে কত মুর্খ সে আমার জানতে বাকি নাই। তুই তো দেখছি তাদের সবার উপরে। দাঁড়া, হতভাগা! তোর ব্যবস্থা করছি আমি। 
পাশেই খাস সেপাই দাঁড়িয়েছিল রাজার। রাজা তাকে বলল— নিয়ে যা এটাকে। খামারঘরে মুরগিদের সাথে রেখে দিয়ে আয়। কাল সকালে এটা দিয়েই জলখাবার বানাতে বলবি বাবুর্চিকে।
সেপাই এসে খামচে তুলে নিয়ে গেল মুরগিকে। খামারে গিয়ে, পিছনের দরজা খুলে, ভিতরে ছুঁড়ে দিল।
কত আশা নিয়ে রাজার বাড়ি এসেছিল মুরগি। অথচ ঘটনা ঘটে যাছে একেবারে বিপরীত। এখন তো মৃত্যুদণ্ডই হয়ে গেল তার। মনে ভারি দুশ্চিন্তা বেচারির। কিন্তু বাক্সটা হাতছাড়া করেনি কোনমতেই।  আগলে রেখেছে যত্ন করে। ফলে, সে একা আটকে পড়ল না খামারে। সাথে তিন বন্ধুও আছে বাক্সের ভিতরে।
রাজার খামার বলে কথা। কত রকমের পশু আর পাখির ভীড়। সেপাই পাখিদের ঝাঁকে ছুঁড়ে দিয়ে গেছে মুরগিকে। নতুন পুঁচকে একটাকে দেখে, তেড়ে আসছে অন্য মুরগিগুলো। কেউ পালক খামছে দিচ্ছে। কেউ চেষ্টা করছে চোখটাই খুবলে দিতে। একজন আবার করেছে কী, বাক্সটা খুলে ফেলেছে ঠোক্কর মেরে।
আর যায় কোথায়! শেয়ালটা ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। শুরু করে দিয়েছে তার কেরামতি। সামনে যাকে পাচ্ছে, টুঁটি কামড়ে ধরছে। মূহুর্তেই বাছাধন অক্কা। একটার পর একটাকে মেরে চলেছে শেয়াল।
খামারঘরে তখন ভয়াণক হুটোপাটি। দৌড়-ঝাঁপ, হৈ-হল্লা। সেপাইদের কানে গেছে শব্দ। তারা দৌড়ে এসেছে। তাদের সাড়া পেয়ে লোক-লস্কর সব ছুটে এসেছে। গোলমাল কানে যেতে, রাজাও বেরিয়ে এসেছে। রানি বেরিয়ে এসেছে। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড!
রাজা হেঁকে উঠল— যত নষ্টের গোড়া ঐ মুরগিটা। ওটাকে ধরে লাগা এক আছাড়! শুনেই, শেয়াল এক লাফে পাঁচিলের বাইরে। মুরগিরও কাহিল অবস্থা। মাথা চিড়িক করে উঠল তার—বাঁচতে হলে, পালাতে হবে।
অমনি দৌড়াতে শুরু করেছে সে। পালাচ্ছে, কিন্তু বাক্সটা হাতছাড়া করেনি কোন মতেই। বাক্স নিয়েই পালাচ্ছে সে। মুরগি পালাচ্ছে দেখে, রাজার সেপাইরাও তাড়া করছে তাকে। 
সেপাইদের দৌড়ের সাথে মুরগি কি আর পেরে ওঠে? একটু বাদেই, একেবারে নাগালের মধ্যে এসে গেছে লোকগুলো। অমনি বাক্সের ঘেরাটোপ ছেড়ে,  নদী বেরিয়ে এসেছে।  সেপাই আর মুরগির মাঝে একটা ভরা জলের নদী তৈরি হয়ে গেল সাথে সাথে। পার হয়ে আসবে, সে উপায় নাই সেপাইগুলোর। তারা চেঁচাতে লাগল— ডিঙি চাই এক্ষুনি। ডিঙি নৌকা নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।
ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল সেপাইদের। সেই সুযোগে মুরগি সরে পড়ছে আরও দূরে। ডিঙিতে নদী পার হয়ে, সেপাইরা আবার কাছে এসে পড়েছে। মুরগি ততক্ষণে বনের ভেতর এসে পড়েছে। 
আগুন তখনও বাক্সের ভিতরে। রাজা আর তার সেপাইদের কাণ্ড দেখে দেখে, সে রেগে খাপ্পা। প্রথম থেকেই মাথা গরম হয়ে উঠেছে তার। ছিল ছাই হয়ে। এখন একেবারে গনগনে হয়ে উঠেছে ভেতরে ভেতরে। 
মুরগি বনে ঢুকেছে দেখে, সেপাইগুলোও বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তা দেখে, আর চুপ করে থাকতে পারল না আগুন। ছিটকে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। গনগনে ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল চার দিকে। কিছু পড়ল সেপাইদের গায়ে-মাথায়। তারা চিৎকার করতে লাগল। কিছু ফুলকি  পড়ল শুকনো ঘাসে আর পাতায়। দাউ-দাউ আগুন জ্বলে উঠল তাতে। পরিত্রাহি ডাক লোকগুলোর। পালাবার পথ পায় না।
সব দিক রক্ষা হোল। তবে, একটা বেয়াক্কেলে কাজ হয়ে গেছে আগুনের। বেরিয়ে পড়বার সময় মুরগির কথা খেয়াল করেনি। মুরগিটার গায়েও পড়ে গিয়েছিল কয়েকটা ফুলকি। ধবধবে সাদা চেহারা ছিল মুরগির। সেটা নষ্ট হয়ে গেল।
সেদিন থেকে সাদা মুরগি প্রায় দেখাই যায় না বনে। আগুনের তাতে সারা গায়ে তামাটে ভাব। তাতে কালো কালচে কালচে পোড়া ছোপ। সেদিন থেকে বনের মুরগিদের এমনই চেহারা। 
সেদিন থেকে মুরগিটার নাতি-পুতি, তাদের নাতি-পুতি, বা তাদেরও নাতি-পুতিরও একই দশা। আজও আগুনের ছ্যাঁকার দাগ রয়ে গেছে বনের মুরগিদের পালকে।

🍂

Post a Comment

0 Comments